E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০

বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ (১৯৪৫-২০২৩)

গৌতম গঙ্গোপাধ্যায়


গত ১১ আগস্ট, ২০২৩ প্রয়াত হলেন বিজ্ঞানী বিকাশ চন্দ্র সিংহ। বিজ্ঞানী ও বিশেষত বিজ্ঞান প্রশাসক হিসাবে তিনি ভারতের বিজ্ঞান গবেষণার জগতে বিরাট অবদান রেখে গেছেন সন্দেহ নেই। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক স্তরের পরীক্ষাতে ভারতের অংশগ্রহণের সূচনা তাঁর নেতৃত্বে ও উৎসাহেই সম্ভব হয়েছিল।

বিকাশ সিংহের জন্ম মুর্শিদাবাদের কান্দির পুরনো রাজপরিবারে ১৯৪৫ সালের ১৬ জুন। তাঁদের বাড়িতে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর যাতায়াত ছিল। পরিণত বয়সে বিকাশ সিংহের স্মৃতিচারণাতে সেই কথা অনেকবার এসেছে। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা করে ১৯৬৪ সালে স্নাতক হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে অমলকুমার রায়চৌধুরী, সমরেন্দ্রনাথ ঘোষাল ও শ্যামল সেনগুপ্তের নাম কলকাতার পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে প্রবাদপ্রতিম হয়ে গিয়েছে। ঘটনাচক্রে এই বছর এই তিনজনের শতবর্ষ।

এরপর বিকাশ সিংহ ইংল্যান্ডে পড়তে যান। তিনি কেমব্রিজের কিংস কলেজ থেকে ১৯৬৭ সালে বি.এ. এবং ১৯৬৮ সালে এম.এ.-তে উত্তীর্ণ হওয়ার পরে ১৯৭০ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেন। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৬ তিনি লন্ডনের কিংস কলেজে গবেষণা করেছিলেন। তারপর রাজা রামান্নার আহ্বানে তিনি দেশে ফিরে মুম্বাইয়ের 'ভাবা অ্যাটমিক রিসার্চ সেন্টার'-এ যোগ দেন।

১৯৮৪ সালে তিনি কলকাতার ভেরিয়েবল এনার্জি সাইক্লোট্রন সেন্টার বা ভিইসিসি'র একটি বিভাগের প্রধান হয়ে কলকাতায় ফিরে আসেন। ১৯৮৭ সালে তিনি ভিইসিসি'র অধিকর্তার দায়িত্ব পান। এত অল্প বয়সে দেশের কোনো মুখ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানের প্রধান হওয়ার দৃষ্টান্ত বিরল। ১৯৯২ সালে তিনি কলকাতার সাহা ইন্সটিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের অধিকর্তার দায়িত্বও নিয়েছিলেন। ২০০৯ সাল পর্যন্ত একই সঙ্গে দু'টি বড়ো প্রতিষ্ঠান চালনার দায়িত্ব শুধু যে তিনি সাফল্যের সঙ্গে পালন করেন তা নয়, দু'টিকেই তিনি অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। তাঁর সময়েই এই দুই প্রতিষ্ঠানে বহু নতুন বিষয়ে গবেষণা শুরু হয়। নিজে তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হলেও পরীক্ষামূলক বিজ্ঞানকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়ার বিষয়ে তাঁর কুণ্ঠা ছিল না। তাঁর উদ্যোগে ভিইসিসি-তে মেডিক্যাল সাইক্লোট্রনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই সাইক্লোট্রনে যে সমস্ত তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ তৈরি হয় সেগুলি ক্যান্সার সহ বহু রোগের নিরাময় বা নির্ধারণে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সেই মেডিক্যাল সাইক্লোট্রন এখন কলকাতার উপকণ্ঠে কাজ শুরু করেছে এবং অনেক কম খরচে তেজস্ক্রিয় পদার্থ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহ করছে। তিনি অধিকর্তা থাকার সময় সাহা ইন্সটিটিউটে বায়োফিজিক্স, সারফেস ফিজিক্স জাতীয় আধুনিক বিষয়ে গবেষণা সামনের সারিতে আসে। ভিইসিসি-র সুপারকন্ডাক্টিং সাইক্লোট্রন, রেডিওঅ্যাক্টিভ আয়ন বিম প্রকল্প, সাহা ইন্সটিটিউটের অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল অ্যাকসিলারেটর ফ্রেনা - এই সমস্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে দুই ইনস্টিটিউটে গবেষণাতে নতুন জোয়ার আসে। কিছুদিন তিনি একই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্বও সামলেছেন। কনিষ্ঠ বিজ্ঞানী ও ছাত্ররা যাতে ঠিক মতো কাজ করতে পারে, তাদের কোনো অসুবিধা না হয়, সেদিকে বিশেষভাবে নজর রাখতেন বিকাশ সিংহ।

বিকাশ সিংহ নিউক্লিয় বিক্রিয়া বিষয়ে গবেষণা শুরু করেছিলেন। এক বিশেষ তত্ত্ব যার নাম অপটিকাল মডেল, সেখানে তাঁর দখল ছিল প্রশ্নাতীত। লন্ডনের কিংস কলেজে ছ' বছরে তাঁর কুড়িটি গবেষণাপত্র পদার্থবিজ্ঞানের কৃতিত্বের সাক্ষ্য দেয়। এরপরে তিনি কোয়ার্ক গ্লুয়ন প্লাজমা বা কিউজিপি বিষয়ে মন দেন। এই বিষয়ে তিনি পৃথিবীর পথিকৃৎদের মধ্যে অন্যতম; চল্লিশ বছর আগে ১৯৮৩ সালে এই বিষয়ে তাঁর প্রথম প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয়েছিল। এই সমস্ত গবেষণাতে তাঁর অনেক সঙ্গীর মধ্যে তিনজনের নাম আলাদা করে বলতে হয়, তাঁরা হলেন দীনেশ কুমার শ্রীবাস্তব, শিবাজি রাহা ও প্রয়াত ভাস্কর দত্ত। বিকাশ সিংহের পরে ভিইসিসি'র অধিকর্তা হন শ্রীবাস্তব। শিবাজি রাহা দীর্ঘদিন বোস ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা ছিলেন।

কিউজিপি নিয়ে কিছু কথা এখানে বলা প্রয়োজন। প্রোটন ও নিউট্রনের মধ্যে আছে কোয়ার্ক কণা। কোয়ার্ক কণাদের মধ্যে গ্লুয়ন কণা বিনিময়ের সাহায্যে ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া হয়। সাধারণভাবে কোয়ার্ক কণারা প্রোটন নিউট্রন ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ থাকে। কিন্তু সৃষ্টির আদিতে বিগব্যাঙের সময় মহাবিশ্ব ছিল অত্যন্ত ক্ষুদ্র ও উত্তপ্ত। তখন সেই প্রচণ্ড ঘনত্বে কোয়ার্করা খুব কাছাকাছি ছিল, ফলে আলাদা করে প্রোটন নিউট্রন মেসন ইত্যাদি কণার কথা বলা যেত না। এই অবস্থা বা দশাকে বলা হয় কিউজিপি। ব্রহ্মাণ্ড যত প্রসারিত হয়েছে, তার ঘনত্ব ও তাপমাত্রা হ্রাস পেয়েছে, এক সময় কোয়ার্করা প্রোটন ইত্যাদির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ল। এই ঘটনাকে এক প্রকার দশা পরিবর্তন বলতে পারি। পৃথিবীর পরীক্ষাগারে দুটি ভারি নিউক্লিয়াসের মধ্যে উচ্চশক্তির সংঘর্ষ ঘটিয়ে সেই আদি অবস্থাকে পুনরায় সৃষ্টি করা সম্ভব। সেই অবস্থাকে দেখা যায় নানা ভাবে, বিকাশ সিংহ জোর দিয়েছিলেন তার থেকে বেরিয়ে আসা ফোটন, ও ইলেকট্রন ও মিউয়ন কণা পর্যবেক্ষণের উপরে।

বিকাশ সিংহকে কেন্দ্র করে কিউজিপি নিয়ে তাত্ত্বিক গবেষণার একটি দল দেশে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু তাতেই তিনি সন্তুষ্ট হননি। তিনি জোর দিলেন পরীক্ষা করে দেখার উপর। এবং এখানেই বিজ্ঞান প্রশাসক হিসাবে আমরা তাঁর অন্য একটি রূপ দেখতে পাই। এই ধরনের পরীক্ষা করে দেখার মতো যন্ত্র আমাদের দেশে নেই। পৃথিবীর দুটি পরীক্ষাগার কিউজিপি বিষয়ে পরীক্ষানিরীক্ষাতে নেতৃত্ব দিয়েছে, একটি হলো আমেরিকার ব্রুকহাভেনের রিলেটিভিস্টিক হেভি আয়ন কোলাইডার, অন্যটি হলো সার্নের লার্জ হ্যাড্রনিক কোলাইডার। বিকাশ সিংহের চেষ্টাতে ভারতীয় বিজ্ঞানীরা এই পরীক্ষাগারের গবেষণাতে অংশ নেন। তাঁর দূরদৃষ্টি থেকে তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ভারতকে যদি মর্যাদার সঙ্গে এই সমস্ত জায়গাতে কাজ করতে হয়, তাহলে শুধুমাত্র পরীক্ষার সময়ে অংশ নেওয়া বা তার তথ্য বিশ্লেষণ করলে চলবে না। তাঁর চেষ্টাতেই ভারতীয় বিজ্ঞানীরা নিজেরা যন্ত্র বানিয়ে পরীক্ষাতে ব্যবহার করেছেন; তাঁদের তৈরি ফোটন মাল্টিপ্লিসিটি ডিটেক্টর এবং মিউয়ন চেম্বার এখন এই সমস্ত পরীক্ষাগারের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসাবে কাজ করে চলেছে। এই জন্য দেশেই তৈরি হয়েছে মানস নামের সেমিকন্ডাক্টর চিপ, এই প্রযুক্তি যে ভারতে সম্ভব তা কেউ কল্পনাই করতে পারত না। ভারতে একের পর এক আন্তর্জাতিক আলোচনাচক্র আয়োজন করে সেখানে সারা পৃথিবীর প্রথম সারির বিজ্ঞানীদের তিনি নিয়ে এসেছিলেন।

একজন বা দু'জন ভারতীয় ব্যক্তিগতভাবে কী করলেন, তার থেকে বিকাশ সিংহের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, দেশ হিসাবে ভারত কী কাজ করছে। ভারত এখন সার্নের সহযোগী সদস্য, তার পিছনে তাঁর প্রচেষ্টার কথা বলতেই হবে। জার্মানিতে তৈরি হচ্ছে আর সর্বাধুনিক নতুন পরীক্ষাগার ফেসিলিটি ফর অ্যান্টিপ্রোটন অ্যান্ড আয়ন রিসার্চ, সংক্ষেপে ফেয়ার। বিকাশ সিংহ পরিকল্পনা স্তর থেকেই ভারত যেন তাতে অংশ নেয় তার চেষ্টা করেছিলেন। অংশীদারত্বের হিসাবে ভারত এখন সেই প্রকল্পে তৃতীয়।

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে সবাইকে নিয়ে চলার জন্য বিকাশ সিংহ চেষ্টা করে গেছেন। শুরুতে ভারত থেকে মাত্র চারটি প্রতিষ্ঠান এই ধরনের আন্তর্জাতিক পরীক্ষাতে অংশ নিচ্ছিল। এখন শুধুমাত্র কলকাতা থেকেই ভিইসিসি ছাড়াও সাহা ইনস্টিটিউট, বোস ইন্সটিটিউট, কলকাতা ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এই সমস্ত প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। সারা ভারতের মোট পঁচিশটি গবেষণা কেন্দ্র ও পনেরটি শিল্প প্রতিষ্ঠান এখন ফেয়ার-এ কাজের অংশীদার। শিল্প প্রতিষ্ঠানের কথা আলাদা করে বলতেই হয়, কারণ আন্তর্জাতিকমানের যন্ত্র সরবরাহের মাধ্যমে তারা নিজেদের প্রযুক্তির উন্নতি করতে পারছে এবং ব্যবসার পরিমাণ বাড়াতে পারছে। তিনি ফেয়ার-এর পরিচালনা কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন।

অবসর নেওয়ার পরেও কাজ থামাননি বিকাশ সিংহ। পঁচাত্তর বছর বয়সেও পৃথিবীর প্রথম সারির গবেষণা পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একক গবেষণা। বিজ্ঞান প্রসারে ও প্রচারেও সক্রিয় ছিলেন, নিয়মিত বিভিন্ন পত্রিকাতে বিজ্ঞান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। ‘সৃষ্টি এবং কৃষ্টিঃ বন্ধনহীন গ্রন্থি’ এবং ‘স্থান, কাল ও বিশ্বলোক’, এই দুই বইতে তাঁর রচনাগুলি গ্রন্থিত হয়েছে। আমৃত্যু বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর ও পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চের কাউন্সিল সদস্য ছিলেন তিনি। সাহিত্য বা ইতিহাসেও তাঁর উৎসাহ ছিল। রবীন্দ্রনাথের অনুরাগী বিকাশ সিংহের উৎসাহেই নিউটাউনে তৈরি হয়েছে টেগোর সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ফিলোজফি। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, পদ্মশ্রী ও পদ্মভূষণ সম্মান, রবীন্দ্র পুরস্কার, সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্মশতবার্ষিকী পুরস্কার, মেঘনাদ সাহা পুরস্কার ইত্যাদি।

এখন যখন বিজ্ঞানের নামে অবিজ্ঞান ও অপবিজ্ঞানের চর্চা প্রাধান্য পাচ্ছে, সেই সময় নিজে যা বিশ্বাস করেন তা সোজাসুজি বলা প্রয়োজন তা তিনি বুঝেছিলেন। ২০২০ সালে কলকাতার টেলিগ্রাফ পত্রিকাতে এক সাক্ষাৎকারে বিকাশ সিংহ বলেন, সমস্ত পশ্চিমি চিন্তাভাবনার মূল ভারতীয় চিন্তাতে পাওয়া যাবে, এটা একেবারেই ভুল ধারণা এবং তা হয় একান্তই অজ্ঞতাপ্রসূত বা তার পিছনে অন্য উদ্দেশ্য আছে। ভারতীয় দর্শনের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও তিনি বলেছিলেন, পাশ্চাত্যের অনেক চিন্তাই সেখানে পাওয়া যাবে না। তিনি সাক্ষাৎকারে চারটি উদাহরণের কথা বলেছিলেন। আইজ্যাক নিউটনের মাধ্যাকর্ষণ সূত্র, সিগমুন্ড ফ্রয়েডের মনোবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, রেনে দেকার্তের দর্শনের পাশাপাশি তিনি উল্লেখ করেছিলেন মার্কস ও এঙ্গেলসের শ্রেণি ও শ্রেণি সংগ্রামের তত্ত্বের কথা। কখনো কোনো বামপন্থী দলের সদস্য না হয়েও মার্কস-এঙ্গেলসের তত্ত্বের প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল। তাঁর প্রয়াণে ভারতীয় বিজ্ঞান গবেষণাতে এক বিরাট শূন্যস্থানের সৃষ্টি হলো।