৬১ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৮ আগস্ট, ২০২৩ / ৩২ শ্রাবণ, ১৪৩০
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (চব্বিশ)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখলেও, লোকায়তদের উত্থাপিত উদাহরণ (যেমন পদ তৈরির ক্ষেত্রে) আধুনিক বিজ্ঞানের ফার্মেন্টেশন (Fermentation - গাঁজানো), ডিসটিলেশন (Distilation-পাতন)-এর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার অর্থ এটা নয় যে, লোকায়তরা এই গাঁজানো বা পাতন পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে জ্ঞাত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এই ফার্মেন্টেশন বা গাঁজানো পদ্ধতি বিজ্ঞানের আবিষ্কার হিসাবে চিহ্নিত। সুতরাং এই পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে লোকায়তদের জ্ঞাত হওয়ার কোনো প্রশ্ন ছিল না। পাতন বা ডিস্টিলেশন পদ্ধতি অষ্টাদশ শতাব্দীর পূর্বে আবিষ্কৃত হয়নি। লোকায়তরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে জ্ঞাত না হওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক ধারণা গড়ে উঠেছিল। যার জন্যই বিভিন্ন বস্তুর সংমিশ্রণে উত্তেজক পদার্থ মদ (অ্যালকোহল) উদ্ভবের ক্ষেত্রে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তির অবতারণা তারা করেনি। আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কার বস্তুতে আশ্রয় করে চেতনার উদ্ভবকে স্পষ্ট করে উপস্থিত করেছে। লোকায়ত দর্শনের পক্ষে বস্তু ও তার বিকাশের ধারা সম্পর্কে জ্ঞান ছিল না। এটার মধ্যে অস্বাভাবিকতা নেই। কিন্তু একথা স্বীকার করতেই হবে যে, বস্তুকে আশ্রয় করেই চেতনা - একথা অত্যন্ত বলিষ্ঠতার সাথে লোকায়ত দর্শন উপস্থিত করেছিল। বিস্ময়করভাবে এই প্রশ্নে তাদের মধ্যে আপসহীন মনোভাব ছিল - যা বস্তুবাদী ধারাকে শক্তি অর্জনে সাহায্য করেছিল।
ভারতীয় দর্শনে ‘পরিবর্তন’ ও ‘স্থায়িত্ব’
● ভারতীয় দর্শনে বস্তু ও চেতনা সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়ে ‘আত্মা’ (Soul)–র কথা এসেছে। বস্তু ও আত্মা সম্পর্কিত আলোচনায় আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে। ভারতীয় দর্শনে ‘আত্মা’র তত্ত্বের পক্ষাবলম্বীরা লোকায়ত দর্শনের বিরুদ্ধে যত বলেছেন, তার থেকে ঢের বেশি বলেছেন বৌদ্ধ দর্শনের বিরুদ্ধে। বৌদ্ধ দর্শনও ‘আত্মা’-র অস্তিত্বকে বাতিল করে। বৌদ্ধ দর্শনকে ‘অনাত্মাবাদ’ও বলা হয়। তবে লোকায়ত ও বৌদ্ধ দর্শনের ‘আত্মা’র অস্তিত্বকে বাতিল করার ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। বস্তুকে ভিত্তি করে চেতনা গড়ে ওঠার বক্তব্য বৌদ্ধ দর্শনের ক্ষেত্রে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ নয়। আত্মা একটি কল্পকাহিনি, যাকে ঘিরে অধিবিদ্যকরা (Metaphysicians) নিজেকে এবং সকলকে প্রতারিত করে - বৌদ্ধ দর্শনের মত। তারা দৃঢ়তার সাথে বলে, ধরাবাঁধা কোনো রূপ নেই। সমস্ত কিছুই অবিরাম পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছে - অস্তিত্বের মধ্যে আসা এবং অস্তিত্বের বাইরে চলে যাওয়া, সমস্ত কিছুই এই চিরস্থায়ী প্রবাহের মধ্যে বিরাজ করছে। সুতরাং আত্মার স্বীকৃতির কোনো প্রশ্ন নেই। এটাই বৌদ্ধ দর্শনের বক্তব্য।
● ভারতীয় দর্শনে দু’টি দার্শনিক অবস্থান থেকে আত্মাকে বাতিল করা হয়। লোকায়ত দর্শন সম্পূর্ণ বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা খারিজ করে। বৌদ্ধ দর্শন দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিভঙ্গির ফলে আত্মাকে বাতিল করে। ভারতীয় দর্শনে লোকায়ত ও বৌদ্ধ দুইটি পৃথকভাবে বিরাজ করছে। মার্কস এবং এঙ্গেলস সর্বপ্রথম দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির সাথে বস্তুবাদকে সমন্বিত করে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদী দর্শনের প্রতিষ্ঠা করেন। তবে ভারতীয় দর্শনে এই দুইটি ধারার সমন্বয় ঘটেনি। পৃথক পৃথক ধারা হিসাবে লোকায়ত ও বৌদ্ধ দর্শন বিরাজ করেছে। এটা বলা কোনো অত্যুক্তি হবে না যে, প্রকৃতি বিজ্ঞানের ব্যাপক বিকাশ আধুনিক যুগে ঘটার ফলে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দর্শন প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে। লোকায়ত ও বৌদ্ধ দর্শনের সময়কালে প্রকৃতি বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি সম্ভব ছিল না। লোকায়ত দর্শনের মধ্যে যে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে পরবর্তীকালের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণার পূর্বাভাস লক্ষিত হয়েছে। সার্বজনীন প্রবাহ (Universal flux) সম্পর্কে বৌদ্ধ দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি যা আত্মার অস্তিত্বকে খারিজ করে। প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের এটা একটা বিপ্লবী বৈশিষ্ট্য।
● নিরন্তর ধারা (প্রবাহ) সম্পর্কিত ধারণা ভারতীয় দর্শনে বৌদ্ধ দর্শনের আবির্ভাবের পূর্ব থেকে ছিল। সাংখ্য দশনেও সার্বজনীন প্রবাহের কথা বলা হয়েছে। তবে বৌদ্ধ দর্শনে যে সার্বজনীন প্রবাহের কথা বলা হয়েছে, সাংখ্য দর্শনের সার্বজনীন প্রবাহ তার থেকে পৃথক। সাংখ্য দর্শনের প্রভাব বৌদ্ধ দর্শনে পরিলক্ষিত হয়। সার্বজনীন প্রবাহ সম্পর্কিত সাংখ্য দর্শনের বক্তব্য বৌদ্ধ দর্শনকে প্রভাবিত করেছে - একথা বলা অত্যুক্তি নয়। সাংখ্য দর্শনে যেভাবে চিরস্থায়ী প্রবাহের কথা বলা হয়েছে, তার থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক অনুমান করা যেতে পারে, সাংখ্য দর্শনে তার মূল রূপে মূলত বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সাথে দ্বান্দ্বিকতার মিলনের একটা আদিম প্রবণতা কি লক্ষিত হয়?
● বৌদ্ধ দর্শনে গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর পর যে মহাযান ধারার উদ্ভব হয়, বিশেষ করে শূন্য ভাদিন নাগার্জুনের সময়কালে বৌদ্ধ দর্শনের বস্তুবাদী ধারা যথেষ্ট দুর্বল হয়, এমনকী ভাববাদী ধারাতে অনেকাংশে পর্যবসিত হয়। পরবর্তীকালে বৌদ্ধ দর্শনের সৌত্রান্তিক ধারায় দ্বান্দ্বিক সৌত্রান্তিক পুনরায় স্থাপিত হয়। যদিও প্রকৃত সৌত্রান্তিক দর্শনে নথিপত্র পাওয়া যায়নি। ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এমনকী তিব্বতেও সৌত্রান্তিক নথি-পুস্তক পাওয়া সম্ভব হয়নি। সৌত্রান্তিক দর্শন বৌদ্ধ দর্শনের তাৎক্ষণিকতা (Momentariness)-কে পুনরায় তুলে ধরল।
● ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা উত্থাপিত হয়, তা হলো, ভাববাদের বিরুদ্ধে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে ভারতীয় দর্শনের যে ধারাগুলি অত্যন্ত শক্তিশালী বক্তব্য উপস্থিত করেছে, যেমন ন্যায় বৈশেষিক, সাংখ্য এবং মীমাংসা এই তিনটি দর্শনের ধারা এদের দার্শনিক অবস্থানের ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। ভারতীয় দর্শনে ‘স্বাধীনতা’ (Freedom) সম্পর্কিত আলোচনায় এই বিষয়টি প্রকটভাবে উপস্থিত হয়েছে। প্রশ্ন হওয়াই স্বাভাবিক, কেন ভাববাদী দর্শনের চরম বিরোধীরা শেষ পর্যন্ত ‘স্বাধীনতা’ সম্পর্কিত ভাববাদী ধারণাকে গ্রহণ করছে? এর সম্পূর্ণ উত্তর এখনই দেওয়া সম্ভব নয়। তবে লোকায়ত দর্শন ‘আত্মা ও তার মুক্তি’ সম্পর্কিত ভাববাদী ধারণাকে সম্পূর্ণভাবে খারিজ করত। মুক্তি (মোক্ষ), স্বর্গ, স্থানান্তরকামী আত্মা (Transmigrating soul), সবই কল্পকাহিনি। মুক্তি সম্পর্কে আজেবাজে, অলীক ধারণা থেকে মুক্ত হওয়ার আবেদন লোকায়ত দর্শন উপস্থিত করল। আত্মার মুক্তির ধারণাকেই তারা খারিজ করল। যে সময়ে লোকায়ত দর্শনের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, অর্থাৎ কয়েক হাজার বছর পূর্বে জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির মান বিবেচনায় রেখে একথা বলা যেতেই পারে যে, এটা ছিল অত্যন্ত সাহসী ও অত্যন্ত অগ্রসর ভাবনা। যুগজনিত সীমাবদ্ধতার কারণেই লোকায়ত (চার্বাক দর্শন সহ) দর্শনের পক্ষে আরও বাড়তি কথা বলা সম্ভব হয়নি। লোকায়ত দর্শনই একথা বলেছিল যে, যেকোনো দর্শন যে সামাজিক-নৈতিক মূল্যবোধের কথা বলে তা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। নির্দিষ্ট শ্রেণির অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বজায় রাখার লক্ষ্যেই দর্শনের মাধ্যমে এই মূল্যবোধগুলিকে তুলে ধরা হয়। বর্তমান সময়ে আমরা শাসকশ্রেণির মতাদর্শগত হাতিয়ারের কথা বলি। বর্তমান সময়ের ভাষায় না হলেও, শাসকশ্রেণির স্বার্থ বজায় রাখার জন্য দর্শনের ভূমিকার কথা লোকায়ত দর্শন উল্লেখ করেছে। তবে এটাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, বস্তুকে আশ্রয় করে চেতনা গড়ে উঠলেও, মানবজীবন ও সমাজ জীবন সর্বক্ষেত্রে মানব-চেতনার যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা - সে ব্যাপারটি লোকায়ত দর্শনে আলোচনায় আসেনি। তৎকালীন সময়জনিত সীমাবদ্ধতার কারণেই এটা ঘটেছে।
● সমগ্র আলোচনায়, যদিও সংক্ষিপ্ত পরিসরের আলোচনা, এটা আমাদের কাছে অনেকটাই পরিষ্কার হয়েছে, ভারতীয় ঐতিহ্যগত চিন্তা তথা ভারতীয় দর্শনের কোন ধারা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও জীবন্ত। বলিষ্ঠতার সাথে কোন ধারার আমরা উত্তরাধিকারী - এই দাবি করার সাথে সাথে মেহনতি মানুষের স্বার্থে সৃজনশীলতার সাথে কোনো ধারাকে আমরা আরও উন্নততর, বিকশিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করতে পারি। এরই সাথে সাথে ভারতীয় দর্শনের যে ধারার কোনো প্রাসঙ্গিকতা নেই, সেই কথা সোচ্চারে বলার সময়ও এসেছে। এই মুহূর্তে ভারতের বুকে সংঘ পরিবার উগ্র-হিন্দুত্ববাদের নামে ভারতীয় ঐতিহ্যের বাতিলযোগ্য বহু বিষয় বিশেষ জোর দিয়ে উত্থাপন করছে। কেন্দ্রের সরকারে অবস্থানের কারণে প্রচারমাধ্যম, শিক্ষাব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তারা প্রায় মৃত ধারণাগুলিকে সংকীর্ণ স্বার্থে বিশেষভাবে তুলে ধরছে। আপসের মনোভাব নয়, সর্বাপেক্ষা বিপ্লবী শ্রেণি হিসাবে শ্রমিকশ্রেণি - শোষণভিত্তিক সমাজকে শোষণহীন স্তরে উন্নীত করাই যাদের ঐতিহাসিক লক্ষ্য - সাহসিকতার সাথে ভারতীয় সমাজে প্রাচীনকালে মহান চিন্তাবিদ্রা প্রকৃতি জগৎ ও মানব সমাজের সম্পর্ককে অনুধাবন করা ও প্রকৃতির নিয়মাবলী অনুধাবন ও আয়ত্ত করার ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ ও অগ্রগতি ঘটিয়েছেন, তাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কর্তব্য পালন করতে হবে।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)