৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭
চোখে যুদ্ধের দৃঢ় সম্মতি নিয়েই গ্রাম শহর একাকার
শিয়ালদহ স্টেশন থেকে সংহতি সমাবেশ অভিমুখী মিছিল। রয়েছেন কৃষক নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ তেভাগার ঐতিহ্য মেনেই কেন্দ্রীয় সরকারের তিনটি কৃষক বিল বাতিল করার দাবিতে দিল্লির কৃষকদের নাছোড় লড়াইয়ে শামিল হল বাংলা। সারাভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় সমিতির পশ্চিমবঙ্গ শাখার ডাকে বাংলার কৃষক খেতমজুররা দিল্লির কৃষকদের সংহতি জানিয়ে প্রতিবাদে স্তব্ধ করে দিলেন কলকাতার প্রাণকেন্দ্র ধর্মতলার রাজপথ। রানী রাসমণি রোডের তিনটি লেন এদিন উপচে পড়ল কৃষিজীবী এবং শ্রমজীবী মানুষের সংহতি জমায়েতের জেরে। জহরলাল নেহরু রোডের ডোরিনা ক্রসিং ছোঁয়া ভিড়ে দক্ষিণ ২৪ পরগনার ভাঙ্গড় থেকে বর্ধমানের রায়না, উত্তর ২৪ পরগনার দেগঙ্গা থেকে হুগলির গোঘাট, পূর্ব মেদিনীপুরের দাসপুর থেকে পুরুলিয়া থেকে আসা মানুষ মুষ্টিবদ্ধ ভঙ্গিতে কেন্দ্রের কৃষি আইনের সোচ্চার প্রতিবাদ করে মনে করিয়ে দিতে ভোলেনি যে নরেন্দ্র মোদী সরকারের কৃষি আইনের সংস্কার আর মমতা ব্যানার্জির সরকারের বিধানসভায় পাস করানো কৃষি আইন এর আদতে কোন তফাৎ নেই। লড়াইটা নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধেই শুধু নয় মমতা ব্যানার্জির বিরুদ্ধেও। স্লোগান মুখরিত মিছিলগুলিতেও ছিল তার অনুরণন, মৃত্যু নয়, জীবন জয়ের লক্ষ্যে এবার নির্ণায়ক লড়াই হবে।
এদিন সারা ভারত খেতমজুর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত পূর্ব মেদিনীপুরের দাসপুর ব্লকের সুকুমার হাইত সমাবেশে বলছিলেন কাজ না পাবার কথা। ওঁরা প্রায় ৮০ জন এসেছেন। সঙ্গে নিয়ে আসা মুড়ি দিয়ে দুপুরের আহার সেরেছেন। ধান আলু চাষের সঙ্গে যুক্ত ওরা নয়া কৃষি বিল পুরোদমে লাগু হলে আদৌ কোনো কাজ পাবেন বলে মনে করছেন না। জানালেন এই সর্বনাশা বিলগুলি রুখতে তাই প্রতিবাদের পথেই থাকবেন তারা। থাকবেন দিল্লির কৃষকদের পাশেই।
হাওড়া জেলার জগৎবল্লভপুর ব্লক থেকে সংহতি সমাবেশে এসেছেন ওরা। বিশ্বনাথ রায়, ফকির দাসরা বলছিলেন জেলার চাষের হাল-হকিকতের কথা। হাওড়ার একটা বড় অংশের কৃষক আলু চাষের সঙ্গে যুক্ত। বুনেছেন সরষে আর শাকসবজিও। আলুর দাম নিয়ে প্রশ্ন করাতে বললেন, ফড়েদের দৌরাত্ম্যের কথা, ভাই-ভাইপোদের যোগসাজশের কথা। বলছিলেন চাষির দাম পায়নি অথচ বাজারের চড়া দামের মুনাফার ভাগ-বাটোয়ারা হয়েছে রাজ্যের শাসকদলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। জগৎবল্লভপুর গ্রাম সার বড়গাছিয়া থেকে ৫০০ কৃষক ও খেতমজুর এসেছেন এদিনের সমাবেশে। প্রবীণ মানুষ বিশ্বনাথ রায় বলছিলেন, কৃষি আইন হলো ব্রিটিশ আমলের নীলকর সাহেবদের নীল চাষে বাধ্য করার মতো ভয়ঙ্কর একটা কালা আইন। এই আইন ছোটো বড়ো সব চাষীদের বাধ্য করবে চুক্তি চাষে। আমরা তাই এর বিরোধী। এই রাজ্য সরকারের জন্য আমাদের হাতে কাজ নেই , ফসলের দর নেই। তাই এই দুই সরকারের কোনটাকেই আমরা চাইছি না।
এদিনের সমাবেশ যেন ২৬ নভেম্বর আর ৮ ডিসেম্বরের সাধারণ ধর্মঘটের দ্বিতীয় পর্ব ছিল। কৃষিজীবি-শ্রমজীবি মানুষের যৌথ সংহতির চেনা ছবি এদিন আরও স্পষ্টতর। বহু শ্রমজীবি মানুষ এদিন এসেছিলেন সংহতি জানাতে। এসেছিলেন ছাত্র-যুব-মহিলারাও। আওয়াজ ওঠে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বিক্রি থেকে ফসল কেনার কর্পোরেট চক্রান্ত রুখছি রুখব। কলকাতার ব্যস্ততম রাজপথে ছিল বিরোধিতার কোলাজ - হাল বলদ সহ চাষির প্রতীকী চলনের পাশে শাসকবিরোধী ছড়া - ‘শিল্পপতির বাড়ছে পুঁজি, কাড়ছে শাসক চাষির রুজি’ লেখা প্ল্যাকার্ড।
রায়না-২ অঞ্চল থেকে সংহতি সমাবেশে এসেছেন চৌধুরী রুস্তম আলীরা। মোদী সরকারের নয়া কৃষক আইন খারিজ করার দাবি নিয়ে ওরা এসেছেন কলকাতায়। রানি রাসমণি রোড চত্বরেই একটু সকাল সকাল একসঙ্গে সেরেছেন দুপুরের খাওয়া। মিটিং শোনার ফাঁকে বলছিলেন ফসলের দাম না পাবার কথা। ওরা ওয়াকিবহাল তৃণমূল সরকারের একই রকম সর্বনাশী বিল প্রসঙ্গে। বলছিলেন সাধারণ কৃষকদের মান্ডির কার্ড না পাবার কথা।অথচ এজেন্টদের কাছে রয়েছে কুড়ি থেকে পঁচিশ খানার মত কিষাণ মান্ডির কার্ড। ধান দিলেও দাম মিলছে দেড় মাস পরে। অসহায় রুস্তম আলী বলছিলেন সরকার টাকা না দিলে লেবারকে কোথা থেকে টাকা দেব? ঘরের মেয়েদের গয়না বন্ধক দিয়ে পেমেন্ট করার পরিস্থিতিও এবার নেই আমাদের।
রানি রাসমণি রোডে সংহতি সমাবেশের একাংশ।
ফাঁকি অন্যত্রও। দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলে লক্ষ্মীভোগ চালের বিঘে পিছু খরচ ১২ থেকে ১৩ হাজার টাকা। সেখানেও লোকসান। জবাবদিহি করার মতো কেউ নেই। আরও এক কৃষক প্রভাত কর বলছিলেন জবাবদিহি করবে কে? নিজেরাই তো সব কার্ড নিয়ে বসে আছে। বউয়ের নামে, ছেলের নামে শ্বশুরের নামে সব কার্ড করে রেখেছে। বাজারের ফসলের দাম এর সঙ্গে চাষির প্রাপ্যের আসমান জমিন তফাৎ। ৬০ কেজি ধানের বস্তার দাম মিলছে এগারোশো টাকা। নিজেদের বস্তা, নিজেদের লেবার নিয়ে ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে মিলে নিয়ে যেতে হচ্ছে। সেখানে আবার ধান ভিজে বলে ১০-৫ কিলো ধান বাদ যাচ্ছে। তারপর কিষাণ মান্ডি থেকে চেক দিচ্ছে। সেই টাকা পেতেও বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে।
কৃষি বিল বাতিলের দাবিতে সংহতি সমাবেশে যোগ দিতে পুরুলিয়া জেলার মানবাজার থেকে এসেছেন প্রায় ৫০০ জন খেতমজুর। আগের দিন রাতে ট্রেনে চেপে, বাসে চেপে সকালে পৌঁছেছেন ধর্মতলায়। সকাল থেকে তেমন কিছু খাওয়া হয়নি। বলতে গেলে ভুখা পেটেই শির উঁচিয়ে সবার সঙ্গে গলা মিলিয়ে ‘না’ বলতে এসেছেন মোদীকে। তাদের একজন পুরুষোত্তম দেব বলছিলেন, এই আইন চালু হলে কৃষকের হাতে জমি থাকবে না। আমাদেরও কাজ থাকবে না। তাই আমরা এই বিলের বিরোধী। রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও তাদের ক্ষোভ কম নেই। কাজ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না এলাকায় বলছিলেন ওঁরা।
হুগলির গোঘাট থানার দু'নম্বর ব্লক থেকে এসেছেন শেখ শওকত আলিরা। বলছিলেন স্থানীয় পঞ্চায়েত থেকে মানুষ ঠিকমতো পরিষেবা পান না সে কথা। চুরি চলছে সেখানে। গরিব মানুষ তার ন্যায্য অধিকার পায়না। শস্য বীমা থেকে আমফানের ঝড়ের টাকা মানুষ পায়নি। ‘ওরা’ ভাগ করে নিয়েছে। ফসল বেচতে পারছে না কেউ। সমবায়ের ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। কৃষকরা নতুন করে মেম্বার হতে পারছে না। লোন পাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কৃষক মারা বিল এনেছে মোদী সরকার। আমরা তার বিরোধী। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এর বিরুদ্ধে বিধানসভায় কোন বিল আনেননি। উপরন্তু নিজেরা একই রকম কৃষক স্বার্থবিরোধী আইন এনেছে এই বাংলায়। আমরা মোদীর বিরোধী মমতা ব্যানার্জিরও বিরোধী। দুয়ারে সরকার বলে যেটা চলছে তা ভাঁওতা। এই ভাঁওতাবাজির বিরুদ্ধে জেলায় মানুষ পথে নামছেন। বামপন্থীদের নেতৃত্বে প্রতিবাদ করছেন। কৃষকের পাশে একমাত্র বামপন্থীরাই আছেন। কৃষক সভা রয়েছে। তা ছাড়া কেউ নেই। বললেন পাশে থাকা আলুচাষী শেখ আবু তাহের, শেখ বাপিরা। ওদের প্রশ্ন সরকার যদি মানুষের জন্য হয়ে থাকে তাহলে যে আইন মানুষ চাইছে না সেটা পাশ করে লাভ কি সরকারের?
পশ্চিম মেদিনীপুর সদর এলাকার খড়গপুর ১ নম্বর ব্লক থেকে এসেছেন সপরিবারে বীরেন সামন্তরা। বেরিয়েছেন সকাল সাতটায়। ৭০০ জন এসেছেন ট্রেনে। সামান্য একটু মুড়ি জল দিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরেছেন। ওরা সোচ্চার ধর্মতলার প্রতিবাদ সমাবেশে। কি দাবি নিয়ে এসেছেন? বলছিলেন, কালা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এসেছেন তাঁরা। আমার জমি চলে যাবে দালালের হাতে, কর্পোরেটের হাতে - এ হতে দেব না। ২৫ কুইন্টাল ধান আমার। গত তিন মাস ধরে বেচতে পারিনি। সরকারের দর ১৮৬০ টাকা। বাইরে বারোশো টাকা। এই দামে কিনছে ফড়েরা। কেউ সঠিক দাম পাচ্ছে না। এই দালাল রাজ দিল্লিতে কায়েম করছে মোদী আর এখানে করছে তৃণমূল। দাম পাচ্ছেন না মানুষ। রাজনীতি থেকে দূরে থাকা কৃষকরাও তাই বলছেন এই আইন বাতিল না করলে আমরা মারা পড়ব। গরিব চাষি আমরা। জমি, ফসল,আমাদের সম্বল, জমি আমাদের মা।
এমন অসংখ্য প্রতিবাদী মুখ একযোগে একই দাবিতে, শীতের বিকেলে রাজপথে দাঁড়িয়ে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিলেন মোদীকে-মমতাকে। কৃষি আইন পাল্টাও। লেবার কোড বাতিল করো, না হলে আমরা বাতিল করব তোমাদের।