৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭
তৃণমূলের ভণ্ড রাজনীতির কুনাট্য
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তৃণমূলের জমানায় এবং মুখ্যমন্ত্রীর সৌজন্যে রাজ্যে অলীক কুনাট্যের অন্ত নেই। এগুলির মধ্যে সাম্প্রতিকতম সংযোজন হলো চিট ফান্ড-কাণ্ডে লক্ষ লক্ষ গরিব সাধারণ মানুষের কষ্টার্জিত কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেনের একটি চিঠি। অতি সম্প্রতি জেলবন্দি এই প্রতারক প্রধানমন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন - বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তীর মতো কমিউনিস্ট নেতার নামের পাশাপাশি কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী, তৃণমূল ছেড়ে বিজেপি-তে যাওয়া মুকুল রায় এবং তৃণমূল ও সরকারের ডুবন্ত তরী থেকে সদ্য ঝাঁপ দেওয়া শুভেন্দু অধিকারী নাকি তাঁর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন!
এ কুনাট্যের নাট্যরূপ যে খুবই দুর্বল তা কারও বুঝতে অসুবিধা হবার নয়। যখন কয়লা ও গোরু পাচার কাণ্ডে কোটি কোটি টাকার বেআইনি লেনদেনের সঙ্গে শাসকদল তৃণমূলের প্রত্যক্ষ সংযোগ বেআব্রু হয়ে পড়ছে; দলের নেতা ও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব ব্যানার্জি থেকে শুরু করে একাধিক দলীয় বিধায়ক, জনপ্রতিনিধির পদত্যাগ এবং অনেকেরই বিজেপি শিবিরে যোগদান নিয়ে জেরবার দল ও সরকার - ঠিক তখনই সুদীপ্ত সেনের মতো একজন জালিয়াতকে সামনে এনে এমন মিথ্যা নাটক সাজানো হলো, তা মানুষের বিশ্বাসযোগ্য হওয়া তো দূরের কথা, হাসির উদ্রেক করেছে। সরকার পরিচালনায় চূড়ান্ত ব্যর্থতা, একের পর এক জনবিরোধী-অগণতান্ত্রিক নীতি ও পদক্ষেপের ফলে জনমানসে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, তার সাথে সীমাহীন দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা কারণে ক্রমবর্ধমান জনরোষে বিপন্ন শাসকদল ও সরকার এখন পরিত্রাণ পেতে এমনই মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে!
গত সাত বছরে রাজ্য প্রশাসনেরই নিয়ন্ত্রণে থাকা অবস্থায় কয়েকশো বার সিবিআই-র জেরায় এজলাসে হাজির থাকতে হয়েছে সারদা কাণ্ডের এই প্রতারককে। কিন্তু কোনোবারই এই চিঠির বিষয় উল্লেখ করেননি। অসংখ্যবার তিনি মিডিয়ারও মুখোমুখি হয়েছেন। এই জালিয়াতি কাণ্ডেই ধৃত তৃণমূলের সাংসদ কুণাল ঘোষও একটা সময়ে আদালত থেকে বেরনো ও ঢোকার মুখে উপস্থিত সাংবাদিকদের নিয়ম করে বলতেন, চিট ফান্ডের সবচেয়ে বড়ো সুবিধাভোগীর নাম মমতা ব্যানার্জি। জেলে থাকার সময়ে সুদীপ্ত সেন নাকি তাঁকে জানিয়েছেন, মমতার আঁকা ছবি তিনি কিনেছিলেন বিপুল টাকায়। এমনকি স্বয়ং সুদীপ্ত সেনও যে কয়েকবার সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছিলেন, তাতে শাসকদল তৃণমূলের দিকেই অভিযোগের আঙুল তুলেছিলেন। কিন্তু কোনো সময়েই বিমান বসু, সুজন চক্রবর্তী সহ বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের কথা উল্লেখ করেননি। তিনি এমন অভিযোগ সংবলিত চিঠি যেমন গত সাত বছরে সিবিআই-কে দেননি, তেমনি বিতর্কিত পুলিশ অফিসার রাজীব কুমার যখন রাজ্য পুলিশের তদন্ত সংস্থা ‘সিট’-এর দায়িত্বে ছিলেন, তখনও এই বিরোধী নেতাদের নাম মনে আসেনি প্রতারক সুদীপ্ত সেনের।
এদিকে তদন্তে প্রকাশ, গোরু পাচারকারী এনামুল হক এবং কয়লা পাচারকারী অনুপ মাঝি ওরফে লালারাই চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি ফাঁস হবার পর হয়ে উঠেছিল তৃণমূলের ‘ফান্ড ম্যানেজার’। আয়কর দপ্তরের তদন্তে সামনে চলে এসেছে, ডালহৌসি ও শেকসপিয়র সরণির ঠিকানায় চলা চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট সংস্থার মাধ্যমে প্রায় ১৬০টির মতো ভুয়ো সংস্থা তৈরি করে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। শুধুমাত্র রানিগঞ্জ, আসানসোল ও সংলগ্ন বাঁকুড়ার অবৈধ খাদান থেকে প্রতি মাসে ২৭ থেকে ৩০ কোটি টাকা লেনদেন হয়েছে। জানা গেছে, কয়লার পাশাপাশি বালি, স্পঞ্জ আয়রন কারবারেও বিপুল পরিমাণ নগদ টাকার লেনদেনের তথ্য ও নথিপত্র মিলেছে।
এই তদন্তে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার আধিকারিকরা জানিয়েছেন, কয়লা ও গোরু পাচার কারবারের মাধ্যমে রীতিমতো সমান্তরাল অর্থনীতি চলেছে। কয়লা পাচারচক্রের পান্ডা লালার লিখিত বয়ানে তদন্তকারী অফিসাররা নিশ্চিত, শাসকদলের দু’নম্বর নেতা ও তার স্ত্রীর অ্যাকাউন্টেও টাকা ঢুকেছে। আরও জানা গেছে, সারদার টাকা যে রুটে বিদেশে গিয়েছিল, সেভাবে এই কেলেঙ্কারির টাকাও বিদেশে গেছে। বিদেশের যে সংস্থার অ্যাকাউন্টে টাকা গেছে, সেই সূত্রে জড়িয়েছে রাজ্যের শাসকদলের অন্যতম ক্ষমতাবান নেতার স্ত্রীর নাম। আয়কর দপ্তরের তল্লাশি ও তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, রাজ্য পুলিশের শীর্ষমহল থেকে শুরু করে হরিশ মুখার্জি রোডের ঠিকানাতে এই বখরা নিয়মিত যেত। এই প্রাপ্তি তালিকায় রাজ্যের কয়েকজন মন্ত্রীর নামও রয়েছে।
মুর্শিদাবাদ-মালদহে বাংলাদেশ সীমান্তের গোরু পাচারচক্রের অন্যতম পান্ডা এনামুল হকও কয়লা পাচারকারী লালার মতো তৃণমূলের একজন ফান্ড ম্যানেজার। ২০১৯ সালের নির্বাচনেও জঙ্গীপুরের তৃণমূলী সাংসদ খলিলুর রহমানের সঙ্গে একের পর এক নির্বাচনী সভায় দেখা গেছে তাকে। রঘুনাথপুরের বিধায়ক, জঙ্গীপুর পৌরসভার চেয়ারম্যানের সঙ্গে প্রকাশ্যে তৃণমূলের কর্মসূচিতে দেখা গেছে এই গোরু পাচারকারীকে। এমনকি নিজেকে ‘সমাজসেবী’ হিসেবে দাবি করা এই গোরু পাচারকারীর বেশ কিছু ব্যক্তিগত অনুষ্ঠান, কম্বলবিলির অনুষ্ঠানেও লালগোলা, জঙ্গীপুরের তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীদের দেখা গেছে।
আয়কর এবং সিবিআই’র সূত্রে প্রকাশ, গোরু পাচার থেকে মাসে কয়েক কোটি টাকার ‘প্রসাদ’ যেত মুর্শিদাবাদ ও কলকাতার তৃণমূল নেতাদের কাছে।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বেআইনি চিট ফান্ড কারবার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোরু পাচারে এনামুল হক এবং কয়লা পাচারে লালার মতো মাফিয়ারা সামনে চলে আসে।
লক্ষণীয় ঘটনা হলো, যখন রাজ্যে কয়লা ও গোরু পাচার ও বেআইনি লেনদেন নিয়ে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থার তদন্ত চলছিল, সে সময়েই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কলকাতায় আসেন। তিনি যখন বিধাননগরে, তখন মুখ্যমন্ত্রী আশ্চর্যজনকভাবে নয়াদিল্লিতে ফোন করেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পুত্র জয় শাহকে। সরকারিভাবে যদিও জানানো হয় অমিত শাহ-র স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বেগ জানিয়ে মাস্ক পরার জন্য তাঁর পুত্রকে নাকি ফোন করেন মুখ্যমন্ত্রী। এই উদ্বেগের কথা সরাসরি কলকাতা সফররত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে না জানিয়ে দিল্লিতে তাঁর পুত্রকে জানানো নিয়ে স্বাভাবিক কারণেই নানা প্রশ্ন ও সংশয় তৈরি হয়। কয়লা ও গোরু পাচার কাণ্ডে কেন্দ্রীয় সংস্থার তদন্ত বন্ধ করার আরজি কিনা - তা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। রাজ্যবাসীর অজানা নয়, বিপুল প্রমাণ ও তথ্য থাকা সত্ত্বেও তৃণমূল-বিজেপি’র গোপন বোঝাপড়ায় কীভাবে সারদা-নারদা তদন্ত চলে গেছে শীতঘুমে।
যাই হোক, এভাবে কয়লা ও গোরু পাচার কাণ্ডে যখন শাসকদল ও সরকারের চূড়ান্ত নাজেহাল অবস্থা এবং সারদা রিয়ালিটি নিয়ে চূড়ান্ত চার্জশিট দিতে উদ্যত সিবিআই ঠিক তখনই শাসকদলের নেতা ও মন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারীর পাশাপাশি আরও অনেক নেতা-মন্ত্রীর দলত্যাগের উদ্যোগে বিপন্ন হয়ে পড়ে শাসকদল। তেমনই একটি অবস্থায়, শাসকদলের অপকৌশলে সুদীপ্ত সেনের এমন একটি চিঠি প্রকাশ! এই চিঠি সম্পর্কে বামপরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী যথার্থই বলেছেনঃ ‘‘একেবারে কাঁচাহাতের কাজ, বোঝাই যাচ্ছে সবটা। সাত বছর ধরে আমরাই লড়েছি। কোর্টে গিয়েছি আমরা। তৃণমূল তো ঠেকাতে গিয়েছিল সিবিআই তদন্ত। মানুষজন হাসবেন এসব শুনে।’’
প্রসঙ্গত, গত ১৪ অক্টোবর, ২০২০ চিট ফান্ড-কাণ্ডে প্রতারিতদের ক্ষতিপূরণ এবং প্রতারকদের শাস্তির দাবিতে মুখ্যমন্ত্রীকে একটি চিঠি দেন সুজন চক্রবর্তী এবং বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান। সেই চিঠিতে দাবি জানানো হয় - চিট ফান্ড সংস্থাগুলির চিহ্নিত অস্থাবর সম্প্রতি অধিগ্রহণ বা ক্রয় করে প্রাপ্ত অর্থ কোর্ট কমিটিতে জমা করা হোক। যাতে প্রতারিতদের মধ্যে তা বিলি করা যায়। সেই সঙ্গে প্রতারিত মানুষের অর্থ ফেরত এবং প্রতারক ও সহযোগীদের শাস্তির দাবি জানানো হয়।
এছাড়া আমানতকারীদের হেনস্তা ও আক্রমণ বন্ধ করতে রাজ্য সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণ; সিবিআই-ইডি সহ তদন্তকারী সংস্থাগুলি প্রতারকদের কাছ থেকে যে সম্পত্তি এবং অর্থ উদ্ধার করেছে, তা প্রতারিতদের মধ্যে বিলি করার জন্য উদ্যোগ ও চাপ সৃষ্টির দাবি করা হয়। এছাড়া যে আমানতকারীরা ইতিমধ্যে নানা কারণে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন, তাদের ন্যূনতম ১০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থার দাবিও জানানো হয়।
এমন দাবি রাজ্য প্রশাসনের কাছে আগেও জানানো হয়েছে। কিন্তু কোনো সঠিক উদ্যোগ নিতে তাদের দেখা যায়নি। উল্টে শাসকদল মত্ত থেকেছে গরিব মানুষের অর্থ ও সম্পত্তি লুঠ করতে। লকডাউনের সময়ে গরিবদের জন্য রেশনের চাল এবং আমফান ঝড়ে ক্ষতিপূরণের টাকা শাসকদলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের লুঠের ঘটনায় গোটা রাজ্যে ক্ষোভ ছড়িয়েছে। সম্প্রতি প্রকাশিত কয়লা ও গোরু পাচার কাণ্ডে লেনদেনের সঙ্গে শাসকদলের নাম উঠে আসার মধ্য দিয়ে আবারও প্রকট হয়েছে তৃণমূলের সঙ্গে দুর্নীতি কেলেঙ্কারি শব্দগুলো যেন সমার্থক হয়ে গেছে। এসব থেকে দৃষ্টি ঘোরাতেই ভোটকৌশলী পিকে’র পরামর্শে নিত্যনতুন কৌশল অবলম্বন ক্রমাগত চলছে। তৃণমূলের এই ভণ্ড রাজনীতির কুনাট্যে সুদীপ্ত সেনের চিঠিও নবতম সংযোজন। কিন্তু এত কিছু করেও তৃণমূলের ডুবন্ত তরী রক্ষা করা যে দুরহ, তা ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে - তা টের পাচ্ছে তৃণমূলও!