E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭

উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের নির্দেশ হাইকোর্টের


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দীর্ঘ প্রায় ছ’বছর মামলা চলার পর রাজ্যে উচ্চ প্রাথমিকে সহকারি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া (২০১৬) সম্পূর্ণ বাতিল বলে ঘোষণা করল কলকাতা হাইকোর্ট। কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য গত ১১ ডিসেম্বর এই রায় দিয়েছেন। রাজ্যের স্কুল সার্ভিস কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ বেআইনি আখ্যা দিয়ে প্যানেল থেকে শুরু করে মেরিট লিস্ট সমস্ত বাতিল করে এই রায়ে আদালত বলেছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে নতুন করে শুরু করতে হবে নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে। কোর্টের এই রায়ে আপার প্রাইমারির ১ লক্ষ ২০ হাজার সফল পরীক্ষার্থী এখন প্রবল অনিশ্চয়তার মুখে।

এই রায়ের প্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারের চরম ব্যর্থতা এবং দুর্নীতির তালিকায় আরও এক ভয়ঙ্কর নজির যুক্ত হলো। শুধু পার্থ চ্যাটার্জির শিক্ষাদপ্তর নয়, গোটা তৃণমূল দলটির নানামাপের নেতাদের নানাস্তরে এই নিয়োগ কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগসমূহ কার্যত মান্যতা পেল এই রায়ে। নিজের দপ্তরের এই পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে একটি শব্দও খরচ না করে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বলেছেন, আদালতের নির্দেশের কথা শুনেছি। রায়ের কপি এখনও হাতে পাইনি। নির্দেশের কপি হাতে পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

এ প্রসঙ্গে জানা গেছে, উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিলের কলকাতা হাইকোর্টের সিঙ্গল বেঞ্চ-এর নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আপাতত ডিভিশন বেঞ্চে যাচ্ছেনা স্কুল সার্ভিস কমিশন। তাই বলা যেতে পারে, রায়ে উল্লিখিত নিয়োগে দুর্নীতি ও বেনিয়ম যে হয়েছে, তা কার্যত স্বীকার করে নিল এসএসসি এবং বকলমে ‘সততার প্রতীক’ মমতা ব্যানার্জির সরকার।

এই রায়কে খুব সময়োপযোগী ও সঠিক বলে অভিহিত করে চাকরিপ্রার্থীদের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য জানান, নিয়োগ প্রক্রিয়া ছিল চূড়ান্ত দুর্নীতিতে ভরা । তৃণমূল সরকার কোনো নিয়ম না মেনেই নিয়োগ করেছিল। কে কোন্ দলের, কে ঘুষ দিতে পারে বিচার না করে আগামীদিন নিয়োগ করা হবে। যোগ্য প্রার্থী মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হোক। ...প্রকৃত যোগ্য প্রার্থীরা যাতে বঞ্চিত না হন সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

১১ ডিসেম্বর কলকাতা হাইকোর্ট ওই রায়ে এসএসসি’র পুরনো নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ বাতিল করে বলেছে, নিয়োগ বিধি মেনে ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি ভেরিফিকেশনের কাজ শুরু করতে হবে। ৫ এপ্রিলের মধ্যে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কাজ শেষ করে ১০ মে মেধা তালিকা প্রকাশ করতে হবে। ২০২১-এর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে নিয়োগপত্র প্রার্থীদের হাতে দিতে হবে। বিচারপতি মৌসুমী ভট্টাচার্য তাঁর রায়ে নির্দিষ্ট করে বলেছেন, এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে যে সমস্ত প্রার্থী রয়েছেন তাঁদের বয়সসীমা ২০১৬ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ধরে চলতে হবে। কারণ ওই তারিখেই সরকার তার নিয়োগ প্রক্রিয়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশ করেছিল।

দু’দফায় ক্ষমতায় এসেছেন মমতা ব্যানার্জি। ১০ বছরে দু’বারও সুষ্ঠুভাবে শিক্ষক নিয়োগ করতে পারলেন না মুখ্যমন্ত্রী। আপার প্রাইমারি নিয়ে হাইকোর্টের রায় জানার পর ক্ষুব্ধ হবু শিক্ষকরা বলেছেন, ‘মমতা ব্যানার্জির সরকার পরপর দু’বার শাসন ক্ষমতায়, অথচ দুটো এসএসসি হয় না এরাজ্যে। শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে এমন অবহেলা এর আগে কখনও হয়নি।’

যদিও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ফি বছর হয়ে এসেছে এসএসসি। ২০০৫ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে নিয়োগের পরীক্ষা দেখে উৎসাহিত হয়েছিলেন এরাজ্যের শিক্ষিত যুবকরা। গত ১০ বছরে সেই শিক্ষক নিয়োগের গোটা প্রক্রিয়াটাই দুর্নীতির জালে জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। নিয়োগের স্বচ্ছতার অভাবই পরীক্ষার্থীদের টেনে নিয়ে যায় আদালতে।

এ প্রসঙ্গে সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, ‘...আদালতে সরকার প্রমাণ করতে পারেনি যে, দুর্নীতি হয়নি। যাঁদের চাকরি পাওয়ার কথা, তাঁরা পাননি। তাই আদালত এই রায় দিয়েছে, যাতে প্রমাণিত হয়েছে, এই সরকার অপদার্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত। পশ্চিমবঙ্গে কোনো দিন এমন ঘটনা ঘটেনি যে, পাঁচ বছর পরেও নিয়োগ হলো না, কোর্টের নির্দেশে প্যানেল বাতিল হয়ে গেল। শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। মুখ্যমন্ত্রী জবাব দিন’।

উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ নিয়ে মামলার আবেদনকারীরা বারেবারে এসএসসি’র কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যে চরম দুর্নীতির মধ্যে ডুবে গিয়ে পছন্দের প্রার্থীদের নম্বর বাড়িয়ে দিয়েছে। কখনও ইন্টারভিউতে নম্বর বাড়ানো হয়েছে। কখনও লিখিত (টেট) পরীক্ষার নম্বর বাড়িয়ে পছন্দের প্রার্থীদের প্যানেলের মধ্যে রাখা হয়েছে। বাদ পড়েছিলেন প্রশিক্ষিত যোগ্যপ্রার্থীরা। কমিশনের তরফে আদালতকে জানানো হয়েছিল, প্রায় ১২ হাজার অভিযোগ কমিশনের কাছে জমা হয়েছে। কমিশন সেই সব অভিযোগ খতিয়ে দেখেও নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু রেখেছে। খতিয়ে দেখার কথা কমিশন আদালতকে জানালেও আবেদনকারীদের অভিযোগের কোনো গুরুত্ব রাজ্য সরকার দেয়নি। আদালতে আবেদনকারীরা জানান, কমিশনের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার সময় বলা হয়েছিল ১৪ হাজার ৩৩৯টি পদে শিক্ষক নিয়োগ হবে। তখন ১ লক্ষ ২০ হাজার প্রশিক্ষিত প্রার্থী আবেদন করেছিলেন। ভেরিফিকেশন হয়েছিল প্রায় ৪৪ হাজার প্রার্থীর। ইন্টারভিউতে ডাক পেয়েছিলেন ২৪ হাজার ৭০০ প্রার্থী। মেরিট লিস্ট তৈরি হয়েছিল প্রায় ২৪ হাজারের। এই লিস্টের মধ্যেই ঢুকে পড়েছিল প্রায় ২০ হাজার নতুন নাম। যে নামগুলি নতুনভাবে সংযোজন করা হয়েছিল, তাঁদের সকলের ক্ষেত্রেই বিভিন্ন সময়ে নিয়মবিধি ভেঙে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতা হাইকোর্ট এই অনিয়মের বিরুদ্ধে বহুবার কমিশনকে সতর্ক করে নতুনভাবে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে বলে স্থগিতাদেশ জারি করেছিল। কথা শোনেনি কমিশন।

এদিকে সফল পরীক্ষার্থীরা এখন চরম অনিশ্চয়তার মুখে। ২০১৪ সালে নিয়োগের আবেদন করেছিলেন কয়েক লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী। ২০১৫ সালের ১৬ আগস্ট পরীক্ষায় বসেছিলেন আবেদনকারীরা। ২০১৬ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছিল। সফল হয়েছিলেন ১ লক্ষ ২০ হাজার পরীক্ষার্থী। তারপর তথ্য যাচাই করার জন্য ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া শুরু করে কমিশন। তথ্য যাচাই করার ইন্টারভিউ প্রক্রিয়া চলাকালীনই দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে আসে। আদালতে মামলা শুরু হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়া আরম্ভ করার ক্ষেত্রে শুরু থেকেই নিস্ক্রিয় থাকে কমিশন। শুনানি চলাকালীন আদালতের বিভিন্ন অন্তর্বর্তী রায়ে কমিশনের পক্ষ থেকে সদিচ্ছার অভাব দেখা যাওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করেন বিচারপতি। বিভিন্ন পর্বে আদালতে বহু প্রার্থী অস্বচ্ছতার অভিযোগ এনে মামলায় অংশীদার হন। দীর্ঘ শুনানির পর এদিন আদালত গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া বাতিল করেছে।

এই মামলায় প্রার্থীদের পক্ষের অন্যতম আইনজীবী শামিম আহমেদ বলেন, এই রায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের পক্ষে রায়। আদালত এই মামলায় অনেকবার অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিয়েছে। সরকার সেই নির্দেশকে মান্যতা দিলে হাজার হাজার বেকারকে অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে থাকতে হতো না।

রায় কার্যকর করার প্রসঙ্গে একাধিক প্রার্থী সংগঠনের বক্তব্য, আগামী মার্চের মধ্যে রাজ্যে বিধানসভা ভোটপ্রক্রিয়া শুরু হয়ে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে ভোটপ্রক্রিয়ার মধ্যে তথ্য যাচাই, ইন্টারভিউ, প্রার্থীবাছাইয়ের কাজ ধাক্কা খাবে না তো? সেজন্য ভোটপর্ব শুরুর আগে মার্চের মধ্যে পুরোপুরি নিয়োগ প্রক্রিয়া মিটিয়ে দেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। দ্রুত নিয়োগ সম্পন্ন করার দাবিতে আবারও আন্দোলনে নামবে বলে জানিয়েছে একাধিক প্রার্থী সংগঠন।

তবে তাতেও পুরোপুরি জট কাটবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশেষত করোনা ভাইরাসজনিত অতিমারীর পরিস্থিতির জন্য ধোঁয়াশা বেড়েছে। প্রার্থীদের বক্তব্য, আপাতত উচ্চ প্রাথমিকে শূন্যপদের সংখ্যা ১৪,৩৩৯। নির্ধারিত ১:৪ অনুপাতের কারণে কয়েক হাজার প্রার্থীকে ইন্টারভিউয়ে ডাকতে হবে। করোনা পরিস্থিতিতে কমিশনের অফিসে এতজন প্রার্থীর ইন্টারভিউ নেওয়া আদৌও সম্ভব হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিকল্প হিসেবে অনলাইনে ইন্টারভিউ নেওয়া হলেও তা কতটা বাস্তবসম্মত তা নিয়ে প্রার্থীদের মনে প্রশ্ন আছে। কারণ অনেক প্রার্থীর বাড়ি কিংবা বাড়ির কাছে ইন্টারনেট পরিষেবা দুর্বল। আগের বেশ কিছু যোগ্য সফল প্রার্থী মনে করছেন যে পরবর্তীতে তাঁদের পরীক্ষার গুণগত মান ব্যাহত হতেও পারে।