৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭
আর আপনি ভাবছেন এটা শুধু কৃষকদেরই ব্যাপার?
পি সাইনাথ
“এই আইনের অধীনে অথবা এই আইনের কোনো বিধি বা নির্দেশিকার অধীনে যে কোনো কিছু যা ভালো কিছু বিশ্বাসে করা হয়েছে বা করার চেষ্টা হয়েছে এমন কোনো বিষয়ে (in respect of anything which is in good faith done or intended to be done under this Act or of any rules or orders made thereunder) কেন্দ্র সরকার বা রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, অথবা কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কোনো আধিকারিকের বিরুদ্ধে অথবা কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে কোনো মামলা, মোকদ্দমা বা অন্য কোনো আইনি প্রক্রিয়া চালানো যাবে না।”
‘দ্য ফারমারর্স প্রোডিউস ট্রেড অ্যান্ড কর্মাস (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) অ্যাক্ট, ২০২০’-র ১৩ নং অধ্যায়ে আপনাকে স্বাগত। প্রসঙ্গত, এই আইনটিই ‘এগ্রিকালচারাল প্রোডিউস মার্কেটিং কমিটিজ’ যা কিনা এপিএমসি নামে বেশি পরিচিত, তাকে কার্যত ছেঁটে ফেলতে উদ্যত।
আর আপনি ভাবছেন, নতুন এই আইনগুলো শুধু চাষিদেরই ব্যাপার? হ্যাঁ নিশ্চয়, এমন অন্য আইনও আছে যেখানে সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না - যাতে তারা তাদের আইনি দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এই আইনটি কিন্তু সেইসবেরও ওপর দিয়ে যাচ্ছে। এখানে তো ‘যে কোনো’ বিষয়ে (in respect of anything) ‘ভালো কিছু বিশ্বাসে’ (in good faith) যে যা করবে তাকেই তাতে নির্বিচারে রেহাই দেওয়া হয়েছে। ‘ভালো কিছু বিশ্বাসে’ করা অপরাধের জন্য তাদের আদালতে নিয়ে যাওয়া যাবে না, শুধু তাইই নয়, এমনকি যে অপরাধ তারা করতে চলেছে (অবশ্যই ‘ভালো কিছু বিশ্বাসে’) তাতেও তাদের ছাড় দেওয়া হয়েছে।
আদালতের আইনি আশ্রয় আপনি পাবেন না, এই কথাটি নিতান্তই যদি আপনি খেয়াল না করে থাকেন - তাহলে আপনার জন্য - ১৫ নং অধ্যায়ে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে রাখা হয়েছেঃ “এই আইনের অধীনস্ত বা এই আইনের কোনো বিধির দ্বারা ক্ষমতাসম্পন্ন কোনো কর্তৃপক্ষ দ্বারা গৃহীত হতে পারে ও নিষ্পত্তি ঘটতে পারে এমন কোনো বিষয়ে কোনো মামলা বা মোকদ্দমা গ্রহণের কোনো এক্তিয়ার কোনো দেওয়ানি আদালতের নেই।’’
এই ‘অন্য যে কোনো ব্যক্তি’ (‘any other person’)-টি আসলে কে, যার ‘ভালো কিছু বিশ্বাসে’ করা কাজগুলি আইনত অভিযোগই করা যাবে না? ইঙ্গিতঃ প্রতিবাদী কৃষকেরা তাঁদের স্লোগানে যে কর্পোরেট দৈত্যদের নাম উচ্চারণ করছেন, সেই নামগুলো শোনার চেষ্টা করুন! এসবই আসলে ‘স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যবসা করা’র (‘ease of business’-এর) ব্যাপার - বড়ো, এক্কেবারে বৃহৎ ব্যবসার!
“কোনো মামলা, মোকদ্দমা বা অন্য কোনো আইনি প্রক্রিয়া চালানো যাবে না...” !কেবল কৃষকই যে আইনের কাছে বিচার চাইতে পারবে না, তাই নয়, কেউই পারবে না। অন্য কেউও না। জনস্বার্থ মামলার ক্ষেত্রেও এটা প্রযোজ্য হবে। কোনো অলাভজনক গোষ্ঠী, কোনো কৃষক ইউনিয়ন বা কোনো ব্যক্তি (তা তিনি ভালো বা মন্দ যে বিশ্বাসের দ্বারাই চালিত হোন না কেন) এখানে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না।
১৯৭৫-’৭৭-এর জরুরি অবস্থা বাদ দিলে, নিঃসন্দেহেই, আইনের আশ্রয় নেবার নাগরিক অধিকারকে এমন নির্বিচারে বহিষ্কার করা হয়নি অন্য কোনো আইনে (জরুরি অবস্থার সময়ে তো আমরা সমস্ত মৌলিক অধিকারকেই সাদামাটাভাবে বরখাস্ত করে রেখেছিলাম)!
প্রতিটি ভারতীয়ই প্রভাবিত হচ্ছেন। এই তিন আইনের আইনি-পরিভাষাগুলিকে যদি বাংলায় অনুবাদ করি, (নিচু-স্তরের) প্রশাসনকে বিচারব্যবস্থায় পরিণত করা হবে। এ আইন তাদের পরিণত করবে আদতে ন্যায়াধীশ, বিচারক এবং ফাঁসুড়েতে। কৃষক এবং দৈত্যাকার কর্পোরেশনের মধ্যে যে অন্যায় ভারসাম্যহীনতা আগে থেকেই আছে, এটা তাকে আরও বাড়িয়ে তুলবে।
উদ্বিগ্ন এক বার কাউন্সিল (দিল্লির) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে জানতে চেয়েছেঃ “প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত, প্রশাসনিক সংস্থার সাথে জড়িত কোনো কাঠামোর হাতে কীভাবে এমন কোনো মামলা বিচারের ভার দেওয়া যেতে পারে যার নাগরিক পরিণতি (civil consequences) আছে?”
(প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষের - পড়ুন মহকুমাশাসক ও অতিরিক্ত জেলাশাসকদের - ভালো আর সৎ উদ্দেশে স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য কত সুনাম রয়েছে তা ভারতীয় মাত্রই জানেন) এই প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিদের হাতে বিচারক্ষমতা সঁপে দেওয়াটা, দিল্লির বার কাউন্সিলের ভাষায়, ‘ভয়ঙ্কর এবং এক ভ্রান্তি’। আইনজীবিকায় এর প্রভাব বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছেঃ “এটা যথেষ্ট পরিমাণেই জেলা আদালতগুলোকে ক্ষতি করবে এবং আইনজীবীদের উৎপাটিত করবে।’’
এখনও ভাবছেন, আইনগুলো শুধুই কৃষকদের ব্যাপার?
দ্য ফারমারর্স (এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড প্রোটেকশন) এগ্রিমেন্ট অন প্রাইস অ্যাসুয়েরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস অ্যাক্ট, ২০২০’ চুক্তি সংক্রান্ত এই আইনে প্রশাসনের হাতে আরও বেশি বিচারক্ষমতা তুলে দেওয়া হয়েছে।
‘ভালো কিছু বিশ্বাস’-এর কথাটা এই আইনের ১৮ নং অধ্যায়েও আবার ফিরে এসেছে।
১৯ নং অধ্যায়ে বলা হয়েছেঃ “এই আইনের দ্বারা বা অধীনে যেসব বিবাদের নিষ্পত্তির জন্য মহকুমাস্তরের কর্তৃপক্ষ বা আপিল কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে, তেমন কোনো বিবাদ সংক্রান্ত মামলা গ্রহণ করার এক্তিয়ার কোনো দেওয়ানি আদালতের থাকবে না এবং এই কর্তৃপক্ষ বিবাদ সংক্রান্ত যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে তার ওপর কোনো আদালত বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ স্থগিতাদেশ জারি করতে পারবে না।” (অতিরিক্ত জোর আরোপিত)
এবং ভারতীয় সংবিধানের ১৫ নং ধারাটি সম্পর্কে ভাবুন যা বাক্-স্বাধীনতা এবং অভিব্যক্তির স্বাধীনতা, শান্তিপূর্ণ জমায়েত করার, আন্দোলন করার স্বাধীনতা, ইউনিয়ন বা অ্যাসোসিয়েশন গড়ার স্বাধীনতা সম্পর্কিত…
এই কৃষি আইনের ১৯ নং অধ্যায়টি ভারতীয় সংবিধানের ৩২ নং ধারার ওপরেও আঘাত হানছে; যা কিনা সাংবিধানিক প্রতিকার (আইনি ব্যবস্থা)-এর অধিকারকে নিশ্চিত করে। ধারা ৩২-কে সংবিধানের মৌলিক গঠনের অংশ মনে করা হয়।
ভারতীয় গণতন্ত্রের ওপর নতুন কৃষি আইনগুলোর এই প্রভাব সম্পর্কে ‘মূলধারার’ মিডিয়া (যারা দেশের ৭০ শতাংশ মানুষকে বাদ রেখেই নিজেদের খবর সাজায়, তাদের সম্পর্কে এ এক আজব বিশেষণ) নিশ্চিতভাবেই অবহিত না হয়ে থাকতে পারে না। অথচ জনস্বার্থ বা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বদলে মুনাফার সাধনাই তাদের চালিত করছে!
বিভিন্ন স্বার্থের (বহুবচনে) সংঘাতকে এরা ঢেকে রাখে। এই মিডিয়াগুলোও আসলে কর্পোরেশন। ভারতের বৃহত্তম কর্পোরেশনের যিনি শিরোমণি তিনিই আবার সবচেয়ে ধনী, সবচেয়ে বড়ো মিডিয়া মালিক এই দেশের। দিল্লির দ্বারপ্রান্তে কৃষকদের স্লোগানে যাদের নাম উচ্চারিত হচ্ছে, ‘আম্বানি’ তো তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্যদিকে, এমনকি নিচের তলাতেও, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ‘ফোর্থ এস্টেট’ আর ‘রিয়াল এস্টেট’কে আলাদা করে দেখেছি। ‘মূলধারা’র মিডিয়া এই মহাকাশে এমনই গভীরভাবে খচিত যে তারা নাগরিকদের স্বার্থকে (শুধু কৃষকদের স্বার্থের কথা ছেড়েই দিন) কর্পোরেশনের স্বার্থের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে পারে না।
ওদের কাগজে আর চ্যানেলে কৃষকদের তুলে ধরা ছবিগুলো - ধনী কৃষক, শুধুই পাঞ্জাবের কৃষক, খালিস্তানি, ভণ্ড, কংগ্রেসী ষড়যন্ত্রকারী এবং ইত্যাদি প্রভৃতি - (কিছু উজ্জ্বল - এবং সাধারণ - ব্যতিক্রম ছাড়া) রাজনৈতিক রিপোর্টগুলি ছিল অটল, নিরলস।
বড়ো মিডিয়ার সম্পাদকীয় কলামগুলি অবশ্য অন্য লাইন নিয়েছে। কুমিরের কান্না। সরকারই আসলে ব্যাপারটা আরও ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারত! হাজার হোক, এরা তো সব ভুলে-ভরা গণ্ডমুর্খেরই দল যারা কিছু বোঝে না বলেই সরকারের নীতিনির্মাতা, অর্থনীতিবিদ এবং প্রধানমন্ত্রীর অসামান্য বুদ্ধি তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে হবে! দেখাতে হবে যে এঁরা কত যত্নশীল আইন বানিয়েছেন, কৃষকদের জন্য এবং বৃহত্তর অর্থনীতির জন্য তা কতই না গুরুত্বপূর্ণ! এই বলে তারা দাবি করেঃ এই আইনগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য এবং এগুলি কার্যকর করা উচিত।
“এই গোটা পর্বের গোলমালটা”, ইণ্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর একটি সম্পাদকীয় লিখছেঃ “আসলে সংস্কারে নয় (বাড়তি গুরুত্ব আরোপিত), আসলে গোলমালটা যে পদ্ধতিতে কৃষি আইনগুলি পাশ করানো হয়েছে তাতে, সরকার যে কৌশলে কমিউনিকেট করেছে তাতে বা কোনো কৌশলের অনুপস্থিতিতে।” এক্সপ্রেস বড্ড উদ্বিগ্ন কেননা এই অনিপুণ আচরণের ফলে অন্যান্য মহৎ পরিকল্পনাগুলোও (‘যেমন এই কৃষি আইনগুলি’ যা আদতে “ভারতীয় কৃষির প্রকৃত সম্ভবনার ফসল ঘরে তোলার জন্য জরুরি সংস্কার”) আঘাতপ্রাপ্ত হবে।
দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া তার সম্পাদকীয়তে বলছেঃ “কৃষকদের মধ্যে এমএসপি অধ্যায়ের আসন্ন মৃত্যু সম্পর্কে যে ধারণাটি তৈরি হয়েছে তা মুছে ফেলা”ই হলো সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব। যতই হোক, “কেন্দ্রের সংস্কার প্যাকেজটি কৃষিবাণিজ্যে বেসরকারি অংশগ্রহণের অত্যন্ত বিচক্ষণ এক প্রয়াস। কৃষি থেকে দ্বিগুণ আয়ের স্বপ্নটা এই নতুন সংস্কারগুলির সাফল্যের ওপরেই নির্ভর করছে…” এবং এই ধরনের সংস্কারগুলো “ভারতের খাদ্য-বাজারের ক্ষতিকারক সব বিকৃতিকেও সারিয়ে তুলতে পারে।”
“এই পদক্ষেপের (নতুন আইন) সপক্ষে যুক্তিগ্রাহ্য বক্তব্য আছে”, হিন্দুস্তান টাইমস-এর একটি সম্পাদকীয় কলামের বক্তব্য। এবং “কৃষকদের এটা স্বীকার করতে হবে যে আইনগুলোর বাস্তবতা পাল্টাবে না।” সংবেদনশীল হওয়ার প্রয়োজন সম্পর্কেও এই সম্পাদকীয়টি সওয়াল করছে। এই কলামটি সেই কৃষকদেরই “উগ্র-পরিচিতির ইস্যুতে ছক” কষতে দেখতে পেয়েছে এবং তাদের ‘উগ্রপন্থী’ লব্জ ও কাজের সাথে একাত্ম করে দেগে দিয়েছে।
অনিচ্ছাকৃতভাবেই কৃষকরা কোন্ ষড়যন্ত্রকারী দলের প্রতিনিধিত্ব করে ফেলছে বা তারা কাদের স্বার্থে কাজ করছে - জাতীয় প্রশ্নগুলোয় সরকার জর্জরিত হয়ে থাকতেই পারে। তবে এরা কাদের প্রতিনিধিত্ব করছে সে’ব্যাপারে কিন্তু সম্পাদকীয় কলাম লিখিয়েদের স্বচ্ছ ধারণা আছে। সম্পাদকীয় কলাম লিখিয়েরা নিরাপদেই কর্পোরেটের পা থেকে খুঁটে খাচ্ছে, যে পা’গুলো ওদের খিদে মেটায়।
এমনকি প্রকৃত অর্থে যে খবরের চ্যানেলগুলো সবচেয়ে কম পক্ষপাতদুষ্ট, তাদের আলোচনাগুলোতেও সেই প্রতিষ্ঠানের বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি মুগ্ধ সব বিশেষজ্ঞ আর বুদ্ধিজীবীদের ছকের মধ্যে থাকা প্রশ্নগুলোই চর্চিত হয়।
ঠিক এই সময়টাতেই কেন? শ্রম আইনগুলোকেও এখনই তড়িঘড়ি সংশোধন করা হলো কেন? এই প্রশ্নগুলো কখনোই খুব ঐকান্তিকভাবে তুলে ধরা হয় না। ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হয়ে ফিরে এসেছেন গত নির্বাচনে। আরও অন্তত ২-৩ বছর তাঁর এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। ভারতীয় জনতা পার্টি সরকারের কেন এটা মনে হলো যে, অতিমারীর এই চরম সময়টাই এই আইনগুলো পাশ করিয়ে নেওয়ার শ্রেষ্ঠ সময় - যখন কিনা আরও হাজারটা অন্য বিষয়ে অনেক বেশি মনোযোগ দাবি করছে, অতিমারী মোকাবিলার জন্যই?
বেশ, হিসেবটা হলো, এটা এক এমন সময় যখন কোভিড-১৯-এর কাঁপুনিতে, অতিমারীর মারে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কৃষক, শ্রমিকেরা সংগঠিত হতে পারবে না আর কার্যকরভাবে প্রতিরোধও করতে পারবে না। মোদ্দা কথাটা হলো, এটা নিছক ভালো সময়ই নয়, এটাই শ্রেষ্ঠ সময়। এভাবেই সরকার প্ররোচিত হয়েছে তার বিশেষজ্ঞদের দ্বারা, তাদের কেউ কেউ “একটা দ্বিতীয় ১৯৯১ মুহূর্ত” দেখতে পেয়েছেন; ভিত্তিগত সংস্কারের দিকে ঠেলে দেওয়ার এক সুযোগ, উৎসাহহীনতা-দুর্দশা-বিশৃঙ্খলাকে দুয়ে নেওয়ার সুযোগ খুঁজে পেয়েছেন। সরকার প্ররোচিত হয়েছে বিশিষ্ট সম্পাদকের দ্বারাও, যিনি আকুতি জানিয়েছিলেন, “একটা ভালো সঙ্কটের অপব্যয় কখনও কোরো না”। প্ররোচিত হয়েছে নীতি আয়োগের প্রধানের দ্বারাও, ভারতে “বড্ড বেশি গণতন্ত্র” থাকায় যিনি বিরক্তি প্রকাশ করেছেন।
এবং এই আইনগুলো যে অসাংবিধানিক - সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রশ্নটার উল্লেখ প্রায় নেই-ই। থাকলেও তা খুবই ভাসা-ভাসা এবং কপট। রাজ্যতালিকাভুক্ত একটি বিষয়ে বিস্ফোরণের মতো আইন বানানোর কোনো অধিকারই কেন্দ্রের নেই।
কৃষকরা কেন সরকারের কমিটি গঠনের প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়েছে তা নিয়েও তেমন কোনো আলোচনা নেই। দেশের সমস্ত কৃষক যদি কোনো একটি কমিটি রিপোর্টের কথা জেনে থাকে এবং তার সুপারিশ লাগু করার দাবি করে থাকে তাহলে সেই কমিটিটি হলো ‘ন্যাশনাল কমিশন অন ফারমারর্স’ - যেটাকে তারা ‘স্বামীনাথন রিপোর্ট’ বলে। এই রিপোর্টকে কবরস্থ করার প্রশ্নে ২০০৪ সাল থেকে কংগ্রেস এবং ২০১৪ সাল থেকে বিজেপি নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চালিয়েছে। যদিও দুই দলই এই সুপারিশগুলি কার্যকর করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
আর হ্যাঁ, ১০,০০০-এর বেশি কৃষক দিল্লিতে সংসদ ভবনের কাছে জমায়েত করেছিলেন ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে, ওই রিপোর্টের মূল সুপারিশগুলো লাগু করার দাবিতে। তাঁরা স্লোগান তুলেছিলেন ঋণমকুব, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিশ্চয়তা সহ অন্যান্য দাবিতেও। যার মধ্যে কৃষি সঙ্কট নিয়ে আলোচনার জন্য সংসদে বিশেষ অধিবেশনের দাবিও ছিল। মোদ্দা কথা হলো, যেসব ব্যাপারে আজ কৃষকরা আপত্তি জানাচ্ছেন, দিল্লি দরবার সেগুলোই দাবি করছে। আর শুধুই পাঞ্জাব নয়, এই কৃষকেরা ২২টি অঙ্গ রাজ্য ও ৪টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন।
ভাইরাসের ভয়ে আর অতিমারীর দাপটে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হওয়ার ব্যাপারে সরকারের সমস্ত হিসেব যে আদতে ভুল ছিল সেটা আমাদের দেখিয়ে দিলেন কৃষকেরা - যাঁরা সরকারের দেওয়া চায়ের কাপও ফিরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা আগেও নিজেদের (এবং আমাদেরও) অধিকারের সপক্ষে দাঁড়িয়েছেন, এবারও দাঁড়াচ্ছেন। বিরাট ঝুঁকি নিয়েও তাঁরা এই আইনকে রুখে দিতে চান।
তাঁরা বারংবার এমন কিছু কথা বলছেন যেগুলোতে ‘মূলধারা’র মিডিয়া পাত্তা দেয় না। গোটা দেশের কাছে খাদ্যের ওপর কর্পোরেটের নিয়ন্ত্রণের অর্থ কী, এ'ব্যাপারে ওঁরা আমাদের সতর্ক করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে কোনো সম্পাদকীয় চোখে পড়েছে কখনও?
ওঁদের অনেকেই জানেন যে ওঁরা আসলে তিনটি আইন প্রত্যাহারের চেয়েও বেশি কিছুর জন্য লড়ছেন। নিজেদের জন্য বা পাঞ্জাবের জন্য লড়াইয়ের চেয়েও বেশি কিছুর জন্য। এই তিন আইনের প্রত্যাহার আমাদের নিয়ে যাবে সেইখানেই যেখানে আমরা আগে ছিলাম - সেটাও ভালো ছিল না কখনোই - সেই ভয়ানক এবং চলমান কৃষি সঙ্কটেই। এই তিন আইন প্রত্যাহার সেই সঙ্কটে বাড়তি মাত্রা যুক্ত হওয়াটা আটকাবে, একটু মন্থর করবে। আরেকটা কথা, ‘মূলধারা’র মিডিয়া না দেখলেও, কৃষকেরা এই আইনগুলোকে দেখছেন নাগরিকদের আইনি আশ্রয় পাওয়ার অধিকার কেড়ে নেওয়ার অস্ত্র হিসেবে। আর যদি তাঁরা এইভাবে দেখে বা বুঝে নাও থেকে থাকেন তাহলেও - তাঁদের এ লড়াই সংবিধান এবং গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামোকে রক্ষার লড়াই।
[এই লেখাটির একটি সংস্করণ প্রথম প্রকাশিত হয় The Wire-এ ৯ ডিসেম্বর, ২০২০। ১০ ডিসেম্বর, ২০২০ Peoples’ Archive of Rural India-তে প্রকাশিত।]
অনুবাদঃ সৌম্যজিৎ রজক