৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭
বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে রেলপথ
অমিতাভ রায়
বিলিমোরা-ওয়াঘাই ন্যারোগেজ রেলপথ।
অবশেষে মৃত্যু পরোয়ানায় সই-সাবুদ সম্পূর্ণ হলো। এবার আর হুঙ্কার নয় সরাসরি হুকুমনামা জারি করে বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে একশো সাত বছর ধরে চলতে থাকা একটি ঐতিহ্যবাহী রেলপথ। এক নির্দেশে একটা রেলপথ বন্ধের ঘোষণা করলে বিষয়টা বাড়তি গুরুত্ব পেয়ে যেতে পারে বলে একই হুকুমনামায় আরও দশটি রেলপথ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
ঘটনাচক্রে এই এগারোটি রেলপথই গুজরাটে অবস্থিত। রেলমন্ত্রকের এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর (ফ্রেট মার্কেটিং) ১০ নভেম্বর, ২০২০ এই হুকুমনামায় স্বাক্ষর করেছেন। পশ্চিম রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজারকে পাঠানো এই হুকুমনামায় পরিষ্কার বলে দেওয়া হয়েছে যে, অবিলম্বে এগারোটি রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দিতে হবে। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। কাজেই এই এগারোটি রেলপথ অচিরেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে। বাস্তবে বন্ধ হয়ে গেছে। এই রেলপথগুলি হলোঃ
● নাদিয়াদ থেকে ভদরান।
● আঙ্কলেশ্বর থেকে রাজপিপলা।
● বোরিয়াভি থেকে ভাদতল হয়ে স্বামীনারায়ণ।
● কোসাম্বা থেকে উমরপাডা।
● সামলায়া জংশন থেকে টিম্বা রোড।
● ঝাগাড়িয়া জংশন থেকে নেতরাং।
● ছুছাপুরা থেকে তাংখালা।
● ছোটা উদেপুর থেকে জাম্বুসার।
● বিলিমোরা থেকে ওয়াঘাই।
● চোরান্ডা থেকে মোতিকোরাল।
● চাঁদোদ থেকে মালসার।
হুকুমনামার প্রাপ্তিস্বীকার করে পশ্চিম রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার জানিয়েছেন যে, এই এগারোটি রেলপথের মধ্যে বেশ কয়েকটিতে ইতিমধ্যেই ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বাকিগুলোয় বন্ধ করে দেওয়া হবে।
বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং বন্ধ হতে চলা এগারোটি রেলপথের মধ্যে তেষট্টি কিলোমিটার দীর্ঘ বিলিমোরা থেকে ওয়াঘাই রেলপথ বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯১৩-এ এখনকার গুজরাটের অন্তর্গত বরোদা রাজ্যে এই রেলপথ নির্মিত হয়েছিল। বরোদার তখনকার শাসনকর্তা গায়কোয়াড বংশের রাজাদের উদ্যোগে নির্মিত এই রেলপথে ভালসাদ জেলার বিলিমোরা জংশন স্টেশন থেকে রওনা দিয়ে ডাং জেলার ওয়াঘাই জংশন স্টেশন পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করত। তেষট্টি কিলোমিটার পথ পাড়ি দেওয়ার সময় মধ্যবর্তী দশটি স্টেশনে যাত্রীদের ট্রেন থেকে নামা-ওঠার সুযোগ ছিল। সরকারের নীতি কার্যকর করতে গিয়ে এক হুকুমনামা মারফত এই সুযোগ সুবিধা এখন ইতিহাসে পরিণত হয়ে গেল।
যাত্রী কম, অলাভজনক যাত্রাপথ আখ্যা দিয়ে এর আগেও অনেক প্রাচীন রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিকল্প যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে ওঠার পর সেইসব শ্লথগতির ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি হয়নি। এই প্রসঙ্গে অতীতের হাওড়া-আমতা রেলপথের কথা স্মরণ করা যায়। কিন্তু বিলিমোরা থেকে ওয়াঘাই পথে কোনো বিকল্প যাতায়াত ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। পাহাড়-অরণ্য সমৃদ্ধ ডাং জেলা এখনও পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা বলে পরিচিত। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে যাওয়া গুজরাটের মধ্যে যে এত দরিদ্র একটা জেলা থাকতে পারে তা প্রচারের দাপটে লোকে ভুলেই গেছে। মহারাষ্ট্রের সীমান্তে পাহাড় অরণ্যের মধ্যে পড়ে থাকা অনুর্বর জমিতে সামান্য কিছু চাষের কাজ হয়। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে কাছাকাছি কোনো বাজারে নিয়ে যাওয়ার জন্য এই ট্রেনই ছিল একমাত্র ভরসা। এখন তা-ও বন্ধ হয়ে গেল।
পরাধীন দেশের সামন্ততান্ত্রিক শাসনকর্তা নিজের রাজ্যের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সুবিধার জন্য এই রেলপথ নির্মাণ করিয়েছিলেন। স্বাধীন দেশের গণতান্ত্রিক শাসনকর্তা সেই সুবিধা কেড়ে নিয়ে উচ্চস্বরে উচ্চারণ করছেন - “গত শতাব্দীর আইন দিয়ে বর্তমান শতাব্দীর নির্মাণ সম্ভব নয়।” ঘটনাচক্রে যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে তথাকথিত বিকাশ ঘটিয়েছিলেন বলে প্রচার করা হয় সেই রাজ্যে অবস্থিত দেশের দরিদ্রতম জেলার একমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে রেলের নতুন নীতির সূচনা করা হলো। একবার শুরু যখন হয়েছে তখন আগামী দিনে আরও অনেক রেলপথে ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেওয়ার হুকুম দেওয়া হবে। কাজেই সবসময় সকলকে সতর্ক থাকতে হবে।