E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৮শ সংখ্যা / ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ / ২ পৌষ ১৪২৭

তৃণমূল এবং বিজেপি’র অশিষ্ট ধারাভাষ্য

গৌতম রায়


পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনকে সামনে রেখে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি এবং রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস, সাধারণ মানুষের স্বার্থ এবং জীবন-জীবিকার প্রশ্নসমূহকে বাদ দিয়ে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ভেতর দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে আদাজল খেয়ে নেমেছে। যে কোনো রাজনৈতিক দল, নির্বাচনী সংগ্রামে নিজেদের রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরে মানুষের কাছে যাবে, এটাই রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। এই পথে কখনোই আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি হাঁটে না। তাদের স্বাভাবিক মিত্র তৃণমূল কংগ্রেসও হাঁটে না।

দখল করা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে সমস্তরকমের সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক পদগুলিকে কেন্দ্রের শাসক এবং রাজ্যের শাসকেরা জোরজবরদস্তি করে ব্যবহার করতে শুরু করে দিয়েছে দীর্ঘদিন ধরে। এতদিন পর্যন্ত কেন্দ্রের শাসকেরা রাজ্যপাল পদটিকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের যে সমস্ত দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন,পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান রাজ্যপাল জাগদীশ ধনকারকে দিয়ে সেই সমস্ত দৃষ্টান্ত অতিক্রম করতে চলেছে বিজেপি। রাজ্যপালের পদকে কেন্দ্রের শাসক নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে - এই অভিযোগ বামপন্থীরা দীর্ঘদিন ধরে করে আসছেন।

ছয়ের দশকে এই রাজ্যের রাজ্যপাল ধরমবীরের ভূমিকা বা আটের দশকে অনন্তপ্রসাদ শর্মার ভূমিকা ঘিরে রাজ্যপালের পদকে কেন্দ্রের শাসকের রাজনৈতিক স্বার্থপূরণের ব্যবহার করবার ভয়ঙ্করতম দৃষ্টান্ত এই পশ্চিমবঙ্গে স্থাপিত হয়েছিল। সেদিন যাঁরা রাজ্যপালের সেই ভূমিকাকে সমর্থন করেছিলেন তাঁদের একাংশ বা তাঁদের রাজনৈতিক উত্তরসূরিরা আজকে বর্তমান রাজ্যপাল জাগদীশ ধনকারের ভূমিকা ঘিরে সমালোচনায় মুখর। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে গোপালকৃষ্ণ গান্ধী যেভাবে তৎকালীন নির্বাচিত বামফ্রন্ট সরকারের সঙ্গে সংঘাতে গিয়ে, সেই সময়ের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাজনৈতিক মাইলেজ পাইয়ে দিয়েছিলেন, সেই অবস্থায় রাজ্যপালের পদের রাজনৈতিক ব্যবহার ঘিরে সেদিন কিন্তু যাঁরা একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, তাঁরাই আজ জগদীশ ধনকারের ভূমিকা ঘিরে সমালোচনায় মুখর।

অপরপক্ষে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি’র প্রতি কার্যত আনুগত্য প্রকাশ করেই বর্তমান রাজ্যপাল যেভাবে রাজ্য সরকারের খুঁটিনাটির মধ্যেও অংশগ্রহণ করার চেষ্টা করছেন, সেটি ভারতের সংবিধানকে বিধ্বস্ত করবার একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত হিসেবে উঠে আসতে শুরু করেছে। রাজ্যপাল যদি কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষাবলম্বন করেন, সেই রাজনৈতিক দলকে মাইলেজ পাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, আর সেক্ষেত্রে যদি রাজ্যপালের নিয়োগকর্তা রাষ্ট্রপতি আর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কার্যত নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেন - তাহলে সেটি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান, সর্বোপরি যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে একটি বিপজ্জনক পদচিহ্ন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল জাগদীপ ধনকারের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যে রাজনৈতিক বিরোধ, সেটিকে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়দলই নিজের নিজের দলের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করলেও ভারতের সংবিধানের যে মূল দুটি-স্তম্ভ ধর্মনিরপেক্ষতা আর যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামো তাকে ধ্বংস করতে যে বিজেপি’র উদ্যোগ, রাজ্যপাল আর রাজ্য সরকারের মধ্যে সংঘাতের ভেতর সেটির উদ্দেশ্য নিহিত রয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধকে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয় দলই মতাদর্শের লড়াই বলে কোনদিনও মনে করে না। তাদের কাছে রাজনৈতিক বিরোধ মানে হলো খুন, জখম, হিংসা, সংঘর্ষ। গত লোকসভা (২০১৯) নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিজেপি ১৮টি আসন জেতবার পর, এই রাজনৈতিক সংঘর্ষের নাম করে খুন জখম সন্ত্রাস হিংসার রাজনীতিকে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয় রাজনৈতিক দলই, একটা ভয়াবহ জায়গায় নিয়ে গিয়েছে।

খুন-জখমের রাজনীতি কায়েম করে বিরোধীদলকে শায়েস্তা করার কৌশল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি পুরনো পদ্ধতি। সেই পদ্ধতির ভেতর দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গে এমন একটা পরিস্থিতি কায়েম করতে চাইছেন যে, যাতে করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার, রাজ্যপালের পদটিকে ব্যবহার করে, রাজ্যের উপর কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের জায়গাটিকে প্রসারিত করতে পারে। বস্তুত, এই উদ্দেশ্য নিয়েই বিজেপি একেবারে ঘরের লোককে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হিসেবে কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে পাঠিয়েছে।

রাজ্যপালের মাধ্যমে বিজেপি যাতে তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে তার জন্য সমস্ত রকমের পরিবেশ-পরিস্থিতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর রাজনৈতিক সতীর্থরা একদম জোরকদমে সৃষ্টি করে চলেছেন। নিজের ডুবন্ত জনপ্রিয়তাকে ফিরে পাওয়ার জন্য কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের হস্তক্ষেপটিকে মমতা একটি রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছেন কিনা এই প্রশ্নটিও ধীরে ধীরে তীব্র হতে শুরু করেছে। পুলিশ প্রশাসনের একটা বড়ো অংশ, রাজনৈতিক হিংসা, সংঘর্ষ, হত্যা থামাতে আদৌ যত্নবান নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সরকারের পুলিশ এবং প্রশাসনের সর্বস্তরের ব্যক্তিদেরকে দলীয় কর্মীর মতো ব্যবহার করতে চান। সবাই যে মমতার সেই প্ররোচনায় পা দেন, একথা ভাববার কোনো কারণ না থাকলেও, এটা বলতেই হয় যে, প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের আমলাদের একটা বড়ো অংশ, প্রশাসক হিসেবে নিজেদের দায়িত্ব পালন না করে, রাজ্যের শাসকদলের কার্যত তাঁবেদারের মতো ভূমিকা পালন করেন।

ফলে নির্বাচনের দিন যত এগিয়ে আসছে, ততই রাজ্যে রাজনৈতিক হিংসা ক্রমবর্ধমান। বিজেপি এবং তৃণমূল উভয় রাজনৈতিক দলই, কেন্দ্র এবং রাজ্যে নিজেদের সীমাহীন ব্যর্থতা ঢাকতে, এই রাজনৈতিক হিংসার ঘটনাবলিকে সবথেকে বেশি সামনে তুলে আনার চেষ্টা করছে। কেন্দ্রীয় সরকারের ভয়াবহ জনবিরোধী অর্থনীতি এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপ, গোটা দেশকে একেবারে আগ্নেয়গিরির প্রান্তসীমায় এনে দাঁড় করিয়েছে। আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার আরএসএস’র রাজনৈতিক কর্মসূচি সাম্প্রদায়িকতাকে প্রচার, প্রসার এবং প্রয়োগের ক্ষেত্রে এমন একটা জায়গায় এনে দাঁড় করিয়েছেন যে, সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা এখন সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদে পরিণত হয়েছে। অতিমারীজনিত পরিস্থিতির দরুন গোটা দেশে তীব্র অর্থনৈতিক সঙ্কট। গোদের উপর বিষফোঁড়ার মতো ছাঁটাইয়ের সমস্যা গোটা দেশে এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক সঙ্কট ডেকে এনেছে। বেকারির সমস্যাকে ছাপিয়ে গেছে ছাঁটাই, কর্মহীনতার সঙ্কট।

দেশের মোট শ্রমিকদের ভেতর ৮০ শতাংশের ওপর অসংগঠিতক্ষেত্রে নিয়োজিত। সেই অসংগঠিত শ্রমিকদের বেশিরভাগই এখন কার্যত কর্মহীন। একেবারে উচ্চবেতনের কর্মী থেকে শুরু করে, সাধারণ শ্রমিক, প্রত্যেকে নিজের নিজের কর্মক্ষেত্রে একটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। নিজস্ব পরিমণ্ডলের বাইরে গিয়ে, অন্য পরিমণ্ডলে তাঁদের রুটি-রুজির সন্ধানে নিয়োজিত হতে হচ্ছে।

অর্থনীতিবিদদের একটা বড়ো অংশের মতে, ভারতের অর্থনৈতিক মন্দা অতিমারীর এই পর্বে তীব্র হয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকস্তরে বিশেষজ্ঞরা ক্ষুধাজনিত যে সঙ্কটের সতর্কবার্তা দিচ্ছিলেন, তারও পূর্বাভাস ভারতের দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দ্রব্যমূল্যের আকাশছোঁয়া দাম এখন উচ্চবিত্তের হেঁশেলে পর্যন্ত প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

এইরকম একটি অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে যাতে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলি উঠে আসতে না পারে, তারজন্যই একদিকে সম্প্রদায়িক, ধর্মান্ধ, মৌলবাদী অবস্থান, জাতিভেদ ইত্যাদির সুড়সুড়ি। অপরপক্ষে, রাজনৈতিক সংঘর্ষের ভেতর দিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিটাকে অন্যদিকে সরিয়ে রাখাই হচ্ছে আরএসএস এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র প্রধান লক্ষ্য।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দশবছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গ এখন পুরোপুরি একটি বৃদ্ধাবাসে পরিণত হয়েছে। চাকরি না পেয়ে শিক্ষিত বেকারেরা ভিন্ রাজ্যে, বিদেশে পাড়ি দিচ্ছে। প্রথাগত শিক্ষার সুযোগ না পাওয়া কায়িক শ্রমনির্ভর মানুষজন পশ্চিমবঙ্গে পেটের ভাত জোগাড় করতে না পেরে, ভিন্ রাজ্য, এমনকি ভিন্ দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। তাই কায়িক শ্রমনির্ভর শ্রমিকেরা পশ্চিমবঙ্গ থেকে কী হারে ভিন্ রাজ্যে রোজগারের জন্য যেতে বাধ্য হন, তার করুণ চিত্র আমরা অতিমারীর লকডাউনের সময় দেখেছি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালের গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে একটিও বড়ো, ছোটো, মাঝারি-কোনো মাপের শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর গোটা রাজনৈতিক জীবনে যেভাবে অরাজনৈতিক পর্যায়ক্রমগুলিকে সামনে এনে,ক্ষমতা দখলকে একমাত্র লক্ষ্য করে এগিয়ে ছিলেন, সেই পদ্ধতিই কিন্তু গত দশ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা সমাজের বুকে প্রোথিত করে যাচ্ছেন। নিজের সার্বিক প্রশাসনিক ব্যর্থতা, সীমাহীন দুর্নীতির সঙ্গে যে জিনিসটিকে তিনি অত্যন্ত যত্নসহকারে করে গেছেন সেটি হচ্ছে, বিজেপি যাতে এই রাজ্যে ক্রমশ সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হয়, আর তার জেরে নির্বাচনী রাজনীতিতে তারা যাতে সাফল্য লাভ করে।

আজ যে রাজনৈতিক হিংসা একটা বল্গাহীন আকারের এসে দাঁড়িয়েছে, খুন-জখম-রাহাজানি এগুলো যখন রাজনৈতিক সংস্কৃতির একটা ধারাভাষ্য হিসেবে একাধারে মমতা এবং বিজেপি স্থাপন করতে সচেষ্ট, ঠিক সেইসময়ে, বিশেষভাবে বলতে হয়,মমতা ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই, আরএসএসে’র রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং যাতে ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়, তারজন্য সমস্তরকমভাবে তার নিজের প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন।

অটলবিহারি বাজপেয়ী কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকাকালীন যে আরএসএস পশ্চিমবঙ্গে কার্যত মাথা তুলতে পারেনি সেই সময়ের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দৌলতে, বিশেষ করে বামপন্থী আন্দোলনের একটা সজাগ ও সচেতন দৃষ্টিভঙ্গির দরুন এটা সম্ভব হয়েছিল। আর বামফ্রন্ট সরকারের প্রশাসনিক উদ্যোগের ফলেও এটি বাস্তবায়িত হয়েছিল। সেই আরএসএস কিন্তু মমতা ক্ষমতায় আসবার প্রায় সাথে সাথে, এই রাজ্যে কেবল তাদের সাংগঠনিক বিস্তার করতে সমর্থ হয়েছে তাই নয়, তাদের যে সবথেকে বড়ো রাজনৈতিক কর্মসূচি,’ সামাজিক প্রযুক্তিকে নানাভাবে প্রয়োগ করে, নিজেদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপিকে একটা সুবিধাজনক জায়গায় এনে দিতে সমর্থ হয়েছে।

আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের মুখে পশ্চিমবঙ্গে একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করে, কার্যত মমতা যেভাবে বিজেপিকে সাহায্য করছেন, তার সার্বিক পরিস্থিতি তৈরির পেছনে, মমতার ‘প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতা’র একটা বিশেষরকমের ভূমিকা আছে। আমাদের মনে রাখা দরকার যে, গত দশবছরে আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র বিরুদ্ধে কিছু শৌখিন বিরোধিতার কথা মমতা বলেছেন। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বিজেপি যাঁকে তুলে ধরেছিল, সেই নরেন্দ্র মোদীকে কোমরে দড়ি পরিয়ে ঘোরানো কথাও বলেছেন। অথচ, এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের মূলে যে আরএসএস আছে, সেই আরএসএস সম্পর্কে কিন্তু গত দশ বছরে একটি শব্দও মমতা উচ্চারণ করেননি।

বিজেপিকে সভা-সমিতি করতে দেওয়ার প্রশাসনিক অনুমতির ক্ষেত্রে কিছু শৌখিন বিরোধিতা করলেও গত দশ বছরে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত যতবার কলকাতা শহরে এসেছেন প্রকাশ্য সভা করেছেন বা গোপন সভা, করেছেন, কোনো কিছুর ক্ষেত্রেই রাজ্য সরকার কিন্তু কোনোরকম প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেননি। মোহন ভাগবত প্রকাশ্য জনসভায় ভয়ঙ্কর সাম্প্রদায়িক প্ররোচনা দিয়েছেন। কিন্তু সেসব সম্পর্কে মমতা নিজে বা তাঁর দলের লোকজনেরা বা প্রশাসনের লোকজনেরা, একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

যে আরএসএস একদা ‘দেবী দুর্গা’ বলে অভিহিত করে মমতাকে পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের ক্ষমতায় থেকে হটানোর অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে নির্ণয় করেছিল, সেই আরএসএস’র প্রতি মমতা তাঁর দশবছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালের প্রতিটি পদক্ষেপে কার্যত একটা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে চলেছেন। বিরোধীদলকে রাজনীতি করতে দেব না বিশেষ করে বামপন্থীদের রাজনীতি করতে দেব না, বিরোধী জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে ভূমিস্তরের রাজনৈতিক কর্মী, প্রত্যেককেই হয় পুলিশ লেলিয়ে, নয়তো নানাধরনের প্রলোভন দেখিয়ে, মমতা নিজের দলের অন্তর্ভুক্ত করার সবরকমের চেষ্টা করেছেন।

আরএসএস-বিজেপি’র যে বিরোধীশূন্য, স্বৈরতান্ত্রিক, ফ্যাসিবাদী প্রবণতার শাসনতন্ত্র কায়েমের কর্মসূচি, সেই কর্মসূচি গত দশবছরে পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সজাগভাবে পালন করেছেন। পাকিস্তান, বাংলাদেশ সহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলিতে রাজনীতি ব্যতিরেকে, অরাজনৈতিক বিষয়ের উপর নির্ভর করে, এক ধরনের অকর্মণ্য রাজনৈতিক প্রবাহ তৈরির শরিক হয়, সেজন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে অত্যন্ত যত্নবান। সেই যত্নের শরিক যে মমতা এবং নরেন্দ্র মোদী নন, তার নিশ্চয়তা কতোখানি?

গত দশ বছরে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচনী সংগ্রামগুলি এগিয়ে এলে নরেন্দ্র মোদীর দল বিজেপি এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে আর তাঁর দলের যে আচার-আচরণ, তা থেকে, সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থপূরণের দিকটি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মমতার এই অরাজনৈতিক বিষয়াবলিকে অবলম্বন করে, খুন-জখমের রাজনীতিকে পশ্চিমবঙ্গে কায়েম করবার যে সাম্প্রতিক কৌশল, তা থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছে যে, পশ্চিমবঙ্গের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনের মতোই, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ পর্দার আড়াল থেকে, নিজেদের খেলা খেলবে। আর সেই খেলার অন্যতম কুশীলব হলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদী বা জাগদীপ ধনকারেরা।