৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র ধ্বংসকারী, আদিবাসী জনগণের বাঁচার অধিকার হরণকারী
দেওচা-পাঁচামি কয়লা খনি প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আন্দোলন
কলকাতা থেকে বীরভূমের দেউচা-পাঁচামির পথে প্রকল্প বিরোধী জাঠা।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ পরিবেশ-বাস্তুতন্ত্র রক্ষা, আদিবাসী জনগণের জল জমি ও জঙ্গলের অধিকার এবং সংস্কৃতি ও জীবন রক্ষার বিষয় নিয়ে কলকাতা থেকে দেওচা-পাঁচামি পদযাত্রা শুরু হলো ১৫ ফেব্রুয়ারি। কলকাতার রাণুচ্ছায়া মঞ্চ থেকে শুরু হয় এই পদযাত্রা। পদযাত্রার সূচনায় রবীন্দ্রসদনে রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান পদযাত্রীরা। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকালে দেওচা-পাঁচামিতে শেষ হবে এই পদযাত্রা। প্রস্তাবিত দেওচা-পাঁচামি কয়লাখনির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের কর্মসূচির অঙ্গ হিসেবে ‘বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চে’র আহ্বানে এই পদযাত্রা। এই পদযাত্রায় দেওচা-পাঁচামির আদিবাসী মানুষ, সাংস্কৃতিক জগতের বিশিষ্টজনেরা এবং বহু প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মানুষ অংশ নেন। পদযাত্রার সূচনা করেন সংগঠনের আহ্বায়ক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়।
রাণুচ্ছায়া মঞ্চে সংক্ষিপ্ত সভায় দেওচা-পাঁচামির আদিবাসী মানুষরা এই কয়লাখনি নিয়ে তাঁদের ক্ষোভের কথা জানিয়েছেন। সভায় প্রস্তাবিত কয়লাখনি এলাকার বাসিন্দা মাকু হাঁসদা, অশোক মুর্মু প্রমুখরা স্পষ্টভাষায় জানিয়ে দেন, আদিবাসী মানুষদের মতামতকে অগ্রাহ্য করে সরকার যদি কয়লাখনি খননের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে তাহলে তার ফল হবে ভয়ানক। আদিবাসী মানুষ সর্বশক্তি দিয়ে এর বিরোধিতা করবে। আমরা আমাদের জল জমি জঙ্গল ছেড়ে কোথাও যাব না। বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চের পক্ষে নাট্যব্যক্তিত্ব জয়রাজ ভট্টাচার্য বলেন, কয়লা খনি খননের নামে সরকার এই বিশাল জমি আদানি গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিতে চাইছে। আমরা এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে সমস্বরে ‘না’ বলতে চাইছি।
প্রথমদিনের পদযাত্রা কলকাতার মেয়ো রোডে গান্ধী মূর্তিতে এসে শেষ হয়। কলকাতায় এদিনের পথপরিক্রমায় পদযাত্রীরা প্রথমে বাবাসাহেব আম্বেককরের মূর্তিতে এবং শেষে গান্ধী মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। দ্বিতীয় দিন, ১৬ ফেব্রুয়ারি পদযাত্রা হয় হাওড়া ময়দান থেকে বালি পর্যন্ত। হুগলি জেলার উত্তরপাড়া থেকে শ্রীরামপুর পর্যন্ত পদযাত্রা হয় ১৭ ফেব্রুয়ারি। এরপর পদযাত্রীরা ১৮ ফেব্রুয়ারি হাঁটবেন পূর্ব বর্ধমান এবং পশ্চিম বর্ধমানে। ওইদিন রাত্রিতে পদযাত্রীরা বীরভূমের ইলমবাজারে পৌঁছবেন। ১৯ ফেব্রুয়ারি বোলপুর থেকে সিউড়ি এবং ২০ ফেব্রুয়ারি সিউড়ি থেকে মহম্মদবাজার পদযাত্রা হবে। ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে মহম্মদবাজার থেকে হাঁটা শুরু করে পদযাত্রীরা দেউচা-পাঁচামিতে পৌঁছবে। সেখানে বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চের পক্ষ থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সহ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করা হবে। বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠন ওই কর্মসূচিতে অংশ নেবে।
২০২১ সালের ২২ মার্চ হাওড়ার শরৎসদনে এক ফ্যাসিবিরোধী কনভেনশনের মধ্যদিয়ে আত্মপ্রকাশ করে ‘বিদ্বেষের রাজনীতি বিরোধী জনমঞ্চ’। এবছরের ৬ ফেব্রুয়ারি কলকাতার তপন থিয়েটারে জনমঞ্চের প্রথম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে দেউচা-পাঁচামি প্রস্তাবিত কয়লাখনির বিরুদ্ধে যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। এই কর্মসূচির মূল আহ্বান ছিলঃ “যেখানে আগ্রাসন সেখানেই প্রতিরোধ, যেখানে নিপীড়ন সেখানেই লড়াই - ভাষা হোক বা ভূমি। মাতৃভাষা দিবসে মাতৃভূমির অধিকার রক্ষার শপথ দেউচা-পাঁচামিতে”। কর্মসূচির আহ্বানের মেজাজের সাথে সঙ্গতি রেখেই পদযাত্রার একদম সামনের ব্যানারে লেখা হয়েছিলঃ “বিরুদ্ধতার চাবুক ওঠাও হাতে”। ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে শুরু করেছে।
বীরভূমের মহম্মদবাজার ব্লকের ১২.২৮ বর্গ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এই কয়লা ব্লক। এর মধ্যে দেওচা-পাঁচামি’তে ৯.৭ বর্গকিলোমিটার এবং দেওয়ানগঞ্জ-হরিনসিংহা’তে ২.৫৮ বর্গকিলোমিটার। প্রায় ৩ হাজার ৩০০ একর জমিজুড়ে খনি খনন হবে। এখানে মজুত কয়লার পরিমাণ আনুমানিক ২১১ কোটি টন। মাইনিং সংক্রান্ত অনুসন্ধান রিপোর্ট অনুযায়ী চারটি কয়লার স্তর আছে এখানে। সবচেয়ে উপরের কয়লার স্তরটিতে পৌঁছতে গেলে ২২৫ মিটারের বেশি পুরু ও শক্ত ব্যাসল্ট পাথর কাটতে হবে। এই ব্যাসল্ট পাথর কেটে কয়লার তোলার প্রযুক্তি ভারতে নেই। বিদেশ থেকে এই প্রযুক্তি আনতে হবে। এই পুরু পাথর কেটে কয়লা তোলা এবং এই খনি খননের জন্য যে বিশাল সংখ্যক মানুষ উচ্ছেদ হবেন তাঁদের পুনর্বাসন সহজসাধ্য নয়। আবার এটা খোলামুখ কয়লাখনি। এমনিতেই সারা বিশ্বে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমানোর জোরদার প্রয়াস চলছে। আর বিপদজ্জনক এবং পরিবেশ দূষণের দিক বিবেচনা করে বেশিরভাগ কয়লা উৎপাদনকারী দেশে খোলামুখ কয়লাখনি নতুনকরে খনন করা হয় না; আর যেগুলি আছে সেগুলি থেকে উৎপাদন বন্ধ করা হচ্ছে কিংবা চেষ্টা চলছে বন্ধ করার। খোলামুখ খনি ব্যাপক বায়ু, জল ও শব্দ দূষণ ঘটায়। যদিও ভারতে খোলামুখ খনি থেকে এখনও উৎপাদন রমরমিয়ে চলছে।
বহুবছর আগে রাষ্ট্রায়ত্ত কোল ইন্ডিয়া এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায়। ২০১৩ সালে কেন্দ্রীয় সরকার প্রকল্পের বিপুল ব্যয়ভারের কারণে পশ্চিমবঙ্গের সাথে আরও ৬টি রাজ্যকে যুক্ত করে। তৈরি করা হয় বীরভূম কোলফিল্ডস লিমিটেড। কিন্তু প্রযুক্তিগত জটিলতা ও বিপুল ব্যয়ভারের কারণে সব রাজ্যই প্রকল্প থেকে সরে যায়। ২০১৫ সালে রাজ্য সরকার একাই সব দায়িত্ব নিতে চায়। কেন্দ্রীয় সরকার ২০১৯ সালে অনুমোদন দেয় এবং কোলব্লকটি ওয়েস্ট বেঙ্গল পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেডকে বণ্টন করে। এই প্রকল্প রূপায়ণ হলে ১৯টি গ্রামের প্রায় ৪ হাজার ৩০০টি পরিবারের ২১ হাজারেরও বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবেন। আর খোলামুখ খনির সরাসরি প্রভাব পড়বে ৫৩টি জনপদের ৭০ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবনে।
জীবনধারণের ন্যূনতম সুযোগসুবিধা থেকে এলাকার গরিব আদিবাসী মানুষরা বঞ্চিত। পাথর খাদানের ভয়াবহ দূষণে আক্রান্ত বীরভূমের একটা বড়ো অংশের মানুষ। তারমধ্যে এই আদিবাসী মানুষরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এখন দেওচা-পাঁচামির আদিবাসী মানুষের জীবনের ওপর দিয়েই স্টিম রোলার চালাতে চাইছে রাজ্য সরকার। এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষের লড়াই ক্রমশ তীব্র হচ্ছে। রাণুচ্ছায়া মঞ্চের সভায় ওই এলাকার আদিবাসী মানুষ জানিয়েছেনঃ তৃণমূলীরা গ্রামে মিটিং করতে এসেছিল। তারা ওদের মিটিং করতে দেয়নি। এই রাগে তৃণমূলীরা মহম্মদবাজারের পুলিশকে আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। পুরুষ পুলিশের হাতে আক্রান্ত হয় মহিলারাও। পুলিশ মহিলাদের তলপেটে লাথিও মারে।
মঞ্চে বক্তব্য রাখছেন বিকাশ ভট্টাচার্য।
রাণুচ্ছায়া মঞ্চের সভায় রাজ্যসভায় সিপিআই(এম) সাংসদ বিকাশঞ্জন ভট্টাচার্য বক্তব্য রাখেন। অর্ক মুখার্জি, কাজী কামাল নাসের, বাবুদাস পাউরিয়া সঙ্গীত পরিবেশন করেন।