৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
রাজ্যের চার পৌরনিগম নির্বাচনেও নাগরিক অধিকার পদদলিত
ভোট লুটের বিরুদ্ধে বিক্ষোভের ফলে রানীগঞ্জে অবরুদ্ধ ৬০ নং জাতীয় সড়ক।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ১২ ফেব্রুয়ারির পৌর ভোটে আবারও সেই একই ছবি দেখা গেল। দেখা গেল ভোট লুঠ আর বিরোধীদের ভোট প্রক্রিয়া থেকে গায়ের জোরে সরিয়ে সাধারণ মানুষের রায় প্রতিফলিত হতে না দেওয়ার স্বৈরশাসক সুলভ মনোভাব। যা ১৬ তারিখের ফলাফলেই আরও পরিষ্কার আর স্পষ্ট দিনের আলোর মতো। এই পরিস্থিতিতেও বামফ্রন্টের ভোট গত বিধানসভার তুলনায় বেড়েছে সামগ্রিকভাবেই। চারটি কর্পোরেশনে বামফ্রন্টের ভোটের হার দাঁড়িয়েছে ১৩.৫৩ শতাংশ। বিজেপি পেয়েছে ১৫.৮১ শতাংশ। চন্দননগর এবং বিধাননগরে বামফ্রন্ট দ্বিতীয় স্থানে আছে, যেখানে আসানসোল এবং শিলিগুড়িতে দ্বিতীয় বিজেপি। তবে বামফ্রন্টের ভোটের শতাংশের তুলনায় জয় এসেছে কম সংখ্যক ওয়ার্ডে।
বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে সিপিআই(এম) নেতা রবীন দেব তৃণমূল কংগ্রেসের এই ভোট লুটের বলেছেন, ৪টি কর্পোরেশন নির্বাচনের ফলাফলে স্পষ্ট, বামফ্রন্টের জনসমর্থন বেড়েছে। বামফ্রন্টের পক্ষে ভোটের হার বেড়েছে। এর পাশাপাশি বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূল প্রার্থীদের প্রায় ১০০ শতাংশের কাছাকাছি ভোট প্রাপ্তিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তীব্র সমালোচনা করে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘...৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছে তৃণমূলের প্রার্থী! নির্লজ্জ ভোট লুট ছাড়া এটা সম্ভব? যেখানে তৃণমূল প্রার্থীরা ভোট পেয়েছেন সেখানকার এলাকার বাসিন্দাদের ৯৪ থেকে ৯৬ শতাংশের হাতের আঙুলে ভোটের কালি দেখাতে পারবে রাজ্য নির্বাচন কমিশন?’ বলা বাহুল্য, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তরফে এর কোনো উত্তর আসেনি।
দিনের পর দিন চুরি, লুট, স্বজনপোষণ, দুর্নীতি সহ নানা অপরাধ আর অপশাসনের বোঝা যতই ভারী হচ্ছে, মানুষের প্রত্যাখ্যানের আশঙ্কায় ততই লাগাতার ভোট লুট করে পরিত্রাণ পেতে মরিয়া হচ্ছে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস। এই অপকর্ম চাপা দিতে ভোট লুটকে গণতন্ত্রের উৎসব বলে মুখ্যমন্ত্রী এবং অনুপ্রাণিত মিডিয়া সবুজ ঝড় বলে চালানোর চেষ্টা করছে বারবার। তবুও পেশিশক্তি ব্যবহার করে ভোটাধিকার কেড়ে নেবার সমস্ত ক্ষত দগদগে ঘা হয়ে ফুটে উঠছে ভোটের ফলাফলে। মানুষের ক্ষোভও চাপা থাকছে না। কলকাতা কর্পোরেশন থেকে রাজ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ৪টি পৌর কর্পোরেশনের নির্বাচন - সেই একই চিত্রনাট্য অব্যাহত। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় জনগণের অংশগ্রহণকে কেন্দ্রীয় এবং বেশি করে রাজ্য নির্বাচন কমিশন পরিচালিত ভোটে লাগাতার গৌণ করার বিরুদ্ধে জনমানসে ক্রোধ এখন রাজ্যের সর্বত্র বাড়ছে।
শিলিগুড়ির ১৯ নং ওয়ার্ডের বিজয়ী সিপিআই(এম) প্রার্থী মৌসুমী হাজরা।
এর মধ্যেও লক্ষ্যণীয়, শিলিগুড়িতে বামফ্রন্টের ভোটের হার ২০২১-এর মে মাসের বিধানসভা ভোটের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। গত বছর মে মাসে ভোটের হার ছিল ১৬ শতাংশ। এবার তা বেড়ে ১৮.০৬ শতাংশ হয়েছে। এখানে বিজেপি বিধানসভায় আগে পেয়েছিল ৫০ শতাংশ, এবার তা নেমে এসেছে ২৩.২৪ শতাংশে। আবার তৃণমূল বিধানসভায় পেয়েছিল ৩০ শতাংশ, যা এখন বেড়ে হয়েছে ৪৭.২৪ শতাংশ।
আবার প্রতি কথায় উন্নয়নের ঢাক পেটানো সত্ত্বেও সেই সাফল্যে ভর করে জনতার দরবারে যেতে প্রবল তৃণমূলী অনীহায় ধরা পড়েছে উন্নয়নের অন্তসারশুন্যতার উপলব্ধির আতঙ্ক। ভোট প্রাপ্তির খতিয়ানে নীরবে সেই আতঙ্কের পাটিগণিত প্রতিফলিত। যেমন বিধাননগরে। বিধাননগর পৌরনিগমের একাধিক ওয়ার্ডে তৃণমূল পেয়েছে মোট ভোটের ৮০ থেকে ৯৬ শতাংশ। বহুদলীয় গণতন্ত্রে এমন পরিস্থিতি কার্যত অসম্ভব এবং অবাস্তব বলেই বিশেষজ্ঞদের মত। ভোটের দিন মানুষের অভিজ্ঞতাও ঠিক তেমনটাই। এখানে গত বছর বিধানসভায় তৃণমূল জয়ী হয়েছিল ৭ হাজারেরও বেশি ভোটে। বিধানগর পুরসভার যে ১৪ টি ওয়ার্ড ওই বিধানসভার মধ্যে পড়ে সেখানে মমতা ব্যানার্জির দল এগিয়ে ছিল মাত্র কয়েকশ’ ভোটে। কিন্তু এবারের পৌর ভোটে ওই ১৪ টি ওয়ার্ডে শাসকদলের জয়ের ব্যবধান প্রায় ৫০ হাজার। বিধাননগর কর্পোরেশনে বামফ্রন্ট ভোট পেয়েছে প্রায় ১১ শতাংশ, যা গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের মিলিত ভোটের চেয়ে বেশি।
চন্দননগরের ১৬ নং ওয়ার্ডের বিজয়ী সিপিআই(এম) প্রার্থী অভিজিৎ সেন।
চন্দননগরে বামফ্রন্ট গত বিধানসভার তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি ভোট পেয়েছে। বামফ্রন্টের ভোটের হার ২৮.৭২ শতাংশ। চন্দননগরে ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন বামফ্রন্ট মনোনীত সিপিআই(এম) প্রার্থী। এখানে মোট ৩২টি ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়েছিল।
আসানসোল কর্পোরেশন ১০৬টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। এখানে বামফ্রন্ট দুটি আসনে জয়ী হয়েছে। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট এবং আইএসএফ একত্রে পেয়েছিল ৫.২৬ শতাংশ ভোট। এবার বামফ্রন্ট পেয়েছে ১১.২৭ শতাংশ ভোট। বিজেপি’র ভোট বিধানসভার ৪৪.৫ শতাংশের তুলনায় নেমে এসেছে ১৭.০৫ শতাংশে।
যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা পৌর সংস্থার ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসকদলের অগণতান্ত্রিক আচরণের দু’টি ধাপ ফুটে উঠেছে বিগত এক দশক ধরেই। প্রথম ধাপ হলো এগুলির মেয়াদ শেষ হলেও নির্বাচন এড়াতে প্রশাসক বসিয়ে মানুষের রায়কে অগ্রাহ্য করা, যা সামগ্রিকভাবে গণতান্ত্রিক পথে জনরায় গ্রহণের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন। যা এতদিন চলছিল ৪ পৌর নিগম সহ রাজ্যের ১০৮টি পৌরসভায়। আর দ্বিতীয় পদক্ষেপ হলো, জনমতের চাপে এবং আদালতের নির্দেশে বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসের মধ্য দিয়ে এগুলি দখল করা। বলা হচ্ছে, এই সংস্থাগুলি কার্যত তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় এটিএম, যেখান থেকে অবাধে টাকা সরানো যায়! তাই জনগণের টাকা দেদার হাতানোর এই মওকা তৃণমূলের নিচুতলার বা পাড়াস্তরের নেতারা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না। কারণ তাদের তো উপরতলার নেতাদের মতো সারদা-নারদা-গোরু-কয়লা পাচারের বখরার টাকা পাবার এলেম নেই। তাই সোশ্যাল মিডিয়ায় মনোনয়ন না পাওয়ায় তৃণমূলীদের ঝগড়া-কাজিয়া আর কাজ করে বা খেটে সংসার চালানোর কষ্ট করতে নারাজ হয়ে কান্নাকাটি করার বহু ভিডিয়ো দেখা যাচ্ছে, সামনে আসছে। তাই বিনা নির্বাচনে একের পর এক পুরসভা দখল। তাই পুরভোটে মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রাণিত ভাই-ভাইপোদের এই অস্ত্র হাতে দাপাদাপি। তাই দ্বিজেন মুখোপাধ্যায়ের মতো মৃত ভোটাররা দলে দলে ভোট দিয়ে গেলেন! তৃণমূলের তরফে বার্তাটা স্পষ্ট, জনতার রায় তাদের পক্ষে যাবেনা, তাই মানুষের বোধ এবং বিবেচনায় অনাস্থা, অনাস্থা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।
এই পরিস্থিতিতে বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী ২৭ ফেব্রুয়ারি রাজ্যে যে পৌরসভাগুলোতে নির্বাচন হবে সেখানে আমরা সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করব।