৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
‘আওয়াজ’-এর উদ্যোগে প্রয়াত শিল্পী ওয়াসিম কাপুরকে বিনম্র শ্রদ্ধা
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ প্রয়াত বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুরকে স্মরণসভার মধ্যদিয়ে শ্রদ্ধা জানালো সামাজিক সংগঠন, ‘আওয়াজ’। ১৫ ফ্রেব্রুয়ারি কলকাতার ইরান সোসাইটিতে এই স্মরণসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রসঙ্গত, চিত্রশিল্পী ওয়াসিম কাপুর ছিলেন এই সংগঠনের সভাপতি। এদিন কথায়, কবিতায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানান বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এদিনের সভায় কলকাতা ও সংলগ্ন বিভিন্ন জেলা থেকে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। স্মরণসভার সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের সহসভাপতি বদরুদ্দোজা খান। সভার সূচনায় প্রয়াত শিল্পীর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান করে শ্রদ্ধা জানানো হয়। শোকপ্রস্তাব পাঠ করেন সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সেখ সাইদুল হক।
সভায় প্রয়াত শিল্পীর স্মৃতিচারণ করেন তাঁর দীর্ঘদিনের বন্ধু-চিত্রশিল্পী, আর্ট কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ দীপালি ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, একটা ভয়ঙ্কর বিড়ম্বিত সময়ে ওয়াসিম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। তাঁর এই চলে যাওয়া আমাদের জন্য বিরাট ক্ষতি। এখন এরাজ্যের শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই প্রকাশ্যে মুখ দেখাতে চান না। তাঁরা শাসকদলের রোষানলে পড়ার ভয়ে যেন আত্মগোপন করে আছেন। দেউচা-পাঁচামিতে খনি নির্মাণ করতে গরিব মানুষকে জমি থেকে উচ্ছেদ করতে চাইছে রাজ্য সরকার। এনিয়ে শিল্পী-বুদ্ধিজীবীরা অনেকেই নীরব।
তিনি ওয়াসিম কাপুরের শিল্প সৃষ্টিতে অসামান্য নৈপুণ্যের কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা যখন আর্ট কলেজে ছিলাম, তখন মকবুল ফিদা হুসেইনের উদ্যোগে ইয়ং আস্টির্টদের নিয়ে একটি চিত্র প্রদর্শনী হয়েছিল। তাতে ওয়াসিমের সঙ্গে আমিও সুযোগ পেয়েছিলাম। ওয়াসিম অসামান্য দক্ষতায় পোট্টের্ট এঁকেছেন। বর্তমানে বোরখা নিয়ে দেশজুড়ে হইচই হচ্ছে। ওয়াসিম অনেক আগেই বোরখা নিয়ে সিরিজ করেছিলেন। তিনি মুসলিম মহিলাদের বোরখা পরাকে সমর্থন করতেন না। বোরখা সিরিজের মধ্যে দিয়ে তিনি মহিলাদের সামাজিক বঞ্চনা, যন্ত্রণার ছবিই ফুটিয়ে তুলেছিলেন। তিনি শিশু বয়সে পায়ে আঘাত পেয়ে দীর্ঘদিন শয্যাশায়ী ছিলেন। তখন জানলা দিয়ে বাইরের জগৎ দেখেছেন। সেই গভীর পর্যবেক্ষণ থেকেই তিনি একেঁছিলেন রিকশাওয়ালা সিরিজ। ওয়াসিম কাপুর বামপন্থী চেতনা নিয়ে মেরুদণ্ড সোজা করে ছিলেন। শত প্রলোভন ও দুর্বিপাকেও বিকিয়ে যাননি। এই চেতনা থেকেই রাজ্য সরকারের পুরস্কার গ্রহণ করেননি তিনি।
রাজ্য প্রতিবন্ধী সম্মিলনীর সভাপতি কান্তি গাঙ্গুলি তাঁর স্মৃতি চারণায় বলেন, ষাটের দশকে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সময়ে ওয়াসিমের বাবা সালেখ লক্ষ্ণৌভি’র স্নেহসান্নিধ্যে এসেছিলাম। সেই সূত্রে শিল্পী ওয়াসিমের পরিবারের সঙ্গে তিন দশকের বেশি সময় ধরে পরিচয়। তারপর রাজ্য প্রতিবন্ধী সন্মিলনীর সূত্রে ঘনিষ্ঠতা প্রগাঢ় হয়েছে। আমার দেখা শিল্পী ওয়াসিম একজন বিরল, নির্লোভ, শিল্পচর্চায় নিমগ্ন মানুষ। তিনি মানসিক দৃঢ়তায় প্রতিবন্ধকতাকে জয় করেছিলেন। যেমন করেছিলেন সাঁতারবিদ মাসুদুর রহমান বৈদ্য। এত বড়ো মাপের শিল্পীকে হারিয়ে আমাদের বিরাট ক্ষতি হয়ে গেল। বামপন্থার প্রতি গভীর বিশ্বাস ছিল তাঁর। সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে প্রতিবন্ধী ছেলেমেয়েদের ওয়াসিম কাপুরের নামে পুরস্কার দেবার কথা ঘোষণা করেন তিনি।
চিকিৎসক ও সমাজকর্মী ফুয়াদ হালিম বলেন, শিল্পী ওয়াসিম কাপুরের বাবা সালেখ লক্ষ্ণৌভি আমার বাবার (হাসিম আব্দুল হালিম) সঙ্গে কাজ করেছেন। তাঁরা ছিলেন আমাদের পরিবারেরই অংশ। ওয়াসিম কাপুরের আঁকা অনেক তৈলচিত্র ইরান সোসাইটিতে রয়েছে। আমাদের দুই পরিবার অনেক সংগ্রামের সাথি হিসেবে দীর্ঘ সময় পেরিয়েছি, আগামী দিনেও পেরবো।
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, শিল্পী ওয়াসিম কাপুর ছিলেন আমাদের সংগঠনের রাজ্য কমিটির উপদেষ্টা। তাঁর মতো শিল্পীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে সময় লাগত না, আবার তিনি নিজে থেকেও ঘনিষ্ঠ হতেন। তিনি যেমন আমার কবিতা শুনে ছবি এঁকেছেন, তেমনি বিভিন্ন প্রদর্শনীতে তিনি তাঁর ছবির মধ্য দিয়ে বিকল্প সময়ের কথা তুলে ধরেছেন। তিনি বঞ্চিত ও ভাঙাচোরা জীবনের ছবি এঁকেছেন। জ্যোতি বসু’র জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে আকাদেমিতে চিত্র প্রদর্শনী করার ক্ষেত্রে ওয়াসিম কাপুর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পরিশেষে তিনি ওয়াসিম কাপুর স্মরণে শঙ্খ ঘোষ রচিত ‘অভাবনীয়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেন।
সারা ভারত শান্তি ও সংহতি সংস্থার রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক অঞ্জন বেরা এদিনের স্মরণসভায় বলেন, তিনি ছিলেন আমাদের সংগঠনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। আমাদের সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হলো একজন শিল্পী চলে গেলেন। ওয়াসিম কাপুরের আঁকা ছবিগুলো দেখলে মানুষটাকে বোঝা যাবে। আদ্যন্ত শিল্পী এই মানুষটির সঙ্গে কথা বললে বিশেষ অনুভূতি হতো। শিল্প সৃষ্টির পাশাপাশি তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতাও ছিল। সীমিত ভাবনায় তাঁকে বেঁধে রাখা যাবে না। আমাদের সংস্কৃতির যে উচ্চ ধারণা রয়েছে তার প্রতিনিধিত্ব করতেন তিনি। বাম আমলে মাদ্রাসা ছাত্রদের আঁকা ছবির প্রদর্শনী তিনি উদ্বোধন করতে এসেছিলেন। জ্যোতি বসু’র জন্মশতবর্ষের চিত্র প্রদর্শনীতে ছবি দিয়ে এবং নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেন, আজ দেশে অসহিষ্ণুতা বাড়ছে, বহুত্ববাদ আক্রান্ত হচ্ছে, ধর্ম-জাতপাতের নামে বিভাজন বাড়ছে। দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সব কিছু নস্যাৎ করা হচ্ছে। এমনই একটা সময়ে তাঁর মতো সৃজনশীল মানুষদের প্রয়োজন ছিল অনেক।
জনবাদী লেখক সংঘের রাজ্য সম্পাদক অধ্যাপক রাম আহ্লাদ চৌধুরী শিল্পী ওয়াসিম কাপুরের পারিবারিক ঐতিহ্য, তাঁর বাবা কবি সালেখ লক্ষ্ণৌভি’র কমিউনিস্ট পার্টি ও প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ততা - ইত্যাদির উল্লেখ করে বলেন, ওয়াসিম কাপুরের মতো শিল্পী একদিনে তৈরি হয়নি। দেশ-সমাজ-পৃথিবীর নানা উত্থানপতন, ঘটনাবলির দিকে সজাগ দৃষ্টি ছিল তাঁর। আজ গোটা বিশ্ব গরিব-বড়োলোক দু’টো ভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। এক্ষেত্রে ওয়াসিমের স্পষ্ট অবস্থান ছিল। তিনি আজীবন মানুষের জন্যই শিল্প সৃষ্টি করে গেছেন।
সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক সাইদুল হক বলেন, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যখন আমাদের সংগঠন গড়ার প্রস্তুতি চলছিল, তখন একবাক্যে সবাই সভাপতি হিসেবে ওয়াসিম কাপুরের নামই প্রস্তাব করেছিলেন। তাঁর মতো একজন শিল্পী আমাদের সংগঠনের সভাপতি হওয়ায় আমরা গর্বিত। তিনি ছিলেন একজন আপসহীন যোদ্ধা। তাঁর শিল্পকলার মধ্য দিয়েই তিনি বেঁচে থাকবেন।
সভার সভাপতি এবং সংগঠনের সহ-সভাপতি বদরুদ্দোজা খান বলেন, তিনি আমাদের সংগঠনের নেতৃত্বে ছিলেন। এজন্য আমরা গর্ববোধ করি। তিনি আমাদের মধ্যে নেই, কিন্তু তাঁর শিল্প সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে থাকবেন।
এদিনের সভায় কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে শিল্পীকে শ্রদ্ধা জানান সেলিনা খাতুন, রাম প্রহ্লাদ চৌধুরী, তড়িৎ আঢ্য। এছাড়া অন্যান্যদের মধ্যে স্মৃতিচারণা করেন শিল্পীর ভাইঝি হেনা কাপুর, ইরশাদ গহর, নওসাদ মোমিন, নুরুল ইসলাম, রশিদা খাতুন প্রমুখ। এদিনের সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রয়াত শিল্পীর কনিষ্ঠ ভাই সেলিম কাপুর।