৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
প্রয়াত কমরেড সলিল ভট্টাচার্য
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রবীণ সিপিআই(এম) নেতা, বিশিষ্ট কবি, প্রাবন্ধিক, অবিভক্ত বর্ধমান জেলার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব কমরেড সলিল ভট্টাচার্যের জীবনাবসান হয়েছে। ৭ই ফেব্রুয়ারি, সোমবার রাতে বর্ধমানের একটি বেসরকারি নার্সিংহোমে তিনি প্রয়াত হয়েছেন। বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর।
কমরেড সলিল ভট্টাচার্যের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু। তিনি এদিন বলেন, ‘‘কমরেড সলিল ভট্টাচার্যের সঙ্গে ছাত্র-যুব আন্দোলনের সময় থেকেই আলাপ ছিল। পরে তিনি অধ্যাপক আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং পরিবারের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানাচ্ছি।’’
শোক জানিয়েছে সিপিআই(এম) পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটি। প্রয়াত কমরেড সলিল ভট্টাচার্যের মরদেহ পরদিন সকালে পার্টির জেলা দপ্তরে নিয়ে আসা হলে সেখানে তাঁর দেহে রক্তপতাকা দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন পার্টির প্রবীণ নেতা মদন ঘোষ, অরিন্দম কোঙার, জেলা সম্পাদক সৈয়দ হোসেন প্রমুখ। এরপর মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তাঁরা ছাড়াও আভাস রায়চৌধুরি, অমল হালদার, অরিন্দম কোঙার, অচিন্ত্য মল্লিক, তাপস সরকার, সমর ঘোষ, অপূর্ব চ্যাটার্জি প্রমুখ নেতৃবৃন্দ। এছাড়াও মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান প্রবীণ পার্টিনেতা জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য, গৌরি ব্যানার্জি, অধিক্রম স্যানাল, স্বপ্না সেন, কমরেড সলিল ভট্টাচার্যের স্ত্রী উষা ভট্টাচার্য, তাঁর কন্যা, পুত্র, জামাতা। অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দও প্রয়াত সলিল ভট্টাচার্যের মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন।
কমরেড সলিল ভট্টাচার্য ১৯৬০ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। তিনি ১৯৬৪ সালে বিপিএসএফ’র জেলা সভাপতি ও রাজ্য সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি অবিভক্ত বর্ধমান জেলার ডিওয়াইএফআই’র প্রথম সম্পাদক নির্বাচিত হন ১৯৬৯ সালে। সেই সময়ে তিনি সংগঠনের রাজ্য সহ-সভাপতিও নির্বাচিত হন। প্রয়াত কমরেডের স্মৃতিচারণা করে মদন ঘোষ বলেন, ত্রিবেণী কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয়ে কমরেড সলিল ভট্টাচার্য বর্ধমানে আসেন। বর্ধমানে আসার পর পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ হয়। বাংলায় এমএ-তে ভর্তি হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদকের পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য তাঁকে মনোনীত করা হয় ছাত্র ফেডারেশনের পক্ষ থেকে। বাংলা সাহিত্যের উপর তাঁর দখল ছিল অসাধারণ। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের প্রচারে তাঁর অসাধারণ বক্তৃতা সাধারণ ছাত্রসমাজকে উদ্দীপ্ত করে। তিনি বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হন। তিনি সেই সময়ে ছাত্রনেতা হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং বিপিএসএফ’র রাজ্য কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ছাত্র আন্দোলনের পরে তিনি যুব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ছাত্র-যুব আন্দোলনে অংশ নিয়ে কারাগারেও থেকেছেন।
কমরেড সলিল ভট্টাচার্য ১৯৬৮ সালে ডিওয়াইএফআই’র অবিভক্ত বর্ধমান জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে অল্প কিছুদিন সিএমএস হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তিনি অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত হয়ে প্রথমে বেঙ্গাই কলেজ, পরে চন্দননগর, শ্রীরামপুর মিশনারি কলেজ, সেখান থেকে খান্দরা কলেজে অধ্যক্ষ হন। পরে বর্ধমান শহরের বিবেকানন্দ কলেজে অধ্যাপনা করেন। বর্ধমান শহরের বিভিন্ন সেমিনার ও সভায় তাঁর বক্তব্য ছিল আকর্ষণীয়। তিনি ভালো গান গাইতে পারতেন, তাঁর লেখার দক্ষতাও ছিল অসাধারণ। শুধু সাহিত্য সম্পর্কে লেখা নয়, কবিতা লেখাতেও তিনি ছিলেন দক্ষ। তিনি বেশ কয়েকটি ভাষায় আন্তর্জাতিক সঙ্গীত গাইতে পারতেন। গণশক্তি, নন্দন, নতুন চিঠি সহ একাধিক পত্রিকায় তাঁর লেখা কবিতা ও রচনা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি একাধিক কবিতার বই রচনা করেছেন। তিনি ১৯৮৮ সালে হুগলি জেলা পরিষদের সদস্য ও শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ নির্বাচিত হয়েছিলেন। শেষের ২-৩ বছর কমরেড সলিল ভট্টাচার্য অসুস্থতার মধ্যে কাটিয়েছেন। প্রথমে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতাল, পরে বর্ধমানে গত সাত দিন ভরতি ছিলেন একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে। সেখানেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘের অবিভক্ত জেলা কমিটির সভাপতি ছিলেন তিনি। রাজ্য কমিটির কার্যকরী কমিটির সদস্যও ছিলেন। বর্ধমান জেলা এবং জেলার বাইরেও বহু জায়গায় তিনি নানা আলোচনাসভায় বক্তা হিসাবে উপস্থিত থেকেছেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এই অভিভাবকের প্রতি পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সঙ্ঘ গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে। এদিন তাঁর দেহ চিকিৎসাশাস্ত্রে গবেষণার জন্য বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের হাতে তুলে দেওয়া হয়।