৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
চলে গেলেন প্রবাদপ্রতিম সঙ্গীতশিল্পী গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়
বিশেষ প্রতিবেদনঃ সাত দশক ধরে গান শোনাবার লগ্ন এবার শেষ হয়ে গেল। দীর্ঘ অসুস্থতার শেষে ১৫ ফেব্রুয়ারি জীবনাবসান হলো প্রবাদপ্রতিম সংগীত শিল্পী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। তাঁর প্রয়াণে শ্রোতাদের সামনে পথ শেষ না হওয়ার সুরেলা অনিশ্চয়তার বিস্ময় থমকে গিয়ে ঠাই নিল ইতিহাসের বাঁকে। গত ২৬ জানুয়ারি হঠাৎ জ্বরে অসুস্থ বোধ করায় শিল্পীকে লেক গার্ডেন্সের বাড়ি থেকে এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে উডবার্ন ওয়ার্ডে ভরতি করা হয় তাঁকে। জানা যায় কোভিডেও আক্রান্ত হয়েছিলেন তিনি। তাঁর ফুসফুসে সংক্রমণ ধরা পড়লে এবং হৃদযন্ত্রে সমস্যা দেখা দেওয়ায় পরে তাঁকে অ্যাপোলো হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় হৃদযন্ত্র বিকল হয়ে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর বয়স হয়েছিল ৯০। তাঁর স্বামী বিশিষ্ট গীতিকার শ্যামল গুপ্ত আগেই প্রয়াত হয়েছেন। রয়েছেন তাঁর কন্যা ও জামাতা।
তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। গভীর শোক জানিয়েছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু এবং সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র। ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর মরদেহ সাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রবীন্দ্রসদনে রাখা হয়। রবীন্দ্র সদনে তাঁর মরদেহে বামফ্রন্টের পক্ষে শ্রদ্ধা জানান বিমান বসু, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, সুজন চক্রবর্তী এবং রমলা চক্রবর্তী। পরে বিকেলে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়।
কলকাতার ঢাকুরিয়ায় ১৯৩১ সালের ৪ অক্টোবর জন্ম সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের। মা হেমপ্রভা মুখোপাধ্যায়, বাবা নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। ছোটবেলায় প্রথম দিকে বাবা মায়ের কাছেই তাঁর গান শেখা শুরু। গানের প্রতি টান রয়েছে তা বুঝতে পেরে তাঁকে এরপর পাঠানো হয় সঙ্গীতাচার্য যামিনী গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে মার্গসংগীতের তালিম নিতে।
শাস্ত্রীয় সংগীতের চর্চায় তখন থেকেই নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সন্তোষ কুমার বসু, এটি কানন, চিন্ময় লাহিড়ী প্রমুখের কাছে। ১৯৪৬ সালে প্রথম হন গীতশ্রী পরীক্ষায়। বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স, অল ইন্ডিয়া মিউজিক কনফারেন্সে অংশগ্রহণ ও সাফল্য আসে তারপর। পরীক্ষক ছিলেন ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, মহম্মদ দবীর খাঁ, রথীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ। এরপর তাঁর দাদা তাঁকে সঙ্গীত গুরু জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের কাছে নিয়ে যান। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ তাঁকে বড়ে গোলাম আলি খাঁয়ের কাছে প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গুরু বড়ে গোলাম আলি খাঁ তাঁকে গান শেখানোর সময় বলেছিলেন, গান শেখার চেয়ে শুনলেই বেশি লাভ। একভাগ শিখনা তো তিন ভাগ শুননা।আজীবন গুরুর শিক্ষা মেনে চলেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
১৯৫০ সালে তিনি মুম্বাই যান নেপথ্য শিল্পী হিসেবে গান গাইতে। সেখানে তার থাকার ব্যবস্থা করে দেন শচীন দেব বর্মণ। হিন্দি ছবিতে প্রথম প্লেব্যাক-এর সুযোগ এসেছিল তাঁর কাছে সুরকার অনিল বিশ্বাসের মাধ্যমে। তার সুরে তারানা ছবির জন্য গেয়েছেন সন্ধ্যা। এই ছবিতে তাঁর সঙ্গে যুগ্মভাবে একটি গান গেয়েছিলেন লতা মঙ্গেশকর। দুই প্রবাদপ্রতিমের সখ্যতার শুরুও সেখান থেকেই। ১৯৫২ সালে তিনি কলকাতায় ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেন। যদিও এর মধ্যেই তাঁর গাওয়া হয়ে গিয়েছে ১৭টি হিন্দি ছবিতে গান। প্রসঙ্গত, একবার তিনি মন্তব্য করেছিলেন ভালোবেসে গান করা ও অর্থ উপার্জনের মধ্যে ফারাক অনেক।
১৯৬৬ সালে গীতিকার শ্যামল গুপ্তর সঙ্গে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন তিনি। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনে নানা ধরনের গান গেয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথ এবং রবীন্দ্র সমসাময়িকদের কাব্যগীতি রেকর্ড করেছেন। তাঁর গলায় বিভিন্ন উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে শ্রোতারা যেমন খেয়াল ধ্রুপদ শুনেছেন তেমনি বিচিত্রানুষ্ঠানে শুনেছেন বাংলা আধুনিক সহ সিনেমার গান। মুম্বাই কলকাতা মিলিয়ে বহু সুরকারের সুরে তিনি গান গেয়েছেন। শচীনদেব বর্মণ, অনিল বাগচী, মদনমোহন, সলিল চৌধুরী, অনুপম ঘটক, নচিকেতা ঘোষ, রবীন চট্টোপাধ্যায়, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুধীন দাশগুপ্ত - তালিকা শেষ হবে না। চলচ্চিত্র সংগীতে উত্তম-সুচিত্রা জুটির জন্য গান গাইতে গিয়ে ইতিহাস তৈরি হয়েছিল হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর নেপথ্য শিল্পী হিসেবে গায়নের রসায়নে, যা আজ পর্যন্ত মিথ হিসেবে অটুট।
তাঁর একান্ত অনুরাগীরা গর্বের সঙ্গে বলেন লতা মঙ্গেশকরের আগেই তিনি নেপথ্য শিল্পী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। ১৯৬৮ সালে শুরু হওয়া নেপথ্য সঙ্গীত শিল্পীদের জাতীয় পুরস্কার ১৯৭১ সালেই সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে পেয়ে গেছেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। হলিউডের সাউন্ড অব মিউজিক ছবির অনুপ্রেরণায় তৈরি জয়জয়ন্তী ছবির ‘আমাদের ছুটি ছুটি’ এবং উত্তম কুমার সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় অভিনীত নিশিপদ্ম ছবির ‘সকল সোনা মলিন হলো’ এই দুটি গানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের অসংখ্য গানের মধ্যে বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে শ্রাবন্তী মজুমদারের সঙ্গে মা মেয়ের ভূমিকায় তুমি আমার মা আমি তোমার মেয়ে গানটি। এই গানটিতে গীতিকার পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায় সুরারোপ করেছিলেন পরিমল দাশগুপ্ত। কন্যা সন্তানের জন্ম সাধারণ ভারতীয় পরিবারে যে চিত্র তৈরি করে সেই সংস্কার উত্তরণের কথা বলা ছিল এই গানটিতে। এই উপমহাদেশে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই গানটিতে এখনো যে কতটা আলোড়িত তার চিহ্ন বহন করছে সোশ্যাল মিডিয়া।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াতে গানকেই মাধ্যম করে তোলেন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের সেই স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর সাংগীতিক অবদানের কথা স্মরণ করেছেন সশ্রদ্ধ চিত্তে।
সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সভাপতি হিরণ্ময় ঘোষাল ও সম্পাদক দিব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। শোক প্রকাশ করেছেন পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পী সংঘের রাজ্য সভাপতি অধ্যাপক পবিত্র সরকার, রাজ্য সম্পাদক রজত বন্দ্যোপাধ্যায়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গ আদিবাসী ও লোক শিল্পী সংঘের রাজ্য সম্পাদক শঙ্কর মুখোপাধ্যায় প্রয়াত সঙ্গীত শিল্পীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখ্য, গত জানুয়ারি মাসেই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম পদ্মশ্রী সম্মানের জন্য মনোনীত করার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত তুমুল বিতর্ক তৈরি করে। প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে প্রত্যাখান করেন কিংবদন্তী শিল্পী। একইসঙ্গে বিতর্ক আরও জোরালো হয়, যখন নবতিপর শিল্পী তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘‘বাংলার শ্রোতারা বুঝতে পারবেন কোন যন্ত্রণা থেকে পদ্মশ্রী ফিরিয়ে দিয়েছি।’’