৫৯ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ৫ ফাল্গুন, ১৪২৮
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস - একুশে ফেব্রুয়ারি
আবুবকর সেখ
একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সহ সমস্ত বাংলা ভাষা ব্যবহারকারী জনগণের নিকট একটি গৌরবোজ্জ্বল দিন। এই দিনটি শহিদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবেও সুপরিচিত। বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতিবিজড়িত একটি দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি (৮ ফাল্গুন, ১৩৫৮ সাল, বৃহস্পতিবার) বাংলাকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণে বেশ কয়েকজন ছাত্র শহিদ হন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন আব্দুল বরকত, আব্দুল জব্বার, আব্দুস সালাম, রফিকউদ্দিন আহমদ ও শফিউর রহমান। এই পঞ্চ শহিদকে বাংলাদেশ সরকার ভাষা আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় শহিদের স্বীকৃতি ও মর্যাদা দিয়েছে। এছাড়াও আরও দুইজন - অহিউল্লাহ ও আব্দুল আউয়াল ২২ ফেব্রুয়ারি নিহত হন। আহতের সংখ্যাও ছিল বেশ কয়েকজন।
প্রেক্ষাপট
১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ পাকিস্তান অধিরাজ্যের অংশ হয়ে যায়। পাকিস্তানের সরকার, প্রশাসন, সামরিক বাহিনীতে পাকিস্তানের পশ্চিম প্রান্তের আধিপত্য দেখা দেয়। করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে শুধুমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং স্কুল ও মিডিয়াতে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব প্রান্তের জনগণ এর প্রতিবাদ শুরু করেন। ঢাকায় ছাত্ররা তমদ্দুন মজলিসের প্রতিষ্ঠাতা আব্দুল কাসেমের নেতৃত্বে মিছিল বের করেন। পরে একটি বৈঠকে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি সরকারি ভাষা এবং পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম করার দাবি উত্থাপনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। তা সত্ত্বেও পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে দেয় এবং একইসাথে মুদ্রার নোট ও স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে দেওয়া হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্ৰহণ করেন। ফলে বাংলা ভাষাভাষী জনগণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে একটি সরকারি ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জমায়েতে অংশ নেয় ও একটি মিছিল বের করেন। এই সময় থেকে ধারাবাহিকভাবে ভাষার দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে।
১৯৫২ সালের হিসেব অনুযায়ী পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালি, যারা মোট নাগরিকদের ৫৪ শতাংশ।
উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণা করার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। তখন সকাল ঠিক ৯টা। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে সমবেত হতে শুরু করেন। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ক্যাম্পাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এবং অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। সোয়া এগারোটার সময় ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে সমবেত হয়ে সশস্ত্র পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙার চেষ্টা করেন। ছাত্রদের একটি দল ঢাকা মেডিকেল কলেজের দিকে দৌড়ে এগিয়ে যায়। বাকিরা পুলিশ পরিবেষ্টিত ক্যাম্পাসে মিছিল করতে থাকেন। উপাচার্য সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীকে গুলি না চালানোর জন্য অনুরোধ করেন এবং ছাত্রদের ক্যাম্পাস ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। উপাচার্যের নির্দেশ মেনে ছাত্ররা চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময়ে ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে পুলিশ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে গ্রেপ্তার করেন। গ্ৰেপ্তারের সংবাদ ছড়িয়ে পড়তেই বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে এবং তাদের প্রস্তাব উত্থাপনের দাবি জানায়। এরইমধ্যে ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিংয়ের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টা করলে পুলিশ গুলি চালায়। সেই গুলি চালনায় নিহত হয়েছিলেন পূর্ব উল্লেখিত ছাত্ররা। তাই তখন থেকেই ২১ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন দিবস বা রাষ্ট্রভাষা দিবস বা শহিদ ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, পৃথিবীতে মানুষ স্বাধীনতার জন্য, বন্দি মুক্তির জন্য, অত্যাচারের বিরুদ্ধে, রাজনৈতিক ও সামাজিক শোষণের বিরুদ্ধে, খাদ্যের দাবিতে, ন্যায়বিচারের জন্য, জনবিরোধী আইন প্রণয়নের বিরুদ্ধে,অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বিরুদ্ধে আন্দোলন,কলকারখানার অবৈধ লকআউটের বিরুদ্ধে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের দাবিতে আন্দোলরত জনতার উপর শাসকশ্রেণির পুলিশ গুলি চালিয়ে অগণিত মানুষকে হত্যা করেছেন। কিন্তু ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথম।
বাংলাদেশের পর আমাদের দেশে অসম রাজ্যে বাংলা ভাষা নিয়ে আন্দোলনে দ্বিতীয় শহিদ হওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৯৬১ সালের ১৯ মে অসম রাজ্যে অসমীয়া ভাষাকে বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকার শিলচর শহরে আন্দোলনরত ১১ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হন। তাই অসম ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বাঙালিরা শিলচর রেলস্টেশনে নিহত ১১ জনের স্মৃতির স্মরণে ১৯ মে ভাষা আন্দোলন দিবস হিসেবে পালন করে থাকে।
এ উপলক্ষে একুশের গান
একুশে ফেব্রুয়ারি, যেদিন সশস্ত্র পুলিশের গুলিতে ছাত্ররা হতাহত হন সেসময় ঢাকা কলেজের ছাত্র আব্দুল গাফফার চৌধুরী (যিনি বিখ্যাত কলামিস্ট হিসেবে এখন পরিচিত। বেশ কিছু নতুন পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। এখনো বাংলাদেশের প্রধান পত্রিকাগুলোতে নিয়মিত লেখেন। সমসাময়িক ঘটনা ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি নিয়ে তাঁর লেখা অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রবাসী বাংলাদেশী হিসেবে বর্তমানে লন্ডনে বসবাস করেন) ঢাকা মেডিকেল কলেজে যান আক্রান্ত ছাত্রদের দেখতে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের আউটডোরে তিনি মাথার খুলি উড়ে যাওয়া একটি লাশ দেখতে পান, যেটি ছিল ভাষা আন্দোলনকারী রফিক উদ্দিন আহমদের লাশ। লাশটি দেখে তাঁর মনে হয়, এ যেন তাঁর নিজের ভাইয়েরই রক্তমাখা লাশ। তৎক্ষণাৎ তাঁর মনে গানের প্রথম দুটি লাইন জেগে ওঠেঃ ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি’’। পরবর্তীতে ধীরে ধীরে তিনি গানটি লেখেন -
‘‘ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া-এ ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি/ আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি।...’’
ভাষা আন্দোলনের প্রথম প্রকাশিত লিফলেটে গানটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। ১৯৫৩ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে সংকলনেও’ গানটি প্রকাশিত হয়। প্রথমে আব্দুল লতিফ গানটিতে সুরারোপ করেন। পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের এক বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বিখ্যাত সুরকার আলতাফ মাহমুদ ১৯৫৪ সালে গানটিতে আবার সুরারোপ করেন। এই সুরটিই জনতার মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন থেকেই এই সুরটিই স্বীকৃত সুর হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
শহিদ দিবস পালন
১৯৫২ সাল থেকে প্রতি বছর দিনটি জাতীয় শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় একুশে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাদিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও অন্যান্যরা এবং সর্বস্তরের জনগণ দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রীয় শহিদ মিনারে এসে ভাষা শহিদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ঠিক সেই সময় ‘‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কী ভুলিতে পারি’’ - গানের করুণ সুর ধ্বনিত হতে থাকে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। এদিন শহিদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে রেডিও, টেলিভিশন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলিও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। বাংলা একাডেমি ফেব্রুয়ারি মাস জুড়ে ঢাকায় একুশে বইমেলার আয়োজন করে। ভাষা শহিদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একুশে ফেব্রুয়ারি প্রভাত ফেরিতে এই গান গেয়ে সকলে শহিদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন। বিবিসি শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় এটি তৃতীয় স্থান অধিকার করেছে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটি বর্তমানে হিন্দি, মালয়, ইংরেজি, ফরাসি, সুইডিশ, জাপানি সহ ১২টি ভাষায় গাওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ
কানাডার ভ্যাঙ্কুভার শহরে বসবাসকারী দুই বাঙালি রফিকুল ইসলাম ও আব্দুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার জন্য ১৯৯৮ সালে জাতিসংঘের মহাসচিব কোফি আন্নানের নিকট একটি আবেদনপত্র পেশ করেন। সেসময় সেক্রেটারি জেনারেলের প্রধান তথ্য কর্মচারী হিসেবে কর্মরত হাসান ফেরদৌসের নজরে আবেদনপত্রটি আসে। তিনি ১৯৯৮ সালের ২০ জানুয়ারি রফিককে জাতিসংঘের অন্য কোনো সদস্য রাষ্ট্রের নিকট থেকে এধরনের একটি প্রস্তাব আনার কথা বলেন। সেকারণে রফিক ও আব্দুস সালাম ‘‘মাদার ল্যাংগুয়েজ লাভার্স অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’’ নামে একটি সংগঠন দাঁড় করান। এতে একজন ইংরেজভাষী, একজন জার্মানভাষী, একজন ক্যান্টোনিজভাষী, একজন কাচ্চিভাষী সদস্য ছিলেন। তাঁরা আবারো কোফি আন্নানকে ‘‘এ গ্ৰুপ অফ মাদার ল্যাংগুয়েজ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’’-এর পক্ষ থেকে আরেকটি আবেদনপত্র পেশ করেন এবং তার একটি কপি ইউএনও’র কানাডীয় দূত ডেভিড ফাউলারের নিকট প্রেরণ করেন।
১৯৯৯ সালে তাঁরা ইউনেস্কোর আনা মারিয়ার সঙ্গে দেখা করেন। আনা মারিয়া পরামর্শ দেন তাঁদের প্রস্তাবের পক্ষে ৫টি সদস্য দেশ - কানাডা, ভারত, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড ও বাংলাদেশ দ্বারা আনীত হতে হবে। তারপর বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন দানে ২৯টি দেশ অনুরোধ জানাতে কাজ করেন।
১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর প্যারিস অধিবেশনে এই প্রস্তাব উত্থাপন করা হয় এবং ১৮৮টি দেশ সমর্থন জানালে একুশে ফেব্রুয়ারিকে ‘‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি থেকে দিবসটি জাতিসংঘের সদস্য দেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে।
২০১০ সালের ২১ অক্টোবর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে - ‘‘এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ’’-এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে পাশ হয়।
বাংলাদেশে মাতৃভাষার প্রভাব
২০১৩ সালে বাংলাদেশের ঢাকা বাংলা একাডেমি থেকে ‘‘বিবর্তনমূলক বাংলা অভিধান’’ প্রকাশিত হয়। এই অভিধান সম্পর্কিত কার্যক্রমের উপর বাংলা একাডেমির সম্পাদক জনাব গোলাম মুরশিদ সাহেব একটি দীর্ঘ ভূমিকা লেখেন। তাতে তিনি উল্লেখ করে বলেনঃ ‘‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ও বাংলা ভাষার ওপর প্রভাব বিস্তার করে।... দেশ বিভাগের চব্বিশ বছরের মধ্যে জন্ম নেয় স্বাধীন বাংলাদেশ। ফলে, বাংলা ভাষা এই প্রথম একটা দেশের সরকারি ভাষায় পরিণত হলো। সেন আমল, পাঠান আমল, মোগল আমল, ইংরেজ আমল - এক হাজার বছরের মধ্যে - কোনো সময়েই বাংলা ভাষা বঙ্গদেশের সরকারি ভাষার মর্যাদা লাভ করেনি অথবা যথেষ্ট পরিমাণে সরকারি আনুকূল্যও পায়নি পাঠান এবং ইংরেজ আমলে সরকারি পৃষ্ঠপোষণায় কিছু অনুবাদ-কর্ম ছাড়া। ১৯৭১ সালের পর বাংলা ভাষার একটা সার্বভৌম স্বদেশ গঠিত হলো। সে দেশের লেখাপড়া এবং সরকারি কাজকর্ম সবই হতে আরম্ভ করল বাংলা ভাষায়। এর ফলে বাংলা ভাষার পালে রাতারাতি হাওয়া লাগল। শতাধিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হলো, হাজার হাজার বই প্রকাশিত হলো, লাখ লাখ নথি লেখা হলো বাংলায়, এবং বাংলা ভাষার উন্নতির জন্যে এমন সরকার পৃষ্ঠপোষণা পাওয়া গেলো, যা বাংলা ভাষার জন্মের পর থেকে কখনোই দেখা যায়নি।’’ (পৃষ্ঠা-১০)
সুতরাং উপরের উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় একটি জাতিগোষ্ঠীর সার্বিক বিকাশ এবং তার বেঁচে থাকার যাবতীয় উন্নয়নের ক্ষেত্রে ভাষার গুরুত্ব কতখানি।
ভাষার গুরুত্ব
মানুষমাত্রেরই ভাষা আছে। আর এই ভাষা তার মনুষ্যত্বের অভিজ্ঞান, ভাষা দিয়েই মানুষের সমস্ত যাপন, শিক্ষা, দীক্ষা, সংস্কৃতি-প্রবেশ, কর্ম, অগ্ৰগতি, সংগ্ৰাম। এই ভাষাতেই তার সুখ-দুঃখ-ভয়ের সংবাদ,এই ভাষাতেই তার বিপুল সৌন্দর্যময় এক প্রকাশ - যার নাম সাহিত্য। এই ভাষার সাহায্যেই সে নিজের আত্মরক্ষায় সক্ষম হন। অর্থাৎ ভাষা তার সবরকম মানবিক অস্তিত্বের সূত্র। কাজেই ভাষা যখন ব্যাহত, অপমানিত বা বিধ্বস্ত হয় তখন তার অস্তিত্বের শিকড় ধরে টান মারে।
সাহিত্যিক ও ভাষাবিদ পবিত্র সরকার এই ভাষা সংক্রান্ত বিষয়ে একটি লেখায় একটি পরিসংখ্যানের উল্লেখ করে বলেনঃ ‘‘১৯৯৯ সালেই লিঙ্গুইস্টিক সোসাইটি অব আমেরিকার মুখপাত্র ‘এথনোলগ’ দেখিয়েছিল যে, পৃথিবীতে ৫১টি ভাষার বক্তা বেঁচে আছে মাত্র একজন করে, ৫০০ ভাষার বক্তা ১০০ জনের কম, ১০০০ ভাষার বক্তা ১০০০-এর বেশি নয়, ৩০০০ ভাষার বক্তা দশ হাজারের কাছাকাছি, আর ৫০০০ ভাষার বক্তা এক লক্ষের মতো। ভাষার সংখ্যাই যেখানে সাত হাজারের মতো, সেখানে এই হিসাব রীতিমতো আতঙ্কজনক। ভাষাবিজ্ঞানীরা এও অনুমান করেছেন যে, মানুষ যখন প্রথম ভাষা ব্যবহার করতে শুরু করল (আজ থেকে আনুমানিক পঁয়ত্রিশ-চল্লিশ হাজার বছর আগে) তখন মানুষের ভাষার যে সংখ্যা ছিল আজ তার অর্ধেক টিকে আছে, আর এই একবিংশ শতাব্দীতে তারও অর্ধেক বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর জীব বা উদ্ভিদের বৈচিত্র্যের বিলোপের মতোই ভাষা বিলোপও মানবসভ্যতার এক চরম ক্ষতি। ভাষা বিলোপের সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায় একটা গোষ্ঠীর সমস্ত জ্ঞান, স্মৃতি, সাহিত্য, সংগীত। এ তথ্য বহুল প্রচারিত যে, ইংল্যান্ডের কর্নিশ ভাষার শেষ ব্যক্তি ডলি পেনট্রিথ মারা গেছেন ১৭৭৭ সালে, আর ২০১০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি খবর বের হলো, আন্দামানের ‘বো’ ভাষার শেষ ব্যাক্তিও চলে গেছেন। মনে রাখতে হবে, একজন বক্তা বেঁচে থাকলেও ভাষা বেঁচে থাকে না, ভাষার কথোপকথনের জন্যে দুইজনের দরকার হয়।’’
সুতরাং পরিশেষে একথা আমাদের উপলব্ধি করা প্রয়োজন যে, একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ সহ পৃথিবীর সমস্ত দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ উদযাপন করবেন শুধুমাত্র একটি শোক বা উৎসবের মেজাজে নয়, আমাদের প্রত্যেককে নিজের ভাষা সংক্রান্ত আত্মজিজ্ঞাসায় উন্মুখ হওয়া প্রয়োজন এই বোধ থেকেই দিনটি পালিত হওয়া প্রয়োজন, তাহলেই দিনটি পালনের সার্থকতা খুজে পাওয়া যাবে।