E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮

নাতাসা-দেবাঙ্গনা-আসিফ জামিনে মুক্ত

প্রতিবাদের অধিকারকে স্বীকৃতি দিল্লি হাইকোর্টের

সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির দাবি পলিট ব্যুরোর


জেল থেকে মুক্তির পর নাতাসা ও দেবঙ্গনা।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ নাতাসা নারওয়াল, দেবঙ্গনা কলিতা এবং আসিফ ইকবাল তানহা’র জামিন গত ১৫ জুন মঞ্জুর করে দিল্লি হাইকোর্ট। তাঁরা তিহার জেল থেকে মুক্তি পান ১৭ জুন সন্ধে সাতটায়। এই তিনজনের বিরুদ্ধেই অমিত শাহয়ের দিল্লি পুলিশ দানবীয় ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করেছিল। এই জামিন মঞ্জুর করতে গিয়ে বিচারপতি সিদ্ধার্থ মৃদুল এবং বিচারপতি অনুপ জয়রাম ভাম্বানি’র বেঞ্চ তাৎপর্যপূর্ণ কয়েকটি মন্তব্য করেছেন। তাঁরা বলেছেনঃ “দেশজোড়া প্রতিবাদ দেখে তা রোধ করতে উদ্বেগের মাথায় রাষ্ট্র এই পদক্ষেপ নিয়েছে। এতে সংবিধানে নাগরিকদের প্রতিবাদ করার যে অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে তার সঙ্গে সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের যে পার্থক্য রয়েছে সেটা কোথাও যেন অস্পষ্ট হয়ে গেছে। যদি এই জাতীয় মানসিকতা বাড়তে থাকে তবে তা’হবে গণতন্ত্রের পক্ষে খুবই দুঃখের দিন।”

দিল্লি হাইকোর্টের রায় সত্ত্বেও এই তিন ছাত্রছাত্রীর ঠিকানা ও জামিনদার সংক্রান্ত তথ্য খতিয়ে দেখে করকরডুমা আদালতের অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের কাছে রিপোর্ট জমা দিতে অযথা বিলম্ব করে দিল্লি পুলিশ। তারফলে জামিন মঞ্জুরের পর আরও ৪৮ ঘণ্টা জেলে থাকতে হয় এই তিনজনকে। শেষে ১৭ জুন সন্ধে সাতটায় তাঁরা তিহার জেল থেকে বাইরে আসেন। জেল থেকে বেরিয়ে এঁরা বলেনঃ ভয় দেখিয়ে, জেলে ঢুকিয়ে প্রতিবাদ বন্ধ করতে পারবে না।ঐক্যবদ্ধভাবে তারা সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে। এই তিনজনের সংশ্লিষ্ট তথ্য যাচাইয়ের জন্য আরও সময় চেয়েছিল দিল্লি পুলিশ। কিন্তু দায়রা আদালতের বিচারক রবীন্দ্র বেদী তাঁর নির্দেশে বলেনঃ “জামিনদারেরা সকলেই দিল্লির বাসিন্দা। আমার পর্যবেক্ষণ হলো,যাচাইয়ের প্রক্রিয়া গতকাল দপুর ১টার মধ্যে হয়ে যওয়া উচিত ছিল। তদন্তকারী অফিসার বলেছেন, অভিযুক্তদের স্থায়ী ঠিকানা যাচাই করতে সময় লাগবে। কিন্তু সেটা এই রিপোর্ট জমা না-পড়া পর্যন্ত তিনজনকে জেলে আটকে রাখার যক্তিগ্রাহ্য কারণ হতে পারে না।” এরপরই আদালত থেকে মুক্তির নির্দেশ জেলে পৌঁছায়। যদিও এই তিনজনের জামিনের বিরোধিতা করে দিল্লি পুলিশ সুপ্রিম কোর্টে গেছে।

প্রসঙ্গত, নাতাসা নারওয়ালকে দিল্লি দাঙ্গায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে অভিযুক্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করেছিল দিল্লি পুলিশ। নাতাসা নারওয়াল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি’র ছাত্রী এবং সমাজকর্মী। দেবঙ্গনা কলিতাও এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। এরাঁ দুজনেই ‘পিঞ্জরা তোড়’ সংগঠনের সদস্য। আসিফ ইকবাল তানহা জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। এই তিনজনই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। এঁরা প্রায় একবছর জেলে বন্দি। নাতাসা নারওয়ালের জমানত দিয়েছেন সিপিআই(এম)’র পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত। সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ১৫ জনের বিরুদ্ধে দিল্লির দাঙ্গায় ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে ইউএপিএ ধারায় মামলা দয়ের করেছিল দিল্লি পুলিশ। দিল্লি পুলিশ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আওতাধীন। তাই স্বাভাবিকভাবে দিল্লি হাইকোর্টের এই মন্তব্য যে সরাসরি অমিত শাহর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের উদ্দেশে তা পরিষ্কার।

দিল্লি হাইকোর্টের এই রায়কে স্বাগত জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো এবং এই রায় মেনে নিয়ে বিভিন্ন জেলে যেসব রাজনৈতিক বন্দি রয়েছেন তাঁদের সবার মুক্তির দাবি জানিয়েছে। এক বিবৃতিতে পলিট ব্যুরো বলেছেঃ আদালত এই রায়ের মধ্যে দিয়ে সরকারের সমনে আয়নাটা তুলে ধরেছে। এই রায় বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলায় বন্দিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেখানে দেখা গেছে, সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রতিবাদ করলে দেশবিরোধী বলে ছাপ মেরে দেওয়া হচ্ছে। সেই ব্যক্তিকে নানা দমন-পীড়নে সন্ত্রস্ত করা হচ্ছে।এরপরেই তাদের জেলে বন্দি করা হচ্ছে ইউএপিএ আইনে। তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মিথ্যা মামলা দায়ের করা হচ্ছে। সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেনঃ তিন রাজনৈতিক বন্দির মুক্তির ক্ষেত্রে দিল্লি হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছে তা দেশের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দির ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তাঁরা দেশের সংবিধানপ্রদত্ত প্রতিবাদের অধিকারের বলেই প্রতিবাদ সংগঠিত করেছেন। তাঁদের অন্যায়ভাবে জেলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। সীতারাম ইয়েচুরি সকল রাজনৈতিক বন্দি যাঁদের রাষ্ট্রদ্রোহ এবং ইউএপিএ ধারায় মিথ্যা মামলায় বন্দি করে রাখা হয়েছে তাঁদের সকলের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন।

নাতাসা নারওয়ালের বিরুদ্ধে দিল্লি পুলিশ যে অভিযোগগুলি এনেছিল তা খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্ট বলেছে, উত্তেজক বক্তৃতা, চাক্কাজ্যাম, মহিলাদের প্ররোচিত করার মতো যে প্রমাণ দেওয়া হয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে নাতাসা প্রতিবাদ সংগঠিত করছিলেন, হিংসা ছড়াচ্ছিলেন এমন অভিযোগ করা যাবে না। নাতাসার বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলায় অভিযোগ আনা হয়েছিল। সবকটিতেই তিনি জামিন পেয়েছেন। জেলে থাকাকালীন অবস্থায় তাঁর বাবা মারা গিয়েছিলেন। তখন তিনি কয়েকদিনের জন্য প্যারোলে মুক্তি পান।

আসিফ ইকবাল তানহার মামলায় হাইকোর্ট বলেছে, সন্ত্রাসবাদী কাজ একটি অস্পষ্ট শব্দ। তাই এর অর্থ ছোটো পরিসরেই দেখা প্রয়োজন। ইউএপিএ কেবলমাত্র ভারতকে রক্ষা করা সম্পর্কিত বিষয়েই ব্যবহার করা উচিত। যে কোনো সাধারণ ঘটনার ক্ষেত্রে এই আইন ব্যবহার করা যাবে না, যা সাধারণ আইনেই সমাধান করা যায়। ইউএপিএ আইন লাগু করার পেছনে এটা উদ্দেশ্য ছিল না যে, সাধারণ ও সাধারণ ধরনের অন্য অপরাধ তা যতই গুরুতর বা জঘন্য প্রকৃতির হোক, তাকে এই আইনের আওতা আনা হবে। এই ধরনের মামলা ভারতীয় দণ্ডবিধিতেই বিবেচনা করা যেতে পারে।

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি ব্যাপক সাম্প্রদায়িক প্রচার ও উসকানি চালিয়েছিল। তা সত্ত্বেও তাদের নির্বাচনে ভরাডুবি ঘটে। এরপর বিজেপি’র নেতা- মন্ত্রীদের প্রত্যক্ষ মদতে দিল্লিতে দাঙ্গা সংগঠিত হয়। যার পরিণতিতে ৫৩ জন নিহত হয় এবং আহত হয় কয়েকশত মানুষ। এদের সিংহভাগই ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। অসংখ্য বাড়িঘর, দোকানপাট লুট করা হয় এবং আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। এই সব অপরাধে অভিযুক্ত বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের একজনকেও পুলিশ গ্রেপ্তার করেনি। এর পরিবর্তে সিএএ-এনআরসি বিরোধী আন্দোলনকারীদের পুলিশ ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করে জেলে বন্দি করে।