E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮

ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় ত্রাণের হাহাকার, সরকারি সাহায্য অপ্রতুল

ক্ষয়ক্ষতির হিসেবে অদ্ভুত তথ্য রাজ্য সরকারের


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের পর কুড়ি দিনেরও বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও সুন্দরবন অঞ্চল সহ পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের দুর্দশার মাত্রা কমেনি। সুন্দরবন এলাকায় বহু জায়গাতেই এখনো জল দাঁড়িয়ে আছে। সর্বত্র ধ্বংসের চেহারা। ত্রাণ সাহায্যের জন্য মানুষ হাহাকার করছেন। ঘরবাড়ি ভেঙে যাওয়ায় বহু মানুষ অসহায়, আশ্রয়হীনভাবে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। এদিকে জমিতে লোনাজল ঢুকে যেমন চাষের ব্যাপক ক্ষতি করেছে, তেমনি আগামী দিনে সেই সমস্ত জমিতে চাষ আবাদ করা কঠিন হয়ে উঠেছে। গবাদি পশুরও মৃত্যু হয়েছে অনেক। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর এক অনিশ্চয়তা আর আশঙ্কার মধ্যে দিন কাটছে ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত হাজার হাজার মানুষের। মুখ্যমন্ত্রী ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের পর সংবাদমাধ্যমে সাড়া তুলে ঘোষণা করেছিলেন ‘দুয়ারে ত্রাণ’। কিন্তু তার আশায় আশায় থেকে দিন কেটে যাচ্ছে দুর্গত মানুষদের। যেটুকুও বা ত্রাণ সাহায্য আসছে, সেখানেও দলবাজির অভিযোগ উঠেছে। গতবারের আমফানের সময়ের মতো শাসক দলের স্থানীয় মাতব্বররা এবারেও ত্রাণ সামগ্রী চুরি করছে। আবার বিপন্ন মানুষদের জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ও বামপন্থী সংগঠনগুলো যখন ত্রাণ দিতে যাচ্ছে, তখন বিভিন্ন জায়গায় তারা তৃণমূলের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। এমনকী হিঙ্গলগঞ্জের একটি এলাকায় বিরাটি থেকে ত্রাণ দিতে আসা একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যদের উপর কয়েকদিন আগে শাসক দল হামলা, বোমাবাজি পর্যন্ত করেছে।

আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, দক্ষিণ ২৪ পরগনার জেলার মৌসুনি দ্বীপে বানভাসি গৃহহীন মানুষদের ত্রাণ দিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে তৃণমূলের স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান। গত ১০ জুন পঞ্চায়েত প্রধান হাসনা বিবির জারি করা এক নোটিশে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, প্রধানের অনুমতি ছাড়া কোনো স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কোনো ধরনের ত্রাণ দেওয়া ও পারাপার করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। অন্যথায় আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে। এমনই অমানবিক ও অন্যায় আচরণ করছে শাসক দল ও স্থানীয় প্রশাসন। এই নোটিশ জারি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মৌসুনি দ্বীপের দুর্গত মানুষজন। তাঁদের অভিযোগ, সরকারের ত্রাণ মিলছে না, মানুষের দেওয়া ত্রাণের উপর নির্ভর করে চলতে হচ্ছে। এখন সেই ত্রাণ দিতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। এই ঘটনায় জেলা সিপিআই(এম)'র পক্ষ থেকে জেলা শাসকের কাছে অভিযোগ জানানো হয়েছে। এভাবে প্রকাশ্যে না হলেও আরও কিছু এলাকায় এমন ঘটনা ঘটেছে।

এদিকে সরকারের ত্রাণের দেখা না মিললেও তাদের ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির অদ্ভুত হিসেবের কথা উঠে এসেছে সংবাদমাধ্যমে। কিন্তু সেই হিসেবের সাথে বাস্তবের কোনো সামঞ্জস্য থাকছে না। সকলেরই অভিজ্ঞতায় রয়েছে, ইয়াসের ধাক্কায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল উপকূলবর্তী তিন জেলা-উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা এবং পূর্ব মেদিনীপুর। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরও ঘোষণা ছিল তাই। কিন্তু রাজ্য সরকারের তৈরি করা তথ্যে জানা যাচ্ছে পূর্ব মেদিনীপুরের চেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা। সেই অনুযায়ী পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় জেলা শাসকের নির্দেশিকায় ঘোষণা করা হয়েছে, ইয়াসের তাণ্ডবে ৩ মহকুমার ১৩ ব্লকের ৩৮৩টি মৌজায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে। যেখানে পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা শাসকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই জেলায় নাকি ক্ষতি হয়েছে ২১টি ব্লকের ৫৫৯৩টি মৌজা। এখানে সব ক’টি ব্লকই ক্ষতিগ্রস্ত দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ উপকূলবর্তী পূর্ব মেদিনীপুরের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে উপকূলের দূরে থাকা, যেখানে সমুদ্র নেই,ইয়াসের তাণ্ডব ছিলনা, সেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়! আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, আমফানের সময়েও এই জেলায় ২১টি ব্লকের ৫৫৯৩টি ব্লক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ইয়াসের ধাক্কায়ও নাকি ২১টি ব্লকের ৫৫৯৩টি ব্লকের ক্ষতি হয়েছে!

আবার তেমনই সরকারি হিসেবে দেখানো হয়েছে, দুই ২৪ পরগনার চেয়ে নাকি বেশি ক্ষতি হয়েছে হুগলি জেলায়! সকলেরই জানা, দুই ২৪ পরগনা জেলায় ইয়াসের ভয়ঙ্কর তাণ্ডবের কথা। এই দুই জেলা শাসকের নির্দেশিকা জানাচ্ছে, দুই জেলা মিলিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্লকের সংখ্যা ২৬। ক্ষতিগ্রস্ত মৌজা ৮০৪। যেখানে হুগলি জেলায় জেলা শাসকের নির্দেশিকা জানাচ্ছে, জেলায় নাকি ১৮টি ব্লকই ক্ষতিগ্রস্ত। আর ফসলের ক্ষতি হয়েছে ১৯৭৩টি মৌজায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, দুই ২৪ পরগনা জেলায় ক্ষতির পরিমাণ হুগলি জেলার অর্ধেকেরও কম! আরও চমকপ্রদ দিক হলো, কলাইকুণ্ডায় প্রধানমন্ত্রী মোদীর কাছে মমতা ব্যানার্জি যে ক্ষয়ক্ষতির রিপোর্ট তুলে দিয়েছিলেন তাতে দেখানো হয়েছিল ১৫টি জেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে কলকাতা ছাড়া বাকি ১৪টি জেলা ছিল গ্রাম প্রধান। কিন্তু জেলা শাসকেরা অর্থ দপ্তরের কাছে যে হিসাব পেশ করেছেন, তাতে আছে ৮টি জেলা। মুখ্যমন্ত্রীর পেশ করা নথিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল চার জেলা-উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা, পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলা। কিন্তু রাজ্য সরকারের কাছে পেশ করা জেলা শাসকদের নথিতে চাষের ক্ষয়ক্ষতির নিরিখে হুগলি ও পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনীপুর ও হাওড়া জেলা। জেলা শাসকেরা ফসলের ক্ষয়ক্ষতি সংক্রান্ত যে রিপোর্ট ব্যাঙ্কগুলির কাছে জমা দিয়েছেন তার ভিত্তিতেই ক্ষতিপূরণ পাবেন ওই সমস্ত জেলার কৃষকরা।

ইয়াসের তাণ্ডবে ক্ষয়ক্ষতির যে হিসাব রাজ্য সরকার তৈরি করেছে তার যে পুরোপুরি ভিত্তি নেই তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা খেয়ালখুশি মতো যে কারণেই এই নথি তৈরি হোক না কেন, তা দুর্গত মানুষদের কতটা সহায়ক হবে তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দুর্গত মানুষদের প্রতি মমতা সরকারের মনোভাবও প্রকট হয়েছে।

তবে ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবে বিপন্ন মানুষদের জন্য সরকারের যে ভূমিকাই থাক না কেন, এসএফআই, ডিওয়াইএফআই, সিআইটিইউ, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি কর্মচারী, শিক্ষক সংগঠন, ব্যাঙ্ক কর্মীদের সংগঠন সহ বিভিন্ন সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা তাদের সাধ্যমতো ত্রাণ ও সাহায্য নিয়ে দুর্গত মানুষদের পাশে দাঁড়াচ্ছে। এছাড়া স্টুডেন্টস হেলথ হোমও বানভাসি এলাকায় স্বাস্থ্য পরিষেবা দিচ্ছে, প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র ও ত্রাণ দেবার পাশাপাশি স্বাস্থ্য শিবির করছে।পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চও সাধ্য অনুযায়ী দুর্গত মানুষদের ক্রমাগত সাহায্য করে যাচ্ছে। এদিকে রেড ভলান্টিয়াররাও সাধারণ মানুষের সাহায্যকে সম্বল করে কোভিড মোকাবিলার পাশাপাশি ইয়াসের তাণ্ডবে বিধ্বস্ত এলাকাগুলোতে বিপন্ন মানুষদের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে চলেছে।