E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮

অতিমারী পরিস্থিতিতে ইঞ্জেকশন চুরি ও গরমিলের পরিসংখ্যান পিছিয়ে দিচ্ছে রাজ্যকে


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন চুরি এবং সরকারি স্তরে মৃত, অ্যাকটিভ ও আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর প্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের কোভিড পরিস্থিতি এই মুহূর্তে পরিকাঠামো গত ভাবে সঙ্কটজনক স্তরে চলে গেছে বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। রাজ্যের ভোট প্রক্রিয়াকে ঢাল করে রোগীর পরিসংখ্যানে কারচুপি করা হয়েছে বলে আগে থেকেই যে অভিযোগ উঠেছিল, রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরের কাজকর্মে তাতে সিল মোহর পড়েছে বলেও মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

জানা গেছে, রাজ্যে ভোট প্রক্রিয়া চলাকালীনই গত ২৪ এপ্রিল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে কোভিডের লড়াইয়ে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ, প্রায় ১১ লক্ষ টাকার জীবনদায়ী মহার্ঘ টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন চুরি হয়েছিল। তার দেড় মাস পরে যখন সোসাল মিডিয়ায় ইঞ্জেকশন চুরির কথোপকথনের ‘অডিও ক্লিপ’ ভাইরাল হয় তারপরেই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নাকি জানতে পারেন এই চুরির কথা। এমনকি মুখ্যমন্ত্রীও এই ঘটনায় প্রতিক্রিয়া দেন। যদিও তাতেও ‘ষড়যন্ত্র’র গন্ধ পেয়েছিলেন তিনি।

কোভিড চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ, দামি ইঞ্জেকশনের ২৬টি ভায়াল মেডিক্যাল কলেজের সিসিইউ’ থেকেই চুরি হয়ে যাচ্ছে, এমন ঘটনা সামনে আসতেই তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। সরকারি হাসপাতাল থেকেই কোভিড চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ টসিলিজুমাব ইঞ্জেকশন চুরিকাণ্ডে অভিযুক্ত সিস্টার ইন চার্জকে কোচবিহারের মাথাভাঙা মহকুমার হাসপাতালে বদলির নির্দেশ দিল স্বাস্থ্য ভবন। কয়েকদিন আগেই আগে এই ইঞ্জেকশন চুরিকাণ্ডে অভিযুক্ত মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক দেবাংশী সাহাকে কোচবিহারের শীতলকুচি ব্লকের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে বদলি করা হয়েছে।

এর আগে চিকিৎসকদের সংগঠন এএইচএসডি’র তরফে নির্দিষ্টভাবে দাবি করা হয়েছিল যে তদন্ত রিপোর্ট জনসমক্ষে আনতে হবে। ব্যবহারেরও নিয়ম অনুযায়ী ৪০০ মিলিগ্রামের এই ইঞ্জেকশন সাধারণভাবে একটিই দেওয়া হয় রোগীকে, কারো কারো ক্ষেত্রে দুটি লাগতে পারে। শুধুমাত্র চিকিৎসক লিখলেই হবে না, সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে উচ্চ আধিকারিকদের অনুমতি প্রয়োজন, তবেই মিলবে। ফাঁস হওয়া অডিওতে (অপরীক্ষিত) বারেবারে তৃণমূল বিধায়ক নির্মল মাঝির নাম আসলেও একটিবারের জন্য তদম্ত কমিটি তা নিয়ে জেরা করেনি। বেমালুম ছাড় দেওয়া হলো হাসপাতালেরই রোগী কল্যাণ সমিতির চেয়ারম্যান ও তৃণমূলী বিধায়ককে।

কার্যত কোভিডের ইঞ্জেকশন নিয়ে এত বড় কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিতে চাইছে সরকার। এই ঘটনা নিয়ে দু-দুটো তদন্ত কমিটি গড়া হয়েছিল। তাদের দুটি রিপোর্টই এক। কীভাবে তোলা হলো ইঞ্জেকশন, কার নির্দেশে, সে বিষয়ে কোনকিছুই বলা হলো না। কোভিডের ইঞ্জেকশন কেলেঙ্কারির তদন্ত ও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়াও এরপর ‘ক্লোজড ম্যাটার’ হতে চলেছে বলে দাবি স্বাস্থ্য ভবনের একাংশের।

অন্যদিকে লকডাউনের সময় সীমা বাড়ালেও রাজ্যের কোভিড পরিসংখ্যানের গরমিল নিয়ে ডামাডোল তুঙ্গে। মে এবং জুন মাসের রোগীর অঙ্কে পরিস্কার কারচুপি। এ প্রসঙ্গে সরব জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত, আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখালে মহামারী মোকাবেলার প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গরমিলের বিষয়ে ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্য সচিবকে চিঠি দিয়েছিলেন এএইচএসডি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডাক্তার মানস গুমটা। তিনি বলেছেন, তথ্য হলো মহামারী মোকাবিলার গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। আমরা প্রথম থেকেই সরকারকে বলেছি যে মহামারীতে তথ্য গোপন আরো সংকট তৈরি করে। তার নিরিখেই লড়াইয়ের পদ্ধতি ঠিক করতে হয়। অভিযোগ, রাজ্যে সংখ্যাতত্বের নিরিখে এমন তত্ত্ব সাজানো হচ্ছে যেন রাজ্যে মাত্র ৩ দিনে একজন কোভিড রোগী সেরে উঠেছেন। একজন কোভিড রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরে তার শরীরের ১০ দিনে সেই ভাইরাসের সংক্রমণ থাকে। কিন্তু এই রাজের সরকার যেভাবে কমিয়ে দেখাতে শুরু করেছে, তাতে অঙ্ক বলছে গোটা দেশে একমাত্র এ রাজ্যেই যেন কোভিড রোগী তিন দিনে সেরে উঠছে! গরমিলের উদাহরণ হিসেবে মে মাসের একটা ছোট্ট পরিসংখ্যান উল্লেখ করা যেতে পারে। ১ মে রাজ্যে অ্যাকটিভ করোনা রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৮ হাজারেরও বেশি। ৬ মে এক ধাক্কায় কমে দাঁড়ায় ৩৫ হাজারে। কমতে কমতে ৯ জুন তা আরো কমে দাঁড়ায় ১৪ হাজারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দাবি জানিয়েছেন, দায়সারা মরজিমাফিক তথ্য নয়, অবিলম্বে স্বচ্ছতার সঙ্গে কোভিড সংক্রান্ত সঠিক তথ্য দিতে হবে।

রাজ্যে এই মুহূর্তে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ৪০ হাজারের বেশি। যুক্তি দিয়ে সেই কথাই বারবার সামনে আনছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। অথচ স্বাস্থ্য দপ্তর বলছে, ১৬ জুনের হিসাবে রাজ্যে অ্যাকটিভ কোভিড কেসের সংখ্যা ২১ হাজার। স্বাস্থ্য দপ্তরের বুলেটিনে বিস্তর ভুল রয়েছে বলে বক্তব্য চিকিৎসকদের এক বড় অংশেরই। কিন্তু সেই ভুল তথ্য দিয়েই রোজ তৈরি করা হচ্ছে বুলেটিন। এ ছাড়াও নমুনা পরীক্ষা, রিপোর্ট দেওয়ার তারিখ আপলোড করা নিয়েও বেড়েছে বিভ্রান্তি।

এই পরিস্থিতিতে অবশ্যম্ভাবী তৃতীয় ঢেউ আসার আগেই সমস্ত কোভিড হাসপাতালে অক্সিজেন ও ক্রিটিকাল বেডের সংখ্যা বাড়ানোর দাবি জানিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ ও ফোরামঅফ সাইন্টিস্ট ইঞ্জিনিয়ার্স এন্ড টেকনোলজিস্ট সহ বেশ কয়েকটি সংগঠন। আশঙ্কা করা হচ্ছে, করোনার আসন্ন তৃতীয় ঢেউয়ে আক্রান্ত হবে ১৬ বছরের কম বয়সি এবং শিশুরা। সুতরাং প্রতিটি হাসপাতালে পৃথক পেডিয়াট্রিক ভেন্টিলেটর এবং আইসিইউ চালু করার দাবি জানিয়েছে ওই সংগঠনগুলি। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাস থেকে তৃতীয় ঢেউ আসতে পারে। তার জন্য তৈরি থাকতে হবে সবাইকে। রাজ্য সরকারকে এই বিষয়ে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে চিকিৎসা ক্ষেত্রে সমস্ত রকম সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে। ওই ৫ সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বলেছেন, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিকেও যথেষ্ট উন্নত করতে হবে। কোভিড চিকিৎসায় সেগুলিকে স্বাস্থ্য দপ্তরের মূল কেন্দ্রের সঙ্গে প্রযুক্তিগতভাবে যুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে।