৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮
দেশের একাধিক রাজ্যে কোভিডে মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যায় গরমিলের অভিযোগে উদ্বেগ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যগুলিতে বিভিন্ন মেয়াদের লকডাউনের জেরে বর্তমান কোভিড পরিস্থিতিতে দেশে মৃতের এবং আক্রান্তের সংখ্যা কিছুটা নিম্নমুখী হলেও তা জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ কমাতে পারছে না। কারণ ইতিমধ্যেই মধ্য প্রদেশ, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ প্রভৃতি রাজ্যে সংখ্যাতত্ত্বের ব্যাপক গরমিল অতিমারী মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর ব্যাপ্তিকেই প্রশ্নের মুখে ঠেলে দিয়েছে। টিকা প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কর্পোরেটগুলির মুনাফার জেরে টিকার দাম এবং জোগানের বৈষম্যের বিশ্বব্যাপী চিত্র তাঁদের এই উদ্বেগ আরও বাড়িয়েছে। সাম্প্রতিক জি-সেভেন বৈঠক চলাকালীন টিকার পেটেন্ট সাময়িক স্থগিত করার দাবিকে বৈধতা দেবার প্রসঙ্গও উঠে এসেছে বিশেষজ্ঞদের আলোচনায়। এর পাশাপাশি ভারতের ছাত্র সংগঠনগুলির যৌথ মঞ্চ অতিমারী পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষাক্ষেত্রে পরীক্ষা স্থগিত সহ ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নানা বৈষম্য নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি দিয়েছে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে।
গত ২৪ ঘন্টায় (১৬ জুন) দেশে ৬০ হাজার পার করল দৈনিক করোনা সংক্রমণ। গত ২৪ ঘন্টায় দেশে করোনা আক্রান্ত হয়েছেন ৬৭ হাজার ২০৮ জন। গত ২৪ ঘন্টায় করোনায় মৃত্যু হয়েছে ২ হাজার ৩৩০ জনের। গত ২৪ ঘণ্টায় মোট ১৯ লক্ষ ৩১ হাজার ২৪৯টি নমুনা পরীক্ষা করানো হয়েছে। এখনও পর্যন্ত দেশে মোট মৃত্যু হয়েছে ৩ লক্ষ ৮১ হাজার ৯০৩ জনের। বর্তমানে দেশে সক্রিয় রোগীর সংখ্যা ৮ লক্ষ ২৬ হাজার ৭৪০ জন।
ওয়ার্ল্ডোমিটারের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী এখনও পর্যন্ত সারাবিশ্বে গত ২৪ ঘণ্টায় (১৬ জুন) করোনা সংক্রমিত হয়ে মৃত্যু হয়েছে ৯ হাজার ৪৪১ জনের। একই সময়ে করোনা শনাক্ত হয়েছে ৩ লক্ষ ৯৬ হাজার ৬২৩ জনের। বিশ্বে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮ লক্ষ ৪৮ হাজার ৮২৫ জন। বিশ্বে মোট শনাক্ত রোগীর সংখ্যা ১৭ কোটি ৭৮ লক্ষ ৭ হাজার ৩৯৬ জন। বিশ্বজুড়ে সক্রিয় করোনা রোগীর সংখ্যা বর্তমানে ১ কোটি ১৬ লক্ষ ৫৪ হাজার ২৭৯ জন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রকের দাবি, এখনও পর্যন্ত সারাদেশের প্রায় ২৬ কোটি ৫৫ লক্ষ ১৯ হাজার ২৫১ জনকে টিকা দেওয়া হয়েছে। ২১ কোটির বেশি মানুষ প্রথম ডোজ পেয়েছেন, দ্বিতীয় ডোজ পেয়েছেন প্রায় ৫ কোটি মানুষ। দেশের পেটেন্ট আইনে বাধ্যতামূলক অনুমোদন কাজে না লাগিয়ে এখানে নরেন্দ্র মোদীর সরকার দেশের দু’টি বেসরকারি সংস্থার হাতে টিকাকরণের স্বত্ব তুলে দিয়েছেন। ২৫ শতাংশ মানুষ এখনও টিকা না পেলেও এক-চতুর্থাংশ টিকা পাঠানো হয়েছে বেসরকারি কর্পোরেট হাসপাতলে।
দেশের একাধিক রাজ্যে কোভিড রোগে মৃত্যু সহ একাধিক ক্ষেত্রে গরমিল সামনে এসেছে। ১৩ জুনের খবর, মহামারীতে মৃত্যুর হিসেব সংশোধিত করেছে মহারাষ্ট্র সরকার। মৃতের সংখ্যা ৮ হাজার ৮০০ বেড়ে যায় সংশোধনী অনুযায়ী। অভিযোগ, বিহার মধ্যপ্রদেশ ও উত্তর প্রদেশে রোগ পরীক্ষার উপযুক্ত পরিকাঠামো না থাকায় করোনার উপসর্গ থাকলেও সরকারি ব্যবস্থায় চিহ্নিত হননি বহু রোগী। পাটনা হাইকোর্টের তিরস্কারের পর মৃতের সংখ্যা সংশোধন করেছে বিহারও। গুজরাটের সরকারি স্তরে মৃতের সংখ্যা গোপন করার অভিযোগ উঠেছে। পশ্চিমবঙ্গে আক্রান্ত এবং চিকিৎসাধীন রোগীর সংখ্যায় গুরুতর অমিলের অভিযোগ তুলেছেন চিকিৎসকরাই।
কোভিডে মৃত্যুর হার নিয়ে কারচুপির অভিযোগ সামনে এসেছে বিজেপি শাসিত মধ্যপ্রদেশে। রিপোর্টে প্রকাশিত, দ্বিতীয় ঢেউতে মৃত্যুর হার যা দেখানো হয়েছে প্রকৃত সংখ্যা তার প্রায় তিন গুন (২৯০ শতাংশ) বেশি। সিভিল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেমের রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত ২০১৮-১৯ সালে মধ্যপ্রদেশে এপ্রিল থেকে মে মাসে গড় মৃত্যুর হার ছিল ৫৯ হাজার। চলতি বছর ওই একই সময় গড় মৃত্যুর হার দাঁড়িয়েছে ২.৩ লক্ষ। অথচ সরকারিভাবে কোভিডে স্বীকৃত মৃত্যুর সংখ্যা মাত্র ৪,১০০। মৃত্যুর হার নিয়ে কারচুপি স্পষ্ট। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মত আক্রান্ত এবং মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখালে মহামারী মোকাবেলার প্রস্তুতি ক্ষতিগ্রস্ত হয় জনস্বাস্থ্য উপরিকাঠামো ধরা যায় না।
দিল্লিতে এই সপ্তাহ থেকেই লকডাউন শিথিল হয়েছে। তবে কিছু বিধিনিষেধ বজায় থাকবে। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এক্ষেত্রে নজরদারি চলবে। দিল্লিতে সংক্রমণ কমায় অর্থনৈতিক কাজকর্মের সঙ্গে সঙ্গে কোভিডের তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলার তোড়জোড় করার ওপর জোর দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। একইসঙ্গে তামিলনাডুতেও এই সপ্তাহ থেকে লকডাউন কিছুটা লঘু করা হচ্ছে।
দিল্লির হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবে মৃত্যু নিয়ে কমিটি গঠনের জন্য কেন্দ্রের অনুমতি চেয়ে আপ সরকার দিল্লির লেফটেন্যান্ট গভর্নর অনিল বাইজালের কাছে ফাইল পাঠিয়ে ছিল। সেই অনুমোদন দেয়নি কেন্দ্রীয় সরকার। ১৬ জুন সেই অনুমতি নাকচের কথা জানিয়ে দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীষ সিসোদিয়া বলেছেন, মৃত্যুর তদন্ত করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জন্যই ওই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
এদিকে ‘ইকনমিস্ট’ পত্রিকার এক রিপোর্টে জানানো হয়েছে, সাধারণ সময়েই প্রতি ২০ পরিবারের একটি চিকিৎসার খরচের কারণে দারিদ্রে ডুবে যায়। করোনাকালে ভারতে তা মারাত্মক আকার নিয়েছে। কোভিডের প্রথম প্রবাহ থেকেই মেডিক্যাল খরচের হার বহুগুণ বেড়ে গিয়েছে। হাজার হাজার পরিবার ডুবে গেছে দেনায়। বাড়ি বিক্রি, বন্ধক, অলঙ্কার বিক্রি, সঞ্চিত সমস্ত অর্থ ব্যয় প্রত্যেক দিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। যাঁদের সে সঙ্গতিও নেই সেইসব পরিবারের হাজার হাজার মানুষ প্রাণও হারিয়েছেন নিঃশব্দে নীরবে ঘটেছে এমনটাও।
অন্যদিকে ভারতে দুই-তৃতীয়াংশ নাগরিকের কোনও স্বাস্থ্য বিমা নেই। কেন্দ্রের ‘আয়ুষ্মান ভারত’ বা রাজ্য সরকারগুলির বিমা কোভিডে কাজে লেগেছে খুবই কম। এমনকি সরকারি হাসপাতালও ফিরিয়ে দিয়েছে ওই সব বিমার কার্ড। বেসরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্য বিমার ক্ষেত্রে কোভিড বাদ দিয়েছে অধিকাংশই। দ্বিতীয় প্রবাহে দেখা যাচ্ছে, ওষুধসহ চিকিৎসার অনেক সরঞ্জামের অর্থ দেওয়া হচ্ছে না। বিমা সংস্থা ইচ্ছেমতো বাদ দিচ্ছে অনেক চিকিৎসার খরচ। ক্যাশলেসের সুবিধা নামে থাকলেও বিমাকারীকে আগে নিজের পকেট থেকে খরচ মেটাতে হচ্ছে। রাজ্য সরকারগুলি অনেক দেরিতে বেসরকারি হাসপাতালে বিলের ঊর্ধ্বসীমা ঘোষণা করলেও যথাযথ নজরদারি করা হচ্ছে না। জানা গেছে ৫০ শতাংশ ক্লেম ফেরত এসেছে, এখনও কোনও টাকা পাওয়া যায়নি। অনেক ওষুধ বাজার থেকে কিনে দিতে হয়েছে রোগীর পরিবারকে, সরকারি হাসপাতালেও তা মেলেনি।
করোনা মোকাবিলায় টিকাকরণের হার দ্রুত বাড়ানোর প্রয়োজন দেখিয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলি। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে বহুজাতিকের টিকা এবং ওষুধেরর পেটেন্ট স্থগিত সংক্রান্ত আলোচনা করতে পারে ১৮ জুন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার পেটেন্টের সাময়িক ছাড়ের সংস্থান রয়েছে। এখনই তা ব্যবহার করে টিকা বৈষম্যের হাত থেকে বিশ্বকে রক্ষা করা উচিত। পেটেন্টের চাপ না থাকলে কম খরচে উৎপাদন বাড়ানোর যুক্তিতে সরব উন্নয়নশীল দেশগুলি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যে টিকাকরণের সমন্বয় মঞ্চ তৈরি করেছে তা থেকে নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে গিয়েছে ০.৩ শতাংশ টিকা।
ফাইজার, মর্ডারনা, অ্যাস্ট্রোজেনেকার মতো কর্পোরেটগুলির সদর দপ্তর পশ্চিমের ধনী দেশগুলিতে। পেটেন্ট-এর মালিকানা স্বত্ব ব্যবহার করে মুনাফা করে পেটেন্টএ ছাড় ঠেকাতে মার্কিন প্রশাসন এবং ইউরোপের ওই দেশগুলির মূল যুক্তি, বহুজাতিক কর্পোরেটকে নিজেদের পণ্যে মালিকানার অধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া উচিত, না হলে ভবিষ্যতে এরা আর গবেষণায় খরচ করবে না। ফের জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে বিজ্ঞানের প্রয়োগ থেকে সমাধানে পৌঁছানোর প্রক্রিয়া ধাক্কা খাবে।
সর্বজনীন টিকাকরণের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্তরে গড়ে ওঠা বিভিন্ন আন্দোলন সরাসরি খারিজ করছে তাদের এই যুক্তি। সমাজকর্মীরা বলছেন, মানুষের খরচে সরকারি সহায়তায় চলছে গবেষণার মূল কাজ। টিকা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর এই সামাজিক দ্রব্যে পেটেন্ট বসিয়ে ব্যক্তিগত মুনাফা নিশ্চিত করা হয়েছে। তাদের দাবি, টিকার সঙ্গে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সামাজিক দ্রব্য হিসেবে দেখতে হবে। প্রসঙ্গত, এপ্রিলের ফোর্বস তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গিয়েছে টিকার ব্যবসা নতুন ৯ জনকে বিলিয়নিয়ার করেছে।
অতিমারী সামলাতে শিশু ও কমবয়সিদের জন্য ভ্যাকসিনই গুরুত্বপূর্ণ ও নিরাপদ হাতিয়ার হতে চলেছে। সম্প্রতি সায়েন্স জার্নাল ‘সায়েন্স ইমিউনোলজি’-তে প্রাথমিক ট্রায়ালের ভিত্তিতে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে, এযাবৎ দু’টি কোভিড ভ্যাকসিনে ছোট বাচ্চাদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে। এগুলির প্রয়োগে সার্স-কোভ-২’এর বিরুদ্ধে ভালো পরিমাণে অ্যান্টিবডির সাড়া দেখা গেছে।