৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮
অসমে বিজেপি সরকারের অমানবীয় এবং সাম্প্রদায়িক উচ্ছেদ অভিযান
কমলেশ গুপ্ত
করিমগঞ্জ জেলায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ।
সদ্য সমাপ্ত অসম বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন মিত্রজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ইতিমধ্যে সরকার গঠন করেছে। অবশ্য সর্বানন্দ সোনোয়ালের পরিবর্তে প্রভাবশালী মন্ত্রী ডঃ হিমন্ত বিশ্ব শর্মাকে নাটকীয়ভাবে অসমের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করেছে বিজেপি দলের হাইকমান্ড। উল্লেখ করা যেতে পারে, ২০১৬ সালে বিজেপি জোট মোট ১২৬টি আসনের মধ্যে ৮৬টি আসন লাভ করেছিল। এবার পেয়েছে ৭৫টি আসন। প্রাপ্ত ভোটের হার ৪৪.৫২ শতাংশ। অন্যদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন মহাজোট ৫০টি আসন পেয়েছে। প্রাপ্ত ভোটের শতাংশ ৪৩.৬৪। নবগঠিত অসম জাতীয় পরিষদ, রাইজর দল এবং নির্দল মিলে লাভ করেছে ১১.৮৪ শতাংশ ভোট, আর আসন পেয়েছে একটি (অখিল গগৈ)। পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে, ‘সিএএ’ বিরোধী দলগুলো যদি ছোটোখাটো বিভেদ ত্যাগ করে মহাজোটে শামিল হয়ে নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে পারতো তবে মহাজোট আরও ১৫ থেকে ২০টি আসন অনায়াসে লাভ করতো। অপ্রিয় হলেও সত্য যে, নবগঠিত অসম জাতীয় পরিষদ(অজাপ) আর ‘রাইজর দল’ এবং কয়েকজন নির্দলীয় প্রার্থীর অবাঞ্ছিত অবস্থানের ফলে বিজেপি মিত্রজোট সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করার সোনালি সুযোগ লাভ করেছে। কম করে ১৫টি বিধানসভা কেন্দ্রে মিত্রজোট প্রার্থীরা যে পরিমাণ ভোট লাভ করে জয়ী হয়েছে, সেই কেন্দ্রগুলোতে মহাজোটের সাথে অজাপ, রাইজর দলের ভোট যোগ করলে নিশ্চিতভাবে জয়লাভ করতো মহাজোটের প্রার্থীরা। যাই হোক, সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠতাই শেষকথা।
শাসনভার লাভ করেই হিমন্ত বিশ্ব শর্মার সরকার ভয়ংকর কোভিড পরিস্থিতিতে যখন স্বাস্থ্য পরিষেবার বেহাল অবস্থা, মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানের পথ রুদ্ধ, প্রতিষেধকের জন্য চলছে হাহাকার, বন্যা নিয়ন্ত্রণের মতো জরুরি কর্তব্য চূড়ান্তভাবে অবহেলিত, তখন গোহত্যার বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন, এনআরসি শুদ্ধিকরণ এবং ‘বাংলাদেশি’, ‘রোহিঙ্গা’ প্রভৃতি তকমা দিয়ে রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে ১৭ মে চতিয়া বিধানসভা কেন্দ্রের জামুগুরিহাট অঞ্চলে ২৫টি পরিবারকে উচ্ছেদ করার মধ্য দিয়ে এই অভিযান নতুন করে শুরু হয়। তারপর চিরাং জেলার করাইবাড়ি বনগাঁও, রুনিখাতার ওদালগুরি ৫নং বনাঞ্চল, করিমগঞ্জ জেলার লোরাইপোয়া লঙ্গাই সংরক্ষিত বনাঞ্চলে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে বাড়িঘর, খেতখামার ধ্বংস করা হয়। ৬ জুন হোজাই জেলার লংকা রেভিনিউ সার্কেলের তারালাংসু কাকিটিলা বাজারে ৭৪টি পরিবারের ঘরদুয়ার ভেঙে ফেলে। একশো বিঘার বেশি জমিতে চাষ করা আখ এবং হলুদ সম্পূর্ণ ধ্বংস করেছে। লক্ষণীয়, নতুন সরকার শপথ গ্রহণের পরের দিনই গুয়াহাটি হাইকোর্ট কোভিড অতিমারীর সময়ে সবরকমের উচ্ছেদ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়। গত ১০ মে আবারও প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে গঠিত তিন বিচারপতির ডিভিশন বেঞ্চ উচ্ছেদ বন্ধের নির্দেশ জারি করেছিল। সরকার এই নির্দেশ অমান্য করেই উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছে।
এই উচ্ছেদ অভিযান সাম্প্রদায়িক এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। চিরাং জেলার করাইবাড়ির উচ্ছেদ বাদ দিলে অন্যান্য উচ্ছেদগুলোতে মুসলমান নাগরিকদের উচ্ছেদের লক্ষ্য হিসেবে স্থির করা হয়েছে। ‘সন্দেহযুক্ত নাগরিক’, ‘বাংলাদেশি’ তকমা লাগিয়ে এদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হচ্ছে যে, তারা অবৈধভাবে বনাঞ্চলে অথবা সরকারি জমি দখল করেছে। আসলে এইসব অভিযোগ এনে সরকার উচ্ছেদ অভিযানকে ন্যায্যতা প্রদান করতে চাইছে। অথচ যাদের উচ্ছেদ করা হয়েছে তারা কেউ বিদেশি প্রমাণিত হননি। এই মানুষগুলো যুগ যুগ ধরে ওই সব মাটিতে বসবাস করে আসছেন। চিরাং জেলার করাইবাড়ি অঞ্চলে গোর্খা, সূত্রধর, রাজবংশী এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের গরিব পরিবারের ওপর উচ্ছেদের খাড়া নেমে এসেছে।
করিমগঞ্জ জেলার পাথারকান্দি রাজস্ব চক্রের ছলামনা গ্রামে প্রায় ৩০টি সংখ্যালঘু পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। পাথারকান্দির বিজেপি বিধায়ক কৃষ্ণেন্দু পাল এই পরিবারগুলোকে রোহিঙ্গা শরণার্থী বলে অভিযোগ তুলেছেন। এই অমানবিক উচ্ছেদ অভিযানের বিরুদ্ধে যখন মানুষ সোচ্চার হচ্ছেন, তখন বিজেপি সম্প্রীতি নষ্ট করার চিরাচরিত খেলায় নেমে পড়েছে। রোহিঙ্গা বলে যাদের বলা হচ্ছে তারা তিরিশ-চল্লিশ বছর ধরে ওই অঞ্চলে বসবাস করছেন। এমনকী তাদের পূর্বপুরুষদের নাম ১৯৬৬ সালের বা তারও আগের ভোটার তালিকার আছে।
শোণিতপুর জেলায় যে পঞ্চাশটি পরিবার উচ্ছেদ হয়েছে তাদের ‘বাংলাদেশি’ বলছেন বিজেপি নেতারা। হোজাই জেলায় যাদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধেও ওই একই মিথ্যা অভিযোগ এনে প্রচার চালানো হচ্ছে। করিমগঞ্জ জেলার উচ্ছেদ হওয়া মানুষ সংবাদমাধ্যমের কাছে জানিয়েছেন - ‘সম্প্রতি নির্বাচনের সময় বিজেপি নেতারা আমাদের কাছে ভোট চাইতে এসেছিলেন। আমরা যদি রোহিঙ্গা হই তবে আমাদের কাছে ভোট চাইতে এসেছিলেন কেন? আসলে আমরা বিজেপি’কে ভোট দেইনি, তাই ওই দল প্রতিহিংসার রাজনীতি আরম্ভ করেছে।’
উচ্ছেদ অভিযানকে বৈধতা দিতে সম্প্রতি অসমের নবনির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী এক সাংবাদিক বৈঠকে মন্তব্য করেছেন, ‘জন্মনিয়ন্ত্রণ না করলে দখলকারীরা একদিন কামাখ্যা মন্দির দখল করে নেবে। মুসলিম মহিলারা ১০-১২টা করে সন্তান জন্ম দেয়। তারা যদি কম সন্তান জন্ম দেয় তাহলে আর জমি দখল হবে না।’ বিরোধী দলগুলো অভিযোগ করেছে মুখ্যমন্ত্রী উচ্ছেদ অভিযানকে বৈধতা দিতে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের খেলায় মেতেছেন, তিনি গোটা মুসলমান সম্প্রদায়কে দখলকারী সাজানোর চেষ্টা করছেন। ‘কামাখ্যা মন্দির বেদখল হবে’ এমন ভয়ংকর উসকানিমূলক মন্তব্য করে মুখ্যমন্ত্রী তার পদমর্যাদার হানি করেছেন। এভাবে মানুষের মৌলিক সমস্যার সমাধান করার পরিবর্তে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি করে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন। ইতিমধ্যে সিপিআই(এম) অসম রাজ্য কমিটি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে শুধু বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, আন্দোলন গড়ে তুলছে। গত ১০ জুন রাজ্যের সর্বত্র কোভিড পরিস্থিতির মধ্যেও বিক্ষোভ প্রদর্শনের কর্মসূচি পালন করেছে। মহাজোটের পক্ষ থেকেও উচ্ছেদের বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছে এবং অবিলম্বে হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে উচ্ছেদ বন্ধ করার দাবি উত্থাপন করেছে। অন্যথায় বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার হুঁশিয়ারি দিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী জনবিস্ফোরণের বিষয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাও বিভ্রান্তিকর। অসমের প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যা হচ্ছে ৩৯৮ জন। পক্ষান্তরে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা হচ্ছে ১০২৮। উত্তরপ্রদেশের জনসংখ্যা হচ্ছে নয় শতাধিক।
অসমের নতুন সরকার সত্রের জমি বেদখলের অজুহাতেও মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষের ওপর উচ্ছেদের খাড়া নামিয়ে আনার পরিকল্পনা করেছে। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, সত্রের উন্নয়নের জন্য পূর্বের সামন্তপ্রভুরা ভূমিদান করতেন। সেইসব দেবোত্তর ভূমির কর্তৃত্ব সত্রাধিকারি বা সত্রের প্রধানের উপর বর্তায়। সত্রাধিকারিরা পরবর্তীকালে বহু দেবোত্তর জমি বিক্রি বা হস্তান্তর করেছেন। সেইসব হস্তান্তরের কোনো বৈধ নথিপত্র বহুক্ষেত্রে করা হয়নি। চাষাবাদের সুবিধার জন্য পরিশ্রমী বহু মুসলমানকেও জমি হস্তান্তর করা হয়েছে। যুগ যুগ ধরে সেইসব মানুষ ওই জমিতে বসবাস করছেন। এই বাস্তব পরিস্থিতি বিচার না করেই তাদের বেদখলকারী হিসেবে গণ্য করে উচ্ছেদের পরিকল্পনা চলছে। এর ফলে নতুন করে রাজ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রাপ্ত সংবাদ মতে দরং জেলায় ৭৭ হাজার বিঘা জমিতে নতুন করে উচ্ছেদের পরিকল্পনা করা হয়েছে, যার ফলে এক বিশাল অংশের গরিব মানুষ ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হতে চলেছে।
অসমের ভূমি ব্যবস্থায় রয়েছে নানা জটিলতা। তার উপর প্রতি বছর বন্যা এবং নদী ভাঙনের ফলে বাস্তুভিটে এবং কৃষিজমি হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ সরকারি জমি অথবা বনাঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। কিছুদিন পূর্বের জরিপ অনুযায়ী অসমের ২৬৩৫৫টি গ্রামে প্রায় ৫৫ লক্ষ ৮৫ হাজার পরিবার বাস করে। তাদের ১৯ শতাংশের বাসগৃহের মেয়াদি পাট্টা নেই। আর ২০ শতাংশের কোনো পাট্টাই নেই। ৫০ শতাংশের কোনো কৃষিজমি নেই। প্রতিবছর এই সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অসমের ২০ শতাংশ মানুষ চর অঞ্চলে বসবাস করে। তাদের অধিকাংশের জমির পাট্টা নেই। প্রায় ৫০০ গ্রাম আছে যা বনাঞ্চলে অবস্থিত, তাতে প্রায় ৩৫ হাজার পরিবার বাস করে। আইন মতে তাদের পাট্টা দেওয়ার সুযোগ আছে, কিন্তু সরকার কোনো পাট্টার ব্যবস্থা করছে না। ১৯৬৫ সালের পর আর কোনও জরিপ হয়নি। ফলে জমি বন্দোবস্তির কাজ বন্ধ আছে। ট্রাইবেল জনসাধারণ সাধারণভাবে পাট্টা সংগ্রহের কথা ভাবে না বললেই চলে।
এমতাবস্থায় ২০১৬ সালের পর থেকেই গরিব মানুষকে ভূমি বণ্টন না করে অমানবীয়ভাবে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। যুগ যুগ ধরে বিভিন্ন ভাষা এবং ধর্মের লক্ষ লক্ষ মানুষ যে মাটিতে বসবাস করছেন সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সেই পরিবারগুলোকে মাটির অধিকার প্রদান করা অথবা বিকল্প স্থানে সংস্থাপনের ব্যবস্থা করা। সে বিষয়ে পরিকল্পনা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরিবর্তে বিজেপি সরকার কোভিডের ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নতুন করে সমস্যার সৃষ্টি করছে। প্রথম থেকেই বিজেপি সরকার রাজ্যে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে এবং তারই অংশ হিসাবে উচ্ছেদ অভিযানে মুসলমান মানুষকে আক্রমণের লক্ষ্য করা হয়েছে। এর বিরুদ্ধে রাজ্যের বাম, গণতান্ত্রিক, মানবতাবাদী এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি সোচ্চার হচ্ছেন।