E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮

প্যারি কমিউন ১৫০: সারা বছর চলুক চর্চা

সুপ্রতীপ রায়


এবছর প্যারি কমিউনের দেড়শো বছর। তাই এই উপলক্ষে সারা বছর চলবে আলোচনা, চর্চা। শোষণমুক্ত পৃথিবী যাঁরা গড়তে চান তাঁদেরকে অনুপ্রাণিত করে প্যারি কমিউন। শোষকশ্রেণির কাছে প্যারি কমিউন বা রুশ বিপ্লব আতঙ্ক। কী ঘটেছিল প্যারি নগরীতে? ১৮৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেডানে প্রুশিয়ার বাহিনীর কাছে তৃতীয় নেপোলিয়নের আত্মসমর্পণের পর ফ্রান্সে অস্থির অবস্থা তৈরি হয়েছিল। এই অবস্থার পটভূমিতেই ১৮৭১ সালে ১৮ মার্চ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণি ক্ষমতা দখল করেছিল।

১৮৭১ সালে প্যারি কমিউনের ঘটনার আন্তর্জাতিক চরিত্র ও ঐতিহাসিক তাৎপর্য ছিল। বিপ্লবের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণির ক্ষমতা দখল প্রথম ঘটে প্যারি কমিউনের মধ্যে দিয়ে। বুর্জোয়া শ্রেণির হাত থেকে ক্ষমতা দখল করা যায় এবং শ্রমিকশ্রেণির রাজ কায়েম করা যায় তা বাস্তবের মাটিতে প্রমাণ করেছিল প্যারি কমিউন। এটা ঠিক প্যারি কমিউন টিকে ছিল মাত্র ৭২ দিন। কিন্তু কমিউন পৃথিবীর দেশে দেশে শ্রমিকশ্রেণিকে অনুপ্রাণিত করেছিল। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে কী ধরনের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হবে তা দেখিয়ে দিয়েছিল প্যারি কমিউন। পৃথিবীতে যতদিন শোষণ মুক্তির লড়াই চলবে ততদিন প্যারি কমিউন আলোচিত হবে।

প্যারি কমিউন প্রসঙ্গে মার্কস বলেছিলেন: ‘‘কমিউন হলো সাম্রাজ্যের সাক্ষাৎ বিপরীত’’। তিনি আরও বলেছিলেন: ‘‘কমিউন শ্রেণি শাসনের রাজতন্ত্রী রূপটিকে শুধু অপসারিত করবে না, খাস শ্রেণি শাসনকেই দূর করবে। কমিউন ছিল সেই প্রজাতন্ত্রেরই একটি নির্দিষ্ট রূপ’’। মার্কস বলেছিলেন, ‘‘মেহনতি মানুষের প্যারি আর তাদের কমিউন নতুন এক সমাজের মহিমান্বিত অগ্রদূত হিসাবে চিরকাল সমাদৃত হবে’’।

ফরাসি বিপ্লব পৃথিবীর ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৭৮৯-১৮৭১ অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লব ও প্যারি কমিউনের মধ্যবর্তী সময় পৃথিবীতে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিল। এই সময়কালে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিকশ্রেণির অনেকগুলি আন্দোলন থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেই সমৃদ্ধ হয়েছিল পরবর্তীকালে বিভিন্ন দেশের শ্রমিক আন্দোলন। এ প্রসঙ্গে রুশ বিপ্লবের পরপরই লেনিনের উক্তিটি স্মরণীয়। তিনি বলেছিলেন:” We are now Commiune plus one”.

নেপোলিয়ন ১৭৯৯ সালে ফ্রান্সে প্রথম প্রজাতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। যদিও ১৮১৪ সালে নেপোলিয়নকে উৎখাত করে পুনরায় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল বুরবোঁ রাজবংশের একটি অংশ। প্রথম প্রজাতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষ পেয়েছিল অধিকার, নতুন মর্যাদা। ফলে তাঁরা রাজতন্ত্রকে মেনে নিতে পারেননি। ১৮৩০ সালের জুলাই বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে বুরবোঁ রাজবংশের পতন ঘটেছিল। দ্বিতীয়বারের জন্য প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও শ্রমিকশ্রেণির অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ফলে শ্রমিকশ্রেণি আন্দোলনমুখী হয়।

শ্রমিকশ্রেণির আন্দোলনগুলির মধ্যে সবিশেষ উল্লেখযোগ্য, ১৮৩১ সালের ফ্রান্সের শিল্প শহর লিঁয়তে শ্রমিক আন্দোলন। লিঁয়তে রেশম বস্ত্র শিল্পে সঙ্কটের কারণে শ্রমিকদের মজুরি হ্রাস ও ছাঁটাই চলতে থাকে। ১৮৩১’র ২১ নভেম্বর প্রায় লক্ষাধিক ধর্মঘটী শ্রমিকের মিছিল দেখে ভয়ে শহরের পুলিশ বাহিনী পিছিয়ে যায়। ন্যাশনাল গার্ড শহরে প্রবেশ করলেও শ্রমিকরা পিছিয়ে যাননি। তাঁদের স্লোগান ছিল: ‘‘কাজ করে বাঁচবো, নয়তো লড়াই করে মরবো।’’ যদিও শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা পরাজিত হয়েছিলেন। কিন্তু এই শ্রমিক আন্দোলন ভবিষ্যতের শ্রমিক আন্দোলনকে পথ দেখিয়েছিল।

লুডাইট আন্দোলন (১৭৯০-১৮৩০) আরেকটি উল্লেখযোগ্য আন্দোলন। শ্রমিকদের অবস্থার অবনতি হওয়ার ফলে তাঁরা শুরু করেছিলেন যন্ত্রভাঙার আন্দোলন। নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল সেই আন্দোলন। লুডাইট আন্দোলনের প্রভাব অন্য দেশগুলিতে পড়েছিল। এটা ঠিক শোষণের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে শ্রমিকদের ধারণার অভাব ছিল। ফলে তাঁরা মালিককে দায়ী না করে যন্ত্রকে দায়ী করেছিলেন।

চার্টিস্ট আন্দোলন (১৮৩৮-১৮৪৮) দেখিয়ে দিয়েছিল - শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন হবে না, অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চাই রাজনৈতিক ক্ষমতা। চার্টিস্টদের আন্দোলন শ্রমিকদের প্রভাবিত করেছিল। অবশ্য শেষ পর্যন্ত শোষক শ্রেণির বেপরোয়া আক্রমণের কাছে চার্টিস্ট আন্দোলন পরাস্ত হয়েছিল।

জার্মানিতে শ্রমিকদের উপর প্রচণ্ড নির্যাতন চলছিল। ১৮৩২ সালে জার্মানি থেকে বিতাড়িত বিপ্লবীরা ফ্রান্সের প্যারিসে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন জার্মান শ্রমিকদের প্রথম সংগঠন ‘জার্মান পিপলস ইউনিয়ন’। গড়ে তোলা হয়েছিল ‘‘নির্বাসিতদের লিগ’’ নামে একটি গোপন সংগঠন। ১৮৩৬ সালে জার্মান বামপন্থীরা ওই সংগঠন থেকে বেরিয়ে এসে ‘‘ন্যায়নিষ্ঠদের লিগ’’ গঠন করেছিলেন।

মার্কস ও এঙ্গেলস ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক আন্দোলনগুলিতে সহায়তা করেছিলেন।

প্রতিটি শ্রমিক আন্দোলনের প্রবণতার দিকে তাঁদের নজর ছিল। ব্রাসেলসে ‘কমিউনিস্ট -করেসপন্ডেস ব্যুরো’ গঠন করেছিলেন - বিভিন্ন দেশের সমাজতন্ত্রীদের ও শ্রমিকদের সংগঠিত করার জন্য।

সমাজতন্ত্র সম্পর্কে ভ্রান্ত তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিরুদ্ধে মার্কস-এঙ্গেলস লড়াই চালিয়েছেন। ‘ন্যায়নিষ্ঠ লিগ’-এ যোগদান করে তাঁরা তাদের মতবাদ বিশ্লেষণ করেছিলেন। ১৮৪৭ সালে সংগঠনটির নতুন নাম হয় ‘কমিউনিস্ট লিগ’। দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের পর মার্কস ও এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নীতিগুলি গৃহীত হয়। শ্রমিকশ্রেণির সামনে তুলে ধরার জন্য একটি ইস্তাহার তৈরির দায়িত্ব অর্পিত হয় মার্কস ও এঙ্গেলসের উপর। ১৮৪৮-এর ফেব্রুয়ারি মাসে আত্মপ্রকাশ করে ‘কমিউনিস্ট ইস্তাহার’। ইস্তাহারে ঘোষিত হল - ‘‘সর্বহারার শৃঙ্খল ছাড়া হারাবার কিছু নেই, জয় করবার জন্য রয়েছে সারা জগৎ’’। ‘‘সব মানুষ ভাই ভাই’’-এর বদলে উচ্চারিত হলো ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’। শ্রমিকশ্রেণি নতুন দিশা খুঁজে পেলেন।

১৮৪৮ সালে প্যারিস শহরে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে শ্রমিকরা ধর্মঘটে নামেন। শ্রমিকরা দাবি করেন কাজের অধিকার, জীবনযাত্রার মানের উন্নতি, বিনা বেতনে সর্বজনীন বাধ্যতামূলক শিক্ষা, বাক্ স্বাধীনতার নিশ্চয়তা। আন্দোলনের দাবিগুলির মধ্যে গুণগত পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। ৩ দিনের (২৩-২৫ ফেব্রুয়ারি) সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে পতন ঘটেছিল রাজতন্ত্রের। এটি ইতিহাসে ‘ফেব্রুয়ারি বিপ্লব’ নামে পরিচিত। অবশ্য বুর্জোয়াদের নেতৃত্বেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল অস্থায়ী সরকার। ভোটাধিকারসহ অনেকগুলি দাবি অর্জিত হয়েছিল।

কিন্তু শোষকশ্রেণি শ্রমিকদের এই সাফল্য মেনে নিতে পারেনি। ১৮৪৮-র ২৩-২৪ এপ্রিলের নির্বাচনী ফলাফল বুর্জোয়ারা মেনে নিতে পারেনি। তাই ফলাফলে কারচুপি করা হয়। ফলে অস্থায়ী বুর্জোয়া সরকারকে বিদায় দেওয়ার লড়াই শুরু হয়। মিছিল, মিটিং, জমায়েতে কেঁপে ওঠে প্যারি। শ্রমিকরা অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের ঘোষণা করে। যদিও শাসকশ্রেণি সেনাবাহিনী দিয়ে বিদ্রোহ দমন করেছিল। ১৮৪৮ সালে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব ইউরোপের দেশে দেশে পড়েছিল।

জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল। মিউনিখ সহ জার্মানির শিল্পসমৃদ্ধ শহরগুলিতে শ্রমিকরা বিদ্রোহ করেছিল। প্রুশিয়াতে গড়ে উঠেছিল কমিউনিস্ট লিগ - বার্লিন শহরে শ্রমিকরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল। বিদ্রোহীরা জয়ী হন। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর উদারপন্থী বুর্জোয়ারা বিদ্রোহী জনগণকে ধোঁকা দিয়েছিলেন। জার্মানির কোলন শহরে মার্কস-এঙ্গেলস শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করেছিলেন। আগস্ট মাসে গঠিত হয়েছিল ‘‘দি ওয়ার্কার্স ব্রাদারহুড’’। অস্ট্রিয়া, ইতালি, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরিসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে শ্রমিক আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। ফরাসি বিপ্লবের প্রভাব ইউরোপের বাইরে দেশগুলিতেও পড়েছিল।

১৮৫০-৭০ খুবই গুরুত্বপূর্ণ দুটি দশক। ১৮৫৭-৫৯ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে দেখা দেয় সঙ্কট। শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে স্বভাবতই ক্ষোভ দেখা দিল। ১৮৬১-১৮৬৫ আমেরিকায় গৃহযুদ্ধ হয়। বিদায় নেয় বর্ণবিদ্বেষী দাস প্রথা। আমেরিকা, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সসহ পৃথিবীর একাধিক দেশে শ্রমিকশ্রেণি জঙ্গি আন্দোলনে শামিল হন।

১৮৬৪ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনে বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। গঠিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক। লন্ডনের সেন্ট মার্টিন হলে প্রথম আন্তর্জাতিকের অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এই সংগঠনের নাম দেওয়া হয় ‘শ্রমজীবী মানুষের আন্তর্জাতিকের সংঘ’। উদ্বোধনী বক্তব্য রেখেছিলেন কার্ল মার্কস। প্রথম আন্তর্জাতিকের সময় মার্কস ও এঙ্গেলসকে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর ধারণা ও তত্ত্বের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছিল।

মার্কস ও এঙ্গেলসের বৈজ্ঞানিক মতবাদের প্রথম প্রতিফলন ঘটেছিল ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউনে। ১৮৭১ সালের ‘‘১৮ মার্চ প্রত্যুষে কমিউন দীর্ঘজীবী হোক এই বজ্রনির্ঘোষে প্যারিস জেগে উঠল’’। প্যারির রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেছিল মেহনতি মানুষ।

৭২ দিনের সরকার অনেকগুলি ঐতিহাসিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। বাতিল করা হয়েছিল কুখ্যাত প্যারি পুলিশবাহিনীকে। কমিউন ঘোষণা করেছিল, একমাত্র সশস্ত্র বাহিনী হবে জাতীয় রক্ষীবাহিনী ও অস্ত্রবহন করতে পারে এমন সশস্ত্র নাগরিককেই জাতীয় রক্ষীবাহিনীতে নাম নথিভুক্ত করতে হবে। ১৮৭০ সালের অক্টোবর থেকে পরের বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত সব ধরনের বসত বাড়ির খাজনা ছাড় দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল, কমিউনের কোনো সদস্য বা কর্মচারীর বেতন ৬০০০ ফ্রাঁর বেশি হবে না। ডিক্রি জারি করে কমিউন চার্চ থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করেছিল এবং ধর্মীয় কাজে সরকারি আর্থিক সাহায্য নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। অত্যাচারের প্রতীক গিলোটিন প্রকাশ্যে পোড়ানো হয়েছিল।

কমিউনের সদস্য থেকে সমস্ত ক্ষেত্রেই সরকারি কাজ চলতো শ্রমজীবীদের মজুরিতে। রাষ্ট্রের কোনো নেতৃত্ব বা প্রভাবশালী ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা প্রত্যাহার করা হয়। কমিউনের সিদ্ধান্তগুলির নির্দিষ্ট শ্রেণি চরিত্র ছিল। কমিউনের বেশিরভাগ সদস্যই ছিলেন শ্রমিক অথবা শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি। কমিউন গঠিত হয়েছিল সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে - নির্বাচিত পৌরসভার প্রতিনিধিদের নিয়ে। প্রতিনিধিদের দায়বদ্ধতা ছিল নির্বাচকদের কাছে। গঠিত হয়েছিল নতুন ধরনের রাষ্ট্র। লেনিনের কথায়: ‘‘কমিউনার্ডরা তখন সৃষ্টি করেছিলেন এক নতুন ধরনের রাষ্ট্র--শ্রমিকদের রাষ্ট্র’’।

শোষক শ্রেণি অনুধাবন করেছিল প্যারি কমিউন তাদের শ্রেণি স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে। ওরা উপলব্ধি করেছিল, প্যারি কমিউন পুঁজিবাদের উপর আঘাত হেনেছে। অতএব কমিউনকে উৎখাত করতে হবে। তাই ১৮৭১ সালের ২১ মার্চ তাদের অনুগত সেনাবাহিনী দিয়ে প্যারিস আক্রমণ করে। ভার্সাই সরকারের সেনাবাহিনী এবং জার্মান সরকারের সেনাবাহিনী দ্বারা প্যারিকে ঘিরে ফেলা হয়।

এক সপ্তাহ ধরে লড়াই হয়। ২৮ মে পতন হয় কমিউনের। নিরস্ত্র পুরুষ, মহিলা ও শিশুরাও বাদ যায়নি অত্যাচার থেকে। বর্বরতম অভিযান চলে। হত্যালীলার সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারও করা হয় অসংখ্য মানুষকে, ত্রিশ হাজার মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়, গ্রেপ্তার করা হয় প্রায় ৪৫,০০০ মানুষকে। রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়। প্যারি কমিউনের পতনের পর তিয়ের ঘোষণা করেছিলেন, ‘‘সমাজতন্ত্রকে আমরা শেষ করে দিয়েছি’’। কিন্তু সমাজতন্ত্রকে শেষ করা যায় না।

বলাবাহুল্য, প্যারির বৈপ্লবিক ঘটনাবলিতে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁরা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র থেকে অনেক দূরে অবস্থান করতেন। ব্যাঙ্ক অব ফ্রান্স কমিউনের হাতে এসে পড়ার পরও কমিউন ব্যাঙ্ক অফ ফ্রান্সের সদর দপ্তর প্যারি দখল নেয়নি। একইরকমভাবে কমিউন রেল কোম্পানির সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেনি। কৃষকদের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেনি কমিউন।

প্যারি কমিউন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও শ্রমিকশ্রেণির ভবিষ্যৎ বিপ্লবী আন্দোলনের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ পালন করেছিল। প্যারি কমিউনের গুরুত্ব অপরিসীম। প্যারি কমিউনের পঞ্চদশ বার্ষিকীতে কমিউনকে স্মরণ করে এঙ্গেলস লিখেছিলেন, ‘‘...ওরা আন্তর্জাতিককে শেষ করে ফেলার আশা করেছিল। আজ সর্বহারার আন্তর্জাতিক ঐক্য, বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব কমিউনের পূর্বের তুলনায় হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী ও সুসংহত।...’’ (ফরাসি সংবাদপত্র লা সোস্যালিস্ট-এ প্রকাশিত ২৭ মার্চ, ১৮৮৬)

মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনের গুরুত্ব বিশ্লেষণ করে লিখেছেন, ‘‘এটা হলো মূলত শ্রমিক শ্রেণির সরকার। আত্মসাৎকারী শ্রেণির বিরুদ্ধে উৎপাদক শ্রেণির সংগ্রামের ফল হলো এটা, অবশেষে আবিষ্কৃত হলো সেই রাজনৈতিক রূপ যার আওতায় শ্রমের অর্থনৈতিক মুক্তি সাধন কার্যকর করতে হবে।’’ (ফ্রান্সের গৃহযুদ্ধ)

যাঁরা ভেবেছিলেন প্যারি কমিউনকে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে শোষণ মুক্তির আন্দোলন শেষ করে দেওয়া যাবে তাদের ভাবনা যে ভুল তা বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। প্যারি কমিউনের আদর্শের মৃত্যু নেই। লেনিনের কথায়, ‘‘কমিউনের আদর্শ হচ্ছে সমাজ বিপ্লবের আদর্শ। শ্রমজীবী মানুষের সম্পূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আদর্শ। এ হচ্ছে সারা দুনিয়ার প্রলেতারিয়েতের আদর্শ। এই অর্থে কমিউনের মৃত্যু নেই’’।

প্যারি কমিউনের ১৫০ বছর। অসংখ্য ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে। রুশ বিপ্লব জন্ম দিয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের। আবার তার পতনও ঘটেছে। সোভিয়েতের পতনের পর অনেকেই আনন্দে মেতে উঠেছিলেন। কিন্তু মার্কসবাদের সত্যতা বারে বারে প্রমাণিত হয়েছে। মার্কসীয় তত্ত্ব আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। প্যারি কমিউনের আদর্শের মৃত্যু নেই। সমাজ বিপ্লবের লড়াইয়ে প্যারি কমিউনের শিক্ষাগুলি বারবার মনে রাখতে হবে।