E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৪৪ সংখ্যা / ১৮ জুন, ২০২১ / ৩ আষাঢ়, ১৪২৮

কর্মী নির্বাচনের মানদণ্ড প্রসঙ্গে জর্জি দিমিত্রফ

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


গরিব মানুষের দাবি, আন্দোলনকে দেখার সুযোগ কমে গেছে সরকারের বা কর্পোরেটের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়াগুলোতে। এমন একটা প্রেক্ষাপটে এই দেশের বামপন্থী আন্দোলন নানারকম চড়াই-উতরাইয়ের অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে চলছে। নতুন কর্মী আনা, নতুন-পুরনো সবাইকে রক্ষা করা, তাদের পাশে থেকে সাহায্য করে আরও ধারালো করে তুলে যোগ্যতা অনুযায়ী তাদের সংগঠনের কাজে যুক্ত করা - এই প্রাথমিক কাজটা কমিউনিস্ট পার্টিতে কিভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে করা সম্ভব সেই বিষয়ে জর্জি দিমিত্রফের ভাবনা এই প্রবন্ধের প্রতিপাদ্য।

১৮৮২ সালের ১৮ জুন জর্জি দিমিত্রফ (ডিমিট্রভ)’র জন্ম। বুলগেরিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন, যদিও কমিউনিস্ট নেতৃত্ব হিসাবে সারা বিশ্বে তার পরিচিতি। ১৯৪৪ সালের ৯ সেপ্টেম্বর বুলগেরিয়ার ইতিহাসে একটা গৌরবজনক দিন, কারণ ঐ দিন থেকে ঐ দেশ ফ্যাসিস্ত শাসনমুক্ত জীবন শুরু করে। সদ্য ফ্যাসিস্ট শাসনমুক্ত দেশে সেই দেশের শাসনের দায়িত্বে আসা কমিউনিস্ট পার্টির কাজকে কী ভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া উচিত সেই নিয়ে ১৯৪৬ সালের পার্টি কংগ্রেসে বক্তৃতা দেন দিমিত্রফ। কর্মী নির্বাচনের মানদণ্ড প্রসঙ্গে সেই বক্তৃতা, আরও নানা বক্তৃতার ও লেখালেখির নির্যাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে দেশে দেশে কমিউনিস্ট পার্টিগুলো তাদের দেশের কর্মী নির্বাচনের কাজে লাগাতে পারে।

দিমিত্রফ পার্টির মধ্যে থাকা সভ্যদের চারটি স্তরকে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা জরুরি বলে উল্লেখ করেন। বুলগেরিয়াতে ফ্যাসিস্ত শাসনের অবসানের দিন পর্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে পার্টির সাথে ছিলেন, দিমিত্রফের মতে এরা হলেন প্রথম স্তরের সভ্য। ঐ সময় পর্যন্ত যারা পার্টির সক্রিয় কর্মী ছিলেন না বা গেরিলা সৈন্যদলে যোগ দেবার সামর্থ্য যাদের ছিল না বা যারা জেলে কিংবা বন্দি শিবিরে যেতেও প্রস্তুত ছিলেন না অথচ যারা শ্রদ্ধাভাজন ও নিষ্ঠাবান মানুষ, যারা ‘বাইরে থেকে নিজেদের শক্তি ও সুযোগ অনুসারে’ পার্টির কাজে সাহায্য করে এসেছেন। লড়াই থেকে দূরে থাকলেও এরা ‘আন্তরিকভাবে পার্টিকে সমর্থন করেন, পার্টিকে নৈতিক ও বাস্তব সাহায্য দিতে তাদের চেষ্টা ছিল, গোপন কর্মীদের অজ্ঞাতবাসের ব্যবস্থা তারা করতেন, পার্টি যোদ্ধাদের নানাভাবে সাহায্য করা তাদের কাজ ছিল’ - এই ধরনের সভ্যদের তিনি চিহ্নিত করেছিলেন দ্বিতীয় স্তরের সভ্য হিসাবে। আর এক ধরনের সভ্য যারা ফ্যাসিস্ত আমলে ‘পার্টি থেকে নিজেদের দূরে রাখতেন। নিষ্ক্রিয় তফাতে থাকতেন, তখন তারা নিজের নিজের ব্যক্তিগত ভাবনা নিয়েই দিন কাটিয়েছেন...’। যদিও সেই সময়ে তারা পার্টি সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব দেখান নি, শত্রু দলে চলে গিয়ে তাদের সাহায্য করেন নি। এদের তিনি চিহ্নিত করেছিলেন তৃতীয় স্তরের সভ্য হিসাবে। চতুর্থ স্তরের সভ্য হিসাবে তিনি তাদের চিহ্নিত করেছিলেন, যারা ফ্যাসিস্ত জমানা শেষ হবার পরে যখন রাজনৈতিক কাজের পরিসর তৈরি হয়েছে, তখন নানা সামাজিক সংগঠনে বা রাষ্ট্রযন্ত্রে বা দলের ভিতরে বা কোনো ফ্রন্টে রাজনৈতিক কাজের সূত্রধরে সভ্য হিসাবে এসেছেন। তবে চারটি স্তরের প্রত্যেকটিতে প্রবীণ ও নবীন দুই ধরনের মানুষই আছেন বলে তিনি উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর মতে, ‘সব ধরনের সভ্যকেই যথাযোগ্যভাবে কাজে লাগানোর কথা পার্টিকে ভাবতে হবে’। পার্টির সভ্যদের নিয়ে স্তরবিন্যাস ও প্রত্যেক স্তরের সভ্যদের নিয়ে তাঁর পর্যালোচনা সারা পৃথিবীর কমিউনিস্ট পার্টিগুলোর কাছে সব স্তরের পার্টি সংগঠনে কর্মী নির্বাচনের ও তাদের বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার ও মানদণ্ড হয়ে উঠতে পারে।

তাঁর মতে কমিউনিস্ট পার্টিতে ‘এমন লোকের স্থান থাকতে পারে না যাদের মতলব হলো ব্যক্তিগত স্বার্থের সন্ধান’। দলের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস যারা জানে না, পার্টির সাধারণ নীতির যারা খবর রাখেন না ‘বাইরের থেকে ভুল পথের নির্দেশ ও মিথ্যা প্রচারের প্রভাবে তাহারা বিভ্রান্ত হতে পারেন, শত্রুদের চরদের উসকানিতে তাদের পথভ্রষ্ট হওয়া বিচিত্র নয়’। তাঁর মতে, ‘আমরা কোথায় চলেছি, কিসের জন্যে লড়ছি, পার্টি হিসাবে ও জাতি হিসাবে কোন্ লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে চাই - এই সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা থাকা চাই’। ‘যাঁদের কাজে নিপুণতা আছে তারা সাধারণত চুপচাপ থাকেন, নিজেদের আড়ালে রাখেন। আর যারা কথা সর্বস্ব তারাই নিজেদের ঠেলে সামনে আনাবার চেষ্টা করেন’। তাই তিনি নজর দিতে বলেছেন ‘যে সব কমরেড কর্মনিপুণ অথচ চুপচাপ’, ‘যারা কাজের’, ‘যারা আত্মমর্যাদাশীল নিষ্ঠাবান’ তাদের দিকে, যত্ন নিতে বলেছেন তাদের যারা ‘বিপর্যয়ের মূহুর্তেও হতবুদ্ধি হয় না, সাফল্যের মূহুর্তে যাদের মাথা ঘুরে যায় না’। “বেশ শার্প’’, “বেশ গুছিয়ে-টুছিয়ে বলতে পারে”, “বেশ অ্যাজিটেট করতে পারে” - শুধু এই গুণাবলিই কর্মী নির্বাচনের মানদণ্ড হলে তাহলে বিপদের সম্ভাবনা প্রতি মূহুর্তে। আবার শাসন ক্ষমতাতে এলেই সেই দলকে ঘিরে এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হয় যেন মনে হয় লোক আকর্ষণ করার শক্তি দেশে বা রাজ্যে আর কোনো দলের নেই। যারা এতদিন দলের সাথে ছিলেন না, তাদের মধ্যে অনেকেই অতি উৎসাহী কমিউনিস্ট হিসাবে নিজেদের জাহির করা শুরু করে দেয় যারা ‘অতীতে নিজেদের কীর্তির জন্য এখন খানিকটা অসুবিধায় পড়াতে’ অথবা ‘নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের খোঁজে’ অথবা কারো কারো উদ্দেশ্য থাকে ‘এমন কাজ জোগাড় করা যাতে নিজেদের অথবা আত্মীয়স্বজনের বিলক্ষণ লাভ থাকে’। এই জনস্রোতকে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের মুন্সিয়ানা জরুরি বলে তিনি মনে করেন। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল দেশে বা রাজ্যে ক্ষমতায় না থাকলে তার সাথে থাকা মানুষজনের সংখ্যা হুরহুর করে কমে যায়, তাদের প্রকাশ্য শত্রুরা বা বন্ধু সেজে থাকা শত্রুরা তাদের কাজে প্রশংসা করার উপাদান খুঁজে পায় না। প্রচণ্ড ঝড়ের মুখে ভাঙা বা দুর্বল নৌকার হাল ধরে থাকার মাঝি-মাল্লা গড়ে তোলার মতো শূন্য থেকে শুরু যাত্রাপথে কর্মী নির্বাচনের মানদণ্ড স্থির করতে গেলে আজও প্রাসঙ্গিক দিমিত্রফ। কারণ তিনিই বলেছিলেন দল শাসন ক্ষমতাতে না থাকলেও একদল দলের সাথেই থাকেন। এরা ‘নিজেদের সাংসারিক স্বার্থ, ব্যক্তিগত সুবিধা, এমনকি জীবন পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত’। তিনি এও বলেছিলেন, ‘পার্টিতে অনেক সমর্থ্য লোক থাকলেও তাদের শক্তির সদ্ব্যবহার হয় না’।