৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে প্রতিহত করেই জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে অগ্রসর হতে হবে
সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে আহ্বান সীতারাম ইয়েচুরির
সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণ দিচ্ছেন সীতারাম ইয়েচুরি।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ভারতকে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে আগ্রাসী হিন্দুত্বের রাজনীতির পথ ধরেছে আরএসএস-বিজেপি। এই রাজনীতি একদিকে যেমন দেশের সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ধ্বংস করছে অন্যদিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে জনগণের মননজগৎকেও। সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬ তম সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে এই কথাই বললেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি বলেন, সম্প্রতি পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের ফলাফল এই আগ্রাসী দক্ষিণপন্থী রাজনীতির দাপটেরই ইঙ্গিত দিয়েছে।
এই আগ্রাসী দক্ষিণপন্থী রাজনীতি কীভাবে সংকট-দুর্দশা থেকে মানুষের নজরকে সম্পূর্ণ সরিয়ে দিতে পেরেছে সম্প্রতি বিধানসভা নির্বাচনগুলির ফল তারই প্রমাণ। এর উল্লেখ করে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, কোভিডের সময় উত্তরপ্রদেশের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক শত শত কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয়েছিলেন। হাজার হাজার পরিবার কোভিডে মৃত তাদের প্রিয়জনের দেহকে গঙ্গায় ভাসিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে। চিকিৎসার মতো সৎকারের ব্যবস্থাও তারা করতে পারেনি। এদের মধ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠই হিন্দু। এসবের জন্য দায়ী ছিল বিজেপি সরকারই। কিন্তু মানুষ এসবের বিরুদ্ধে মত না দিয়ে আগ্রাসী দক্ষিণপন্থী হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির স্রোতে ভেসে গেছেন। তারা বলেছে মোদিই হিন্দুদের বাঁচাতে পারে। আর নির্বাচনেও জিতেছে মোদি-যোগীরা। যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং বিজ্ঞানসম্মত ইতিহাস চর্চার ওপর আঘাত না হেনে দক্ষিণপন্থার উর্বর জমি তৈরি কখনই সম্ভব নয়। আরএসএস-বিজেপি সুনিপুণভাবে সেটাই করছে। ইয়েচুরি এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, দক্ষিণপন্থার সফল রূপায়ণের জন্য দেশের শাসকশ্রেণির পাশাপাশি এই রাজনীতির পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনও জরুরি। একদিকে যেমন দেশের বড়ো বুর্জোয়াদের সমর্থন পেতেই করপোরেট ও সাম্প্রদায়িক শক্তির মধ্যে আঁতাত হয়েছে। দেশীয় সম্পদের অবাধ বেসরকারিকরণ, লুট, শ্রমিকদের অধিকার হরণের মধ্যদিয়ে লুটের ধনতন্ত্র গড়ে তোলা হয়েছে। অন্যদিকে, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির মন পেতে সর্বক্ষেত্রে উদারনীতির অবাধ প্রয়োগ চলছে। আর বিশেষকরে, আমেরিকার জুনিয়র পার্টনারে পরিণত করা হয়েছে ভারতকে।
দেশের এই বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার ব্যাখ্যা করে ইয়েচুরি বলেন, এই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে বামপন্থীরাই একমাত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে। তাই বামপন্থীরাই হিন্দুত্ববাদীদের মূল শত্রু। এ প্রসঙ্গে নরেন্দ্র মোদির সম্প্রতি একটি সাক্ষাৎকারের কথা তিনি বলেন। যেখানে, মোদি বলছেন, কমিউনিস্টরা দেশের এককোণায় কেরালায় সরকার চালালেও, এরাই মূল বিপদ। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে বামপন্থীদের শক্তিশালী মতাদর্শগত অবস্থানের জন্যই হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বামপন্থীরা প্রধান শক্তি। শুধু নির্বাচনী লড়াইয়ে নয়, গণসংগ্রাম, শ্রেণিসংগ্রামের মধ্যদিয়ে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হবে। আরএসএস’র রাজনীতি এবং তার প্রয়োগ-পদ্ধতিকে যতক্ষণ না রাজনৈতিক, মতাদর্শগত এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ করতে পারছি ততক্ষণ আমরা এগোতে পারব না। দেশের সংবিধান রক্ষার জন্য যেমন এ লড়াই লড়তে হবে, একইভাবে এ লড়াইয়ে সফল না হয়ে আমরা আমাদের পার্টি কর্মসূচিতে ঘোষিত লক্ষ্য জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যেও অগ্রসর হতে পারব না। তাই বামপন্থীদের স্বাধীন শক্তির বৃদ্ধি ছাড়া এই রাজনীতিকে প্রতিহত করা সম্ভব নয়। বামপন্থীদের ওপর মতাদর্শগত ও শারীরিক আক্রমণের সাথেই আরএসএস-বিজেপি কংগ্রেসকেও শেষ করতে চায়। কেন না কংগ্রেস বিলুপ্ত হলে বিজেপি-ই একমাত্র জাতীয় পার্টি হিসেবে থাকবে। তখন আঞ্চলিক দলগুলি বিজেপি’র ওপর আরও নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আবার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো অক্ষুণ্ণ রেখে বিজেপি’র হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রের লক্ষ্যপূরণ সম্ভব নয়। বাস্তবেও ঘটেছে তাই। ক্ষমতায় এসে বিজেপি দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার ওপরও ধারাবাহিকভাবে আঘাত হেনে চলেছে। ফলত আঞ্চলিক দলগুলির সাথে তাদের দ্বন্দ্বও বাড়বে। তাই বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াইয়ে আঞ্চলিক দলগুলিকে পাশে পাওয়াও সম্ভব।
বিগত সময়ে এনআরসি বিরোধী, কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলন এবং শ্রমিকদের আন্দোলন-ধর্মঘট সংগঠিত হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার বিরোধী এই সব আন্দোলন-সংগ্রামের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনের জন্য কৃষি আইন বাতিলের দাবি সরকার মেনে নিয়েছিল। কিন্তু এখনো তারা ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি সুনিশ্চিতিকরণ সহ অন্যান্য দাবি মানেনি। যখনই আন্দোলন-সংগ্রাম তীব্র হয়েছে তখনই গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর স্বৈরাচারী দমনপীড়ন নামিয়ে আনা হয়েছে। দানবীয় ইউএপিএ আইনের প্রয়োগ বেড়েছে। এক তথ্যের উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেন, বিজেপি জমানায় এই আইনে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৭২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মাত্র ২ শতাংশ। অন্যান্য ক্ষেত্রেও স্বৈরাচারী আক্রমণের ঘটনা বেড়েছে। সংবিধানের ৩৭০ও ৩৫-এ ধারার বিলোপ ঘটিয়ে দেশের একমাত্র মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্য জন্মু ও কাশ্মীরের বিলোপ ঘটানো হয়েছে। লাভ জিহাদ, গোহত্যা বন্ধের মতো আইন প্রণয়ন হয়েছে। এক্ষেত্রেও মূল লক্ষ্য মুসলিম জনগণই। আক্রমণ বৃদ্ধি পেয়েছে দলিত, আদিবাসী জনগণের অধিকারের ওপর, তাদের জীবন-জীবিকা ও বাসস্থানের ওপর। এর মধ্য দিয়ে সামাজিক ন্যায়ের ধারণাকে নস্যাৎ করার চেষ্টা চলছে।
উদার অর্থনীতির বেপরোয়া রূপায়ণে কোভিড মহামারীর সময়ে দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থার যে ভয়াবহ পরিণতি হয়েছে সে প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি তথ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখান যে, মহামারীকালে দেশে বুভুক্ষু মানুষের সংখ্যা ৬ কোটি থেকে বেড়ে ১৩ কোটি ৪০ লক্ষ হয়েছে। বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে ভারতের গুরুতর অবনমন ঘটেছে। বেকারি বৃদ্ধির হার ১২ শতাংশ। বেতনভুক শ্রমিক-কর্মচারীদের আয় কমেছে। রাষ্ট্রসংঘের হিসাব, ভারতে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ২০ কোটি হবে। অন্যদিকে দেশের উপরের দিকের ১০ শতাংশ মানুষের হাতে ৫৭ শতাংশ সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে। আর মাত্র ১৩ শতাংশ সম্পদ রয়েছে দেশের অর্ধেক জনগণের কাছে। এক অশ্লীল বৈষম্য প্রকট হচ্ছে।
বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থতির ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়েচুরি বলেন, পূর্ব দিকে ন্যাটোর আগ্রাসনই রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধের মূল কারণ। যখন ওয়ারশ প্যাক্টের অস্তিত্ব নেই তখন ন্যাটোকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। রুশ সীমান্তে ন্যাটোর ১ লক্ষ ৭৫ হাজার সেনা মোতায়েন রয়েছে। আসলে এ যুদ্ধ আমেরিকা/ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার। ইউক্রেন আসলে মঞ্চ মাত্র। তবে যুদ্ধে কোনো সমস্যার সমাধান হয় না। সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রতি আমেরিকার বর্তমান নীতি প্রসঙ্গে ইয়েচুরি বলেন, চীনের ব্যাপারেও আমেরিকা কৌশল পরিবর্তন করেছে। আগে চীনকে ঘিরতে চাইত, এখন তারা চীনকে বিচ্ছিন্ন করতে চাইছে। কিউবা, উত্তর কোরিয়াকে তারা সন্ত্রাসে মদতকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। আমেরিকার আগ্রাসনবাদী নীতি এবং উদার অর্থনীতির বিরোধিতা করেই লাতিন আমেরিকায় চিলি, পেরু, বলিভিয়া, ভেনেজুয়েলা, হন্ডুরাসে বামপন্থী প্রগতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এই আমেরিকার জুনিয়র পার্টনার হতে গিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে ভারতের দূরত্ব বাড়ছে। আন্তর্জাতিক অর্থনীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে শুরু হওয়া আর্থিক মন্দার কোনো সমাধান বিশ্ব পুঁজিবাদের কাছে নেই। আমেরিকা, ব্রিটেন প্রভৃতি পুঁজিবাদী দেশে স্টিমুলাস প্যাকেজ দিয়ে অর্থনীতিকে সজীব রাখার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছে। সরকারি বন্ড ভেঙে শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগ করা হচ্ছে শেয়ার মার্কেটকে চাঙ্গা রাখার জন্য। এসবের মধ্যেও সমাজতন্ত্রের সঙ্গে পুঁজিবাদ, পুঁজির সঙ্গে শ্রমের দ্বন্দ্ব সহ চারটি কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্বেরই তীব্রতা বাড়ছে বলেও তিনি মত প্রকাশ করেন।