৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে লড়াইয়ের উপযোগী শক্তিশালী পার্টি গড়ে তুলতে হবে
রাজ্য সম্মেলনে খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদন উত্থাপন করে সূর্য মিশ্রের আহ্বান
খসড়া প্রতিবেদন পেশ করছেন সূর্য মিশ্র।
‘‘সামনের দিনগুলি সংঘর্ষ ও সংগ্রামের দিন। অদম্য সাহস ও চরম আত্মত্যাগের প্রস্তুতি নিয়েই আমরা এগোব। জনগণের আস্থা,ভালোবাসা ও বিশ্বাস আমাদের পাথেয়। মানুষের ওপর অগাধ আস্থা, ভরসা রাখতেই হবে। ইতিহাস তো জনগণ রচনা করেন। সর্বহারা, আধা সর্বহারা শ্রেণি - যাদের জয় করার জন্য রয়েছে সারা দুনিয়া - তাঁরা যেমনভাবে চায়, সেইভাবে আমাদের পার্টিকে গণলাইনসম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।’’ সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬ তম সম্মেলনে পেশ করা খসড়া রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে এই আহ্বান জানানো হয়। ১৫ মার্চ সম্মেলনের সূচনা পর্বে এই প্রতিবেদন উত্থাপন করেন পার্টির বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘‘শোষণহীন এক উন্নত, সমৃদ্ধ ভারত গড়ার মূল কাণ্ডারি শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী পার্টি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)। সামনের দিনগুলিতে প্রতিকূলতার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার হিম্মত একমাত্র এই পার্টিরই রয়েছে। এই আত্মবিশ্বাসকে অবলম্বন করেই আমরা সামনের দিকে অগ্রসর হব।’’
এই প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পরিস্থিতির পাশাপাশি গণসংগ্রাম ও গণসংগ্রামের পর্যালোচনা, সংগঠন ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হয়েছে।সূর্য মিশ্র মূলত রাজ্য পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে বলেন, সামগ্রিকভাবে রাজ্যের সামাজিক-অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে পড়েছে। বিশেষকরে রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। অর্থনীতি এমন একটা জায়গায় গেছে যে, আগামীদিনে যে সরকারই আসুক না কেন বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে অর্থনীতি যে অবস্থায় ছিল সেখানে ফিরে আসা সম্ভব হবে না। ব্যাপক ঋণের বোঝা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য পরিকাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। এছাড়া সামাজিক কল্যাণমূলক কাজ, গণতন্ত্রের বিকেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ইত্যাদি সমস্ত ক্ষেত্রে বিধ্বংসী আঘাত নামিয়ে এনেছে। তিনি বলেন, আমরা পার্টির রাজ্য প্লেনামে এই সরকারের চরিত্র বিশ্লেষণ করে বলেছিলাম, এরা জনগণের ওপর ফ্যাসিস্টধর্মী আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। এখানে করপোরেটদের স্বার্থে অর্থনীতিকে ধান্দার ধনতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কেন্দ্রের সরকার যেভাবে করপোরেটদের হাতে কৃষিকে তুলে দিতে চেয়েছে, তৃণমূল সরকারও প্রথমবার শাসন ক্ষমতায় এসে একই উদ্দ্যেশ্যে নীতি প্রণয়ন করেছে। শিল্প ক্ষেত্রেও ওরা একইভাবে করপোরেট স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। এরই সর্বশেষ উদাহরণ হলো বীরভূমের দেউচা-পাঁচামিতে করপোরেটদের স্বার্থ রক্ষায় কয়লা খনির নির্মাণের জন্য আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদের চক্রান্ত করা। এখন আদানিদের এ রাজ্যে যাতায়াত বেড়ে গেছে। এখানে অর্থনৈতিক সংকট এমন জায়গায় গেছে যেখানে দেশের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় হচ্ছে ১০,২১৮ টাকা, সেখানে এরাজ্যে কৃষকরা পাচ্ছেন মাত্র ৬,৭৬২ টাকা। অথচ কেউ কেউ বলছেন কৃষকদের আয় নাকি দ্বিগুণ বেড়েছে,আবার মুখ্যমন্ত্রী বলছেন কৃষকদের নাকি তিনগুণ আয় বেড়েছে!
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, এরাজ্যে ফসলের দাম না পেয়ে কৃষকরা আত্মহত্যা করছেন, গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের ব্যাঙ্ক ঋণদানের ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। তৃণমূল সরকার সমবায় সমিতিগুলিকে ধ্বংস করেছে। এই সুযোগে গ্রামে মাইক্রো ফিনান্স কোম্পানিগুলি প্রবেশ করছে এবং কৃষকদের সর্বনাশ করছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে এ রাজ্য ছিল প্রথম স্থানে। আমাদের থেকে অনেক পিছনে ছিল গুজরাট। এখন এসব ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গ। তিনি বলেন, কেন্দ্রের উদারীকরণ নীতির ফলে সারাদেশে ৯০ হাজার স্থায়ী কর্মীকে স্বেচ্ছাবসর নিতে বাধ্য করা হয়েছে, প্রায় ৬০ হাজার ঠিকা শ্রমিক কাজ হারিয়েছেন। রাজ্য সরকার পরিচালিত রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলির পরিণতিও একই। মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ ছিল একাদশ স্থানে, এখন তা নেমে হয়েছে চতুর্দশ স্থানে। দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ইত্যাদি চরম জায়গায় গেছে। এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করলেই আক্রমণ নেমে আসছে। সরকারি কর্মচারী থেকে পুলিশ - কেউই এই আক্রমণ থেকে রেহাই পাচ্ছেন না। পৌর নির্বাচনের পর তাহেরপুরের ওসি-কে বদলি এর অন্যতম প্রমাণ।
খসড়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কৃষিতে সংকটের ফলে গ্রামেও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মোদি সরকারের দেখানো পথেই এরাজ্যেও তৃণমূল কংগ্রেস সরকার অসংগঠিত শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি কমিয়ে দিয়েছে। শ্রমিকদের মজুরি ও অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার অধিকার খর্ব হচ্ছে। শ্রমিকদের ছাঁটাই ও বদলি বা অন্যান্য দমনমূলক কাজের বিরোধিতা বা মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলন করলেই হামলা-মামলা-বদলি-সাসপেনশন ইত্যাদি শ্রমিক-কর্মচারী বিরোধী পদক্ষেপ গ্রহণ করছে মালিক বা কর্তৃপক্ষ তৃণমূলীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদতে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, আয় ও কর্মসংস্থান বিপজ্জনকভাবে কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের মধ্যে জীবন-জীবিকার বিষয়ে ন্যূনতম আশার বদলে হতাশা বাড়ছে। সূর্য মিশ্র উল্লেখ করেছেন, অধিকার আদায়, স্থায়ী আয় ও সম্পদ সৃষ্টির পরিবর্তে বিভিন্ন সরকারি অনুদান প্রকল্পের নামে যে সস্তা জনপ্রিয় পদক্ষেপগুলি এ রাজ্যে নেওয়া হয়েছে সেসব উল্লেখযোগ্য অংশের জনগণকে আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। এই সমস্ত পদক্ষেপগুলির ক্ষেত্রে আমাদের ইতিবাচক হস্তক্ষেপ দরকার। জনমোহিনী এই সমস্ত পদক্ষেপ সম্পর্কে মানুষকে অনেক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। মানুষের অভিজ্ঞতাই শেষ কথা। এই সময়ে আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ হলো মানুষের অধিকারবোধের চেতনাকে ফিরিয়ে আনা।
প্রতিবেদনে রাজ্যের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্তের কথা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ২০১৯’র লোকসভা নির্বাচনের পর রাজ্যের পরিস্থিতি কঠিন হওয়া এবং পরিস্থিতির আরও জটিলতা হলো বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে কোণঠাসা করতে তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র মধ্যে বোঝাপড়ার বাইনারি। আরও উল্লেখ করা হয়েছে ,২০১৮ সালের পর থেকে রাজ্যের জনগণের জীবনযাত্রা, চিন্তার জগতে এবং সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশে ক্রমাগত দক্ষিণপন্থী ও স্বৈরতান্ত্রিক আক্রমণ চালিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস এবং সহযোগীর ভূমিকা নেয় আরএসএস-বিজেপি। সূর্য মিশ্র বলেছেন, ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে বিপুল সংখ্যক আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয় শাসকদলের প্রার্থীরা। বেশিরভাগ জায়গাতেই মানুষকে ভোট দিতে দেওয়া হয়নি। এই নজির দেখা গেছে সর্বশেষ কলকাতা কর্পোরেশন ও বিভিন্ন জেলায় পৌর নির্বাচনে।
তিনি বলেন, রাজ্যের শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আজ ধ্বংসের পথে। কোভিড পরিস্থিতিতে মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে ছাত্রছাত্রীদের। যাদের পয়সা আছে তারা অবস্থা সামাল দিতে পেরেছে। কিন্তু দীর্ঘ দু’বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পিছিয়ে গেছে ব্যাপক অংশের ছাত্রছাত্রীরা। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও সুনির্দিষ্ট ভূমিকা নিতে হবে।
তিনি আরও বলেছেন,কোভিড পরিস্থিতিতে আমরা বিকল্প উদ্যোগ নিয়েছি। এলাকা দূষণমুক্ত করা, মাস্ক ও সুরক্ষা সামগ্রী ও খাদ্য সামগ্রী বণ্টন ইত্যাদি নানা কাজ করেছি। রাজ্যজুড়ে রেড ভলান্টিয়াররা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছেন। এই অভিজ্ঞতাই দেখিয়ে দেয় আমরা কেবল একটা বিকল্পের জন্য লড়াই করি না, সেই বিকল্প আমরা দিতে পারি। করোনা অতিমারীর প্রাথমিক পর্বে আমাদের কিছুটা আড়ষ্ঠতা ছিল, কিন্তু পরবর্তীতে আমরা তা কাটিয়ে উঠে বিপন্ন মানুষের স্বার্থে রাস্তায় নেমেছি। সাধারণ মানুষের স্বার্থে রাজ্য সরকারের যে সমস্ত দাবি তোলা উচিত ছিল, আমরাই সেসব তুলে ধরেছি। সেই সময়ে আমরা লালবাজার অভিযান করেছি।তখন এমন কোনো জেলা নেই যে আমাদের নেতা-কর্মীরা আক্রান্ত হননি। সমাজের ব্যাপক অংশের মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। সাধারণ মানুষ থেকে সরকারি কর্মচারী কেউই রেহাই পাচ্ছেন না। কেউ মাথা তুলে দাঁড়ালেই শাসকদলের আক্রমণের শিকার হতে হচ্ছে। কমরেড বাদল শেখ নভেম্বর বিপ্লব উপলক্ষে লাল ঝান্ডা তুলতে গেছিল,তাঁকে খুন হতে হলো।
সূর্য মিশ্র পঞ্চায়েত, লোকসভা, বিধানসভা ইত্যাদি নির্বাচনে বিপর্যয়ের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলেন,আমাদের নির্দিষ্ট ইস্যু ঠিক করে পরিকল্পনার মাধ্যমে তা জনগণের ইস্যুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। আনিস হত্যাকাণ্ডে আজও রহস্যের কিনারা হলো না। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে ছাত্র-যুবদের লড়াই চলছে। আমাদের প্রচার আন্দোলনে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। তেমনি বুথ স্তরে সংগ্রাম-আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দুর্বলতা থাকছে। বুথস্তরে গিয়ে রাজ্যস্তরের বা দিল্লির দাবি নয়, স্থানীয় ও আদায়যোগ্য দাবিতে কেন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারব না? এপ্রসঙ্গে তিনি দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সাফল্যের উল্লেখ করে বলেন, তাঁরা যদি বছরভর আন্দোলন করে দাবি আদায় করতে পারে, তবে আমরা কেন পারব না পঞ্চায়েতে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যেতে।
তিনি পার্টিতে মহিলা ও তরুণদের বেশি বেশি করে নিয়ে আসা এবং রেড ভলান্টিয়ারদের অন্যান্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করে তাদের পার্টিতে অন্তর্ভুক্ত করা, সর্বোপরি পার্টিকে নিষ্ক্রিয়তা মুক্ত করার আহ্বান জানিয়ে বলেন, পার্টিকে যে কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। আনিস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র-যুবরা রাজ্যজুড়ে এক কোটি স্বাক্ষর সংগ্রহ করছে। দেউচা-পাঁচামিতে আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করে করপোরেটদের স্বার্থে কয়লা খনি তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে রাজ্য সরকার। এর বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলন চলছে, তবে এই আন্দোলনে আমরা প্রধান শক্তি নই। ওখানে মহিলারাও আন্দোলন করছেন,আরও অনেক সংগঠন রয়েছে। ওরা যা দাবি উত্থাপন করছে আর আমরা যে দাবি করছি তা এক। তাই এই একই দাবিতে সবাইকে নিয়ে ব্যাপকতর আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আজকে ব্যাপকতর আন্দোলনের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে জনগণের আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে হবে আমাদের।
পরিশেষে সূর্য মিশ্র বলেন, সামনের দিনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার শক্তি আমাদের পার্টিরই আছে, তবে নিজস্ব স্বাধীন শক্তি একটা বড়ো ব্যাপার। পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতিতে তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে যারা লড়াই করতে চায় তাদের একসাথে সংগ্রামের ময়দানে নিয়ে আসতে হবে। বর্তমান সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ভাষা পাল্টাতে হবে, পরিস্থিতি পরিবর্তনের লক্ষ্যে লড়াই করার ক্ষমতা অর্জনের উপযোগী পার্টি সংগঠনকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে।