E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮

সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব

মোদি সরকারের জনবিরোধী জাতীয় স্বার্থবিরোধী আর্থিক নীতির প্রতিবাদে

২৮-২৯ মার্চ দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট সফল করুন


কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং কর্মচারীদের জাতীয় ফেডারেশনগুলি আহুত আগামী ২৮-২৯ মার্চের দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটকে সর্বাত্মক সফল করার আহ্বান জানালো সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন। এ সম্পর্কিত প্রস্তাব সম্মেলনে সর্বসম্মতিতে গৃহীত হয়েছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন প্রস্তাবটি আনুষ্ঠানিকভাবে পেশ করেন অনাদি সাহু। সমর্থন করেন অমল হালদার। সম্পূর্ণ প্রস্তাবটি নিচে দেওয়া হলো।


মোদী সরকারের সর্বনাশা উদার আর্থিক নীতিতে দেশ ও দেশের মানুষ বিপন্ন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ক্রমবর্ধমান সংকটের ফলে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে এর ভয়ংকর প্রভাব পড়েছে। আকাশছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র বেকারি, কর্মহীনতা, মজুরি হ্রাস, ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমবর্ধমান, ৮৬ শতাংশের বেশি মানুষের আয় কমেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, রেগা, কৃষি, সেচ সমস্ত সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের বিনিয়োগ কমছে, জনগণের ওপর করের বোঝা দিন দিন বাড়ছে, করপোরেট ট্যাক্স কমছে। কোভিড পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার আর্থিক সংস্কারের নামে জাতীয় স্বার্থ ও দেশবিরোধী পদক্ষেপ নিয়ে চলছে। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকা দারুণভাবে আক্রান্ত। করপোরেট পুঁজির অবাধ শোষণের স্বার্থে বহু সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকার হরণের উদ্দেশে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির মতামতকে উপেক্ষা করে, সংসদে আলোচনা ছাড়াই দে‍‌শের প্রচলিত ২৯টি শ্রম আইন বাতিল করে ৪টি শ্রমকোড তৈ‍‌রি করা হয়েছে। যার মধ্যে দিয়ে শ্রমিকশ্রেণিকে কার্যত ক্রীতদাসে পরিণত করতে চায়। একইভাবে ভীষণভাবে আক্রান্ত দেশের কৃষক সমাজ এবং সাধারণ মানুষ। বিপরীত দিকে সরকারি মদতে বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেট সংস্থাগুলির মুনাফা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে সমগ্র কৃষি ব্যবস্থা‌য় কর্পোরেটের অবাধ শোষণ কায়েম করতে পুরানো কৃষি আইন সংশোধন করে তিনটি কৃষি আইন তৈরি করেছিল যার বিরুদ্ধে কৃষক সংগঠনগুলি ঐক্যবদ্ধভাবে এক বছর প্রতিরোধ আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ও কৃষক বিরোধী এই তিনটি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে। যদিও ফসলের লাভজনক দামের নিরাপত্তামূলক আইন তৈরি বা জনবিরোধী বিদ্যুৎ বিল বাতিল হয়নি, তাই কৃষকরা অবরোধ থেকে ঘরে ফিরে গেলেও লড়াই অব্যাহত রেখেছে। এই ঘটনা প্রমাণ করেছে লড়াই প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদি সরকারকে পিছু হটতে বাধ্য করা যায়।

নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার প্রধানত ৫টি ক্ষেত্রে নব্য উদারনীতির নগ্ন আক্রমণ কেন্দ্রীভূত করেছে। এগুলি হলো -
১। জনগণের ওপর আর্থিক সংকটের বোঝা বৃদ্ধি, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি ও অসহনীয় বেকার সৃষ্টি করা।
২। সামাজিক কল্যাণমূলক খাতে সরকারের ব্যয় বরাদ্দ হ্রাস।
৩। রাষ্ট্রা‌য়ত্ত সংস্থার বিলগ্নিকরণ, বিরাষ্ট্রীয়করণ এবং বিলুপ্তিকরণ।
৪। দেশি-বিদেশি করপোরেট সংস্থাগু‍লিকে বিপুল পরিমাণে কর ছাড় ও সুবিধা প্রদান।
৫। অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ ও স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রগুলিতে নির্বিচারে বিদেশি পুঁজির প্রবেশের অনুমতি প্রদান।

সরকারি তথ্য থে‍কে জানা গেছে যে, শিল্প উৎপাদনের সূচক ক্রমাগত কমেছে, ভারতের রপ্তানিও কমেছে। বেড়েছে মার্কিন ডলারের বিনিয়োগ। যার সিংহভাগই শেয়ার বাজারে, উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে নয়। নয়া উদারবাদী আর্থিক নীতির মূল দর্শনই হলো বেসরকারিকরণ। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলির জাতীয় সম্পদ, পরিকাঠামো, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর থেকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ হটিয়ে দিয়ে দেশ-বিদেশের বৃহৎ পুঁজি নিয়ন্ত্রিত করপোরেট সংস্থার হাতে তুলে দেবার ব্যবস্থা চলছে। ওই নীতি প্রতিফলিত হচ্ছে বেপরোয়া বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে। বাদ যাচ্ছে না প্রতিরক্ষা, ব্যাঙ্ক, বিমা, রেল, বিমানবন্দর, বিএস‍‍এনএল, কয়লাখনি, বিদ্যুৎ, পোর্ট-ডক, ইস্পাত, পেট্রোলিয়াম, সরকারি পরিবহণ ইত্যাদি সরকার নিয়ন্ত্রিত শিল্প সংস্থাগুলি, দেশের সরকারি জমি, জল সম্পদ, বনজ সম্পদ, অরণ্য, সড়ক থেকে ব্রিজ, বন্দর থেকে ডক, সরকারি বিদ্যালয় থেকে কলেজ, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, হাসপাতাল বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। সম্প্রতি মোদি সরকার ন্যাশনাল মনিটাইজেশন পাইপলাইন প্রকল্পের কথা ঘোষণা করেছে এবং ওই প্রকল্পের মাধ্যমে কার্যত নামমাত্র মূল্যে দে‍‌শের যাবতীয় পরিকাঠামো ক্ষেত্র প্রাইভেট করপোরেটদের হাতে তুলে দেবার প্রক্রিয়া শুরু করেছে। বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে দেশের রাষ্ট্রীয় শিল্পগুলি জাতীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। বিপুল পরিমাণে সম্পদ সৃষ্টি করে সরকারের কোষাগারকে শক্তিশালী করছে। নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে, দেশের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিকাশ ঘটাতে সাহায্য করেছে। তাসত্ত্বেও দেশের বর্তমান সরকার বৃহৎ পুঁজি ও করপোরেট সেবায় রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির অবসান ঘটাতে সক্রিয়।

মোদি সরকারের নীতিতে ভয়ংকরভাবে আক্রান্ত শ্রমিকশ্রেণির অর্জিত অধিকার। দেশের কৃষক সমাজও ভয়ংকরভাবে আক্রান্ত। আক্রান্ত সমাজের সব অংশের দরিদ্র সাধারণ মানুষও। এসব মেনে নেয়নি দেশের শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। প্রতিরোধের কর্মসূচিতে শামিল হয়েছেন দেশের কোটি কোটি শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ। বিপরীত দিকে সামাজিক অস্থিরতা, হিংসা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস আর সাম্প্রদায়িক ঘৃণার আবহ সৃষ্টি করে আরএসএস, বিজেপি ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতি করছে। দেশের গণতান্ত্রিক বিধি-ব্যবস্থা ও জনগণের অধিকারগুলির ওপর আক্রমণ করছে। স্পষ্টতই ফ্যাসিবাদী কর্তৃত্ববাদী ও বিভাজনমূলক আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠেছে।

দেশবিরোধী মোদী সরকারের কর্তৃত্ববাদী আক্রমণাত্মক নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রামকে আরও প্রসারিত করার প্রয়োজন উপলব্ধি করেই দেশের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন ও সর্বভারতীয় কর্মচারী ফেডারেশনগুলি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মোদী সরকারের সর্বনাশা নীতির প্রতিবাদ এবং শ্রমজীবী সাধারণ মানুষের জরুরি ১২ দফা দাবি নিয়ে ২৮-২৯ মার্চ, ২০২২ তারিখে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে। সর্বভারতীয় কৃষক সংগঠনগু‍‌লিও গ্রাম ভারত বন্ধের ডাক দিয়েছে। ওই ধর্মঘট সফল করতে পশ্চিমবঙ্গের কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নসমূহ ও ফেডারেশনগুলির যুক্ত কনভেনশন থেকে প্রচার ও ধর্মঘটের প্রস্তুতি চালাচ্ছে। কৃষক খেতমজুর সংগঠনগুলিও প্রচারে নেমেছে। ধর্মঘটের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে অন্যান্য গণসংগঠনগুলি। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র সংগঠিত ও অসংগঠিত ক্ষেত্রে কলকারখানায় শহর ও গ্রামাঞ্চলে প্রচার অভিযান চলছে। কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির প্রতিবাদে এবং সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনে রাজ্যে আগামী ২১-২২ মার্চ জেলায় জেলায় আইন অমান্য, জেল ভরো কর্মসূচি, ২৪ মার্চ কলকাতায় আইন অমান্য, জেলভরো কর্মসূচির আহ্বান জানানো হয়েছে। শ্রমিক কৃষক সংগঠনগুলির ডাকা আইন অমান্য ও ২৮-২৯ মার্চের সাধারণ ধর্মঘট সফল করতে সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬তম সম্মেলন আহ্বান জানাচ্ছে।

সাধারণ ধর্মঘটের দাবিসমূহ -

(১) ‘শ্রম কোড’ এবং ‘এসেনসিয়াল ডিফেন্স সার্ভিসেস অ্যাক্ট’ বাতিল করতে হবে।
(২) সরকারি সংস্থা, ব্যাঙ্ক, বিমা সহ সব রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারিকরণ বন্ধ করো।
(৩) আইসিডিএস সহ বিভিন্ন প্রকল্প কর্মীদের ন্যূনতম মজুরি ও সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প চালু করতে হবে।
(৪) বিভিন্ন প্রকল্পের ঠিকা কর্মীদের স্থায়ীকরণ সাপেক্ষে স্থায়ী শ্রমিকদের মতন বেতন দিতে হবে।
(৫) আয়করের বাইরে থাকা সকল নাগরিকদের মাসে নগদ ৭৫০০ টাকা দিতে হবে এবং বিনামূল্যে রেশন দিতে হবে।
(৬) সকলের জন্য সামাজিক সুরক্ষা দিতে হবে।
(৭) পেট্রোল-ডিজেলের দাম কমাতে কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক কমাতে হবে।
(৮) নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দাম কমাতে হবে।
(৯) জাতীয় পেনশন প্রকল্প বাতিল করতে হবে। প্রবীণদের পেনশন চালু করতে হবে। ন্যূনতম পেনশন যথেষ্ঠ পরিমাণে বৃদ্ধি করতে হবে।
(১০) কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় বাজেটে আরও ব্যয়-বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
(১১) অতিমারী সময়ে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যাঁরা কাজ করছেন, তাঁদের জন্য সুরক্ষা এবং পেনশন চালু করতে হবে।
(১২) মনরেগা প্রকল্পে বিনিয়োগ বৃদ্ধি করো এবং তা শহরেও লাগু করো।