৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
বিএসএনএল বাঁচাও, জাতিকে বাঁচাও
দাবিতে বিএসএনএল কর্মীরা ২৮-২৯ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটে শামিল হবেন
শিশির রায়
কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলিকে হত্যা ও বিক্রি করা এবং দেশের সম্পদ লুঠ করতে বড়ো করপোরেটদের সাহায্য করাই নরেন্দ্র মোদি সরকারের অর্থনৈতিক নীতির বৈশিষ্ট্য। টেলিকম ক্ষেত্রেও এই অর্থনৈতিক নীতি সফলভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে। ১৯৯১ সালে যখন নরসিমা রাও সরকার ভারতে নয়া উদার অর্থনীতি চালু করেছিল, তখন সরকার টেলিকম সেক্টরেও ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। প্রবর্তিত হয় জাতীয় টেলিকম নীতি - এনটিপি-১৯৯৪।
এই নীতি চালুর আগে সরকার একাই টেলিযোগাযোগ পরিষেবা প্রদান করত। কিন্তু জাতীয় টেলিকম নীতি- ১৯৯৪ অনুসারে বেসরকারি সংস্থাগুলিকেও টেলিযোগাযোগ পরিষেবা প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। যদিও সরকার ব্যাখা দিয়ে বলেছিল যে, বেসরকারি সংস্থাগুলি চাহিদা অনুযায়ী টেলিফোন সংযোগ দেওয়ার জন্য তাদের প্রচেষ্টার পরিপূরক হবে এবং আরও বলেছিল যে, ন্যূনতম মূল্যে বিশ্বমানের পরিষেবা প্রদান করা এর লক্ষ্য হবে। কিন্তু এনটিপি-১৯৯৪’র আসল উদ্দেশ্য ছিল, ভারতীয় টেলিকম সেক্টরকে প্রাইভেট করপোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পদক্ষেপ সরকারের আসল উদ্দেশ্য উন্মোচন করেছে।
১৯৯৫ সালে বেসরকারি সংস্থাগুলি মোবাইল পরিষেবা শুরু করে। এটি ছিল ভারতে মোবাইল যুগের সূচনা। তবে ওই সময়ে সরকারি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ডিওটি-কে মোবাইল পরিষেবা চালুর সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয়। দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে ২০০২ সালে বিএসএনএল-কে মোবাইল পরিষেবা শুরু করার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছিল। বিএসএনএল-কে মোবাইল পরিষেবা চালু করার অনুমতি দিতে দীর্ঘ সাত বছরের এই বিলম্ব বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলিকে লাভবান করার জন্য একটি সচেতন পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
১৯৯৫ সালে বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলিকে লাইসেন্স দেওয়ার সময় তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী সুখরাম ঘোষণা করেছিলেন যে, সরকার লাইসেন্স ফি হিসাবে ১২,৫০০ কোটি টাকা রাজস্ব পাবে। কিন্তু ১৯৯৫ থেকে ১৯৯৯ সালের মধ্যে বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলোর লাইসেন্স ফি অত্যাধিক ধার্য করা হয়। এই অজুহাতে তারা বেশিরভাগ লাইসেন্স ফি পরিশোধ করেনি - বাজপেয়ী নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বিজেপি সরকারকে লাইসেন্স ফি পরিশোধ করেনি। তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী ফি না দিলে তাদের লাইসেন্স বাতিল করার হুমকি দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করেননি। এরপরে হাজার হাজার কোটি টাকার পুরো লাইসেন্স ফি’র বকেয়া মকুব করা হয়। এরপর সরকারি নীতি পরিবর্তন করে লাইসেন্স ফি বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলির রাজস্বের সামান্য সংশোধন ধার্য করা হয়। এই বড়ো ছাড়ের পাশাপাশি, বাজপেয়ী সরকার বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলির রাজস্বের সামান্য শতাংশ ধার্য করে। এই কর ছাড়ের পাশাপাশি বাজপেয়ী সরকার বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলিকে তাদের রাজস্ব সংগ্রহকে ছোটো করার অনুমতি দেয় এবং এরফলে বকেয়া লাইসেন্স ফি প্রদানে তারা সরকারকে প্রতারণা করে। এইভাবে কংগ্রেস সরকারের যুক্তি বেসরকারি দরদি নীতিগুলি বাজপেয়ীর বিজেপি সরকার সতর্কতার সাথে এগিয়ে নিয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার টেলিকম সেক্টরে বিশ্বায়নের নীতিগুলিকে আরও জোরালোভাবে প্রয়োগ করেছে।
ভিএসএনএল - একটি পাবলিক সেক্টর কোম্পানি যা বিদেশি যোগাযোগ প্রদান করত। সেই বিদেশ সঞ্চার নিগম লিমিটেডকে টাটার কাছে ১,৪১৫ কোটি টাকা মূল্যে বিক্রি করা হয়েছিল। আজ সমগ্র বিদেশি যোগাযোগ বেসরকারি টেলিকম কোম্পানি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এবং এতে সরকারি ক্ষেত্রের কোনো অংশিদারিত্ব নেই। বাজপেয়ী সরকার এবং পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার একের পর এক বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলির পক্ষে নীতি প্রণয়ন করে এবং বিএসএনএল-কে তাদের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে বাধা দেয়। তারা সচেতনভাবে বিএসএনএল’র বৃদ্ধিকে বাধাদান করেছে। এমনকী একের পর এক অজুহাতে বিএসএনএল’র নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়নি। বেসরকারি টেলিকম কোম্পানিগুলিকে পরিস্থিতির সুবিধা নিতে এবং মোবাইল পরিষেবার বাজার সম্প্রসারণ ও সফল করার সুযোগ করে একটি সংকটের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রী মোদির নেতৃত্বাধীন বর্তমান বিজেপি সরকার বিএসএনএল-কে নির্মূল করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বিএসএনএল’র নন-এক্সিকিউটিভ ও এক্সিকিউটিভ এবং ট্রেড ইউনিয়নগুলির বারংবার দাবি সত্ত্বেও বিজেপি সরকার বিএসএনএল-কে ৪জি প্রযুক্তি ব্যবহার থেকে অনেকদিন বঞ্চিত করে রেখেছে। প্রকৃতপক্ষে, বর্তমান সরকার সমগ্র টেলিকম সেক্টরকে মুকেশ আম্বানির হাতে তুলে দিয়েছে। আজ রাষ্ট্রায়ত্ত বিএসএনএল এবং দিল্লি ও মুম্বাইতে এমটিএনএল ছাড়াও দেশে মাত্র তিনটে বেসরকারি টেলিকম সংস্থা ২০ শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ শুল্ক বাড়িয়েছে। একবার বিএসএনএল শেষ হয়ে গেলে তারা ইচ্ছে মতন শুল্ক বাড়াবে। এবং সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে। মহামারীর পর্বে স্পষ্ট হয়েছে যে, কীভাবে গ্রামীণ এলাকায় দরিদ্র পরিবারের শিশুরা খারাপ ইন্টারনেট সংযোগের এবং পরিষেবা উচ্চমূল্যের শুল্কের কারণে অনলাইন ক্লাস করার জন্য ইন্টারনেট পরিষেবা অ্যাক্সেস করতে সক্ষম হয়নি। তাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়ন এবং ফেডারেশনগুলির আহ্বানে যৌথভাবে ১২দফা দাবির সঙ্গে বিএসএনএল’র নিজস্ব ৫ দফা জ্বলন্ত দাবিতে দেশব্যাপী ২৮ ও ২৯ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটে বিএসএনএল’র নিয়মিত ও অনিয়মিত কর্মচারীরা শামিল হবেন।
৫ দফা দাবি হলোঃ
(১) বিএসএনএল’র সর্বত্র ৪জি চালু সহ ৫জি প্রযুক্তিযুক্ত পরিষেবা প্রদানের নিশ্চয়তা।
(২) অবিলম্বে ১ জানুয়ারি ২০১৭ থেকে বেতনচুক্তি ও পেনশন রিভিশন চালু।
(৩) বিএসএনএল’র জমি বাড়ি সম্পত্তি, কেবল টাওয়ার বিক্রির প্রস্তাব বাতিল করতে হবে কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিএসএনএল’র ম্যানেজমেন্টকে।
(৪) ঠিকাকর্মীদের বকেয়া বেতনসহ ছাঁটাই কর্মীদের পুনর্বহাল।
(৫) ক্যাজুয়াল কর্মীদের ৭ম বেতন কমিশনের সুপারিশ লাগু করা।
[লেখকঃ বিএসএনএল কো-অর্ডিনেশন কমিটির রাজ্য সভাপতি।]