৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
পার্টিকে আরও শক্তিশালী করে গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে অনুষ্ঠিত হলো সিপিআই(এম) বিহার রাজ্য ২৩তম সম্মেলন
বিহার রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে প্যাটেল ময়দানমুখী মিছিল।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ৬ থেকে ৮ মার্চ সমস্তিপুরে অনুষ্ঠিত হলো সিপিআই(এম) বিহার রাজ্য ২৩তম সম্মেলন। সমস্তিপুর হলো সেই বীর শহিদ ভূমি যা সত্তরের দশক থেকে সামন্ততান্ত্রিক শোষণের বিরুদ্ধে লাল ঝান্ডা হাতে বামপন্থী কর্মীদের জীবন বাজি রেখে লড়াইয়ের ইতিহাস সমৃদ্ধ।
প্রকাশ্য সমাবেশ পর্ব
সম্মেলনের প্রকাশ্য সমাবেশ অংশ নিতে সমস্তিপুর জেলায় যে সমস্ত গ্রামে শ্রেণি শত্রুদের হাতে পার্টি কমরেডরা খুন হয়েছেন, সেই প্রতিটি গ্রাম থেকেই ‘শহিদ যাত্রা’ এসে একটি সুবিশাল মিছিলে জড়ো হয় সমস্তিপুর শহরে। এই ঐক্যবদ্ধ মিছিল পরে পৌঁছায় প্যাটেল ময়দানে। সম্মেলন উপলক্ষে গোটা সমস্তিপুর শহর জুড়ে ছিল লাল ব্যানার, ফেস্টুন, পতাকার সজ্জা এবং পার্টির স্লোগান লেখা দেয়াল লিখন।
প্রকাশ্য সমাবেশের মধ্যদিয়ে সম্মেলনের শুরু হয় প্যাটেল ময়দানে। ব্যাপক সংখ্যায় পার্টি কর্মীদের মিছিল দৃঢ় পদক্ষেপে শহরের বিভিন্ন রাস্তা পরিক্রমা করে রক্ত পতাকা হাতে নিয়ে পৌঁছে যায় ময়দানে। দৃপ্ত স্লোগান উচ্চারণের মধ্যদিয়ে শহিদ স্মরণে আনীত রক্ত পতাকা তুলে দেওয়া হয় পার্টি রাজ্য সম্পাদক অবধেশ কুমারের হাতে।
বিহার রাজ্য সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত সভায় বক্তা সীতারাম ইয়েচুরি।
সমাবেশে তাঁর বক্তব্যে পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। দেশের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কেন্দ্রে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার তাদের গত সাত বছরের অপশাসনে দেশের সমস্ত অংশের মানুষের উপর অভূতপূর্ব দুর্দশা নামিয়ে এনেছে। অর্থনীতি সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খল, দেশে বেরোজগারি গত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ, পরিবহণের জ্বালানি তেল এবং গ্যাসের দাম বাড়ার জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম রকেটের গতিতে ঊর্ধ্বমুখী, এসমস্ত সাধারণ মানুষের জীবনজীবিকাকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
তিনি আরএসএস’র হিন্দুত্বের কর্মসূচিকে প্রতিহত করার লড়াইতে সমস্ত বামপন্থী ধর্মনিরপেক্ষ এবং গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার ওপর জোর দিয়ে বলেন, সংবিধানে বর্ণিত দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা এবং গণতান্ত্রিক চরিত্রকে রক্ষা করতে হবে ঐক্যবদ্ধভাবেই লড়াই করে।
সাম্রাজ্যবাদবিরোধী লড়াইয়ে জড়িত সমস্ত অংশের ওপরই লাগাতার আক্রমণ নামিয়ে আনছে আরএসএস এবং তার শাখা সংগঠনগুলি। প্রতি পদক্ষেপে এই আক্রমণ প্রতিহত করতে হবে।
দিল্লিতে কৃষকদের ঐতিহাসিক বিজয়কে স্বাগত জানিয়ে সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ১৩ মাস ধরে প্রকৃতির ভ্রূকুটিকে উপেক্ষা করে চলা কৃষক আন্দোলন বিজেপি’কে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করেছে। বিজেপি’র অচলায়তনকে পরাস্ত করতে শ্রমিক এবং কৃষকদের শ্রেণি ঐক্য গড়ে তুলে লড়াইকে জোরদার করতে হবে। রাজ্যের বর্তমান এনডিএ সরকারের বিকল্প মানুষদের সামনে তুলে ধরতে তিনি বিহারের খেটে খাওয়া মানুষকে নিয়ে শ্রেণি আন্দোলন এবং গণআন্দোলন তীব্র করতে আহ্বান জানান।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুজ সাথী হিসেবে ভারত সরকারের ভূমিকার তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, এই আঁতাত প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলি থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করেছে এবং ভারতের যে স্বাধীন কণ্ঠস্বর পৃথিবীতে পরিচিত ছিল তা রুদ্ধ করেছে। তিনি ইউক্রেনে আটকে থাকা ২০ হাজার ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার বিষয়টি তুলে ধরে তীব্র নিন্দা করেন।
সমাবেশে উপস্থিত পার্টির পলিট ব্যুরোর সদস্য এবং এআইকেএস’র জাতীয় সভাপতি হান্নান মোল্লা তাঁর বক্তব্যে ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের সাধারণ মঞ্চে ৫০০টি কৃষক সংগঠনকে ঐক্যবদ্ধ করার মধ্য দিয়ে অর্জিত সাফল্যের বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন।
তিনি বলেন, এই কৃষক আন্দোলন বিজেপি সরকারকে তিনটি দানবীয় কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য করেছে। এই অভূতপূর্ব কৃষক আন্দোলন শ্রমিক শ্রেণির সমর্থন এবং সহমর্মিতা পেয়েছে আগাগোড়া। শ্রমিক-কৃষকের এই ঐক্য আরো মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে আন্দোলনের মাধ্যমে আরএসএস’র নয়া উদারবাদী নীতিসমূহ এবং সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী কর্মসূচির রুপায়ণ প্রত্যাহার করাতে।
সমাবেশে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিদায়ী রাজ্য সম্পাদক অবধেশ কুমার, অরুণ কুমার মিশ্র, প্রমুখ। তাঁরা তাঁদের বক্তব্যে পার্টিকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানান।
প্রতিনিধি অধিবেশন পর্ব
সমাবেশের পর প্রতিনিধিরা গণেশ শংকর বিদ্যার্থীর নামে অভিহিত সম্মেলনস্থলে প্রবেশ করেন। সম্মেলন উপলক্ষে এই সম্মেলনস্থল শহিদ কমরেডদের প্রতিকৃতি এবং ফুল ও ব্যানার-পোস্টারের মাধ্যমে সুসজ্জিত করা হয়।
সম্মেলনস্থলের বিভিন্ন জায়গায় শহিদ স্মরণে তৈরি অস্থায়ী খিলানে বর্ণনা রয়েছে সিপিআই(এম) যে উপনিবেশ বিরোধী সংগ্রামে বিপ্লবী ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক এবং জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব গড়ে তোলার লক্ষ্য পূরণে এগিয়ে চলেছে সে প্রসঙ্গের।
সম্মেলনের এই পর্বে রক্ত পতাকা উত্তোলন করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। এরপর প্রতিনিধিরা ফুল দিয়ে শহিদ স্তম্ভে শ্রদ্ধা জানান। সম্মেলনের সভাগৃহের নামকরণ করা হয় প্রয়াত প্রাক্তন সম্পাদক বিজয় কান্ত ঠাকুরের নামে এবং পোডিয়ামের নামকরণ করা হয় কৃষক নেতা কমরেড কৃষ্ণকান্ত সিংয়ের নামে। এরপর সর্বোদয় শর্মা, গণেশ সিং, আহমদ আলি এবং নীলম দেবীকে নিয়ে সভাপতিমণ্ডলী গঠিত হয়।
অধিবেশন পর্বের উদ্বোধনের পর সীতারাম ইয়েচুরি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে বিভিন্ন ঘটনার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকারকে পরাস্ত করতে পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে পার্টিকে মজবুত করে গড়ে তুলতে হবে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন সাধারণ ইস্যুতে বাম গণতান্ত্রিক শক্তি, ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি এবং পার্টিগুলিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে। তিনি শ্রেণি এবং গণআন্দোলনে অংশগ্রহণ করার মধ্য দিয়ে গণ লাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
এরপর রাজ্য সম্পাদক অবধেশ কুমার ২২ তম পার্টি কংগ্রেসের লাইন অনুযায়ী আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনা করার প্রেক্ষিতে অর্জিত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখিত রাজনৈতিক সাংগঠনিক খসড়া রিপোর্ট পেশ করেন।
খসড়া রিপোর্টের ওপর ৫১ জন প্রতিনিধি আলোচনা করেন। আলোচনায় প্রতিনিধিরা বিগত বিধান সভা নির্বাচনে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্ধারিত রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করার বিষয়টিকে প্রশংসা করে বলেন এরফলেই ১০ বছর পরে দুজন তরুণ প্রতিনিধিকে বিধানসভার সদস্য করে পাঠানো সম্ভব হয়েছে। প্রতিনিধিদের আলোচনার পর জবাবি ভাষণ দেন বিদায়ী সম্পাদক অবধেশ কুমার। এরপর সর্বসম্মতিতে রিপোর্ট গৃহীত হয়।
সম্মেলন থেকে সর্বসম্মতিতে ৫০ সদস্যের রাজ্য কমিটি তৈরি হয়। সম্পাদক হিসেবে নির্বাচিত হন লালন চৌধুরী।
সম্মেলন থেকে দেশে এবং রাজ্যে কৃষি সংকট, বন্যা, খরা, কৃষিপণ্যের এমএসপি চালু, জল নিকাশির সমস্যা, সারের সমস্যা, পুরনো পেনশন স্কিম ফিরিয়ে আনা, মহিলা শিশু ও দলিতদের উপর অত্যাচারের বিরোধিতা প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব পাশ হয়। আগামী ২৮ এবং ২৯ তারিখে কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির ডাকে সারা ভারত সাধারণ ধর্মঘটের সমর্থনেও প্রস্তাব পাশ হয়।
প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে সর্বজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য রামাশ্রয় সিং অভ্যর্থনা কমিটিকে তাদের সুন্দর আয়োজনের জন্য ধন্যবাদ জানান। বিগত রাজ্য কমিটির যাঁরা বয়সের কারণে অব্যাহতি পেয়েছেন, সম্মেলন থেকে সেই সদস্যদের সংবর্ধিত করা হয়। এদের মধ্যে রয়েছেন রামাশ্রয় সিং, গণেশ সিং এবং বিদায়ী সম্পাদক অবধেশ কুমার। সম্মেলন থেকে ২৩ তম পার্টি কংগ্রেসের জন্য ১৮ জন সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ ও সামন্ততন্ত্রের বিরুদ্ধে শোষণমুক্ত পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার দৃপ্ত স্লোগান এবং আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শেষ হয় সম্মেলন।