৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
রাজ্য বাজেট ২০২২ ও রাজ্যের অর্থনীতি
ঈশিতা মুখার্জি
গত ১১ মার্চ রাজ্য বিধানসভায় পেশ করা হয়েছে বাজেট। রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের যতগুলি বাজেট এর আগে পেশ করা হয়েছে, তার কোনোটিতেই কোনো আর্থিক নীতির দিশা ছিল না। এই বাজেটেও নেই। এই বিষয়ে দেশের বিজেপি সরকারের পেশ করা বাজেটের সাথে রাজ্যের বাজেটের বেশ কিছু মিল লক্ষ করা যায়। প্রথমে সেই মিলগুলি দিয়েই আলোচনা শুরু করি।
এক - দেশ এবং রাজ্য সম্পর্কে পেশ করা তথ্যের অসত্যতা।
দুই - দেশ এবং রাজ্যের অর্থনীতি সম্পর্কে ভুল বার্তা দেওয়া যা মানুষকে মিথ্যা আশায় রেখে দেবে; এটি যে, কোনো নির্বাচিত সরকারের পক্ষে অনৈতিক।
তিন - বাজেটে হিসেবে অসঙ্গতি; আয় ও ব্যয়ের মধ্যে কোনো সামঞ্জস্য প্রকৃত অর্থে নেই যদিও যোগবিয়োগ করে একটি হিসেব দেখানো হয়ে থাকে।
চার - প্রতিশ্রুতির বন্যা যার সাথে গত বছর অর্থনীতি সরকার যেভাবে চালিয়েছে তার কোনো মিল নেই।
পাঁচ - কীভাবে করবে এত কাজ সরকার তা এই দুই সরকারের কেউই উত্তর দিতে পারে না বাজেট বক্তৃতায়। এর থেকে বোঝা যায় যে, দুই সরকার চলেছে একই পথে, একই নীতি নিয়ে। যত বছর গড়িয়েছে, দুই সরকারের বাজেট নীতি আরও কাছাকাছি চলে এসেছে।
কী ঘটল এই রাজ্য বাজেটে? ১৫১ পাতার বাজেট বক্তৃতায় ৩.২১ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব। অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে পিছিয়ে পড়া মানুষের দিকে। এ কথা বলা হলেও বাজেটে কীভাবে তা সম্ভব হবে তা বোঝা যায় না। ১কোটি ২০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের আর্থিক ব্যবস্থা কোথায় ? পেশ করা পরিসংখ্যানে তো পাওয়া যায় না। পিছিয়ে পড়া মানুষের কাছে নানা প্রকল্প এ নামে সে নামে হাজির করেছে সরকার। কিন্তু এক বছরের অতীত জানাচ্ছে, সরকারের হাতে টাকা কোথায়? গত এক বছরে রাজস্ব খাতে ব্যয় প্রস্তাবিত ছিল ২.১ লক্ষ কোটি টাকা। সরকার ব্যয় করেছে ২ লক্ষ কোটি টাকা; অর্থাৎ প্রস্তাবের চেয়ে ব্যয় কমে গেছে। তাই এ বছরের ২.২ লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাবের ভিত্তি কী? জনকল্যাণ খাতে ব্যয় বৃদ্ধি করতে হলে জরুরি হলো মূলধনি ব্যয়। এখানে দেখা যায় যে, গত বছর সেই মূলধনি ব্যয় প্রস্তাবিত ছিল ৩২ হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা, কিন্তু আসলে সরকার ব্যয় করেছে ১৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা। তাহলে এ বছরে ৩৩ হাজার ১৪৪ কোটি টাকার প্রস্তাবের ভিত্তি কী? রাজস্ব আয়ের পথ বন্ধ। এত দুয়ারে পরিষেবা, নানা গোষ্ঠীতে মানুষকে ভাগ করে তাঁদের অনুদান, এত কর্মসংস্থানের কথার ভিত্তি কী? আর্থিক ভিত্তি তো নেই।
এই প্রতিশ্রুতির বন্যা মেটানোর দায় কাদের? সত্য ভাষণ করলে বলতে হয় রাজ্যের সাধারণ মানুষকেই এই আর্থিক দায় বহন করতে হবে। কী ভাবে? তার খানিকটা ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যখন মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করছেন পেনশন, ডি এ দেওয়ার আর্থিক ক্ষমতা নেই রাজ্যের। একটু একটু করে মানুষের উপর কোপ পড়তে চলেছে। প্রস্তাবিত আয়, ব্যয়, ঘাটতির সাথে তো প্রকৃত আয় ব্যয় ঘাটতির মিল নেই। ২০২০-২১ সালে এই সরকার বলেছিল যে, রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়াবে ২৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বছর ঘুরতে দেখা গেল রাজস্ব ঘাটতি ৩২.৯ হাজার কোটি টাকা। তাই এবারে সরকারের প্রতিশ্রুতি যে রাজস্ব ঘাটতি দাঁড়াবে ২৮ হাজার কোটি টাকা। এ কথায় আস্থা রাখার কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই।
সরকারের ঋণ আকাশছোঁয়া। কথায় কথায় ঋণ নিয়েছে সরকার। রাজ্য সরকারের ঋণের বোঝা সংকটজনক। শুধুমাত্র জানুয়ারি মাসেই রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে, এই রাজ্য তিনবারে এক মাসেই ৬,৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেলেছে। উত্তর প্রদেশের পিছনেই হেঁটেছে এই রাজ্য। এ ছাড়া এই জানুয়ারি মাসেই বিশ্বব্যাঙ্ক থেকে এক “কল্যাণমুখী” প্রকল্পের জন্য নেওয়া হয়েছে ১,০০০ কোটি টাকার ঋণ। গত দশ বছরে রাজ্য সরকার ঋণ নিয়েছে ৮২,০০০ কোটি টাকা। ২০১১ সালে জমে থাকা ঋণের পরিমাণ ছিল ১.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা। ২০২০-২১ সালের আর্থিক বছরের শেষে সেই জমে থাকা ঋণ দাঁড়িয়েছে ৫.৫ লক্ষ কোটি টাকা। এই আর্থিক দেউলিয়া পরিস্থিতি এ রাজ্যে অতীতে হয়নি। এই দেউলিয়া অবস্থা অতীতের সব রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। বামফ্রন্ট সরকার চলে যাওয়ার সময় ঋণের বোঝা রেখে গিয়েছিল ১.৯৩ লক্ষ কোটি টাকা রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী। সুতরাং, বর্তমান সরকারের অসত্য বার্তা তার নিজস্ব বাজেটেই প্রকাশিত। এই ঋণ তো সরকারকে শোধ করতে হবে। সরকার ঋণ শোধ করে কীভাবে? রাজ্যের মানুষের উপর দায় চাপিয়ে এই ঋণ শোধ করা হয়। ভবিষ্যতের জনকল্যাণমুখী প্রকল্পগুলি একটি একটি করে বন্ধ হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সমস্ত সুযোগ বঞ্চিত করে রাজ্যের মানবসম্পদ সৃষ্টি না করে এই ঋণ শোধ করতে হবে।
রাজ্যের অর্থনৈতিক অবস্থার যে রঙিন চিত্র বাজেট বক্তৃতায় আছে, তার কোনো ভিত্তি নেই এবং তা অসত্য। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির বৃদ্ধির হার নাকি দেশের আর্থিক বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি এবং সেই হার নাকি ১২.৮২ শতাংশ। এই হিসেবের কোনো ভিত্তি নেই? পরিপ্রেক্ষিত পরিসংখ্যান দেখা যাক। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য অনুযায়ী ২০০৫-২০১০ সালের মধ্যে মাথা পিছু রাজ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৭ শতাংশ। সময়টা ছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়। তখন তা ছিল দেশের জাতীয় আয় বৃদ্ধির হারের চেয়ে বেশি। কিন্তু তৃণমূল সরকারের সময়ে, ২০১২-২০২০ সালের মধ্যে এই হার হয় ৪.২ শতাংশ। তা জাতীয় হারের চেয়ে কম। এই সামান্য তথ্য থেকে বোঝা যায় যে, মাথা পিছু আয়ের ব্যবস্থাও গত দশ বছরে আক্রান্ত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উৎপাদন বৃদ্ধি বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ছিল। কৃষকের হাতে ব্যয় করার মতো আয়ের ব্যবস্থা ছিল। ২০১১ সালের পর রাজ্যে শুরু হলো কৃষক আত্মহত্যা। এনসিআরবি’র তথ্য অনুযায়ী ২০১৪ সালেই কৃষক আত্মহত্যার সংখ্যা এই রাজ্যে ছিল ২৩০। ২০১৫-র পর থেকে রাজ্য সরকার কৃষক আত্মহত্যার কোনো সংখ্যা প্রকাশ করেনি। কেন ঘটেছে এই আত্মহত্যা? কৃষক ফসলের ন্যয্য দাম পাননি। চাষের খরচ বেড়ে গেছে। কৃষি থেকে আয় কমেছে এই রাজ্যে গত দশ বছরে। জাতীয় নমুনা সমীক্ষার ২০১৮-১৯ সালের তথ্য অনুযায়ী জানা যায় যে, চাষ থেকে গড় মাসিক আয় এ রাজ্যে দেশের গড় আয়ের চেয়ে কম। ২০১২ সাল থেকে এই আয় কমে ২০১৮ সালে দাঁড়িয়েছে মাসে ৬,৭৬২ টাকা অর্থাৎ দৈনিক ২২৫.৪০ টাকা। কৃষি থেকে আয় কমেছে, অকৃষিজনিত আয়ের সম্ভাবনাও কমেছে এই রাজ্যে। গ্রামীণ অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে গেছে গত দশ বছরে। শিল্পকারখানার কী অবস্থা গত দশ বছরে? বিনিয়োগ কত হয়েছে এই দশ বছরে? কারখানার সংখ্যা গত দশ বছরে বেড়েছে মাত্র ১,০০০। কিন্তু চালু কারখানার সংখ্যা এর চেয়ে কম, কারণ বহু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে মন্ত্রী জানান যে, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে রাজ্যে ৪টি কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তথ্য বলছে বড়ো, মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্প মিলিয়ে গত দশ বছরে বন্ধ হয়ে গেছে ২১, ৫২১টি শিল্প ইউনিট। ২৭১টি বড়ো শিল্প ইউনিট বন্ধ হয়েছে। রাজ্য সরকারের পেশ করা কোনো তথ্যেই এর খোঁজ পাওয়া যাবে না। নানা সূত্র থেকে যে তথ্য সংগৃহীত হয়েছে, তাতে কিছু খবর পাওয়া যায়। গত দশ বছরে কোনো বড়ো শিল্প হয়নি এ রাজ্যে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র শিল্পে ২০১১ সালেই যখন তৃণমুল কংগ্রেস সরকার ক্ষমতায় আসে, তখনই পরিসংখ্যান জানিয়েছিল যে, রাজ্য দেশের মধ্যে এক নম্বরে ছিল। তারপর দেশের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সেই স্থান এখন দ্বিতীয়তে নেমে এসেছে। এখানেও হয়েছে অবনতি।
এই পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে একটি কথাও বলা নেই রাজ্য বাজেট এবং আর্থিক সমীক্ষায়। বাজেটে মুল জোর দেওয়া হয়েছে দুয়ারে সরকার, লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, ইত্যাদি নানা ব্যক্তিভিত্তিক প্রকল্পের উপর। এগুলি সরাসরি টাকা ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে চলে আসার প্রকল্প। এরকম প্রকল্প তো সব রাজ্যকেই নিতে হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ আলাদা নয়। মারাত্মক অর্থনৈতিক পরিবেশে ক্রমাগত বেড়ে চলেছে ক্ষুধা, বেকারি, আত্মহত্যা। নয়া উদারীকরণের এই অর্থনীতি থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচাতে ব্যক্তিভিত্তিক প্রকল্প নিশ্চয়ই প্রয়োজন। রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের সময়েও এই ধরনের প্রকল্প ছিল। কিন্তু সেটাই বাজেটে সব কিছু হতে পারে না। রাজ্যের শাসকদলের একটি নির্দিষ্ট নীতি থাকা প্রয়োজন যা কৃষিনীতি, শিল্পনীতির জন্ম দেবে। নীতিহীন বাজেটে দেউচা-পাঁচামীর মতো সর্বনাশা প্রকল্পের কথাই লেখা থাকে। এই প্রকল্প ধ্বংসাত্মক। এই নীতি আদিবাসী মানুষদের স্বাভাবিক অধিকারের তোয়াক্কা করে না, জঙ্গল নীতির তোয়াক্কা করে না, পরিবেশ নীতি তোয়াক্কা করে না। নীতিহীনতার থেকেই এই ধরনের প্রকল্পগুলি উঠে আসে। প্রসঙ্গত, অন্যান্য রাজ্যের বাজেটগুলিও একে একে পেশ হচ্ছে সেই সেই রাজ্যের বিধানসভায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য, কেরালা সরকারের বাজেট যা নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি পর্যন্ত বিশেষ কথা বলতে পারেনি। সেই বাজেটে আছে নির্দিষ্ট জেন্ডার বাজেট বা পুরুষ মহিলা ভারসাম্যের কথা, মহিলাদের অধিকারের কথা যা প্রতিটি বাজেটেই ২০০৫ সাল থেকে থাকা উচিত বলে দেশে মনে করা হয়েছিল। এই বাজেটে অনুদান প্রকল্প, যেগুলি স্বাভাবিক প্রকল্প যেমন বিধবা ভাতা - এগুলির কথাই বলা হয়েছে। এই প্রকল্প নতুন কোনো উদ্যোগ নয়, এই প্রকল্প আগেই ছিল। এ রাজ্যের বাজেটে কোনো জেন্ডার বাজেট নেই বা তার উল্লেখও নেই।
কর্মসংস্থানের কথা বলা হলেও তা কী ভাবে হবে সে কথা বলা নেই। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে কিছু বলা নেই। কী আশ্চর্য মিল কেন্দ্রের বাজেটের সাথে! বাজেটে যখন আর্থিক সংস্থান থাকে না, স্বাভাবিক পথ থাকে বেসরকারিকরণ। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এই সব ক্ষেত্রে বেসরকারি পথেই হাঁটছে রাজ্যের সরকার। তাহলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের অধিকারের কথা রাজ্যের নির্বাচিত সরকার জলাঞ্জলি দিল না কী? এ রাজ্যে বেকারি তীব্র। একসময়ে কাজের জন্য এ রাজ্যে ভিনরাজ্যের মানুষ আসলেও, গত দশ বছর ধরে এ রাজ্যের মানুষ দলে দলে ভিনরাজ্যে চলেছেন কাজের খোঁজে। এদের কথা কোথাও তো বাজেটে বলা নেই।
কার ভালো চেয়ে এই বাজেট করেছে রাজ্য সরকার? বোঝা যায় মানবকল্যাণের মোড়কে এই বাজেট আসলে বেসরকারি এবং করপোরেটদের কাছে রাজ্যকে লুঠ করার পথ প্রশস্ত করার দলিল। তৃণমূল সরকারের প্রতি বছরের বাজেট এই রাজ্যে এই কাজই করে এসেছে, কেন্দ্রের মতো ২০২২ সালে অতিমারীর সুযোগে একেবারে বেআব্রু হয়ে এই লুঠের পথ চওড়া করে দেওয়া হলো রাজ্য বাজেটে।