৫৯ বর্ষ ৩১ সংখ্যা / ১৮ মার্চ, ২০২২ / ৩ চৈত্র, ১৪২৮
চোপ! সরকার চলছে!
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ঘটনা - ১
রবিবার ১৩ মার্চ। পুরুলিয়ার ঝালদা। বিকেল নাগাদ বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন ১২ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য নির্বাচিত কংগ্রেস কাউন্সিলর তপন কান্দু। বাড়ি থেকে কিছুটা দূর যাবার পরেই উলটোদিক থেকে একটি বাইক ধেয়ে আসে এবং এক বাইক আরোহী তপন কান্দুকে পিছন থেকে মাথায় গুলি করে চলে যায়। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় কংগ্রেস কাউন্সিলরের।
ঘটনা - ২
রবিবার ১৩ মার্চ। উত্তর ২৪ পরগনার পানিহাটি। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য নির্বাচিত তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর অনুপম দত্ত। যে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ বলে একটি ভিডিয়ো সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। যে ভিডিয়োতে দেখা যাচ্ছে তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্ত একটি বাইকের পেছনে উঠে বসছেন। আর মুহূর্তের মধ্যেই পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নীল ডোরাকাটা শার্ট পরা এক যুবক বন্দুক বের করে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি চালাচ্ছে কাউন্সিলরের মাথায়। ঘটনাস্থলেই লুটিয়ে পড়েন অনুপম দত্ত। তাঁকে স্থানীয় এক বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে মৃত বলে ঘোষণা করেন চিকিৎসকরা।
ঘটনা - ৩
১৩ মার্চের কদিন আগেই এই রাজ্যেই রাজনৈতিক খুন আরও একটা হয়েছে। সেটা হাওড়ার আমতায়। ১৮ ফেব্রুয়ারি মাঝরাত। নিহতের পরিবারের অভিযোগ পুলিশের পোশাক পরিহিত চারজন ওই রাতে তাঁদের বাড়ি যান এবং ছাত্রনেতা আনিস খানকে তিনতলার ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে হত্যা করা হয়। আনিসের হত্যা প্রসঙ্গে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে যে দাবি করা হয়েছে তাকে নৃশংসতম বললেও কম বলা হয়। প্রতিবাদী ছাত্রনেতা আনিস খানের মৃত্যু রহস্য এখনও উদ্ঘাটিত হয়নি। যদিও এই খুনে ইতিমধ্যেই নাম জড়িয়ে গেছে শাসকদল তৃণমূলের। তদন্ত চলছে। সিট গঠন হয়েছে। রাজ্য সরকারের তৈরি করে দেওয়া সিটে আস্থা নেই বলে প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছে নিহতের পরিবার।
ঝালদা, পানিহাটি, আমতা
ঝালদার নিহত কংগ্রেস কাউন্সিলরের স্ত্রী পূর্ণিমাদেবীর অভিযোগ খুবই স্পষ্ট। তিনি সরাসরি তৃণমূল ঘনিষ্ঠ ঝালদা থানার আইসি’র বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ এনেছেন। এই মর্মে জেলা পুলিশ সুপারের কাছে চিঠিও দিয়েছেন। চিঠিতে ঝালদা থানার আইসি সঞ্জীব ঘোষ ছাড়াও পাঁচজনের বিরুদ্ধে খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন পূর্ণিমাদেবী। তাঁরা হলেন - নিহতের ভাইপো তথা তৃণমূল নেতা দীপক কান্দু, তাঁর বাবা নরেন কান্দু, এলাকায় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত বিশ্বনাথ কান্দু, শ্যামাপদ সাউ ও ভীম তিওয়ারি।
পূর্ণিমাদেবীর অভিযোগ, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা হওয়ার পর থেকে ঝালদা থানার আইসি তাঁর ও তাঁর স্বামীর উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন, যাতে তাঁরা তৃণমূলে যোগ দেন এবং তাঁর স্বামী তৃণমূলের টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু তাঁরা তা করেননি। ঝালদায় তৃণমূলের পুরবোর্ড গঠনের জন্য যোগসাজশ করে এই খুন করা হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর। উল্লেখ্য, নির্বাচনের ফলাফলে ঝালদা পৌরসভা ত্রিশঙ্কু হয়। ১২ ওয়ার্ডের পুরসভায় কোনো দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পাঁচটি করে ওয়ার্ড জিতেছে কংগ্রেস এবং তৃণমূল। দুই ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন নির্দল প্রার্থীরা। লড়াই চলছে ঝালদা পুরসভার ক্ষমতা দখলের। যার মধ্যেই এই খুন। এই খুনের পেছনে ক্ষমতা দখলের লড়াই যে আছেই তা বেশ স্পষ্ট।
একইভাবে পানিহাটিতে তৃণমূল কাউন্সিলর খুনের ঘটনায় নিহতের স্ত্রী জানিয়েছেন, এর আগেও একবার তাঁর স্বামীকে খুনের চেষ্টা করা হয়েছিল। এর পেছনে ‘ভেতরের কেউ’ জড়িত আছে। অন্তত সিসিটিভি’র ফুটেজ দেখে সেরকমই মনে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কে কার সঙ্গে হাত মিলিয়ে এই ঘটনা ঘটালো, আমার এত বড়ো সর্বনাশ করলো তার তদন্ত চাই।
একইদিনে রাজ্যের দুই প্রান্তে দুই রাজনৈতিক খুন এবং এর প্রায় দিন কুড়ি আগে আরও একটা খুন। আনিস খানের মৃত্যুতে বাম ছাত্র যুবদের আন্দোলনে রাজ্য কিছুটা তোলপাড় হলেও বাকি দুই মৃত্যু নিয়ে যতটা আলোড়ন পড়া উচিত ছিল তা এখনও হয়নি। রাজ্যের মানুষের যতটা ক্ষুব্ধ হওয়া উচিত ছিল তা তাঁরা আদৌ হয়েছেন বলেও মনে হয়নি। হয়তো বা সাম্প্রতিক সময়ে কিছুটা জলভাত হয়ে হাওয়া খুন জখমের কারণেই এই আপাত নির্লিপ্ততা। একটা সময় ছিল, যখন কথায় কথায় আইনশৃঙ্খলার প্রসঙ্গে বিহার-উত্তরপ্রদেশের উদাহরণ টানা হতো। বলা হতো এটা বিহার-ইউপি নয়। এখানে মুড়ি মুড়কির মতো খুন রাহাজানি হয়না। যদিও এখন সে সব ইতিহাস।
সাম্প্রতিক সময়ে শুধুমাত্র তিন রাজনৈতিক খুন হয়েছে এরকমটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এটা বলা যেতে পারে বিগত কয়েক বছরে রাজ্যে রাজনৈতিক খুনের ঘটনা বেড়েছে। এখানে ২০১১ সালে ‘বদলা নয় বদল চাই’ স্লোগান তুলে তৃণমূলের ক্ষমতায় আসার কয়েকদিনের মধ্যেই রাজ্যে পরপর যে বামপন্থী নেতা কর্মীদের খুন করা শুরু হয়েছিল সেসব প্রসঙ্গ টানতে চাইছি না। কারণ সে সবই ছিল দীর্ঘ ৩৪ বছর পর বাম শাসন হটানোর জান্তব উল্লাস। কিন্তু সাম্প্রতিক যে ক’টি রাজনৈতিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে তার বেশিরভাগই দেখা গেছে শাসকদলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের ফল। একবার দেখে নেওয়া যেতেই পারে রাজ্যের সাম্প্রতিকতম কয়েকটি রাজনৈতিক হত্যা।
● ২০১৮র ১৩ ডিসেম্বর। আক্রমণ হয়েছিল জয়নগরের তৃণমূল বিধায়ক বিশ্বনাথ দাসের ওপর। এলোপাতাড়ি ছোঁড়া বোমা গুলির থেকে তৃণমূল বিধায়ক রক্ষা পেলেও মৃত্যু হয়েছিল ৩ স্থানীয় তৃণমূল নেতা কর্মীর।
● ২০১৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সরস্বতী পুজোর অনুষ্ঠান চলাকালীন ভিড়ের মধ্যে থেকে গুলি করে খুন করা হয় নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাসকে।
● ২০১৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি। রাজ্যের তৎকালীন শ্রম প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেনের ওপর বোমা নিয়ে হামলা হয় মুর্শিদাবাদে নিমতিতা স্টেশনের কাছেই। গুরুতর জখম হন রাজ্যের মন্ত্রী।
● ২০১৯ সালের ৮ অক্টোবর। দুর্গাপুজোর নবমীর রাত। পূর্ব মেদিনীপুরের পাঁশকুড়ায় পঞ্চায়েত সমিতির সহসভাপতি ও তৃণমূল নেতা কুরবান শাহকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
● ২০২০ সালের ৪ অক্টোবর। টিটাগড় থানার কাছেই খুন হয়ে যান প্রাক্তন তৃণমূল বর্তমান বিজেপি নেতা অর্জুন সিং ঘনিষ্ঠ মণীশ শুক্লা। গুলি করে তাঁর দেহ ঝাঁঝরা করে দেয় দুষ্কৃতীরা।
● ১২ জুলাই ২০২১। মঙ্গলকোটের লাকুড়িয়ায় তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি অসীম দাসকে পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করে খুন করে দুষ্কৃতীরা।
● ২০২১ সালের ১৩ আগস্ট। মুর্শিদাবাদের বড়ঞায় দিনের আলোয় খুন হয়ে যান স্থানীয় পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য মোস্তাফা শেখ। এই সময়েই খড়দায় খুন হয়ে যান তৃণমূল নেতা রণজয় শ্রীবাস্তব।
● ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর ক্যানিং-এর সাতমুখীতে নিজের বাড়ির সামনেই খুন হয়ে যান তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি মহরম শেখ।
পরপর এতগুলো খুনের ঘটনার বিবরণীতে হয়তো একটু ক্লান্ত লাগছে। কিন্তু ক্লান্তি আসলেও এটা মেনে নিতে হবে যে ওপরের সবকটাই রাজনৈতিক খুন এবং প্রায় সকলেই শাসকদলের নেতা কর্মী। যে তালিকা থেকে বাদ যাননি বিধায়ক, পঞ্চায়েত সদস্যরাও। এই তালিকায় নেই রাজ্যে ২০১৮ পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘটে যাওয়া হিংসার কথা। যেখানে নয় নয় করে খুন হয়ে গেছিলেন প্রায় এক ডজন মানুষ। মুর্শিদাবাদ থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগনা, উত্তর ২৪ পরগনা থেকে নদীয়া, পূর্ব মেদিনীপুর থেকে কোচবিহার - খুন হয় প্রতিটি জেলায়। যদিও যে মৃত্যু সম্পর্কে তৃণমূল সাংসদ ডেরেক ও ব্রায়েন ট্যুইট করে যা জানিয়েছিলেন তার সারবস্তু অনেকটা এরকম। সাফাই দেবার ঢঙে তিনি জানিয়েছিলেন, রাজ্যের ৫৮ হাজার বুথে ডজন খানেক মানুষের মৃত্যু কী আর এমন বেশি? এর আগে রাজ্যে অনেক বেশি মানুষ মারা গেছেন।
রাজ্যে শুধুমাত্র শাসকদলের নেতা কর্মীদের এতগুলো হত্যার ঠিক কী বিচার হয়েছে বা দোষীরা এখনও শাস্তি পেয়েছেন কিনা তা অজানা। সব ঘটনাতেই হয়তো কিছু গ্রেপ্তারি হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কী কারণে রাজ্যে লাগাতার রাজনৈতিক হত্যা চলছে বা একইদিনে খুন হয়ে যেতে হলো শাসকদলের একজন এবং একজন বিরোধী কাউন্সিলরকে? রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ হলে একের পর এক খুন চলতেই থাকে? এক্ষেত্রে রাজ্যের পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীর কি কোনো দায় নেই? স্বভাবতই বিরোধীদের বক্তব্য খুবই সঙ্গত। যেখানে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের জীবনের নিরাপত্তা নেই সেখানে রাজ্যের সাধারণ মানুষ কতটা নিরাপদ? বলা বাহুল্য এই প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। যদিও মুখ্যমন্ত্রী গত মঙ্গলবার ১৫ মার্চ বিরোধীশূন্য বিধানসভায় জানিয়েছেন, রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যথেষ্ট ভালো। ‘দুটো ঘটনা ঘটেছে বলে রাজ্যকে বিক্রি করে দিতে হবে, ক্রিমিনালদের হাতে দিতে হবে মনে করি না৷’ ‘শুধু পুলিশকে গালাগাল দিলেই হয় না। একজন দু’জনের ভুল ভ্রান্তির জন্যে সবাইকে দোষ দেওয়া যায়না। বাংলার পুলিশের সঙ্গে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের তুলনা চলে৷।’ মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য আর চোখে দেখা বাস্তব এক কী? বোধহয় না।
রাজ্যের আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র জানিয়েছেন, পুলিশের সাহায্যে খুন হয়, পুলিশের সাহায্যে ভোটলুট হয়, পুলিশ দিনকে রাত, রাতকে দিন করতে পারে। এরকম অজস্র দৃষ্টান্ত প্রতিদিন মানুষ প্রত্যক্ষ করছেন। রাজ্যে আইন শৃঙ্খলা নেই।
ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর শেষ রিপোর্ট অনুসারে ২০২০ সালে ভারতে প্রতিদিন গড়ে ৮০টি খুনের ঘটনা ঘটেছে ও ৭৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। গোটা দেশে মোট ২৯,১৯৩টি প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে উত্তরপ্রদেশ (৩,৭৭৯) রয়েছে তালিকার সবার ওপরে। এরপরেই রয়েছে বিহার (৩,১৫০), মহারাষ্ট্র (২,১৬৩), মধ্যপ্রদেশ (২,১০১)। এই তালিকাতে আছে পশ্চিমবঙ্গও। এনসিআরবি রিপোর্ট অনুসারে যে সংখ্যা ১,৯৪৮।
মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় যা-ই দাবি করুন, রাজ্যে আইন শৃঙ্খলার পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে তা দেখা গেছে মাত্র গত এক মাসের তিন রাজনৈতিক হত্যার ঘটনায়। আনিস খান হত্যা ঘিরে যেভাবে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে বা দুই কাউন্সিলরের হত্যাকাণ্ডে যেভাবে দলীয় কোন্দল এবং ক্ষমতা দখলের লড়াই সামনে এসেছে তা ভয়ংকর। ক্রমশ ক্রমশ আরও ভয়ংকর হয়ে উঠছে রাজ্যের অবস্থা। দুষ্কৃতীদের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ। শেষ কয়েক বছরের পরিসংখ্যান বলছে রাজ্যে ক্রমশ বাড়ছে রাজনৈতিক হানাহানি, খুনের ঘটনা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যার পেছনে কাজ করছে শাসকদলের ঘরোয়া কোন্দল, ক্ষমতা বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্ব, ক্ষমতা দখলের নির্লজ্জ লড়াই। বারবার পুলিশের ভূমিকা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। এর শেষ কোথায় জানা নেই। জানা নেই আরও কত মানুষের প্রাণের বিনিময়ে রাজ্যের ভেঙে পড়া আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থার হাল ফিরবে। রাজ্যের পুলিশ মন্ত্রী কী বলেন?