৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
গ্রামের আলোড়িত পদযাত্রায় আগামীর বড়ো লড়াইয়ের সংকেত
পূর্ব মেদিনীপুরের খেজুরির আলপথ ধরে এগোচ্ছে পদযাত্রা।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ রুটি-রুজির সংগ্রামের সাথে ন্যায্য দাবি এবং অধিকার রক্ষার আন্দোলনের দুর্বার শপথে এখন উত্তাল গ্রামের পথ-প্রান্তর। গ্রামবাংলার প্রতিটি প্রান্তে এখন বাঙ্ময় হচ্ছে নানা অবয়বে লাল পতাকার বর্ণময় মিছিলে বঞ্চিত-অত্যাচারিত হাজার-অযুত কণ্ঠের কৃপণ স্লোগান। তাতে উচ্চারিত হচ্ছে দুর্নীতিমুক্ত জনমুখী পঞ্চায়েত গড়ার পাশাপাশি শিল্প গড়া ও কর্মসংস্থানের দাবি। পাহাড় থেকে সমুদ্র সংলগ্ন রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলজুড়ে অকুতোভয় সংগ্রামী অভিযাত্রীরা শাসকদল তৃণমূলের অপশাসন, দুর্নীতি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে যেমন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের আওয়াজকে তীব্র করছেন, তেমনি সাম্প্রদায়িক বিজেপি-আরএসএস-র বিভেদ ও হিংসার রাজনীতিকে প্রতিহত করতে যূথবদ্ধ লড়াইয়ের আওয়াজকে তীব্র করছেন। সিআইটিইউ, সারাভারত কৃষকসভা এবং সারাভারত খেতমজুর ইউনিয়নের ডাকে লাল পতাকা, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন ও রঙিন বেলুনশোভিত বর্ণাঢ্য পদযাত্রা, মিছিল ও সমাবেশে আন্দোলিত সংগ্রাম-দৃপ্ত ছবিই এখন গ্রামীণ বাংলায় মূর্ত হয়ে উঠছে।
শ্রমিক, কৃষক এবং খেতমজুরদের সর্ববৃহৎ তিনটি গণ-সংগঠনের পাশাপাশি গ্রামীণ বাংলার পথজুড়ে চলা মিছিল, পদযাত্রায় শামিল হয়েছেন ছাত্র-যুব-মহিলা-সংস্কৃতিকর্মী সহ বিপুল অংশের আদিবাসী ও জনজাতি অংশের মানুষ। স্বাভাবিকভাবেই মিছিল, পদযাত্রার সংগ্রামী স্লোগানের সাথে আদিবাসীদের চিরায়ত বাদ্যযন্ত্র ধামসা, মাদল, নাকাড়ার শব্দ মিলে আগামী লড়াইয়ের ঘোষণায় এক নতুন সংগ্রামী ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে।
জলপাইগুড়িতে গাঠিয়া নদী পেরিয়ে চলেছে পদযাত্রা। ছবিঃ সঞ্জিত দে
কেন্দ্রের কর্পোরেটমুখী উদার আর্থিক নীতির সঙ্গে উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আগ্রাসী প্রকোপে বিপর্যস্ত, দিশেহারা গরিব শ্রমজীবী মানুষ। এর পাশাপাশি সীমাহীন মূল্যবৃদ্ধি, তীব্র খাদ্য সংকট প্রান্তিক মানুষদের সংকটকে যেমন তীব্র করেছে, তেমনি কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতির ফলে সার, বীজ, ইত্যাদির ভরতুকি হ্রাস ও চাষের উপকরণের অভাবনীয় মূল্যবৃদ্ধি কৃষকদের সমস্যা-যন্ত্রণাকে গভীর থেকে গভীরতর করেছে। তাঁরা উৎপাদিত ফসলের লাভজনক দাম পাচ্ছেন না। তার ওপর জোতদার, ফঁড়েদের নিত্য নতুন উপদ্রব, গ্রামীণ সমবায়গুলো ধ্বংস হওয়ায় চাষের প্রয়োজনে বাধ্য হয়ে মহাজনের ঋণের জালে আবদ্ধ হওয়া এবং সেই ঋণের জালে ফেঁসে কৃষক, খেতমজুরদের আত্মহননের ঘটনা আজ গ্রামবাংলায় নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কৃষি ও কৃষকের যখন এই সার্বিক সংকট, তখন স্বাভাবিকভাবেই কাজ নেই খেতমজুরদের। অভাবের তাড়ণায় পেটের জ্বালায় তাঁদের অবস্থাও সঙ্গীণ। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের জনবিরোধী ও কৃষক-বিরোধী নীতির প্রকোপে এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে কৃষক ও খেতমজুররা আজ জীবনের তাগিদে একরকম বাধ্য হয়েই অসংগঠিত শ্রমিকের পেশা বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। তার ফলে বাংলার গ্রামাঞ্চলের হাজার হাজার যুবক আজ ন্যূনতম খেয়ে-পড়ে বাঁচার তাগিদে পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে পাড়ি দিচ্ছেন ভিনরাজ্যে।
গ্রাম জাগাও বাংলা বাঁচাও পদযাত্রা মিনাখাঁয়।
এই সংকটময় পরিস্থিতিতে কোনো হেলদোল নেই রাজ্য সরকারের। প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরের কর্তা ও শাসকদলের স্থানীয় মাতব্বররা পঞ্চায়েতকে লুঠের আখরায় পরিণত করছে। তারা নির্বিচারে ঘুষ, তোলাবাজি আর কাটমানিতে ফুলে-ফেঁপে উঠছে এদিকে গ্রামীণ উন্নয়ন স্তব্ধ, সরকারি প্রকল্পে বরাদ্দ বন্ধ। উলটে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা গ্রামীণ অসহায় মানুষদের থেকেও বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা পাইয়ে দিতে কাটমানি খাচ্ছে।একশো দিনের প্রকল্পের কাজ বন্ধ। বকেয়া মজুরি মিলছে না। অন্যদিকে ভুয়ো জবকার্ড তৈরি করে মজুরির টাকা দেদার লুঠ করছে তৃণমূলের স্থানীয় মস্তানরা। গ্রামে কোনো রোজগার নেই। নেই কর্মসংস্থান। তৃণমূলের জমানায় কেবল ভরতুকি, প্রতিশ্রুতি ও শিলান্যাস ছাড়া একটিও বড়ো শিল্প গড়ে উঠতে দেখা যায়নি।
নদীয়ার তেহট্টে পদযাত্রা।
তৃণমূলের দুঃশাসনে পঞ্চায়েতকে গায়ের জোরে দখল করার কদর্য নজির দেখেছেন রাজ্যবাসী। শাসকদলের অপকীর্তি ও অপশাসনের বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ আর প্রতিরোধ যাতে দানা বাধতে না পারে, তারজন্য হিংস্র আক্রমণ, সন্ত্রাস চালিয়েছে শাসকদল অন্যদিকে সাম্প্রদায়িক বিজেপি-আরএসএস এই দুযোককালে কপট স্বার্থে বিভেদের রাজনীতি করে গ্রামীণ মানুষের ঐক্যকে বিনষ্ট করতে চাইছে। য়ই সমস্ত অপকর্মের বিরুদ্ধেই আজ গ্রামের মানুষ প্রতিবাদ -প্রতিরোধের দুরন্ত প্রত্যয়ে নতুন লড়াইয়েওর অঙ্গীকারে পথে নেমেছেন। তাঁরা গ্রাম জাগাও, চোর তাড়াও’, বাংলা বাঁচাও-এর স্লোগানে গ্রামবাংলার পথে প্রান্তরে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। যা সংকেত দিচ্ছে গোটা নভেম্বর মাস জুড়েই। তাঁদের এই অভিযাত্রা পথের লক্ষ্য আগামী দিনের বৃহত্তর লড়াইয়ের।