E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯

আদিবাসী মুন্ডা বিদ্রোহের নায়ক বীরসা মুন্ডার জন্মদিনে লড়াই আন্দোলনের শপথ


বিদ্রোহী নায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরসা মুন্ডা

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে কৃষি জমি সহ বনভূমি জলাভূমি রক্ষার লড়াইয়ের বিদ্রোহী নায়ক স্বাধীনতা সংগ্রামী বীরসা মুন্ডার ১৪৮তম জন্ম দিবস ১৫ নভেম্বর রাজ্যে পালিত হলো নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে। পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, উত্তর চব্বিশ পরগনা সহ রাজ্যের বেশ কয়েকটি জেলায় প্রতিকৃতিতে মাল্যদান, মিছিল, সভা, অসংখ্য পদযাত্রা, ফুটবল প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালিত হয়। এদিন রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে জাঠা মিছিল শুরু আগে বীরসা মুন্ডার লড়াই এবং আত্মত্যাগকে স্মরণ করা হয়। সারা ভারত কৃষকসভা আদিবাসী মুন্ডা বিদ্রোহের এই ঐতিহাসিক নেতার সংগ্রামী ঐতিহ্যকে স্মরণ করে গোটা দেশের গ্রামাঞ্চলে পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে আগামীদিনের সংগ্রামের শপথ নেওয়া হয়। এআইকেএস দপ্তরে পতাকা উত্তোলন করেন সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আদিবাসী মুন্ডা সম্প্রদায় বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল ১৮শ শতকের শেষভাগে। তাঁদের আন্দোলনের মূল মর্মবস্তু ছিল কৃষি জমি সহ বনের অধিকার রক্ষা। তাঁদের স্লোগান ছিল - ‘লাঙল যার জমি তার’। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী শাসক কৃষি অর্থনীতিতে ঔপনিবেশিক শোষণের মাত্রা তীব্র করে তুলেছিল। এই সময় মুন্ডা জনজাতি তাঁদের প্রিয় নেতা বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে সামাজিক শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে (১৮৯৫ থেকে ১৯০০ সাল) যে বিদ্রোহ করেছিলেন তা স্বাধীনতার সংগ্রামের ইতিহাসে এক স্বর্ণোজ্জল অধ্যায়।

ব্রিটিশ পুলিস বীরসা মুন্ডাকে গ্রেপ্তার করে রাঁচিতে নিয়ে যায়।

ঊনবিংশ শতকের নয়ের দশক। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তখন বাজার দখলে মত্ত। তাদের কাঁচামাল ও সম্পদ সংগ্রহের লক্ষ্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছিল জমি দখল। মুন্ডাদের যৌথ সামাজিক জমি ব্যবস্থা ‘খুঁৎকাঠি’ যা পরম্পরাগতভাবেই ছিল তাঁদের দখলে, তার ওপর নেমে আসে ব্রিটিশের দালাল-জমিদারদের বিষাক্ত থাবা। বিহারের হাজারিবাগ, রাঁচি, সিংভূম অঞ্চলে ব্রিটিশ সরকারের জমি নীতির বিরুদ্ধে দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে বিদ্রোহের আগুন। ধামসা আর মাদলের তালে গানে গানে বিদ্রোহের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়ে। মুন্ডাদের গোষ্ঠীবদ্ধভাবে চাষাবাদের যে জমি যা খণ্ডকুট্টি নামে পরিচিত তা দখল করতে অমুন্ডা জমিদার এবং মহাজনেরা নেমে পড়ে। আর শ্রেণি শোষণকে আড়াল করতেই ধর্মীয় শোষণ শুরু হয় পাদ্রীদের আগমনের মধ্য দিয়ে। এই সময় চলছিল সীমাহীন রাজস্ব বৃদ্ধি, যার বিরুদ্ধে মুন্ডা সমাজের সর্দাররা আদালতের দ্বারস্থ হলেও বিফল হয়েছিলেন। এই সময় মুন্ডাদের ধর্মান্তরণ শুরু হয়। প্রতিকার চেয়ে মিশনারি পাদ্রীদেরও দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু প্রতিশ্রুতি রাখেননি কেউ।

বীরসা মুন্ডার কিছু অনুগামীকে ব্রিটিশ পুলিস গ্রেপ্তার করে জেলের পথে নিয়ে যাচ্ছে।

এরপর গড়ে ওঠে মুন্ডাদের প্রতিরোধ মঞ্চ। তাঁরা সরাসরি ব্রিটিশ রাজপুরুষদের সঙ্গে দেখা করে বললেন, আমরাই জমির মালিক। জমিদার পরে এসেছে। আমরা সরাসরি ব্রিটিশ সরকারকে কর দেব। ব্রিটিশরা তাদের এই প্রস্তাবে সাড়া না দিয়ে বলেছিল মধ্যসত্ত্বভোগীদের অধিকার সরকারি আইনে আছে। এই সময় বীরসা মুন্ডার নেতৃত্বে তীর ধনুক এবং টাঙ্গি তরোয়াল নিয়ে মহাজনদের সামাজিক বয়কট করে, ঋণপত্র পুড়িয়ে দিয়ে ব্রিটিশ বিরোধী বিদ্রোহ শুরু হয়, যার অভিমুখ ছিল কুখ্যাত জায়গিরদারি ব্যবস্থা। বীরসা মুন্ডা ইংরেজি জানতেন, বলতে পারতেন। কারণ পাদ্রীদের স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন। তিনি মুন্ডা সম্প্রদায় থেকে ক্রমশ আদিবাসীদের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন। জমির অধিকারের দাবির পাশাপাশি তিনি বললেন সমাজ প্রগতির কথা।‌ বললেন আমাদের কুসংস্কার ত্যাগ করতে হবে, কোনো পূজোর জন্য ব্রাহ্মণকে ডাকার দরকার নেই।

বিদ্রোহের মুখে দাঁড়িয়ে ব্রিটিশ সরকার জমির উপর আদিবাসীদের অধিকারের আইন পাস করালেও পরিস্থিতির বদল ঘটালো না। অন্যদিকে দুর্ভিক্ষ আর মহামারীর কবলে উজাড় হয়ে গেল বহু আদিবাসী গ্রাম। বিদ্রোহের নেতা হিসেবে একবার গ্রেপ্তার হওয়ার পরে ছাড়া পেলেন, তবু দমলেন না বীরসা মুন্ডা। গোপনে ব্রিটিশবিরোধী লড়াইয়ের কথা প্রচার করতে লাগলেন। হাজার হাজার আদিবাসীদের নেতৃত্ব দিলেন ব্রিটিশের সঙ্গে মুখোমুখি লড়াইয়ে। প্রবল রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে তাঁদের পরাজয় ঘটল। আদিবাসীদের রক্তে লাল হয়ে গেল মাটি। এক পাদ্রীর বিশ্বাসঘতকতায় ধরা পড়ে যান বীরসা মুন্ডা। জেলে থাকাকালীন কলেরায় তাঁর মৃত্যু হয় ১৯০০ সালের ৩ জুন।