৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
বিজেপি-তৃণমূল কংগ্রেসের দাবার ছক
জীবেশ সরকার
পশ্চিমবঙ্গের উত্তর অংশের জেলাগুলিতে অর্থাৎ উত্তরবঙ্গে একটি বিতর্ক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে উত্থাপন করে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী পরিবেশ তৈরি করা হচ্ছে। কিছু প্রচারমাধ্যমকে ব্যবহার করে ও কিছু বুদ্ধিজীবীর কলমের মাধ্যমে প্রচার ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে, রাজ্যকে বিভাজিত করে উত্তরবঙ্গকে আলাদা রাজ্য বা একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory)-এ পরিণত করা হবে। এমনকী, একথাও বলা হচ্ছে যে, এই কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে আসাম ও বিহারের কিছু অংশও যুক্ত করা হতে পারে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তথাকথিত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মানচিত্র(!) সহ নানা অভিমত প্রচার করা হচ্ছে। একথাও প্রচার করা হচ্ছে যে, কেন্দ্রের স্বরাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজেই নাকি এই প্রস্তাবকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করছেন। এই প্রচারটি গুরুত্ব পাচ্ছে আরেকটি কারণে তা হলো, দেশের অভ্যন্তরীণ সুরক্ষা উপদেষ্টা অজিত দোভালের কয়েকবার উত্তরবঙ্গ সফর ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ। সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হলো, কেন্দ্রের শাসকদলের উত্তরবঙ্গের মন্ত্রী, সাংসদ ও বিধায়করা জোরের সাথে বলে চলেছেন যে, আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল গঠন করার দাবি নাকি খুবই যুক্তিসঙ্গত। বিজেপি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বক্তব্যেও রয়েছে ধোঁয়াশা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টিকারী মনোভাব ও কিছুটা বিপজ্জনক ইঙ্গিত। একটি বিষয় এখন আর গোপন নেই যে, বিজেপি’র মূল নিয়ন্ত্রক আরএসএস-এর উত্তরবঙ্গ কেন্দ্রীক আলাদা পরিকল্পনা তথা আলাদা রাজ্য গঠনের লক্ষ্যে নিজেদের স্বতন্ত্র উত্তরবঙ্গ রাজ্য কমিটি গঠন করার সাথে বিজেপি’র বর্তমান উত্তরবঙ্গ রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল (Union Territory) গঠনের বিষয় প্রচারে ভাসিয়ে দেওয়া একই সূত্রে বাঁধা। আবার একথাও বিবেচনায় রাখা দরকার যে, বিজেপি চায় দেশে এককেন্দ্রীক এম(ন ব্যবস্থা যেখানে রাজ্যগুলি হবে ছোটো ছোটো ও কেন্দ্রীয় সরকারের উপর আর্থিক বা প্রশাসনিকভাবে নির্ভরশীল। বিশেষ করে দেশের সীমান্ত অঞ্চলে বিজেপি প্রত্যক্ষ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রশাসন ও সরাসরি হস্তক্ষেপ করার ব্যবস্থা চায়। উত্তরবঙ্গের ভৌগোলিক অবস্থান, আর্থসামাজিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে বিজেপি’র এই ছোটো রাজ্য সম্পর্কিত নীতি সে কারণেই রাজ্য বিভাজনের প্রচারের উপাদান হিসাবে কাজ করে। বিপদের দিক এখানেই নিহিত।
রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেস দল বা তার নেত্রী-নেতারা যতই জোরগলায় বলুন না কেন যে তারা আলাদা উত্তরবঙ্গ রাজ্য গঠনের বিরুদ্ধে, তাদের এই ময়দানি বক্তৃতার বিশ্বাসযোগ্যতা থাকছে না। উত্তরবঙ্গের মানুষ অভিজ্ঞতায় দেখছেন যে, গ্রেটার কোচবিহার, কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ড সহ নানা আঙ্গিকের আলাদা রাজ্যের দাবিদার সংগঠনের নেতাদের তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি নিজেদের সুবিধামতো কখনো কখনো নির্বাচনী স্বার্থে, কখনও গণআন্দোলনকে মোকাবিলা করার জন্য ব্যবহার করে। তাই এরা রাজ্য সরকার বা কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেস বা বিজেপি উভয়ের সম্মানীত প্রতিনিধি হিসাবে আমন্ত্রিত হয়ে মঞ্চ আলোকিত করে। একথাও প্রচার করা হচ্ছে যে, আত্মগোপনকারী কামতাপুর লিবারেশন অর্গানাইজেশন (কেএলও) নেতা জীবন সিং-এর সাথে নাকি উত্তরবঙ্গে আলাদা রাজ্যগঠন ও তার আত্মসমর্পণ বিষয়ে সরকার আলোচনা করছে। রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকারকে পরাজিত করার লক্ষ্যে তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থনে এরাই স্লোগান তুলেছিল যে, ‘‘উত্তরে কামতা - দক্ষিণে মমতা’’-কে চাই।
কিন্তু সবকিছুর মধ্যে বাস্তবিক সত্য বিষয় হলো যে, মানুষের ঐক্য-সংহতি ও গণতান্ত্রিক শক্তিকে দুর্বল করার জন্য ব্যবহৃত এই কামতাপুর, গোর্খাল্যান্ড, গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের মাথাগুলি - অনন্ত মহারাজ, বংশীবদন বা বিমল গুরুং সহ অন্যান্যরা আসলে ‘দাবার ঘুঁটি’। এরা চালিত হয় কৌশলী পাকা খেলোয়াড়দের দ্বারা। এই খেলোয়াড় হলো শাসকশ্রেণি ও তার রাজনৈতিক দল। কেন্দ্রের করপোরেট হিন্দুত্বের বিজেপি সরকার ও রাজ্যের জনবিরোধী-ভ্রষ্টাচারী তৃণমূল কংগ্রেস সরকার পরিচিতিসত্তার রাজনীতিকে সামনে রেখে এই কূটকৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। বর্তমান সময়ে এই বিপজ্জনক রাজনীতির জাল বিস্তার করতে বেশি সুযোগ পাচ্ছে ওই সুবিধাবাদীরা, নির্বাচনে বামপন্থীদের পরাজয় ও বিধানসভায় বামশক্তির অনুপস্থিতি এবং সংসদে দুর্বল উপস্থিতির কারণে।
।। দুই ।।
জনবিন্যাসে অত্যন্ত বৈচিত্র্যপূর্ণ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি নানা জনগোষ্ঠী, নানা ভাষা, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সমাহারে এক বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। উত্তরে পাবর্ত্য এলাকার পাশাপাশি তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে বাস করে নেপালি ভাষী গোর্খা সম্প্রদায়, যদিও এদের মধ্যে আছে গোষ্ঠী ও সংস্কৃতিগত বিভিন্নতা। চা বাগান অধ্যুষিত জলপাইগুড়ি-দার্জিলিং জেলার তরাই-ডুয়ার্স অঞ্চলে আদিবাসীদের প্রভাব উল্লেখযোগ্য। কোচবিহার-জলপাইগুড়ি ও দুই দিনাজপুরে বড়ো সংখ্যায় বাস রাজবংশী সম্প্রদায়ের। এছাড়াও মেচ, রাভা সহ নানা আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও মতুয়া সম্প্রদায় সহ নানা অংশের তফশিলি সম্প্রদায়ের বসতি উল্লেখযোগ্য। মালদা সহ দুই দিনাজপুরে মুসলিম অধিবাসী ও আদিবাসী বিশেষকরে সাঁওতালদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য। চা বাগান অঞ্চলে আদিবাসীদের বড়ো অংশ হলো ‘ওঁরাও’ জনগোষ্ঠীর।
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর এই অনন্য নজির উত্তরবঙ্গে নানা জাতি-জনজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল হচ্ছে পরিচিতিসত্তার আন্দোলনের নানা উপাদান। এই উপাদানগুলির মধ্যে অনেকাংশে যুক্তির চেয়ে আবেগ ও সেই আবেগকে ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু কিছু উপাদান বাস্তবসম্মত ও সংবেদনশীল বলেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়। বিপরীতক্রমে অবাঞ্ছিত কিছু মন্তব্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা যদি বলেন যে, ‘‘উত্তরবঙ্গ বলে কোনো কিছু তিনি মানেন না!’’ তা শুধু হাস্যকরই নয়, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক্ষতিকারক মনোভাব। এই মন্তব্য করার সময় কি মনে ছিলো না যে সরকারের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তর ও মন্ত্রী আছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ তো সরকার স্বীকৃত নাম। ঔদ্ধত্যে সংহতি বজায় থাকে না, বিনম্রতার সাথে পরিচিতির বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দিয়েই ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।
উত্তরবঙ্গের আয়তন ২১,৩২৫ বর্গ কিলোমিটার। পশ্চিমবঙ্গের মোট আয়তনের প্রায় ২৫ শতাংশ। স্বাধীনতার সময়ে দেশভাগ তথা বাংলাভাগের র্যাঙডক্লিফ রোয়েদাদ প্রয়োগ করা হয়েছিল অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিকভাবে। দেশ বিভাগের পরে অভিবাসনের ফলে উত্তরবঙ্গের ভূমির উপর অত্যধিক চাপ বাড়ে। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা শুরু হয়। কৃষিক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিশ্রমী অভিবাসী মানুষ সরল ও কম পরিশ্রমী রাজবংশীদের চেয়ে এগিয়ে যায়। এর মধ্যে জমিদারি উচ্ছেদ আইন ও বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ভূমিসংস্কার এবং ‘অপারেশন বর্গা’-র ফলে স্থানীয় জোতদাররা যে আর্থসামাজিক প্রতিপত্তি হারায় তার প্রভাব সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। রাজনীতি, ক্ষমতায়নের মতো বিষয়গুলি যুক্ত হয়ে যেমন জাত্যভিমানের জন্ম দেয় তেমনই মনস্তাত্ত্বিক অবনমনও ঘটে। ফলে ক্ষোভ-বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তৈরি হয় ‘উত্তরাখণ্ড’, ‘উ-ত-জা-স’ মতো গ্রামীণ জোতদারদের নিজস্ব সংগঠন, যা নানা প্রক্রিয়ায় শাসক শ্রেণির মদত পায়। উপাদান হিসাবে ব্যবহার করা হয় কোচবিহার রাজ্যের ভারতভুক্তির চুক্তি ও তার পরবর্তী সময়ে সরকারি পদক্ষেপের কিছু ধারার অপব্যাখ্যা। যে অপব্যাখ্যার ধারাবাহিকতা বর্তমান সময়েও বজায় রেখেছে গ্রেটার কোচবিহার আন্দোলনের সংগঠকরা। এর সঙ্গেই যুক্ত করা হয় পরিচিতিসত্তা (Identity)-র বিষয়টি। সামনে আসে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বঞ্চনার বাস্তব বা কল্পিত নানা ঘটনাবলি। ফলে সামাজিক বিন্যাসে বিভেদ ও অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ সৃষ্টি হয়। ভূমিপুত্র ও বহিরাগত তকমায় লড়াইয়ের ভাষ্য তৈরি হতে তাকে। শাসকশ্রেণি ভোটের রাজনীতির উপাদান পেয়ে যায় ও পরিস্থিতি জটিল হয়।
।। তিন ।।
রাজন্যশাসিত কোচবিহারের ভারতভুক্তির ইতিহাসটি জানা থাকলে অপব্যাখ্যার সুযোগ থাকে না। ব্রিটিশ শাসনে যে ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাশ হয় তার ৮নং ধারা অনুযায়ী তৎকালীন দেশীয় রাজ্যগুলি ভারত বা পাকিস্তান যে কোনো রাষ্ট্র যোগদানের অধিকার পায়। এই আইন মোতাবেক কোচবিহার কার সঙ্গে যুক্ত হবে তা নিয়ে বিরোধ থাকলেও কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্রনারায়ণ ১৯৪৯ সালের ২৮ আগস্ট ভরত সরকারের অধীনে রাখার ঘোষণা করে নিম্নের চুক্তি করেন। ভারত সরকারের পক্ষে ভিপি মেনন ও কোচবিহারের মহারাজা জগদ্দীপেন্দ্র নারায়ণ এই চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির প্রধান অনুচ্ছেদটি হলো -
চুক্তি পত্রের অনুচ্ছেদ-১
‘‘মহামহিম কোচবিহার রাজ্যের মহারাজা এতদ্বারা ভারত সরকারের উপর কোচবিহার রাজ্যের পূর্ণ অধিকার, সীমানা, ক্ষমতা যা রাজ্যের পরিচালনার জন্য প্রয়োজন তা পূর্ণভাবে সমর্পণ করলেন এবং উক্ত রাজ্যের শাসনভার হস্তান্তরিত করতে অঙ্গীকার করলেন - যা ১২ই সেপ্টেম্বর, ১৯৪৯ থেকে প্রযোজ্য হবে।...’’
এই চুক্তি অনুযায়ী ভারত সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন দফায় আলোচনা করে কোচবিহার প্রথমে একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃতি পায়। পরে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের উদ্যোগে বাস্তব অবস্থা বিচার করে ভারত সরকার কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের একটি জেলা হিসাবে মর্যাদা দেয়। স্থানীয় জোতদারদের একটি দল ‘হিতসাধনী সভা’ এই সংযুক্তির বিরোধিতা করলেও কংগ্রেস ও বামপন্থীরা সহ সমস্ত গণতান্ত্রিক সংস্থা এই অন্তর্ভুক্তিকেই সমর্থন করে। এখন উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে কোনো কোনো মহল থেকে এই ঐতিহাসিক ঘটনাক্রমকে বিকৃত করার চেষ্টা হচ্ছে।
এই প্রসঙ্গে ইতিহাসের একটি পুরনো পর্ব উল্লেখ করা যেতে পারে। কোচবিহার সন্নিহিত ভুটান রাজার ক্রমাগত আক্রমণ ও উৎপীড়নে বিপদগ্রস্ত হয়ে তৎকালীন কোচবিহারের রাজা ধীরেন্দ্র নারায়ণ ১৭৭৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্য নিয়ে বিপদমুক্ত হন, কিন্তু ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নিম্নোক্ত চুক্তি অনুসারে একটি করদ মিত্র রাজ্যে পরিণত হয় ও পরবর্তীতে বঙ্গদেশ (বাংলা)-র সাথে যুক্ত হওয়ার অঙ্গীকার করে। চুক্তিটির ৩নং শর্ত ছিল -
‘‘রাজ্য শত্রুমুক্ত হইলে রাজা ইংলন্ডীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বশ্যতা স্বীকার করিবেন এবং কোচবিহার রাজ্যকে বঙ্গদেশের সহিত সংযোজিত হইতে দেবেন।’’ (সূত্রঃ কোচবিহারের ইতিহাস - খাঁ চৌধুরি আমাদতউল্লা)
কোচবিহারের এই প্রকৃত ইতিহাস অনুধাবন না করলে অসত্য বা অর্ধসত্য কিছু ঘটনাক্রম উল্লেখ করে জনগণকে বিভ্রান্ত করার সুযোগ থেকে যায়। যাই হোক, নানা আলোচনা ও বিতর্কের অবসান করে ১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি প্রকাশ্য জনসভায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোচবিহারকে পশ্চিমবঙ্গের জেলা হিসাবে অন্তর্ভুক্ত করার ঘোষণা করা হয়। উল্লেখ করা দরকার যে, ১৯৫৪ সালে রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের কাছে কেউই কোচবিহারকে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবি জানায়নি।
।। চার ।।
রাজ্যের উত্তরের জেলা আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, উত্তর দিনাজপুরের একটি অংশ ও দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলের আদিবাসীরা মূলত চা বাগান শ্রমিক বা তাদের পরিবারের সদস্য। দেড়/দুই শতবর্ষ পূর্বে চা বাগান মালিকদের প্রয়োজনে শ্রমিক হিসাবেই এদের পূর্বপুরুষরা ছোটোনাগপুর, সাঁওতাল পরগনা, লোহারদাগা ইত্যাদি স্থান ত্যাগ করে পরিযায়ী (Migrated) হয়ে আসে অর্থাৎ তাদের আনা হয়।বর্তমানে প্রতিটি চা বাগানে যতজন শ্রমিক আছেন তার চেয়ে চারগুণের বেশি তাদের পরিবারের সদস্য, যারা চা বাগানের শ্রমিক নন। এদের বাস্তু জমির নিশ্চয়তা নেই - নেই কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা। বর্তমানে শিক্ষার সুযোগ কিছুটা পেলেও অনেকেই নিরাপদ জীবিকা পাচ্ছেন না। এই সমাজের তরুণ প্রজন্মের কাছে উন্নত জীবন জীবিকার আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি আত্মমর্যাদার প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। পরিচিতিসত্তা (Identity)-র বিষয়টি হয়ে উঠেছে সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। উত্তরবঙ্গের আদিবাসীরা সমশ্রেণিভুক্ত (Homogeneous) নয়। এদের মধ্যেও আছে নানা জনগোষ্ঠীগত বিভাজন। যেমন বিভাজন আছে গোর্খাদের মধ্যেও। উত্তরবঙ্গে চা বাগানে বসবাসকারী আদিবাসীরা মূলত নিজেদের মধ্যে সাদ্রিতে কথাবার্তা বললেও এদের ছেলেমেয়েরা হিন্দি বা ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়া করে। কিন্তু এখন এই শিক্ষিত অংশই শুধু শিক্ষা নয়, তাদের মর্যাদার প্রশ্নে নিজেদের ভাষার স্বীকৃতি দাবি করছে। এই বিষয়গুলির ফাঁকফোঁকর দিয়ে আরএসএস ও শাসকশ্রেণির বিভিন্ন ঘোষিত-অঘোষিত সামাজিক সংস্থা সমগ্র এলাকা জুড়ে সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং করে চলেছে এবং নির্বাচনের সময়ে ফায়দা তুলছে। এই প্রক্রিয়াতেই এরা যুক্ত করছে উত্তরবঙ্গে আলাদা রাজ্য বা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের এক কূটকৌশল ভাবনা ও দাবিকে।
কোচবিহার থেকে মালদা - দিনাজপুর পর্যন্ত বসবাসকারী উত্তরবঙ্গবাসী নানা জাতি-জনজাতির নানা ধারা-উপধারার সমাহারে সম্পৃক্ত। বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যই এই অঞ্চলের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারক হতে পারে। শাসকশ্রেণি ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা চায় এই ঐক্যের বিপরীতে একের বিরুদ্ধে অপরকে স্থাপিত করতে। ব্যবহার করে পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে।
আমরা জানি পুঁজিবাদ যেমন আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি করে, তেমনই আবার ‘পিছিয়ে পড়া’ জনগোষ্ঠীর মধ্যে অগ্রগতির আকাঙ্ক্ষাও তৈরি করে। কিন্তু বর্তমান আন্তর্জাতিক লগ্নি পুঁজি নিয়ন্ত্রিত উদার আথিক নীতির সময়ে ধান্দার পুঁজিবাদ (Crony Capitalism) আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি অস্বাভাবিকভাবে আত্মমর্যাদাহীন সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা সৃষ্টি করে এক জনগোষ্ঠীকে অপর জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে শোষকের আসল চেহারাকে আড়াল করে। দুর্বল করে শ্রেণিআন্দোলন ও গণআন্দোলনের উপাদানগুলিকে। উত্তরবঙ্গও এই চক্রান্তের বাইরে নয়।
।। পাঁচ ।।
বামপন্থীরা ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ও রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতা দাবি করে দেশে গণতন্ত্র ও সংহতিকে শক্তিশালী করতে। কিন্তু আরএসএস বা বিজেপি’র নীতি ঠিক বিপরীত। আরএসএস চায় কেন্দ্রের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছোটো ছোটো রাজ্য ও কার্যত একটি এককেন্দ্রীক প্রশাসন। এছাড়াও আরএসএস-এর নীতি অনুসারেই কেন্দ্রের বর্তমান বিজেপি সরকার দেশের সীমান্ত এলাকায় কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল বা কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত প্রশাসন গঠনের লক্ষ্যে তৎপর।
এই তৎপরতার বিপজ্জনক চিত্র দেখা গেল যেভাবে কেন্দ্রীয় সরকার জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যকে স্বৈরাচারী কায়দায় বিভাজিত করলো ও লাদাখকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করলো - তার মধ্যে। এজন্য কাশ্মীরের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের জন্য বিজেপি’র ‘সার্জিকাল স্ট্রাইক’।
রাজ্যের বামফ্রন্ট সরকার উত্তরবঙ্গের আর্থ-সামাজিক ও ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনায় রেখেই উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, কৃষির উন্নতি ও শিল্পায়ন, শিক্ষার পরিকাঠামো উন্নয়ন ও সংস্কৃতির বিকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল। তফশিলি-আদিবাসী-সংখ্যালঘু সহ গরিব মানুষকে জমি, গরিব মানুষকে বাস্তু জমির পাট্টা, গ্রামগুলিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ও পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সামাজিক প্রকল্পগুলি বাস্তবায়নের যে অগ্রগতি ঘটেছিল বর্তমান সরকারের হাতে তা ধ্বংস হয়ে বিপর্যয়কর চেহারা নিয়েছে।
সিএএ এবং এনআরসি নিয়ে নানা প্রচার ও আসাম সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এর প্রভাব ও নানা ঘটনাবলি উত্তরবঙ্গের জনগণের মধ্যে উদ্বেগ ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। এর সুযোগও গ্রহণ করে নানা স্বার্থান্বেষী মহল।
এই সামগ্রিক প্রেক্ষাপটেই উত্তরবঙ্গের বর্তমান রাজনীতি, বিজেপি’র গোপন অ্যাজেন্ডা, উত্তরবঙ্গের কিছু বুদ্ধিজীবী উত্তর-সত্য (Post Truth) অভিমুখী প্রচার এবং জনবিরোধিতা ও দুর্নীতিতে জর্জরিত তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপি’র গড়াপেটার লড়াই সম্পর্কে সতর্ক থেকে জনগণের জীবন জীবিকার প্রশ্নে শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলনই এই সময়ে উত্তরবঙ্গবাসীর অগ্রাধিকার। আলোচিত নানা সমস্যা, অভাব-অভিযোগ নিরসনে বিভাজন নয়, ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামই সমস্যা সমাধানের প্রকৃত পথ।
বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যর এই অনন্য নজির উত্তরবঙ্গে নানা জাতি-জনজাতি জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিনিয়ত ক্রিয়াশীল হচ্ছে পরিচিতিসত্তার আন্দোলনের নানা উপাদান। এই উপাদানগুলির মধ্যে অনেকাংশে যুক্তির চেয়ে আবেগ ও সেই আবেগকে ব্যবহার করে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধিমূলক তৎপরতা আছে সন্দেহ নেই, কিন্তু কিছু উপাদান বাস্তবসম্মত ও সংবেদনশীল বলেই গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হয়। বিপরীতক্রমে অবাঞ্ছিত কিছু মন্তব্য ক্ষতির কারণ হতে পারে। যেমন রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বোচ্চ নেতা যদি বলেন যে, ‘‘উত্তরবঙ্গ বলে কোনো কিছু তিনি মানেন না!’’ তা শুধু হাস্যকরই নয়, ঔদ্ধত্যপূর্ণ ক্ষতিকারক মনোভাব। এই মন্তব্য করার সময় কি মনে ছিলো না যে সরকারের উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন দপ্তর ও মন্ত্রী আছে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ তো সরকার স্বীকৃত নাম। ঔদ্ধত্যে সংহতি বজায় থাকে না, বিনম্রতার সাথে পরিচিতির বৈচিত্র্যকে মর্যাদা দিয়েই ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে।