৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
নভেম্বর বিপ্লব ও নারী সমাজ
বনানী বিশ্বাস
মহান লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিক পার্টি রুশদেশে ১৯১৭ সালের ৬ নভেম্বর রাত্রে এবং ৭ নভেম্বর সকালে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। রুশ দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সফল হয় এবং প্রতিষ্ঠিত হয় শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব।
মহান লেনিনের প্রদর্শিত পথে এবং যোশেফ স্তালিনের নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে একের পর এক সাফল্য অর্জন করে উৎকৃষ্ট সমাজ ব্যবস্থার পথে চলতে শুরু করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। সাম্রাজ্যবাদের একের পর এক চক্রান্ত ব্যর্থ করে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, ক্রীড়া, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সহ সর্বক্ষেত্রে সাফল্যের শিরোপা পেয়ে এক নতুন বিকল্প সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। মানুষের শোষণমুক্তির সংগ্রামে সর্বশ্রেষ্ঠ মতাদর্শ মার্কসবাদের সফল ও সঠিক প্রয়োগ হয়েছিল নভেম্বর বিপ্লবের মাধ্যমে।
নারীদের বিপ্লবী ও আত্মত্যাগের ভূমিকা নভেম্বর বিপ্লবের সাফল্যের পথে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। লেনিন বলেছিলেন, ‘‘সমস্ত জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের অভিজ্ঞতায় জানা যায় যে, বিপ্লবের সাফল্য নির্ভর করে মেয়েরা কী পরিমাণে বিপ্লবের কাজে অংশগ্রহণ করেছে তার ওপর।’’
নভেম্বর বিপ্লব নিপীড়িতদের মহান বিদ্রোহ যা শেষ পর্যন্ত সফল হয়। বিপ্লবের সাফল্যের অব্যবহিত পরেই সোভিয়েত সরকার নারীর অধিকারের পক্ষে সব আইন চালু করেছে। পুরুষ ও নারীর সমান অধিকার স্বীকার করা হয়েছে। নারীমুক্তি শুধু আদর্শ হিসেবে থাকল না - বাস্তবায়িত হলো। সোভিয়েত রাশিয়া ক্ষমতা গ্রহণ করার পরদিনই নারী-পুরুষের সমতার লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন হয়। বিশ্বে সর্বপ্রথম রাশিয়াতেই ১৮ বছরের নারী ও পুরুষের ভোটাধিকার স্বীকৃত হয়।
নারীর সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন করার জন্য আইন রচনা করা হলো। ১৯১৯ সালে পরিবার আচরণবিধি আইন প্রণীত হয়। এই আইন ১৯২৬ সালে সংশোধিত হয় এবং এই আইন আজ পর্যন্ত নারীদের অধিকার সম্পর্কে সর্বাধিক প্রগতিশীল আইন। বিবাহ বিচ্ছেদের অধিকার, খোরপোশ, বাধ্যতামূলক বিবাহ, বিবাহ সম্পর্কিত সম্পত্তির ওপর অধিকার, অবৈধ জন্ম ধারণার অবলুপ্তি, বিবাহজাত ও বিবাহ ব্যতিরেকে প্রতিটি সন্তানকে পিতা-মাতার সাহায্য দেওয়ার অধিকার এবং প্রতিটি অধিকারকে সুনিশ্চিত করা হয়।
গুরুত্বপূর্ণ আইনের মধ্যে একটি হলো সমান কাজের জন্য সমান বেতনের আইন। এর আগে নিয়োগ কর্তার লাভজনক নিয়ম ছিল নারী শ্রমিকের বিরুদ্ধে পক্ষপাত এবং বৈষম্যমূলক মজুরি নীতি চালু রাখা। বিপ্লবের আগে পর্যন্ত একজন পুরুষ শ্রমিকের দৈনিক গড় মজুরি ছিল এক রুবল একচল্লিশ কোপেক, যেখানে একজন নারী একই কাজের জন্য পেত বাহাত্তর কোপেক - অর্ধেক মাত্র।
চালু হলো আর একটা আইন - পুরুষ ও নারী উভয়েই সপ্তাহে একটা ছুটির দিন অর্জন করলো এবং আট ঘণ্টার শ্রমদিবস চালু হলো।
শ্রমজীবী নারীর সুরক্ষার জন্য যে শিল্প নারীর স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক তাদের সেই শিল্পে নিয়োগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো, ভার বহনকারী জিনিসের ক্ষেত্রে নারীর জন্য নির্দিষ্ট সীমা ঠিক করে দেওয়া হলো। বিপ্লবের অব্যবহিত পরেই লেনিন ঐতিহাসিক মা ও শিশুর আইনে স্বাক্ষর করেন। প্রসূতি ও সন্তানসম্ভবা নারীদের জন্য সামগ্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ করলো - এটা বিশ্ব ইতিহাসে সর্বপ্রথম।
১৯১৭ সালের শেষে আইন জারি হলো যে, প্রসবের নির্দিষ্ট সময়ের আগে ও পরে নারী তার কাজ থেকে ছুটি পাবে পুরো বেতনে, সরকারি ব্যয়ে চিকিৎসার সুযোগ পাবে মা ও শিশু।
১৯২২ সালে সোভিয়েত ল্যান্ড কোডে সাধারণ অধিগৃহীত জমিতে নারী-পুরুষের সমান অধিকার দেওয়া হয়। শিল্পে নারীদের কাজের সুযোগ এবং সামাজিক উৎপাদনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়। পারিবারিক গৃহস্থালির কাজকেও সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করা হয়। নারীদের অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য সাধারণ রান্নাঘর, ভোজনালয়, শৌচালয়, শিশু রক্ষণাগার তৈরি হলো। এই সকল প্রতিষ্ঠানগুলিকে ‘‘Young Shoot of Communism.’’ আখ্যা দেন লেনিন। নারীদের পারিবারিক কাজকে সামাজিক দায়িত্বের মধ্যে নিয়ে আসা হলো।
রুরাল কমিউনে নারী ও পুরুষের পূর্ণ সভ্যপদ দেওয়া হয়। যৌথ কৃষি খামারে নারীরা যুক্ত হয়। নারীদের পার্টি সংগঠনে নিয়ে আসার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। নারীশাখা গঠন করা হয়। তাদের বিভিন্ন গঠনমূলক কাজে যুক্ত করা হয়। অনাথ শিশুদের দায়িত্ব নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বিভাগে নারীদের নিয়োগের ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। নারীদের প্রতি মনোযোগ দেওয়ার ফলে অর্থাৎ সমাজে সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার ফলে নারীদের অবস্থার অগ্রগতি ঘটেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নাৎসিবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের সময়ে সৈনিক হিসাবে তাঁদের ভূমিকা ছিল অনবদ্য। ফ্যাসিস্ত আক্রমণের ভয়াবহতা দেখে সোভিয়েত নারীরা ‘সোভিয়েত উইমেন্স অ্যান্টি ফ্যাসিস্ট কমিটি’ গঠন করেন ১৯৪১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর।
সোভিয়েত রাশিয়ার বীরত্বপূর্ণ কাহিনিগুলি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানের পর শান্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সোভিয়েত রাশিয়া। শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বানে গড়ে ওঠে বিশ্ব নারী সংঘ। বিশ্বশান্তি, নারী ও শিশুদের অধিকার রক্ষা করা এবং সারা পৃথিবীর নারীদের সমবেত করা ছিল বিশ্ব নারী সংঘের প্রধান উদ্দেশ্য। সোভিয়েত রশিয়ার শিশুরা ছিল জাতির সম্পদ। দশ বা অধিক সন্তানের জননীকে পুরস্কৃত করা হতো। মানব সম্পদ সৃষ্টি করার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হতো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি জার্মানির আক্রমণে সোভিয়েত রাশিয়ার যুবসমাজ প্রাণপণ লড়াই করে নাৎসিদের পরাস্ত করেছে এবং যুদ্ধ শেষে লালফৌজ বার্লিনে লাল পতাকা উড্ডীন করে ফ্যাসিস্ত শক্তির পতন ঘটায়। দেশপ্রেমিক নারী সমাজকে সোভিয়েত রাশিয়া সম্মানিত করে। নারীর অধিকার ও মর্যাদা রক্ষায় সমাজতান্ত্রিক দেশ যেভাবে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিল তা ইতিহাসে বিরল। মহাকাশ অভিযানে ইউরি গ্যাগারিনের পাশাপাশি তেরেশকোভাও শামিল হয়েছিলেন।
লিঙ্গ বৈষম্য ছিল না। নারী-পুরুষের সমানাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নারীরা স্বাধীন ছিল। অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ছাড়াও সামাজিক স্বাধীনতা ভোগ করতো। স্বামী নির্বাচনে নারীদের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হতো।
বিপ্লবের ছয় মাসের মধ্যে সমস্ত প্রচলিত আইন বাতিল করা হলো, তার পরিবর্তে এলো নারীর জন্য ন্যায়সঙ্গত লিঙ্গ আইন, জমিদারি প্রথার অবসান এবং কৃষকদের জমি হস্তান্তর - এটা ছিল সোভিয়েতের প্রথম ডিক্রি। লেনিনের স্বাক্ষর সংবলিত সেই ডিক্রিতে জমির ওপর কৃষক রমনীদের সম অধিকার দেওয়া হলো। ১১ নভেম্বর ভোরে আর একটা ডিক্রিতে প্রতিষ্ঠিত হলো আট ঘণ্টা কাজের নিয়ম। ওই একই ডিক্রিতে নিষিদ্ধ হলো নারীদের রাতে কাজ করানোর প্রথা। ১৪ নভেম্বর ‘‘সামাজিক নিরাপত্তা বিধানের’’ আওতায় কর্মরত সকল নারীকে ১৬ মাসের মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার দেওয়া হলো। আরও একটা বিধান সেটাও বিশ্বে প্রথম, মাসিক ঋতুকালে মেয়েদের ঐচ্ছিক ছুটির অধিকার। ১৯১৮ সালে আরও প্রসারিত হলো মাতৃত্বকালীন সুযোগ সুবিধা। সদ্য প্রসূতি মাতা সন্তানদের দেখাশোনা করার জন্য প্রতি তিন ঘণ্টা অন্তর সবেতন কর্মবিরতির সুবিধা পাবে। মজুরি সংক্রান্ত ডিক্রিতে ন্যূনতম মজুরি নির্ধারিত করার সঙ্গে সঙ্গে নারীর জন্য সম মজুরি ধার্য করা হয়।
১৯১৮ সালের জুলাই মাসে গৃহীত হয় সমাজতান্ত্রিক শাসনের প্রথম সংবিধান। সারা পৃথিবীতে প্রথম দেশ সোভিয়েত, যেখানে সম্পত্তি ও শিক্ষা সংক্রান্ত কোনো শর্ত ছাড়াই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভোটদানে সমানাধিকার দেওয়া হয়।
নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের হোতা যে দেশ ইংল্যান্ড, তাদের থেকে এক দশক আগে সোভিয়েতের নারীরা ভোটের অধিকার পেয়েছিল। রাশিয়ায় সর্বজনীন সাক্ষরতার জন্য জারি হয়েছিল ডিক্রি। ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরে সমাজতান্ত্রিক রাশিয়ায় এটা আইন হিসাবে চালু হয়। তার কুড়ি বছরের মধ্যেই ১৯৩৯ সালে রাশিয়ায় নারীদের মধ্যে নিরক্ষরতার অবসান হয়।
নারীদের দক্ষতা ও যোগ্যতার বিকাশের সুযোগ দেওয়া হলো। কারখানায় শিক্ষানবিশী, বৃত্তিশিক্ষার নবিশী এবং কর্মক্ষেত্রে প্রশিক্ষণ সহ সমস্ত সুযোগ পেল নারীরা। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির পুনর্নির্মাণে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন সোভিয়েত নারী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে স্নাতকদের ৩৬ শতাংশ নারী এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য পরিষেবায় নারীরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।
লেনিনের উদ্যোগে সোভিয়েত সমাজের বাস্তব জ্ঞান, কাজের সুযোগ এবং আইনি প্রশিক্ষণের জন্য একটি নারী বিভাগ খোলা হয়েছিল, তার নাম জেঁনোটডেল (Zhenotedel)। এই বিভাগের উদ্দেশ্য ছিল কাজের জন্য মেয়েদের প্রশিক্ষণ দেওয়া। বিপ্লবের সময়ে পার্টির মধ্যে দশ শতাংশ ছিল নারী। জেঁনোটডেল-এর মাধ্যমে সেই সংখ্যা কয়েক মিলিয়নে পরিণত হলো। বিশেষ সংবাদপত্র প্রকাশিত হতো শুধুমাত্র নারী কমিউনিস্ট এবং নারী শ্রমিকদের মতাদর্শগত শিক্ষা দেবার জন্য। এর ফলাফল খুবই উৎসাহব্যঞ্জক এবং এই কারণে প্রথম দশকেই সমস্ত নির্বাচিত পর্বে নারীর প্রতিনিধিত্বের হার চল্লিশ শতাংশ হয়। এটাও একটা ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত, যার তুলনা আজও কোনো পুঁজিবাদী দেশে দেখা যায়নি। ১৯৩০ সালে জেঁনোটডেল ভেঙে দেওয়া হয় এই যুক্তিতে যে, তার আর প্রয়োজন নেই। কিন্তু সার্বিক পর্যালোচনায় এখন মনে হয় ওই সিদ্ধান্ত অপরিণতই ছিল - তখন অনেক কাজ অসমাপ্ত থেকে গিয়েছিল।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জীবিকা ও বাসস্থানের মতো মানুষের মৌলিক সমস্যাগুলির যে সমাধান সম্ভব, সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা বিশ্বের সামনে সেই উদাহরণ তুলে ধরে। যে সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের ভিত্তিতে সোভিয়েত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল তার প্রশংসা বিশ্বের বহু মনীষী অকুণ্ঠভাবে করেছেন। সমকালীন বিশ্বের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা সোভিয়েত রাশিয়ার প্রশংসায় মুখর হয়েছিলেন। প্রখ্যাত ফরাসি উপন্যাসিক হেনরি বারবুশ বলেছিলেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্ম হলো বিশ্ব ইতিহাসের মহত্তম ও সবচেয়ে সুন্দর ঘটনা।’’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নভেম্বর বিপ্লবের ১৩ বছর পর সোভিয়েত দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা রাশিয়ার চিঠিতে লিখেছিলেন - ‘‘যা দেখছি আশ্চর্য ঠেক্ছে। অন্য কোন দেশের মতোই নয়। একেবারে মূলে প্রভেদ। আগাগোড়া সকল মানুষকেই জাগিয়ে তুলেছে।’’ মহান বিজ্ঞানী স্যার অ্যালবার্ট আইনস্টাইন সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের একের পর এক সাফল্যে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন, ‘‘সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একমাত্র পুঁজিবাদের সৃষ্ট ভয়ানক সংকট থেকে মানব সমাজকে মুক্ত করতে সক্ষম। রমাঁ রল্যাঁ, চার্লি চাপলিন সহ বহু বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব সমাজতন্ত্রের ঘনিষ্ঠ অনুরাগীতে পরিণত হয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্বের বিজ্ঞানী-শিল্পী সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের এক উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ব্যক্তিদের ওপর নভেম্বর বিপ্লবের প্রভাব পড়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়নের জন্মলগ্ন থেকেই নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। গৃহযুদ্ধ, বহিঃশত্রুর আক্রমণ, অন্তর্ঘাত প্রভৃতি প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করেই সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ দেশ থেকে অল্পদিনের মধ্যেই অগ্রসর দেশে পরিণত হয়। দ্রুত এই অর্থনৈতিক উন্নয়নের কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ফ্যাসিবাদের মতো বিধ্বংসী শক্তিকে প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও হিটলারের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদকে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত করে সোভিয়েত ইউনিয়ন মানব সভ্যতাকে রক্ষা করেছিল।
১৯৯১ সালে বিপ্লবের ৭৪ বছর পরে সোভিয়েত ইউনিয়নে বিপর্যয় ঘটলো কেন এই নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন আছে। লেনিন রাশিয়ার বুকে প্রথম সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করেছিলেন। তখন সেই দেশ ছিল একটি পশ্চাৎপদ দেশ। ফলে তাঁকে সম্পূর্ণ নতুন পথে চলতে হয়েছিল - কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা, দিক্নির্দেশ তাঁর সামনে ছিল না। তিনি নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালু করেছিলেন, যে রাষ্ট্র ও বেসরকারি উদ্যোগের মধ্যে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যদিও আধিপত্য ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের।
কেউ ভাবতে পারেনি যে, একটা দেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়ে যাওয়ার পর তার আবার পতন হতে পারে, আবার সে দেশে পুঁজিবাদ ফিরে আসতে পারে। সেই কারণে আশঙ্কা করেই লেনিন বারে বারে আত্মসন্তুষ্টি পরিহারের কথা বলেছিলেন।
১৯৯২ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র চর্তুদশ কংগ্রেসের প্রস্তাবে সোভিয়েত বিপর্যয়ের কিছু কারণ চিহ্নিত করা হয়। তার মধ্যে একটি হলো, সে দেশে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার বদলে পার্টির এবং বেশিরভাগ সময়ে পার্টি নেতৃত্ব একনায়কত্বে পরিণত হয়েছিল। ফলে পার্টি ও রাষ্ট্র ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তার সঙ্গে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হুমকির মুখে প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়াতে হয় সোভিয়েত ইউনিয়নকে। সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে গিয়ে উন্নতমানের ভোগ্যপণ্য তৈরির কাজ অবহেলিত থেকেছে।
নভেম্বর বিপ্লবের ৭৫ বছর পর সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হয়েছে এটা সত্য। রাশিয়া সহ পূর্ব ইয়োরোপে যেখানে পুঁজিবাদী প্রতিবিপ্লবে সমাজতন্ত্রের পতন হয়েছে, সেখানে সর্বত্র পুরাতন বৈষম্য ফিরে এসেছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সেই সমস্ত দেশে সব চাইতে দুরবস্থায় রয়েছে নারীরা। এই চিত্রটাও আমাদের সামনে রয়েছে ৭৫ বছর সময়কালে নারীর সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে যে অগ্রগতি ঘটেছিল সেটা সম্ভব হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাতেই। সুদূর ভবিষ্যতের একমাত্র প্রেরণা নভেম্বর বিপ্লব। নভেম্বর বিপ্লবের শিক্ষা ব্যর্থ হবার নয়।