৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
সোভিয়েত বিজ্ঞান আজ কোথায়?
শ্যামল চক্রবর্তী
ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ
১৬৬০ সালে রয়েল সোসাইটি তৈরি হয়। ওই সময় রাশিয়ার জার সম্রাট ছিলেন আলেক্সেই। তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন স্যামুয়েল কলিন্স (১৬১৯-১৬৭০)। মাত্র দু’বছর পর ১৬৬২ সালে রয়েল সোসাইটি স্যামুয়েল-কে করেসপন্ডিং সদস্য মনোনীত করে। বলা যেতে পারে, রাশিয়ার সঙ্গে সোসাইটির যোগাযোগ প্রথম থেকেই শুরু হয়। তবে এটি ছিল ব্যক্তির সঙ্গে সোসাইটির সম্পর্ক। দেশের সঙ্গে তখনও এই সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি।
আলেক্সেই-এর পুত্র পিটার দি গ্রেট যখন রাজাসনে বসলেন তখন যোগাযোগ নিবিড় হতে শুরু করে। ১৬৯৮ সালের ২৭ জানুয়ারি পিটার রয়েল সোসাইটিতে যান। ৬ ও ৯ মার্চ দু’দিন রয়েল মানমন্দির দেখতে যান। চার্লস মন্তাগো সেসময় ছিলেন সোসাইটির সভাপতি। মানমন্দিরের প্রথম অ্যাস্ট্রোনোমার রয়েল ছিলেন বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী জন ফ্ল্যামস্টিড (১৬৪৬-১৭১৯)। ১৬৯৮ সালের ১৩ ও ২১ এপ্রিল পিটার রয়েল টাঁকশাল দেখতে যান। তখন আইজাক নিউটন সেখানে চাকরি করছেন। আইজক নিউটন ও জন ফ্ল্যামস্টিড দুজনেই রয়েল সোসাইটির ফেলো ছিলেন। বিজ্ঞানের বিষয়ে নিউটনের সঙ্গে পিটারের কথাবার্তা নিশ্চয়ই হয়েছে। নইলে পাঁচ বছর পরে নিউটন রয়েল সোসাইটির সভাপতি হয়ে পিটারের কাছে তাঁর লেখা ‘প্রিন্সিপিয়া ম্যাথামেটিকা’ বইয়ের কপি পাঠাতেন না।
রয়েল সোসাইটি ঘুরে আসার পর পিটার রবার্ট আরেসকাইন নামের স্কটল্যান্ডের এক চিকিৎসককে নিজের চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ করেন। পিটারের পরামর্শে রবার্ট রুশ দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবা নতুন করে সাজানোর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অসামরিক ও সামরিক উভয় স্বাস্থ্য পরিষেবা বিভাগের প্রধান করা হয় তাঁকে। পিটারের নির্দেশে তিনি ইয়োরোপ থেকে অনেক বই ও যন্ত্রপাতি কেনেন। সেন্ট পিটার্সবার্গের এক জায়গায় সেগুলি সাজানো হয়। সেখানেই পরে রুশ বিজ্ঞান আকাডেমি গড়ে উঠেছিল। রয়েল সোসাইটি ১৭১৪ সালে দু’জন ব্রিটিশ বণিকের সুপারিশে রুশ দেশের প্রভাবশালী রাজনীতিজ্ঞ লর্ড আলেকজান্ডার মেনশিকভকে রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ দান করে। সভাপতি আইজাক নিউটন নিজে তাঁকে চিঠি দিয়েছিলেন। রয়েল সোসাইটির বিজ্ঞানের ইতিহাস বিষয়ক যে, জার্নাল রয়েছে সেখানে ২০১৭ সালের ৩০ আগস্ট একটি লেখা বেরোয়। সেই লেখায় বলা হয়েছে যে মেনশিকভ প্রায় নিরক্ষর ছিলেন। সোসাইটিতে তাঁর মনোনয়ন তাই পুরোপুরি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বললেই সঠিক হয়। রয়েল সোসাইটির কাজকর্ম ও পরে রুশ বিজ্ঞান আকাডেমির কাজকর্ম রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক আধিপত্য ছিল যাঁদের, তাঁদের হাতেই শুরু হয়েছিল। সূচনাপর্ব থেকেই বিজ্ঞানের সঙ্গে রাজনীতির নৈকট্য তাই অস্বীকার করা সম্ভব নয়।
১৭২৫ সালে পিটার মারা যান। পরের উত্তরাধিকারী প্রথম ক্যাথেরিনের হাতে ১৭২৬ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গ আকাডেমি তৈরি হয়। তৈরি হবার অল্পদিনের মধ্যেই রয়েল সোসাইটির সহায়তা চেয়ে আকাডেমি চিঠি লেখে। আইজাক নিউটন তখনও সভাপতি রয়েছেন। ১৭২৭ সাল পর্যন্ত নিউটন সভাপতি ছিলেন। সোসাইটি ও আকাডেমির সভাপতি দু’জনের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি হয়। রুশ বিপ্লবের পর সেন্ট পিটার্সবার্গ আকাডেমির নাম বদলে রুশ বিজ্ঞান আকাডেমি হয়েছে। দুই প্রতিষ্ঠানের সম্পর্কও নিবিড় থেকে নিবিড়তর হয়েছে। নভেম্বর বিপ্লবের পর সংসদীয় গণতান্ত্রিক দলের সক্রিয় কর্মী ও বিশিষ্ট নৃতত্ত্ববিদ সের্গেই ফেদেরোভিচ ওল্ডেনবুর্গ (১৮৬৩-১৯৩৪) লেনিনের সঙ্গে আকাডেমির ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা বলতে গেলে লেনিন তাঁকে বলেন, এই সারস্বত প্রতিষ্ঠানকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সরকার অর্থকড়ি দিয়ে সহায়তা করবে। রুশদেশের রাজনৈতিক পালা বদল হলো। জারের শাসন থেকে বেরিয়ে এলো মানুষ। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি হলো। লেনিন রুশ বিজ্ঞান আকাডেমিকে রক্ষার জন্য শুরু থেকে সবরকমের সহায়তা করেছেন। তবে লেনিন বেশিদিন বাঁচলেন না। ১৯২৪ সালে তিনি প্রয়াত হন।
ইলিয়া মেচনিকভ
১৯০০ সাল থেকে ওল্ডেনবুর্গ রুশ বিজ্ঞান আকাডেমির সদস্য ছিলেন। জিওগ্রাফিক্যাল সোসাইটি গড়ে তুলেছেন তিনি। মধ্য এশিয়া ভ্রমণ করেছেন। সংস্কৃত পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করেছেন। ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের পর ওল্ডেনবুর্গ প্রাদেশিক সরকারের শিক্ষামন্ত্রী হয়েছেন। রাশিয়ার আদিবাসী জনসংখ্যা নিয়ে কাজ করেন। তাঁর দলের অন্যান্যদের ভূমিকা যেমনই হোক, তিনি বিপ্লবের পর রাশিয়াতেই থেকে যান। ১৯২৭ সাল পর্যন্ত রুশ আকাডেমির স্থায়ী সচিব ছিলেন। পরে সোভিয়েত প্রাচ্যবিদ্যা প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন। এশীয় বিদ্যাচর্চাতেই তাঁর আগ্রহ ছিল বেশি। পারস্পরিক সম্পর্কের একটা পরিসংখ্যান আমরা দিতে পারি। ১৭২৪ থেকে ১৮৭৪ সালের মধ্যে ৪৭ জন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী রুশ বিজ্ঞান আকাডেমির সদস্য হয়েছিলেন। এঁদের শতকরা ৭৫ ভাগ রয়েল সোসাইটির সদস্য ছিলেন। ফলত এঁদের কাছে দুই প্রতিষ্ঠান-ই নিজেদের প্রতিষ্ঠান বলে গণ্য হতো।
এদিকে ব্রিটেনের মাটিতে শিল্প বিপ্লব সংগঠিত হলো। প্রযুক্তি পরিকাঠামো বিকশিত হলো। সমকালের রুশ দেশে তুলনীয় কোনো সামাজিক পরিবর্তন দেখা গেল না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক রচনায় কোনো প্রকৃতিগত বদল চোখে পড়েনি আমাদের। বিভিন্ন বছরে মেধাবী রুশ বিজ্ঞানীরা রয়েল সোসাইটির সভ্য হচ্ছেন। গণিতজ্ঞ চেবিটশেভ ১৮৫৬ সালে রুশ বিজ্ঞান আকাডেমির সদস্য ও ১৮৭৭ সালে রয়েল সোসাইটির সদস্য হয়েছেন।
ব্রিটেনের বিজ্ঞান মহলে বড়ো পরিসরে অভিনন্দিত হলেন রসায়নবিদ মেন্ডেলিভ (১৮৩৪-১৯০৭)। ১৮৭২ সালে লন্ডনের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উপলক্ষে মেন্ডেলিভ পুরস্কারে সম্মানিত হন। এক দশক পরে রয়েল সোসাইটি তাঁকে রসায়নের সর্বোচ্চ পরস্কার ‘ডেভি পদক’ দান করে। ব্রিটেনের বহু বিশ্ববিদালয়ে মেন্ডেলিভ বক্তৃতা করেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক উপাধি লাভ করেন। এডিনবরা, কেমব্রিজ ও অক্সফোর্ডে বক্তৃতা দিয়েছেন মেন্ডেলিভ। একাধিক সোসাইটির সাম্মানিক সদস্য হয়েছেন। ১৮৯২ সালে রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেছেন। শুরুতে মেন্ডেলিভ জার্মান পত্রিকায় গবেষণাপত্র লিখলেও পরে প্রধানত ব্রিটিশ জার্নাল ‘নেচার’-এ তাঁর গবেষণাপত্র বেরিয়েছে। অবজ্ঞাও তাঁর জীবনে কম ছিল না। রুশ বিজ্ঞান আকাডেমি তাঁকে পূর্ণ সভ্য করেনি। অন্তর্কলহের ফলাফল অনেককেই পৃথিবীর ইতিহাসে ভুগতে হয়। ১৮৭৬ সালে পদার্থবিদ্যার বন্ধুরা তাঁকে করেসপন্ডিং সভ্য করেছেন। বহু ব্রিটিশ বিজ্ঞানী মেন্ডেলিভের সঙ্গে গবেষণা করেন। নোবেলজয়ী উইলিয়াম রামজে বলেছিলেন, ‘তিনি আমাদের শিক্ষক’। ১৯০৫ সালে মেন্ডেলিভ রয়েল সোসাইটি থেকে মর্যাদাসম্পন্ন ‘কোপ্লে পদক’ পেয়েছেন। যা আমাদের অবাক করে, ১৯০১ সালে নোবেল পুরুস্কার চালু হলো। মেন্ডেলিভ নোবেল পুরস্কার পেলেন না। পুরস্কারের মাপকাঠিতে বিজ্ঞানজগতে মেন্ডেলিভের বিচার হয় না। তবু নোবেল দানের ইতিহাসে এই অসম্পূর্ণতা তো থেকে গেল। মোট ১৪ বার মেন্ডেলিভ ব্রিটেন গিয়েছেন। ব্রিটেন তাঁকে একুশটি সম্মান দিয়েছে। আমেরিকা ও ফ্রান্স এই দু’দেশ মিলিয়ে তিনি ৮টি পুরস্কার পেয়েছেন। জার্মানি থেকে ৭টি পুরস্কার পেয়েছেন।
১৮৫৯ সাল। ডারউইনের বিখ্যাত বই ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হলো। সংগঠিত ধর্মের কাছে ঘোর আপত্তিকর এই বই। ১৮৬০ সালে এই বই জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়। বিপ্লবোত্তর রুশদেশ এই বই সানন্দে গ্রহণ করে। রুশদেশের জীববিজ্ঞানীরা ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্বকে সমর্থন করেন। বিজ্ঞান ঐতিহাসিকেরা বলেন, রুশ দেশের মাটি হলো ডারউইন ভাবনার দ্বিতীয় ভিত্তিভূমি। জারশাসনের আমলে ১৮১৭ সাল থেকে বই পত্রপত্রিকা লেখালেখি ও প্রকাশের বিষয়ে নানারকমের নিষেধাজ্ঞা ছিল। সেন্সরশিপ ছিল। ১৮৬৫ সালে সেসব আইন-কানুন খানিকটা শিথিল হয়। প্রকাশকদের বলা হলো, বিজ্ঞানের বইপত্র ছাপতে আগাম অনুমতির প্রয়োজন নেই। ১৮৬৪ সালে রুশ ভাষায় প্রথম ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ প্রকাশিত হয়। তবে ‘ডিসেন্ট অফ ম্যান’ প্রকাশ করতে গিয়ে নিষেধাজ্ঞার বহু বেড়াজাল টপকাতে হয়েছে। ডারউইন ভাবনার চর্চা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল সেসময়। আলেকজান্ডার কোভালেভস্কির নাম বলতেই হয়। ১৮৯৫ সালে কোভালেভস্কি রয়েল সোসাইটির সদস্য নির্বাচিত হন। তখনও কিন্তু তিনি রুশ আকাডেমির সদস্যপদ অর্জন করেননি।
যাইহোক, এইভাবে পশ্চিমি সভ্যতার সঙ্গে আদান প্রদানের ফলে রুশ দেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরিকাঠামো গড়ে উঠছিল। ১৯০১ সালে নোবেল পুরস্কার চালু হবার পর রাশিয়া ও সোভিয়েত দেশ মোট ৩২টি নোবেল পুরস্কার পেয়েছে। প্রথম যিনি নোবেল পেয়েছেন তিনি সুপরিচিত। ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ। ১৯০৪ সালে শারীরতত্ত্ববিদ্যা/মেডিসিনে তিনি নোবেল পেয়েছেন। তাঁর কাজের সামাজিক প্রভাব অপরিসীম। নোবেল লাভের তিন বছর পর ১৯০৭ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলো হয়েছেন। ১৯১৫ সালে সোসাইটির মর্যাদাপূর্ণ কোপ্লে পদক পেয়েছেন। তাঁর গবেষণা মনোবিদ্যাকে অধিকতর বৈজ্ঞানিকতা দান করেছে। আমেরিকার দুই বিখ্যাত মনোবিজ্ঞানী জন ওয়াটসন এবং বি এফ স্কিনার সে দেশের মাটিতে পাভলভের ভাবনা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২১ সালের ২৪ জানুয়ারি লেনিন বিজ্ঞানী পাভলভের গবেষণা ও জীবনযাপনে স্বাচ্ছন্দ্য আনতে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন যা লেনিন রচনা সংগ্রহের ত্রিশতম খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। শুরুতে লেনিন বলেন, ‘‘শিক্ষাবিদ আই পি পাভলভ বৈজ্ঞানিক জগতে যে অসামান্য অবদান রেখেছেন পৃথিবীর শ্রমজীবী জনগণের কাছে তার মূল্য অপরিসীম।’’ পাভলভ ও তাঁর সহকর্মীরা যাতে সকলরকমের সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন সেজন্য ম্যাক্সিম গোর্কিকে প্রধান নির্বাচন করে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি হয়। ওঁরা কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। ইভান পাভলভের বৈজ্ঞানিক গবেষণাপত্রগুলি, যেখানে তাঁর দুই দশকের বেশি গবেষণার কৃতিত্ব রয়েছে, সোভিয়েত দেশের সব সেরা মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান থেকে ডিলুক্স সংস্করণ হিসেবে ছাপা হবে। এই গ্রন্থের পূর্ণ স্বত্ব রুশ দেশ বা বাইরের দেশে পাভলভেরই থাকবে। পাভলভ ও তাঁর স্ত্রীকে উচ্চ ক্যালরিসম্পন্ন রেশন দেওয়া হবে। অধ্যাপক পাভলভ ও তাঁর স্ত্রী বর্তমানে যে বাসভবনে রয়েছেন সেখানে তাঁরা আমৃত্যু বসবাস করবেন। পাভলভের গবেষণাগারকে সমৃদ্ধ করার জন্য সমস্তরকমের সহায়তা দেওয়া হবে। আগেই বলেছি, সব কয়টি সিদ্ধান্তের নিচে লেনিনের স্বাক্ষর ছিল। বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত দেশে বিজ্ঞানীদের কোন্ চোখে দেখা হতো - এ তার স্পষ্ট পরিচয়। খেয়াল রাখতে হবে, পাশ্চাত্যের উগ্র ঢক্কানিনাদে কিছুতেই তা যেন চাপা পড়ে না যায়।
সে দেশের দ্বিতীয় নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী ইলিয়া মেচনিকভ ১৯০৮ সালে শারীরতত্ত্ববিদ্যা/মেডিসিনে নোবেল লাভ করেন। পাভলভ রুশ বিপ্লবের পরে দুই দশক বেঁচে ছিলেন। মেচনিকভ বিপ্লবের একবছর আগে ১৯১৬ সালে মারা যান। বর্তমান ইউক্রেনে তাঁর জন্ম। রুশ অর্থোডক্স হিসেবে তাঁর ধর্মীয় পরিচিতি থাকলেও পরিণত বয়সে নিজেকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করেন। ফরাসি দেশে তিনি ডারউইন ভাবনা প্রচার করেছেন। জীবনের অনেকটা সময় তিনি ফ্রান্সে কাটান।
নভেম্বর বিপ্লবের আগে রুশ দেশে নোবেলজয়ী মানুষের সংখ্যা দুই। দুইজনই বিজ্ঞানী। একই বিভাগে এঁরা নোবেল পেয়েছেন। মেন্ডেলিভের নোবেল না পাওয়া আমাদের যেমন বিস্মিত করেছে, তেমনি বিস্মিত করেছে লিও টলস্টয়ের নোবেল না পাওয়া। পর্যায় সারণির কারিগর মেন্ডেলিভ, তিনি নোবেল পেলেন না। পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উপন্যাস ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’ লিখেছেন টলস্টয়। তিনিও নোবেল পেলেন না। স্বীকৃতির প্রশ্নে একটা অবজ্ঞা পশ্চিমি সভ্যতায় কি গোড়া থেকেই সজীব ছিল? সোসাইটির সঙ্গে রুশ আকাডেমির সম্পর্ক সেকথা প্রমাণ করে না। তবু যে ঘটনা পৃথিবীতে ঘটেছে, আমরা তা এড়িয়ে যেতে পারব না।
২০০৩ সালে, ১৯৯১ সালের সোভিয়েত দেশ ভাঙনের পর, ‘সায়েন্স ইন দি নিউ রাশিয়া’ নামে একটি নিবন্ধ লিখেছেন বিশিষ্ট বিজ্ঞান ঐতিহাসিক লরেন্স গ্রাহাম। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং এমআইটি-তে বিজ্ঞান ইতিহাসের অধ্যাপক ছিলেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি এমিরেটাস অধ্যাপক।
সোভিয়েত দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ইতিহাস নিয়ে একাধিক বই লিখেছেন। উল্লিখিত নিবন্ধে গ্রাহাম লিখলেন, ‘‘১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলো, বিজ্ঞানেরও সঙ্গে সঙ্গে প্রায় পতন ঘটল বলা চলে। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অনুদান অদৃশ্য হয়ে গেল। বিজ্ঞান সারা সোভিয়েত দেশ থেকে সংকুচিত হয়ে শুধু রুশ ভূখণ্ডে জায়গা পেল। সেখানে বিজ্ঞান ‘বিলাসিতা’ হিসেবে গ্রাহ্য হতে থাকল। বিজ্ঞানে বরাদ্দ ১৯৯১ সাল থেকে ১৯৯৯ সালে দশ ভাগের এক ভাগ হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার মেধাবী বিজ্ঞানী নানা দেশে চলে গিয়েছেন। সংকট এমন তীব্র যে, কিছু কিছু মানুষ এই ঘটনাকে ‘রুশ বিজ্ঞানের মৃত্যু’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।’’
চরিত্রগত বদল ঘটেছে রুশ বিজ্ঞানের মানচিত্রে। আমেরিকা, ইয়োরোপ, জাপান আর্থিক অনুদান নিয়ে ঢুকে পড়ছে সেদেশে। নানা প্রকল্পের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ১৯৯৯ সালে রাশিয়ায় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি গবেষণা খাতে যে অর্থ বরাদ্দ হয়েছিল তার শতকরা ১৭ ভাগ এসেছে বাইরে থেকে। বিজ্ঞানে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ স্বাগত কিন্তু স্বনির্ভরতা বিসর্জন দিয়ে তা নিশ্চয়ই কাম্য হতে পারে না। গ্রাহাম পুরনো সোভিয়েতের কিছু বিধিব্যবস্থার সমালোচনা করেছেন। অতিরিক্ত কেন্দ্রীকরণের বিরোধিতা করেছেন। তবে নিবন্ধের শেষে তাঁকে বলতে হয়েছে, ‘‘বিজ্ঞান গবেষণায় এই দেশ অর্থ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে পশ্চিমি ধাঁচা নিতে চাইছে, তা নিয়ে বিজ্ঞান শিবিরে তীব্র অন্তঃবিতর্ক চলছে।’’ অস্বীকার করে তো লাভ নেই, সোভিয়েত দেশ বিজ্ঞান প্রযুক্তির বহু ক্ষেত্রে মার্কিন দেশের সঙ্গে সমান তালে পাল্লা দিয়েছিল। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে ছিল। রুশ দেশের বিজ্ঞানে আজ সেই ছবি নেই।