৬০ বর্ষ ১৪ সংখ্যা / ১৮ নভেম্বর, ২০২২ / ১ অগ্রহায়ণ, ১৪২৯
মার্কসীয় দর্শন - দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (নয়)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● পূর্বেই বলা হয়েছে দ্বান্দ্বিকতার তিনটি নিয়ম বা সূত্র (Laws) রয়েছে। এই তিনটি নিয়ম গতি, পরিবর্তন ও বিকাশকে ব্যাখ্যাসহ উপস্থিত করেছে।
প্রথম সূত্র - বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম (unity and struggle of opposites)
● বিকাশের সূত্রগুলির মধ্যে এটা হলো অন্যতম। সমস্ত বস্তু ও ঘটনার মধ্যেই বৈপরীত্য বিরাজ করছে। এই বৈশিষ্ট্য সমগ্র বস্তুজগতে বিরাজ করছে। সমস্ত বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মধ্যে বৈপরীত্য অর্থাৎ বিপরীত দিক তথা শক্তিগুলি বিরাজ করছে। বৈপরীত্যের সংঘাতও ঘটে চলেছে। বৈপরীত্যের সংঘাত থেকেই গতির সৃষ্টি হয়। বিপরীতের এই সংঘাতকেই দ্বন্দ্ব (contradiction) বলা হয়। যে কোনো বস্তু, ঘটনা ও প্রক্রিয়ার মধ্যে যে বিপরীতধর্মী বৈশিষ্ট্যগুলি রয়েছে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব যেমন রয়েছে, আবার ঐক্যও পরিলক্ষিত হয়। তবে ঐক্য হলো সাময়িক। ঐক্যের অর্থ হলো - যে বৈপরীত্য বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে তার কোনো একটি প্রাধান্য যতক্ষণ বিরাজ করে ততক্ষণ ঐক্য থাকে। সংগ্রাম বা সংঘাতটাই হলো প্রধান। বস্তু ও ঘটনা বা প্রক্রিয়ার মধ্যে বৈপরীত্যের অসংখ্য নজির আমাদের চারপাশে রয়েছে। স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, বিপরীতের ঐক্য ও সংগ্রাম সার্বজনীন। উদাহরণস্বরূপ কয়েকটি তুলে ধরা হলো।
অজৈব জগৎ
● পরমাণু - প্রোটন (পজিটিভ অর্থাৎ ধনাত্মক) - ইলেকট্রন (নেগেটিভ অর্থাৎ ঋণাত্মক)
● ফোটন (অর্থাৎ অলোককণা) - পজিট্রন (ধনাত্মক) - ইলেকট্রন (ঋণাত্মক)
● গ্রহের গতি - আকর্ষণ - বিকর্ষণ
● বিদ্যুৎ - ধনাত্মক চার্জ (Positive) - ঋণাত্মক চার্জ (Negative)
জৈব জগৎ
● বিপাক ক্রিয়া - অঙ্গীভূত করা (Assimilation) - অঙ্গীভূত না করা (Dissimilation)
● প্রজাতির বিকাশ - বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন ঘটা (MUTABILITY) - বৈশিষ্ট্যের পুনরাবৃত্তি (HEREDITY)
● স্নায়ুতন্ত্রের কার্যধারা - উত্তেজিত হওয়ার প্রক্রিয়া (EXCITATION) - দমিত হওয়া (INHIBITION)
মানব সমাজ
● বৈষয়িক মূল্যের উপাদান ও বস্তুর পারস্পরিক পরিবর্তন - প্রকৃতি - মানব সমাজ
● শ্রেণি বিভক্ত মানব সমাজ - শোষিত - শোষক
● মানব সমাজের বিকাশ - উৎপাদিকা শক্তি - উৎপাদন সম্পর্ক
মানব সমাজে শ্রেণিসংগ্রাম
● দাস সমাজ - দাস - দাস মালিক
● সামন্ততান্ত্রিক সমাজ - কৃষক - সামন্ত প্রভু
● পুঁজিবাদী সমাজ - পুঁজিপতি - শ্রমিক
চিন্তন প্রক্রিয়া
● যৌক্তিক জ্ঞান (LOGICAL COGNITION) - বিশ্লেষণ (ANALYSIS) সংশ্লেষণ (SYNTHESIS)
● জ্ঞানার্জনের প্রক্রিয়া - বিমূর্তকরণ (ABSTRACTION) - সাধারণীকরণ (GENERALISATION)
গণিত
● যোগ - বিয়োগ
● গুণ - ভাগ
● পার্থক্যসূচক (DIFFERENTIAL) - অখণ্ড (INTEGRAL)
বলবিদ্যা (MECHANICS)
● ক্রিয়া (ACTION) - প্রতিক্রিয়া (REACTION)
রসায়ন বিদ্যা
● পরমাণুর পরস্পর সংযুক্তিকরণ (ASSOCIATION OF ATOMS) - পরমাণুর পরস্পর থেকে বিযুক্তিকরণ (DISSOCIATION OF ATOMS)
চৌম্বকত্ব (MAGNETISM)
● আকর্ষণ - বিকর্ষণ
● ডিম - আবরণ - ভ্রুণ
● বীজ - খোসা - শাঁস
দর্শন
● পক্ষ - বিপক্ষ
● আস্তিক - নাস্তিক
চিন্তা
● প্রগতিশীল চিন্তা - প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা
পদার্থবিদ্যা
● গরম - ঠান্ডা
● উচ্চ চাপ - নিম্ন চাপ
অর্থনীতি
● ব্যবহারিক মূল্য - বিনিময় মূল্য
● বিমূর্ত শ্রম - নির্দিষ্ট শ্রম
● কয়েকটিমাত্র দ্বন্দ্ব এখানে উল্লেখ করা হয়েছে। এভাবেই সমস্ত বস্তু ও ঘটনার মধ্যে বৈপরীত্য রয়েছে। সঠিক পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করলে দ্বন্দ্বগুলি চিহ্নিত করাও সম্ভব।
● দ্বন্দ্বের নানা রূপ রয়েছে। যেমন, প্রধান ও অপ্রধান দ্বন্দ্ব। যে কোনো বস্তু, ঘটনা বা প্রক্রিয়ায় নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করে যে দ্বন্দ্বগুলি তাকে প্রধান দ্বন্দ্ব বলে। তুলনামূলক গৌণ দ্বন্দ্বগুলি অপ্রধান দ্বন্দ্ব। বর্তমান বিশ্বে চারটি প্রধান সামাজিক দ্বন্দ্ব রয়েছে। চারটি দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব।
● দ্বন্দ্বগুলি হলো যথাক্রমে -
(১) পুঁজির সঙ্গে শ্রমের দ্বন্দ্ব,
(২) সাম্রাজ্যবাদের সাথে উন্নয়নশীল দেশগুলির দ্বন্দ্ব,
(৩) সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির মধ্যে দ্বন্দ্ব,
(৪) সাম্রাজ্যবাদ বনাম সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব।
এছাড়াও আরও অনেক দ্বন্দ্ব সমসাময়িক বিশ্বে রয়েছে। সেগুলি হলো অপ্রধান দ্বন্দ্ব।
● এবারে যদি আমরা ভারতীয় সমাজের দিকে দেখি তাহলে দেখব ভারতীয় সমাজে তিনটি প্রধান দ্বন্দ্ব রয়েছে।
দ্বন্দ্বগুলি হলো যথাক্রমে -
(১) সাম্রাজ্যবাদের সাথে ভারতীয় জনগণের দ্বন্দ্ব,
(২) জমিদারতন্ত্রের সাথে কৃষকদের দ্বন্দ্ব,
(৩) পুঁজির সাথে শ্রমের দ্বন্দ্ব।
● প্রধান দ্বন্দ্ব অনেকগুলি থাকলেও, নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে কোনো একটি দ্বন্দ্ব একেবারে সামনে চলে আসে, সেই দ্বন্দ্বের সমাধান দাবি করে। এই দ্বন্দ্বকে মুখ্য দ্বন্দ্ব বলে। এই মুখ্য দ্বন্দ্বের সমাধান অন্যান্য দ্বন্দ্বগুলিকে তীব্রতর করে, সমাধানের প্রশ্নকে ত্বরান্বিত করে। বর্তমান বিশ্বে পরিস্থিতির জটিলতার কারণে কোনো একটি দ্বন্দ্বকে মুখ্য দ্বন্দ্ব না বলা গেলেও বিশ্বের মার্কসবাদীরা সজাগ দৃষ্টি রেখেছেন মুখ্য দ্বন্দ্ব আকারে কোনটি সামনে আসছে সেই দিকে।
● দ্বন্দ্বগুলির মধ্যে যে দ্বন্দ্বের সমাধান অন্যান্য দ্বন্দ্বগুলির সমাধান ঘটায় তাকে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব বলে। বর্তমান বিশ্বের চারটি প্রধান সামাজিক দ্বন্দ্বের মধ্যে ‘সমাজতন্ত্র বনাম সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব’ হলো কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব। একথা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই দ্বন্দ্বের সঠিক সমাধান হলো বিশ্বজুড়ে সমাজতন্ত্রের বিজয়, সাম্রাজ্যবাদের পরাজয়। সাম্রাজ্যবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব তিন রূপে অর্থাৎ মতাদর্শগত, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক রূপে বিরাজ করছে।
● ভারতীয় সমাজে ‘জমিদারতন্ত্রের সাথে কৃষকদের দ্বন্দ্ব’ হলো মুখ্য দ্বন্দ্ব। এই মুখ্য দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভব জনগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। তাই তো সিপিআই (এম)-এর কর্মসূচি ভারতীয় সমাজে আশু বিপ্লবের লক্ষ্য হিসাবে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব’-কে তুলে ধরে। যার মূল অক্ষ (Principal Axis) হলো কৃষি বিপ্লব। আবার ভারতীয় সমাজে কেন্দ্রীয় দ্বন্দ্ব হলো পুঁজি ও শ্রমের দ্বন্দ্ব। ভারতীয় সমাজে এই দ্বন্দ্বের সমাধান হবে সমাজতান্ত্রিক সমাজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ স্থাপনের মধ্য দিয়ে ভারতীয় সমাজের অন্য প্রধান দ্বন্দ্বেরও অবসান ঘটবে।
● বৈরী ও অবৈরী দুই ধরনের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আলাপ-আলোচনার পথে নয়, যে দ্বন্দ্বের সমাধানে সংঘাতই পথ, একের বিজয় ও অপরটির পরাজয় ব্যতিরেকে যে দ্বন্দ্বের সমাধান সম্ভব নয়, তাকে বলে বৈরী দ্বন্দ্ব (ANTAGONISTIC CONTRADICTION)। পুঁজিপতির সাথে শ্রমিকের দ্বন্দ্ব, জমিদারের সাথে কৃষকের দ্বন্দ্ব হলো বৈরী দ্বন্দ্ব।
● যে দ্বন্দ্বের সমাধান আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে সম্ভব তাকে বলে অবৈরী দ্বন্দ্ব (NON-ANTAGONISTIC CONTRADICTION)। যেমন, গরিব কৃষক ও মাঝারি কৃষকের দ্বন্দ্ব, মধ্যবিত্তের সাথে অসংগঠিত শ্রমিকের দ্বন্দ্ব। বৈরী ও অবৈরী দ্বন্দ্বের ফারাক সঠিকভাবে উপলব্ধি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিপ্লবী সংগ্রামের অগ্রগতিকে সম্ভব করার জন্য বৈরী ও অবৈরী দ্বন্দ্ব সঠিকভাবে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
(ক্রমশ)