৫৮ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ১ আশ্বিন ১৪২৭
সংসদে কৃষক বিরোধী বিলের তীব্র প্রতিবাদ বিক্ষোভ আন্দোলন দেশজুড়ে
কৃষক বিরোধী বিল পেশের প্রতিবাদে পাঞ্জাবের বিয়াসে কৃষক বিক্ষোভ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণকে নিশ্চিত করতে কেন্দ্র যে তিনটি অর্ডিন্যান্স এনেছে, তা আইনে পরিণত করতে সংসদের বাদল অধিবেশনের শুরুতেই লোকসভায় বিল পেশ করা হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রকে এভাবে বৃহৎ বাণিজ্যের কাছে উন্মুক্ত করে দেবার বিরুদ্ধে সংসদে সোচ্চার হয়েছেন বিরোধীরা। ইতিমধ্যেই হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষরা বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন। ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদ অধিবেশন শুরুর দিনই কেন্দ্রের জনবিরোধী অর্ডিন্যান্সগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হবার কথা আগেই ঘোষণা করেছিলেন বামপন্থীরা। দেশে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা, বেকারত্ব, পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা, পিএম কেয়ারস ফান্ড নিয়ে বিতর্ক, লাদাখ সীমান্তে উত্তেজনা, কোভিড মহামারি প্রতিরোধে ব্যর্থতা, রাজ্যগুলিকে জিএসটি ক্ষতিপূরণ দিতে অস্বীকার সহ সর্বনাশা অর্ডিন্যান্সগুলিকে আইনে পরিণত করার উদ্যোগের বিরুদ্ধে বিরোধীরাও ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ জানানোর জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
এই অধিবেশনে কৃষকের উৎপাদনের বাণিজ্য এবং লেনদেন প্রসার এবং সরলীকরণ অর্ডিন্যান্স, দাম নিশ্চিন্তকরণে কৃষকের ক্ষমতায়ন এবং সুরক্ষা সমঝোতা অর্ডিন্যান্স এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আইন সংশোধনী অর্ডিন্যান্স সহ মোট ১১টি অর্ডিন্যান্স আইনে পরিণত করার উদ্যোগ নিয়েছে কেন্দ্রের সরকার। অথচ কেন্দ্রের সমস্ত জনবিরোধী পদক্ষেপ ও নীতির বিরুদ্ধে বিরোধীরা যাতে প্রতিবাদ জানাতে না পারে, সেইজন্য প্রশ্নোত্তর পর্ব ছাঁটাই করা হয়েছে।
কৃষক বিরোধী অর্ডিন্যান্স আইনে পরিণত করার কেন্দ্রের উদ্যোগের বিরুদ্ধে ১৪ সেপ্টেম্বর দেশের বিভিন্ন প্রান্তে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে মুখর হয়েছেন কৃষকরা। এদিন উত্তরপ্রদেশ থেকে আসা কৃষকদের একটি প্রতিবাদ মিছিল রাজধানীতে ঢোকার মুখে আটকে দেয় পুলিশ। যন্তর মন্তরে বিক্ষোভ দেখায় সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমিতি। এদিন পশ্চিমবঙ্গ, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু সহ অনেক রাজ্যে কৃষকরা প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন।
লোকসভায় বিল পেশ করে কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিং তোমার দাবি করেন, কৃষিপণ্যের বাণিজ্যে আর কোনো বাধা থাকবে না। কৃষকরা বিনিয়োগ করতে পারেন না। এই বিলের মাধ্যমে এবার কৃষিতে বিনিয়োগ হবে। কৃষকরা বিনিয়োগকারী বেছে নিতে পারবেন। ৮৬ শতাংশ কৃষকের দু-হেক্টরের কম জমি রয়েছে এবং প্রায়ই ন্যূনতম সহায়কমূল্য পান না। যদিও দেশব্যাপী চাপের মুখে কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিয়ম থাকছে। তা তুলে দেওয়া হবে না। কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের নিয়ম থাকছে, তা তুলে দেওয়া হবে না। কৃষিমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই বিলের মাধ্যমে কৃষকরা তাঁদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির জন্য বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করতে পারবেন।
কৃষক বিক্ষোভ রাজস্থানের হনুমানগড়ে।
কৃষিমন্ত্রীর যুক্তি এবং বিলের খসড়া থেকেই প্রমাণিত - এর ফলে কৃষিতে বৃহৎ বাণিজ্যকে ঢোকার রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের প্রস্তাবিত সংশোধনী দেশের খাদ্য নিরাপত্তার পক্ষে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ কৃষিপণ্যের দাম এবং সরবরাহের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নিচ্ছে। এর ফলে ফড়ে ও ব্যবসায়ীদের ফাটকায় কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি হবে। আন্তঃরাজ্য ও রাজ্যের মধ্যে অবাধ বিক্রির নামে যে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হচ্ছে তার ফলে কৃষিপণ্যের বাজার বা মান্ডির মধ্যেও বাইরে চুক্তি চাষের রাস্তা করে দেওয়া হচ্ছে। ইলেট্রনিক ট্রেডিংয়ের লাইসেন্স দেওয়ায় তা সমস্ত কৃষিপণ্যের আগাম ফাটকা বাণিজ্যের পথ করে দেবে। বৃহৎ বহুজাতিক কৃষিবাণিজ্য সংস্থা এবং দেশের কর্পোরেটরা ভারতের কৃষিপণ্যের বাজারে অবাধ প্রবেশের অনুমতি পাবে। এই সমস্ত সংশোধনের ফলে লাভবান হবে ফড়ে, ব্যবসায়ী, আর্থিক মহাজন - যারা উৎপাদন কৃষক এবং ক্রেতা উভয়কেই শুষে নেবে। গণবণ্টন ব্যবস্থার যেটুকু এখনও রয়ে গেছে, তা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যাবে।
বিরোধীরা, বিশেষ করে বামপন্থীরা আগেই বলেছিল, সংবিধানে কৃষি রাজ্য তালিকাভুক্ত। নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির সঙ্গে কথা না বলেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা এই অর্ডিন্যান্সগুলি অনুমোদন করেছে। এর ফলে সংবিধানকে গুরুতরভাবে লঙ্ঘন করা হয়েছে। এদিন লোকসভায় কংগ্রেস দলনেতা অধীর চৌধুরী এই বিলের বিরোধিতা করছেন। সিপিআই(এম) সাংসদ এএম আরিফ বিলে অনুমোদন না দিতে চেয়ে বিধিবদ্ধ প্রস্তাব জমা দিয়েছেন।
এদিন সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, দেশে মহামারীজনিত অন্ধকার পরিস্থিতি চলছে। প্রতিবাদের পরিসর কম। অন্ধকারেই ডাকাতি হয়, কৃষকের সঙ্গে কেন্দ্রও ডাকাতি। এর ফলে কৃষকদের সর্বনাশ হবে, ভারতের কৃষির সর্বনাশ হবে। কৃষিকে কর্পোরেটের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। কৃষক ফসলের ন্যায্য দাম তো পাবেনই না, ফসল বিক্রি করতে এবার নির্ভর করতে হবে বেসরকারি বাণিজ্য সংস্থার ওপর। কৃষিবাজার বা মান্ডিগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়া হলো। দেশে প্রায় সাত হাজার কৃষিবাজারকে অকার্যকর করে দেওয়া হলো। তিনি বলেন, কৃষিবাজার আইনে বরং একচেটিয়া কারবারের বদলে প্রতিযোগিতার সুযোগ ছিল। এখন কেন্দ্র যা পদক্ষেপ নিচ্ছে, তাতে কৃষক আর লাভজনক মূল্য পাবে না। অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন বাতিল করলে খাদ্য নিরাপত্তা বিপর্যস্ত হবে। মডেল চুক্তি চাষের আইন কৃষককে চিরকালের জন্য দাসে পরিণত করবে। বিজেপি সরকার কৃষিতে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ও বেসরকারি ক্ষেত্রকে ডেকে এনে সরকারের দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। এর আগেই সিপিআই (এম) পলিট ব্যুরো অর্ডিন্যান্সের বিরোধিতা করে বলেছিল, মোদী সরকারের আগ্রাসী নয়া উদারনীতি ব্রিটিশ আমলে ভারতের কৃষকদের নির্মম শোষণের দিনগুলিকেই ফিরিয়ে আনবে।
কলকাতার মৌলালিতে কৃষক বিক্ষোভ।
রাজ্যে কৃষক বিক্ষোভ
কৃষক বিরোধী কালা কানুন এবং কৃষিক্ষেত্রকে কর্পোরেটদের হাতে তুলে দিতে কেন্দ্রের সরকারের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে ১৪ সেপ্টেম্বর সারা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের কৃষকরাও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছেন। জেলায় জেলায় বিভিন্ন কৃষক সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ সভা করেছে। এদিন দুপুরে কলকাতার মৌলালি মোড়ে সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে একটি বিক্ষোভ সভা হয়েছে।
এদিন কৃষক-বিরোধী তিনটি বিল অবিলম্বে বাতিলের দাবিতে দেশের ২৫০টিরও বেশি কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত মঞ্চ সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে এদিন এই বিক্ষোভের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এদিনের এই বিক্ষোভ-কর্মসূচি থেকে দাবি করা হয়েছে, ডিজেলের মূল্য হ্রাস করতে হবে, কৃষকদের সফলের ন্যায্য মূল্যের দাবি সহ কৃষকের সমস্ত ঋণ মকুবের দাবি জানানো হয়।
মৌলালির মোড়ে কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির বিক্ষোভ সভায় এই কমিটির সর্বভারতীয় সম্পাদক অভীক সাহা, রাজ্য সম্পাদক কার্তিক পাল, সারা ভারত কৃষকসভার নেতা মদন ঘোষ সহ কৃষকনেতা বেচু দলুই, প্রভাত মজুমদার, মিহির পাল, হরিপদ বিশ্বাস, পরেশ পাল প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। সভায় নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রের জনবিরোধী নীতি ও পদক্ষেপের বিরুদ্ধে, কৃষক-বিরোধী এই বিলের বিপজ্জনক দিকগুলি তুলে ধরার পাশাপাশি কৃষকদের দাবি মানা না হলে লাগাতার আন্দোলন চালিয়ে যাবার ডাক দেন।