৫৮ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ১ আশ্বিন ১৪২৭
সীমান্ত-উত্তেজনা প্রশমনে চীন-ভারত বিদেশ মন্ত্রী পর্যায়ে বৈঠক
শান্তির লক্ষ্যে পাঁচ দফা যৌথ বিবৃতি
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ আর সংঘাত নয়, সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখতে চায় ভারত ও চীন। দ্বিপাক্ষিক বিষয়সমুহ নিয়ে মস্কোয় সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার বৈঠক চলাকালীন প্রায় আড়াই ঘণ্টা মুখোমুখি বৈঠকে বসেছিলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং চীনের বিদেশমন্ত্রী ওয়াঙ ই। পরিস্থিতির উন্নতির প্রশ্নে ১১ সেপ্টেম্বর দু’দেশের বিদেশমন্ত্রী পর্যায়ে দীর্ঘ বৈঠকের পর সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমনে শান্তির লক্ষ্যে মস্কো থেকেই এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করেছে ভারত ও চীন। ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রকাশিত ওই বিবৃতিতে রয়েছে পাঁচ দফা অবস্থানের প্রেক্ষিতে যত দ্রুত সম্ভব সেনা সরানো এবং উত্তেজনা প্রশমনের সদিচ্ছার কথা। এর আগে গত কয়েক মাস সামরিক, কূটনৈতিকস্তরে কয়েক দফা আলোচনা হলেও কোনও আলোচনার স্তরেই শেষে যৌথ বিবৃতি মেলেনি। বৈঠক প্রসঙ্গে মন্ত্রক স্তরের বিশদ আলোচনার পরে ভারতের বিদেশ মন্ত্রক জানিয়েছে, ‘খোলাখুলি ও গঠনমূলক’ আলোচনা হয়েছে এবং চীনের বিদেশমন্ত্রী জানিয়েছেন, চীন ‘সমঝোতামূলক’ পদক্ষেপ নিতে রাজি আছে। বিবৃতিতে উল্লিখিত পাঁচ দফা অবস্থানসমুহের নিষ্পত্তির নির্দিষ্ট সময়সীমার উল্লেখ না থাকলেও, এই অবস্থান যে দু’দেশের রাজনৈতিক পর্যায়ের সিদ্ধান্ত - তা প্রতিফলিত হয়েছে।
যৌথ বিবৃতির পাঁচ দফায় বলা হয়েছে, সীমান্তে এখন যে পরিস্থিতি চলছে তা কোনও দেশেরই স্বার্থবাহী নয়। সুতরাং, দু’দেশের সীমান্তের সেনাদের মধ্যে আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে, দ্রুত সংঘাতের পরিস্থিতি থেকে সরে যেতে হবে, যথাযথ দূরত্ব রক্ষা করতে হবে, যা উত্তেজনা হ্রাস করবে। ঘোষিত অবস্থান সম্পর্কে দুই মন্ত্রীই একমত হয়েছেন একথা উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দু’দেশের নেতারা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উন্নতির বিষয়ে যে ঐকমত্যে পৌঁছেছিলেন তা মান্য করেই চলা উচিত। এই ঐকমত্যের অন্যতম বিষয় হলো মতপার্থক্যকে বিরোধে পরিণত না করা। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, চীন-ভারত সীমান্ত প্রশ্নে ইতিমধ্যেই যে-সমস্ত চুক্তি ও প্রোটোকল রয়েছে, দু’পক্ষই তা মেনে চলবে এবং সীমান্ত এলাকায় শান্তি ও সুস্থিতি বজায় রাখবে। দু’পক্ষই এমন কোনো কাজ করবে না যা পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করে। ভারত-চীন সীমান্ত প্রশ্নে বিশেষ প্রতিনিধি ব্যবস্থার মাধ্যমে আলোচনা ও যোগাযোগ চলতে থাকবে বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে এবং উল্লেখ করা হয়েছে, আলোচনা ও সমন্বয়ের যে ‘ওয়ার্কিং মিকানিজম’ রয়েছে তাদেরও বৈঠক চালিয়ে যাওয়া উচিত। শেষে বলা হয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি হলে সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতির লক্ষ্যে নতুন আস্থাবর্ধক ব্যবস্থা নেবার কাজ দ্রুত হাতে নেওয়া হবে। এই অংশটির ব্যাখ্যায় কূটনৈতিক মহল মনে করছে, চলতি চুক্তি ও প্রোটোকল ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়, আরও কিছু স্থায়ী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, যা ভবিষ্যতে সীমান্তে সংঘাতের পরিবর্তে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে পারে। অন্যভাবে বলা যায়, ‘যুদ্ধজিগিরমূলক’ মনোভাব কমিয়ে আস্থাবৃদ্ধির উপযোগী সদিচ্ছামূলক পদক্ষেপ যা এই বিবৃতিতে প্রকাশিত, বিগত সংঘাতদীর্ণ সময়ে তা উচ্চারিতই হয়নি। বিবৃতিতে উল্লেখ না করলেও ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, ২০১৮ এবং ২০১৯ সালে চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিঙ এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বৈঠকে যে ঐকমত্যের কথা বলেছিলেন, তার প্রাসঙ্গিকতার বিষয়সমূহ সম্পর্কেও।
চীনের বিদেশ মন্ত্রক এই বৈঠকের বিষয়ে যে বিবৃতি দিয়েছে সেখানে বলা হয়েছে, ওয়াঙ ভারতের বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্করকে বলেছেন, দুই বড়ো প্রতিবেশী দেশের মধ্যে মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক। গুরুত্বপূর্ণ হলো এই মতপার্থক্যগুলিকে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের যথাযথ প্রেক্ষিত মাথায় রেখে বিবেচনা করা। দুই দেশই দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। এই অবস্থায় ভারত ও চীনের সংঘাতের বদলে সহযোগিতার সম্পর্ক থাকা উচিত, সন্দেহের বদলে পারস্পরিক আস্থা রক্ষা করা উচিত। যখন পরিস্থিতি জটিল হবে, তখন সামগ্রিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা আরও জরুরি। বর্তমানে দু’দেশের সম্পর্ক আবার মোড়ের মাথায় এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু যদি দু’দেশ সঠিক অভিমুখে সম্পর্ককে পরিচালিত করতে পারে তাহলে সব চ্যালেঞ্জই অতিক্রম করা যাবে।
এদিকে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো ১১ সেপ্টেম্বর দেওয়া এক বিবৃতিতে ভারত-চীন সীমান্ত সমস্যা প্রসঙ্গে ভারত ও চীনের বিদেশমন্ত্রীরা মস্কোয় বৈঠকে বসে যে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন, তার উল্লেখ করে বলেছে, ‘...১৫ জুন সংঘাতে ভারতের সেনাদের প্রাণহানি ঘটেছিল, সম্প্রতি আবার দু’পক্ষের শূন্যে গুলি ছোঁড়ার ঘটনা ঘটেছে। ৪৫ বছর পরে এই ঘটনা ঘটেছে। পরিস্থিতি উত্তেজনাপ্রবণ ও গুরুতর হয়ে রয়েছে, তা প্রশমিত হওয়া প্রয়োজন। সিপিআই(এম) কূটনৈতিক ও সামরিক পর্যায়ের আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গিকেই সমর্থন করে।’
এর আগে চলতি বছরের মে মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সীমান্তে শুরু হওয়া সঙ্ঘাতের পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারত সরকার সুস্পষ্টভাবে কিছু জানায়নি। ১৫ জুন সীমান্তে বিহার রেজিমেন্টের ২০ জন জওয়ানের মৃত্যুর প্রেক্ষিতে পরিস্থিতি সংক্রান্ত জবাবদিহি কার্যত এড়িয়ে যায় সেনাবাহিনী সহ সরকারের প্রতিরক্ষা বিভাগ। এরপর বিরোধীদলগুলির জোরালো প্রশ্নের মুখে সর্বদল বৈঠক ডাকতে বাধ্য হয় সরকার। ১৯ জুন সর্বদলীয় বৈঠকে সমস্ত দলই পুনরায় জানায় যে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় গোটা দেশ ঐক্যবদ্ধ। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, লাদাখে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার কাছে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের সংঘাত এবং আমাদের প্রতিক্রিয়া নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না। এই সবকিছুকে যথাযথভাবে মূল্যায়ন করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।
সর্বদলীয় বৈঠকেও সিপিআই(এম)’র পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি। তিনি তাঁর বক্তব্যে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সীমান্ত বজায় রাখার কথা বলেন। সীতারাম ইয়েচুরি বলেন, ‘...ভারত সরকারের উচিত উচ্চপর্যায়ের আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া, যাতে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখার স্পষ্ট চিহ্নিতকরণ করে সীমান্তে শান্তি ও সুস্থিতি বজায় থাকে।... ভারত বিশ্বকে পঞ্চশীল নীতি দিয়েছে। স্বাধীন বিদেশনীতি অনুসরণ করেছে। দেখতে হবে এ থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই।’ বৈঠকে সোনিয়া গান্ধী, কে চন্দ্রশেখর রাও, মায়াবতী, নীতীশ কুমার, শারদ পাওয়ার প্রমুখ বক্তব্য রাখেন।
প্রসঙ্গত, প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় সীমান্ত সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বোঝাপড়ার জন্য চীনের সঙ্গে ১৯৯৩ সালের চুক্তি ‘Agreement on the Maintenance of Peace and Tranquillity along the Line of Actual Control in the India-China Border Areas’ সম্পাদিত হয়। এরপর অনেকগুলি সমঝোতা হয়েছে। কংগ্রেস এবং বিজেপি দুই দলেরই নিয়ন্ত্রণাধীন ১৯৯৬, ২০০৫, ২০১৩ এবং ২০১৫ সালের তৎকালীন ভারত সরকারগুলি তারা বিভিন্ন সমঝোতাপত্রে স্বাক্ষর করেছে। মতপার্থক্য ও সংঘাত অবসানের জন্য স্বাক্ষরিত এই সমস্ত সমঝোতা ও তার অন্তর্গত বোঝাপড়ার প্রক্রিয়ার দরুন হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি বজায় রাখা এ পর্যন্ত সম্ভবপর হয়েছিল। এর আগে ভারতীয় ও চীনা সৈন্যদের শেষ সশস্ত্র সংঘাত ও মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল ৪৫ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে।
সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর নির্যাস হলো, যদিও চীনের পক্ষ থেকে ভ্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে, তবে ভারত সরকারের কিছু পদক্ষেপও এই পরিস্থিতি সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূমিকা গ্রহণ করেছে। জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের অবলুপ্তি এবং জম্মু ও কাশ্মীর ও লাদাখকে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার সিদ্ধান্তের প্রভাব বহির্বিশ্বে পড়েছে। চীন এই ঘটনাকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখেছে। ভারত সরকারের কাছে তারা এনিয়ে দু’বার প্রতিবাদ জানিয়েছে কেননা তারা মনে করে যে, এর ফলে এতদঞ্চলে প্রশাসনিক কাঠামোর যে পরিবর্তন ঘটেছে তাতে ভারতীয় ভূখণ্ডের যে অঞ্চলে চীনের দাবি রয়েছে তার ওপর প্রভাব পড়বে। কিন্তু ভারত সরকার এ বিষয়টি এড়িয়ে যায়, এমনকি যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের ঘরোয়া আলোচনায় এই বিষয়টি চীন উত্থাপন করে তখনও কোনো প্রতিক্রিয়া ভারত সরকার দেখায়নি। আবার ভারতের সীমান্ত বরাবর কিছু নির্মাণকে অন্য চোখে দেখেছে চীন।
মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফার প্রথম বছরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক রণনীতি যা কিনা চীনের বিরুদ্ধে পরিচালিত, তার অঙ্গ হিসেবে ভারতকে যুক্ত করার প্রক্রিয়া দ্রুততর করা হয়। গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার চতুর্মুখী-জোট মন্ত্রীপর্যায়ে উন্নীত হয়; যখন রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণসভার অধিবেশনের ফাঁকে নিউইয়র্কে এই চারটি দেশের বিদেশমন্ত্রীরা বৈঠকে মিলিত হন। অতিমারীর সময়ে আবার অনভিপ্রেতভাবে বেশ কিছু ঘটনা এবং প্রসঙ্গ উঠে আসে, যা মিলিতভাবে এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যার প্রেক্ষিতে লাদাখে সংঘাত ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন যে, আমেরিকা ও চীনের বিবাদে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান গ্রহণ করাই হবে ভারতের স্বার্থে সবচেয়ে ভালো পদক্ষেপ। সরকারকে ভাবতে হবে যে, চীনের বিরুদ্ধে জোটে শামিল হলে আদৌ দেশের স্বার্থ কতটা রক্ষিত হবে। পাশাপাশি গুরুত্ব দিয়ে বিচার করতে হবে হিন্দুত্ববাদী বিশ্ববীক্ষাসহ অন্যান্য কারণে নেপাল, পাকিস্তান, বাংলাদেশ প্রভৃতি প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সমস্যা কেন বেড়ে চলেছে, সে কথাও।