৫৮ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ১ আশ্বিন ১৪২৭
স্মরণে কমরেড জীবন মাইতি
শহিদিবরণের পঞ্চাশতম বার্ষিকী
অশোক বন্দ্যোপাধ্যায়
মনে বেদনা এবং বিদ্রোহী ক্রোধের ঝড় তুলে পেরিয়ে গেল আরও একটা ৫ সেপ্টেম্বর। এবছরের ৫ সেপ্টেম্বর ছিল স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জীবন মাইতির শহিদিবরণের ৫০তম বর্ষ দিবস। নিজেদের বিপ্লবী প্রত্যয়কে দৃঢ় করতেই তাঁকে আমাদের স্মরণ করা প্রয়োজন। তাঁকে স্মরণ করে হাওড়া জেলায় ওই দিনটি জেলার গণআন্দোলনে শহিদ দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে। ১৯৭০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর রাজ্যে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এক ক্রান্তিকালীন সময়ে লড়াইয়ের মধ্যে থেকেই তাঁর জীবনদীপ নির্বাপিত হয়েছিল।
৭০ বছর বয়সের এই প্রবীণ স্বাধীনতা যোদ্ধা এবং বিপ্লবী কমিউনিস্টের মৃত্যু স্বাভাবিক ছিল না। কমিউনিস্ট-বিরোধী সাম্রাজ্যবাদপুষ্ট প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির নকশাল নামধারী জহ্লাদ বাহিনীর ঘৃণ্য কাপুরুষোচিত আক্রমণে তিনি শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সিপিআই(এম)’র প্রতিষ্ঠার পর রাজ্যব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের অভিঘাতে পর পর দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের অধিষ্ঠান প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি এবং সমস্ত কায়েমিস্বার্থবাদীদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। শুরু হয়েছিল সিপিআই(এম)-কে বিচ্ছিন্ন করার, দুর্বল করার গভীর চক্রান্ত। দু’বারই চক্রান্ত করে যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। শুরু হয়েছিল সর্বত্র সিপিআই(এম) নেতা-কর্মীদের ওপর কখনো প্রকাশ্যে, কখনো গোপনে সশস্ত্র আক্রমণ। সেই আক্রমণে সিআরপিএফ, পুলিশ-প্রশাসন তো ছিলই তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নকশালপন্থী নামে সমাজবিরোধী দুষ্কৃতীরা। সেটাই ছিল তৎকালীন শাসকদল কংগ্রেসের কমিউনিস্টবিরোধী রণনীতির অঙ্গ। পুলিশ-প্রশাসনের চক্রান্তমতোই তৎকালীন নকশাল নামে পরিচিত দুষ্কৃতীরা কমরেড জীবন মাইতিকে অতর্কিত আক্রমণ করে খুন করতে চেয়েছিল। ওই নৃশংস আক্রমণে রক্তাক্ত হয়েও বীরোচিত দৃঢ়তায় প্রতিরোধ করেছিলেন ওই বিপ্লবী বীর। তাই অকুস্থলেই তৎক্ষণাৎ তাঁর মৃত্যু ঘটেনি। কিন্তু চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত তাঁকে বাঁচিয়ে রাখা যায়নি। তিনি শহিদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
মৃত্যুর সময় পর্যন্ত কমরেড জীবন মাইতি ছিলেন সিপিআই(এম)’র হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য, পার্টির দৃঢ়চেতা সংগঠক এবং নেতা। ১৯৭০ সালের ২১ আগস্ট পার্টির জেলা কমিটির সভা করে দুপুরে তাঁর শিবপুরের শিবতলা লেনের বাড়িতে যাচ্ছিলেন কমরেড জীবন মাইতি। বাড়ির কাছাকাছি দুপুরের নির্জন রাস্তায় ওৎ পেতে বসেছিল নকশালপন্থী দুষ্কৃতীরা। তারা অতর্কিতে সশস্ত্র আক্রমণ করে কমরেড জীবন মাইতিকে। হত্যার উদ্দেশে ভোজালি দিয়ে খুনির দল কমরেড জীবন মাইতিকে কোপাতে থাকে, তাদের হাতে পিস্তলও ছিল। আহত অবস্থাতেও প্রতিরোধের ফলে গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়। ভোজালির কোপে গুরুতর আহত রক্তাক্ত অবস্থায় প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতাকে তৎক্ষণাৎ এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কয়েক দিন পর তাঁকে হাসপাতাল থেকে পার্কসার্কাসের কিম্বার নার্সিংহোমে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
কোথাও কোনো কমরেড আক্রান্ত হলেই কমরেড জীবন মাইতি ক্রুদ্ধ ও বিচলিত হয়ে উঠতেন। অসুস্থ শরীর নিয়েই আক্রান্ত কমরেডদের পাশে দাঁড়াতে দৌড়ে যেতেন। ১৯৬৮ সালে পিডিএফ- কংগ্রেস জোট সরকারের আমলে ৫ ফেব্রুয়ারি বালি-নিশ্চিন্দায় সত্যাগ্রহীদের ওপর গুলি চালানো হয়েছিল। বিডিও অফিসের সামনে গুলিতে নিহত হয়েছিলেন সত্যাগ্রহী বীরেন দাশ। সমগ্র এলাকায় সিআরপিএফ মোতায়েন করে সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়। এই ঘটনা কমরেড জীবন মাইতিকে বিচলিত করে তোলে। পরদিন তিনি ঘটনাস্থলে যান। সেইসময়ে হাওড়া জেলা পার্টির কোনো গাড়ি ছিল না। গাড়ি দিয়েছিলেন পার্টির পরম সুহৃদ ডাঃ ভূপেন ঠাকুর। জেলা অফিসে সাহায্যকারী কর্মী হিসেবে আমার সুযোগ হয়েছিল কমরেড জীবন মাইতির সঙ্গে যাবার। গোটা এলাকা ছিল জনমানবশূন্য। চারদিকে সিআরপিএফ ছয়লাপ, এলাকা থেকে বেশ কিছু দূরে আশপাশ থেকে মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। কমরেড জীবন মাইতি এসেছেন খবরটা মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়েছিল এলাকায়। দেখেছিলাম তাঁদের প্রিয় নেতাকে পেয়ে সন্ত্রস্ত মানুষ সব ভয়ভীতি ছেড়ে কিভাবে সমবেত হয়েছিল। কমরেড জীবন মাইতি তাদের সাহস জুগিয়েছিলেন। মানুষ প্রেরণা পেয়েছিল।
১৯৭০ সালে দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেবার পর থেকেই রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছিল সিপিআই (এম) খতম অভিযান। রাষ্ট্রপতি শাসনে শুরু হয়েছিল নব কংগ্রেস-নকশাল দুষ্কৃতীদের জল্লাদবৃত্তি।
প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও নব কংগ্রেস-নকশাল দুষ্কৃতীদের সশস্ত্র আক্রমণে সিপিআই(এম) নেতা, কর্মীদের শহিদের মৃত্যুবরণ করতে হতো। কমরেড জীবন মাইতি আক্রান্ত হবার মাত্র কয়েকদিন আগে ১৯৭০ সালের ২ আগস্ট হাওড়ার বেলুড়ে প্রকাশ্য রাস্তায় বাসের মধ্যে নৃশংসভাবে খুন করা হয়েছিল চটকল শ্রমিক এবং চটকল ইউনিয়নের নেতা কমরেড রামচন্দ্র রায়কে। কমরেড রামচন্দ্র রায়ের নিহত হবার খবর পেয়ে অন্যান্য কমরেডদের সঙ্গে উদ্বিগ্ন এবং ক্রুদ্ধ কমরেড জীবন মাইতি শিবপুর থেকে ছুটে গিয়েছিলেন বেলুড়ে। তখন কে জানত হাওড়া জেলার এই খুনী বাহিনীর পরবর্তী লক্ষ্য কমরেড জীবন মাইতির মতো স্বাধীনতা সংগ্রামী ও বিপ্লবী কমিউনিস্ট।
কমরেড জীবন মাইতি যখন আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন, তখন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত নকশালপন্থীদের এবং তাদের মদতদাতাদের মুখোশ খুলে দিয়ে এক দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছিলেন। সেই প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছিলেন সেই সময়ে নকশালপন্থী, সমাজবিরোধী, দুষ্কৃতীদের সাথে শাসকদল কংগ্রেস এবং পদলেহনকারী আমলা-পুলিশ-প্রশাসনের কি রকম যোগসূত্র গড়ে উঠেছিল এবং ওই চক্রের সমস্ত আক্রমণের লক্ষ্য কিভাবে সিপিআই(এম)’র নেতা, কর্মীরা হয়ে উঠেছিলেন। সেই সময়ে নকশালপন্থী খুনীদের প্রতি সহানুভূতি তৈরির উদ্দেশে সংবাদ প্রচারমাধ্যম এবং কমিউনিস্ট-বিরোধী বুদ্ধিজীবীরা নকশালপন্থী খুনীদের মেধাবী ছাত্র’ বলে তুলে ধরত। তাই দেখে কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্ত লিখেছিলেন, লেখাপড়ায় মেধাবী হলেও তারা তো প্রতিক্রিয়াশীলদের ক্রীড়নক হয়ে কাজ করছে। মেধাবী ছাত্ররাই তো আইএএস, আইপিএস হয়ে প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের হয়ে জনবিরোধী কাজ করে, প্রশাসনের হয়ে সাধারণ মানুষের ওপর অত্যাচার চালায়। অনেক অধ্যাপককেও তো সিআইএ’র এজেন্ট হয়ে কাজ করতে দেখা গেছে। আসল কথা হলো, কে মেধাবী কে অমেধাবী সেটা বড়ো কথা নয়। ছাত্রছাত্রীদের ‘মেধা’ কোন্ পথে পরিচালিত হচ্ছে সেটাই বড় কথা। কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের এই পর্যবেক্ষণ ১৯৭০ সালের প্রেক্ষিতে যেমন সত্য ছিল, বলা যায় বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেও তা’ সমান সত্য হয়েই আছে।
স্বাধীনতা সংগ্রামী, বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা কমরেড জীবন মাইতির জীবনের পরিচয় যেটুকু পাওয়া যায়, তা থেকে বলা যায় - ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতি অবিমিশ্র ঘৃণা, শোষণ-বিরোধী আপসহীন মনোভাব, দেশের স্বাধীনতার জন্য অদম্য স্পৃহা - ছাত্রাবস্থাতেই কমরেড জীবন মাইতিকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করেছিল। জানা যায়, ১৯২০-২১ সাল থেকেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়েছিল। তখনই তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লববাদী ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন। অগ্নিযুগে কমরেড জীবন মাইতি বিপ্লবী ভগৎ সিংয়ের হিন্দুস্থান সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েশনের (এইচএসআরএ) একজন নেতৃস্থানীয় কর্মী ছিলেন। ১৯৩০ সালে ব্রিটিশ শাসকেরা কমরেড মাইতিকে রাজবন্দী হিসেবে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারারুদ্ধ করে। তৎকালীন ‘বেঙ্গল ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ অনুযায়ী কমরেড জীবন মাইতিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। এই কারাবাসকালেই দেউলি ক্যাম্পে তিনি কমিউনিস্ট কনসোলিডেশন-এর সংস্পর্শে আসেন। সেখানেই তিনি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে উঠেছিলেন। কারাজীবনেই কমরেড জীবন মাইতির মননে মার্কসবাদ স্থায়ী আসন করে নিয়েছিল। তখনই তিনি পরবর্তী জীবনে নিজেকে কমিউনিস্টকর্মী হিসেবে গড়ে তোলার এবং কমিউনিস্ট কাজে আত্মনিয়োগ করার সংকল্প গ্রহণ করেছিলেন। দেউলি ক্যাম্পে কমরেড মাইতি কমরেড প্রমোদ দাশগুপ্তের সাথে পরিচিত হন। তৈরি হয় তাঁদের আজীবন কমরেডশিপ। ১৯৩৭ সালের শেষ দিকে তাঁর বন্দীজীবন শেষ হয় এবং দেউলি ক্যাম্প থেকে অন্যান্যদের সাথে তিনিও মুক্তি পান, এর কয়েক মাস পরেই তিনি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ অর্জন করেছিলেন। শুরু থেকেই তিনি পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে নিজেকে উৎসর্গ করেন। শুধু ব্রিটিশ শাসনেই নয়, স্বাধীন সরকারের আমলেও তাঁকে বিনাবিচারে কারারুদ্ধ হতে হয়েছিল। তাঁর জীবনের প্রায় চোদ্দবছর কেটেছে কারান্তরালে। ১৯৬২ সালের ডিসেম্বর মাসেও তাঁকে অন্য অনেকের সাথে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে বিনাবিচারে আটক করা হয়েছিল। মুক্তি পান ১৯৬৩ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায়। ভারত রক্ষা আইনে বিনাবিচারে আটক কমিউনিস্ট বন্দীদের মুক্তি ও গণদাবির ভিত্তিতে কলকাতার মুসলিম ইন্সটিটিউট হলে ১৯৬৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর গণতান্ত্রিক কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দেশহিতৈষী’র তৎকালীন প্রধান সম্পাদক কমরেড মোহিত মৈত্র ওই কনভেনশনের অন্যতম আহ্বায়ক ছিলেন। কনভেনশন থেকে সমস্ত রাজবন্দীর অবিলম্বে মুক্তি দাবি করা হয়েছিল। বন্দীমুক্তির দাবিতে গণআন্দোলনও তখন দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ছিল। কমরেড জীবন মাইতি তখন বন্দী ছিলেন দমদম কারাগারে। সেখানে কমরেড মাইতি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ৫ সেপ্টেম্বর তাঁকে এসএসকেএম হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। সরকার তাঁর জীবনের কোনো ঝুঁকি না নিয়ে এবং বাইরের গণআন্দোলনের চাপে ৬ সেপ্টেম্বর কমরেড জীবন মাইতিকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়।
ইতিমধ্যে, ১৯৬৩ সালের ১৬ আগস্ট দেশহিতৈষী প্রকাশিত হয়। কমরেড জীবন মাইতি তখন দমদম জেলে বন্দী। পত্রিকা দেখার এবং পড়ার সুযোগ তিনি জেলের মধ্যে পাননি। ৬ সেপ্টেম্বর জেল থেকে মুক্তি পাবার পরেই তিনি দেশহিতৈষী হাতে পান। পত্রিকা পড়েই তাঁর মুক্তি প্রসঙ্গে এবং দেশহিতৈষী পড়ে তাঁর অনুভূতির কথা জানিয়ে ৮ই সেপ্টেম্বর দেশহিতৈষী সম্পাদককে তিনি একটি চিঠি লিখেছিলেন। চিঠিতে তিনি লেখেনঃ
প্রিয় মহাশয়,
গত ৬ই সেপ্টেম্বর আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। ৫ই সেপ্টেম্বর দমদম জেল থেকে আমাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। সরকার আমার প্রাণের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিলেন না। ৬ই সেপ্টেম্বর অবস্থা আরও খারাপ দাঁড়ায়। এবং যে কোন মুহুর্তে আমি নিঃশেষ হয়ে যেতে পারি সেই আশঙ্কায় আমাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু আমি আজও বেঁচে আছি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার পূর্বে আমি আমার কয়েকটি কথা জানিয়ে যেতে চাই।
আপনাদের ‘দেশহিতৈষী’র ৬ই সেপ্টেম্বরের সংখ্যা দেখলাম। অন্য কোন সংখ্যা পাইনি। সুতরাং কি উদ্দেশ্য ও কাম্য নিয়ে আপনারা ব্রতী হয়েছেন তা জানি না। এই সংখ্যায় মুসলিম ইন্স্টিটিউট হলে সভার বিবরণী পড়ে যা বুঝলাম তা যদি সত্য হয় তবে সেই উদ্দেশ্য জনসাধারণের কাছে প্রকাশ করা ও নির্ভীকভাবে সংগঠিত জনমত গঠন করার জন্য এই ধরনের একটি পত্রিকার প্রয়োজন ছিল। বাংলাদেশের সমস্ত সংবাদপত্র সাম্রাজ্যবাদের ও দেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শুধু লেজুড়েই পরিণত হয়নি, তারা প্রগতিশীল চিন্তাধারার মধ্যে নানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। জনগণকে এর হাত থেকে বাঁচাতে হবে। সুতরাং আরও ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে মতবিরোধ তার আলোচনা আশা করি যেমন চালাচ্ছেন তেমনি ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাবেন। আজ সরকার খুবই দুর্বল। সরকারবিরোধী মনোভাব পরিস্ফূট না হলেও সরকারী রাষ্ট্রযন্ত্রের স্তম্ভ থেকে শুরু করে জনসাধারণ পর্যন্ত সবাই খুব বিক্ষুব্ধ। সুতরাং সরকারী আঘাত আমাদের উপর যতই আসুক জনসাধারণ আমাদেরই দিকে। নির্ভীকভাবে শ্রমিক, কৃষক ও জনসাধারণের পক্ষে লিখে যান, তাদের সচেতন করুন।
জানিনা আমি কর্মজীবনে ফিরে যেতে পারব কিনা। তবে আমার কথা জানিয়ে দিলাম। আশা করব আপনাদের লক্ষ্য আরও উন্নত হোক। ‘দেশহিতৈষী’ শ্রমিক, কৃষক, নিপীড়িত জনসাধারণের নিশান ঊর্ধ্বে তুলে ধরে শেষ লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবে।
অভিনন্দন সহ
জীবন মাইতি
মুক্ত আটক-বন্দী হাসপাতাল
৮/৯/৬৩
(চিঠিটি ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৬৩ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।)
মুক্তি পাবার পর অত্যন্ত অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি পার্টির হাওড়া জেলা দপ্তরে নিয়মিত কাজে যুক্ত থাকতেন। সেই অবস্থাতেও তিনি সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে মতাদর্শের লড়াইতে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন। ১৯৬৪ সালে সিপিআই’র সপ্তম কংগ্রেসের মধ্যে দিয়ে পার্টি আনুষ্ঠানিকভাবে বিভক্ত হবার পর স্বাভাবিকভাবেই তিনি সিপিআই(এম)’র হাওড়া জেলার সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রবীণ নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হন।
কমরেড জীবন মাইতি ছিলেন প্রকৃত অর্থেই আদর্শনিষ্ট বিপ্লবী কমিউনিস্ট নেতা। শুধু মতাদর্শে দৃঢ় থাকাই নয়, কমিউনিস্ট পার্টির সাংগঠনিক নিয়ম-নীতি, শৃঙ্খলা বিপ্লবী চেতনায় ঋদ্ধ করে মেনে চলাকে তিনি অবশ্য কর্তব্য বলে মনে করতেন। পার্টির নিয়ম শৃঙ্খলার বিচ্যুতি তাঁর কাছে ছিল অসহ্য। বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির শৃঙ্খলা কাকে বলে তার উদাহরণ দিয়ে তিনি একবার এক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলেছিলেনঃ ‘‘তোমার বাঁ হাত যা করবে, ডান হাত তা জানতে পারবে না।’’ পার্টি সদস্যদের এই শৃঙ্খলাবোধে সচেতন করার চেষ্টা তিনি মৃত্যুর আগে পর্যন্ত করে গেছেন।
আবার, একইসাথে সহকর্মী অনুজ কমরেডদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ, স্নেহশীল পিতার মতো আচরণ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আকৃষ্ট না করে পারত না। কমরেডদের যে কোনো দুর্বলতা দেখলে তিনি তা কাটিয়ে তুলতে, সংশোধন করে নিতে সস্নেহ পরামর্শ দিতেন। কমরেডদের অভাব-অভিযোগ, সুবিধা-অসুবিধার দিকে তাঁর সতর্ক এবং মানবিক দৃষ্টি থাকত।
আমার আগের এবং আমার প্রজন্মের যাঁরা তাঁর সান্নিধ্যে এসে পার্টির কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন তাঁরা কমরেড জীবন মাইতির জীবনের এইরকম নানাবিধ বিপ্লবী গুণাবলির পরিচয় পেয়েছেন। পার্টিজীবন নিষ্কলুষ রাখার প্রেরণা পেয়েছেন। তাঁরা দেখেছেন কমরেড জীবন মাইতি যেমন দৃঢ়চেতা সংগঠক ছিলেন, তেমনই প্রতিকূল সময়ে কেমন সাংগঠনিক কৌশলবেত্তা ছিলেন।
ইতিহাস হলো অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন কথোপকথন। আমাদের পার্টির অতীত হলো আত্মত্যাগ, জীবন বলিদান, মানবমুক্তির লক্ষ্যে মরণপণ লড়াইয়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাস রচনা করে গেছেন আমাদের অজস্র বিপ্লবী বীর কমরেড। ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন স্রোত থেকে মানুষেরা এসে কমিউনিস্ট পার্টি এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করেছেন। শত্রুর বীভৎস আক্রমণের সামনেও তাঁরা অকুতোভয় থেকেছেন, রক্তপতাকা উড্ডীন রেখেছেন, সঙ্কটের কল্পনাতে তাঁরা ম্রিয়মান হননি। তাঁদের ওই বীর গাথা আমাদের অনুপ্রাণিত করে, ভবিষ্যতেও করবে। কমরেড জীবন মাইতি ছিলেন তাঁদেরই অন্যতম একজন।
বিপ্লবের মহান বেদিমূলেই কমরেড জীবন মাইতি এবং অন্যান্য শহিদরা জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। শ্রমিক-কৃষক-মেহনতি মানুষ তাদের শেষ সংগ্রামে এই বীর শহিদদের নেতা হিসেবে সামনে পাবে না; কিন্তু তাঁদের আদর্শ, ত্যাগ, মহত্ব এবং সাহস প্রতি মুহুর্তে লড়াইতে প্রেরণা জোগাবে।