E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ১ আশ্বিন ১৪২৭

রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ‘দিল্লি গণহত্যা’ এবং মুক্তবুদ্ধির উপর আঘাত

গৌতম রায়


গুজরাট গণহত্যার অভিমুখ ছিল এনডিএ নামক নীতিবিহীন, সুবিধাবাদী জোটকে উগ্র সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার ভিতরে রাষ্ট্রক্ষমতা টিকিয়ে রাখার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করা। সেই রাষ্ট্রক্ষমতা একক শক্তিতে চরম প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের প্রতিভূ আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি এখন করায়ত্ত করেছে। গণতন্ত্রকে ব্যবহার করে, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের নামে মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে, সেই গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বিনাশ করা এখন ধর্মান্ধ সঙ্ঘ-বিজেপি’র একমাত্র লক্ষ্য। সেই তাগিদেই তারা এম এস গোলওয়ালকর বহুত্ববাদী ভারতকে ধ্বংস করে, রাজনৈতিক হিন্দুত্বের যে অভিমুখ দেখিয়ে গিয়েছিলেন, যে ধ্যানধারণার সাথে চিরন্তন ভারতের প্রবাহিত হিন্দু চেতনার এতটুকু সংশ্রব নেই, তাকেই প্রতিষ্ঠিত করতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন, কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার উঠে পড়ে লেগেছে। সেই উদ্দেশ্য সফল করতেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। সেই তাগিদেই নাগরিকপঞ্জী নির্মাণ। আর তার প্রতিবাদে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষা নির্বিশেষে মানুষের ঐক্যকে ভাঙতেই রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস, দিল্লি গণহত্যা।

সেই সন্ত্রাসের নায়কদের বাঁচানোর তাগিদে প্রথমে গণহত্যাক্লিন্ন মুসলমানদেরই অপরাধী হিসেবে দেগে দেওয়া। তারপর সেই ষড়যন্ত্রকে তীব্র করে তুলতে গণ-আন্দোলন থেকে শুরু করে, সমাজবিজ্ঞানের প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব, যাঁরা বহুত্ববাদে বিশ্বাস করেন, আস্থা রাখেন ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে, তাঁদের এই গণহত্যার মিথ্যে ষড়যন্ত্রী হিসেবে দেখাতে চাইছে কেন্দ্র। তাই সীতারাম ইয়েচুরি, যোগেন্দ্র যাদব, জয়তী ঘোষ, অপূর্বানন্দ, রাহুল রায় প্রমুখ মানুষ, যাঁদের মূল লক্ষ্য গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে মর্যাদার সঙ্গে রক্ষা করা, তাঁদেরকে গণহত্যার ষড়যন্ত্রী হিসেবে দেখাতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করছে বিজেপি। এতখানি বিভ্রান্ত বিজেপি’র রাজনৈতিক প্রতিহিংসা যে, প্রথমে এইসব ব্যক্তিত্বদের মিথ্যে মামলায় ফাঁসাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক নিয়ন্ত্রিত দিল্লি পুলিশকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিষয়টি ঘিরে গোটা দেশে প্রবল বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের সংকল্প ধ্বনিত হওয়ার পর, সীতারাম ইয়েচুরি প্রমুখের নাম ঘিরে শেষপর্যন্ত পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে অমিত শাহ’র নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের অধীনস্ত দিল্লি পুলিশ।

এনআরসি, এনপিআর বিরোধী ব্যাপক জনজাগরণ, যা দিল্লির শাহিনবাগের ভিতর দিয়ে অঙ্কুরিত হয়ে গোটা দেশেই বিজেপি’র সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে এক গণ-অভ্যুত্থানের সমতুল হয়ে উঠতে শুরু করেছিল, তা ব্যাপক আতঙ্ক জাগিয়েছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরে। গোলওয়ালকরের যে তাত্ত্বিক রূপরেখাকে কার্যত ইষ্টমন্ত্র করে আরএসএস-বিজেপি’র বিস্তার, সেই ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদে’র তত্ত্বকেই বিরাট চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল শাহিনবাগ। এমন প্রতিরোধের মুখে মোদী প্রশাসন, তাদের প্রথম দফার শাসনকালে একটিবারের জন্যেও পড়েনি।

গোলওয়ালকরের নির্দেশ ছিল, অতীতের জাতিগুলির অভিজ্ঞতার দ্বারা অনুমোদিত এই চিন্তাচেতনা অনুযায়ী এই হিন্দুস্তানের সকল অহিন্দু মানুষ হয় হিন্দু ভাষা ও সংস্কৃতিকে গ্রহণ করবে, হিন্দু ধর্মকে শ্রদ্ধা করবে এবং পবিত্র বলে স্বীকার করে নেবে, হিন্দু জাতির গৌরবগাথা ছাড়া অন্য কোনো জাতির গৌরবজনক ধারাপ্রকৃতিকে প্রশ্রয় দেবে না। তারা কেবলমাত্র আমাদের এই প্রাচীন দেশ সম্পর্কে নিজেদের অসহিষ্ণুতার মানসিকতাই ত্যাগ করবে না, এই দেশের প্রতি তাদের অবজ্ঞার, বিশেষ করে ঐতিহ্যের প্রতি অবজ্ঞার মানসিকতাকে পরিত্যাগ করবে। এই দেশের প্রতি ভক্তি এবং ভালোবাসার মানসিকতা আর মনোভাব তৈরি করবে। এককথায় তারা আর বিদেশি হয়ে থাকবে না। আর যদি তারা বিদেশি হয়েই থাকতে চায়, তাহলে তাদের থাকতে হবে সম্পূর্ণভাবে হিন্দুজাতির অধীনস্ত এই দেশে, হিন্দুজাতির দাসানুদাস হয়ে। কোনো দাবি তারা উত্থাপন করতে পারবে না। কোনোরকম সুবিধা তারা পাবে না। কোনোরকমের পক্ষপাতমূলক আচরণও তাদের সঙ্গে করা হবে না।নাগরিক অধিকার পর্যন্ত তাদের থাকবে না (উই অর আওয়ার নেশানহুড ডিফাইনড - এম এস গোলওয়ালকর, নাগপুর, ১৯৩৮ সংস্করণ। পৃষ্ঠা-৫২)।

পাঠক, এনআরসি’র মূল ভিত্তি যে মুসলমান বিতারণ, আর সেই তত্ত্বের নির্মাতা যে গোলওয়ালকর, তা বুঝে নিতে আদৌ কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে? আর এই কারণেই এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনগুলির গায়ে রাষ্ট্রদ্রোহিতার লেবেল লটকে দিতে চায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবির। নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনী এনে যে সহনাগরিক মুসলমানদের দেশছাড়া অথবা পাকিস্তানের ‘মোহাজির’ গোছের একটি অবস্থানে তাঁদের ফেলতে চায় আরএসএস-বিজেপি, গোলওয়ালকরের তত্ত্ব এবং সেই তত্ত্ব মোতাবেক বিজেপি’র নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনের উপক্রম থেকে দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে। সেই অপচেষ্টাকে রোখার তাগিদ শাহিদবাগে থাকছে, থাকছে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবাদী ছাত্র-শিক্ষক-অভিভাবক-গবেষকদের অঙ্গীকারে। তাই এসব দমন করতে রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস, দিল্লি গণহত্যা। যেখানে মৃত ৫৩ জনের ভিতরে ৪০ জনই মুসলমান। তাঁদের প্রায় ১৫টি’র বেশি ধর্মস্থানে হামলা চলেছে। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ সবথেকে রাষ্ট্রীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সহনাগরিক মুসলমানরাই। সাফুরা জারগার থেকে নাতাশা নারওয়াল, দেবাঙ্গনা কলিতা, গুলফিশা ফাতিমাদের উপরে কেন্দ্রীয় সরকার নামিয়ে এনেছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। সেই বীভৎসতাকে আরও রাজনৈতিক শয়তানিতে পরিপূর্ণ করতে তাই রাষ্ট্র এখন অস্ত্র শানাচ্ছে সীতারাম ইয়েচুরি, রাহুল রায়, জয়তী ঘোষদের প্রতি।

গোলওয়ালকর তাঁর এই তত্ত্বের নির্মাণকল্পে হিটলারকে স্মরণ করে লিখেছিলেনঃ ‘‘জার্মানদের জাতিত্বের গর্ব আজ সব থেকে বড়ো আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। জার্মানি, নিজেদের জাতীয় সংস্কৃতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে গোটা বিশ্বকে চমকে দিয়ে সেমিটিক জাতি, ইহুদিদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তার সর্বোচ্চসীমায় এখানে জাতিত্বের গর্ব নিজেকে স্থাপন করতে পেরেছে। এটাও শেষ পর্যন্ত জার্মানি প্রমাণ করতে পেরেছে যে, নিজের আলাদা শেকড়বাকড় আছে এমন জাতি বা সংস্কৃতি একসঙ্গে মিলেমিশে একটা পূর্ণাঙ্গ সত্তা তৈরি করতে পারে না।এই শিক্ষাটাই আমাদের হিন্দুস্তানে গ্রহণ করতে হবে। আর এই শিক্ষা থেকেই আমাদের সুফল ঘরে তুলতে হবে’’ (ঐ। পৃষ্ঠা-২৭)।

সহনাগরিক মুসলমানদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়াই যে এনআরসি, এনপিআর তৈরির এক এবং একমাত্র উদ্দেশ্য, সেটা খুব ভালোভাবে বোঝা যায় সঙ্ঘের আদর্শগতভিত্তি তৈরিতে গোলওয়ালকরের যে নির্দেশিকা, তার দিকে দৃষ্টি দিলে। গোলওয়ালকর লিখছেনঃ ‘‘ভারতীয় মুসলমান এবং খ্রিস্টানরা এইদেশে জন্মালেও তারা কি যথাযথভাবে এই দেশের প্রতি অনুগত? না, কখনোই তাদের সম্পর্কে সে কথা বলতে পারা যায় না। ধর্মবিশ্বাসকে তারা পরিবর্তন করেছে। এই ধর্মবিশ্বাসের পরিবর্তনের সাথে সাথেই তাদের জাতির প্রতি ভালোবাসা এবং ভক্তি একদম উধাও হয়ে গেছে’’ (ঐ, পৃষ্ঠা-১২৭, ১২৮)।

কেন এনআরসি-বিরোধী নাগরিক অসন্তোষকে কেবলমাত্র মুসলমানদের অসন্তোষ হিসেবেই দেখাতে চায় সঙ্ঘ-বিজেপি? নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের নামে বহুত্ববাদী চেতনায় বিশ্বাসী ভারতবাসীর নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার উপক্রমের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে, সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, দেশপ্রেমিক মানুষের লড়াইকে ভেস্তে দিতে কেন রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সন্ত্রাস ‘দিল্লি গণহত্যা’ নেমে আসে? সেই গণহত্যার মূল সংগঠকদের আড়ালে রেখে, কেন গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার মানুষ কাফিল খান, সীতারাম ইয়েচুরি, সাফুরা জারগার, উমর খালিদ, জয়তী ঘোষ, রাহুল রায়দের উপর রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তৃত হয়, তা বোঝা যায় সেই গোলওয়ালকরের নির্দেশিকা থেকেই। এই নির্দেশিকারই প্রতিটি অক্ষরকে এখন বাস্তবে প্রয়োগ করতে গোটা রাষ্ট্রশক্তিকে নিয়োগ করেছে আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি।

গোলওয়ালকর লিখছেনঃ ‘‘মুসলমানেরা এই দেশের শত্রুদের সঙ্গে নিজেদের মিশিয়ে দিয়েছে। মুসলমানদের পুণ্যভূমি স্বদেশ নয়, বিদেশ।তারা নিজেদের ‘শেখ’, ‘সৈয়দ’ বলতেই বেশি তৃপ্তি অনুভব করে। এখনো তাদের বিশ্বাস এই যে, ভারতকে তারা জয় করতে এসেছে। ভারতে রাজ্য স্থাপনই তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। তাই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কেবলমাত্র ধর্ম বিশ্বাসের পরিবর্তনই নয়, জাতীয় পরিচয়ের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন মুসলমানেরা করেছে। নিজের মাতৃভূমিকে ফেলে রেখে শত্রুশিবিরে যোগ দেওয়া তো দেশদ্রোহ ছাড়া আর কিছু নয়’’ (ঐ, পৃষ্ঠা-১২৮)।

এই যে ‘দেশদ্রোহিতা’র সংজ্ঞা গোলওয়ালকর নির্দেশ করে গিয়েছিলেন গত শতকের তিনের দশকের মধ্যভাগে, প্রায় একশো বছর পরেও, সেই নির্দেশিকাই আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র কাছে একমাত্র জপমন্ত্র। এই নির্দেশিকার নিরিখেই যে গণ-আন্দোলন, হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির শ্রেণিস্বার্থের পরিপন্থী, সেই আন্দোলন, মতাদর্শ, ভাবধারা, সেই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজনকেই তারা ‘দেশদ্রোহী’ বলে চিহ্নিত করবে। আর এখন রাষ্ট্রক্ষমতা হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবিরের করায়ত্ত বলে, তাদের বিচারে যাঁরা ‘দেশদ্রোহী’ বলে বিবেচিত হবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে নেমে আসবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। তাই দিনের পর দিন জেলে পচতে হয়েছে কাফিল খান, সাফুরা জারগারদের। এখনো জেলের ভিতরে রয়েছেন কবি ভারভারা রাও সহ তাঁর সমমতাবলম্বীরা। দিল্লি গণহত্যার সঙ্গে মিথ্যেভাবে জড়ানো হচ্ছে সীতারাম ইয়েচুরি, জয়তী ঘোষদের। নতুন করে আবার জেল জীবন শুরু হলো উমর খালিদের।

‘উর্দু’, যে ভাষার জন্ম, বিকাশ ভারতে, সেই ভাষা সম্পর্কে ছয়ের দশকের সূচনা পর্বে আরএসএস’র মুখপত্র অর্গানাইজারে লেখা হয়েছিলঃ ‘‘উর্দুর নামে যেন আর একটা পাকিস্তান না সৃষ্টি হয়’’ (অর্গানাইজার, ০২\০২\১৯৬২)। আরএসএস’র এই মানসিকতা থেকেই বোঝা যায় যে, ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা এবং ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা - এই দু’টি বিষয়কেই কিভাবে, দীর্ঘসময়ের অনুশীলনের ভিতর দিয়ে, তারা একটা মৌলবাদী চিন্তার জঙ্গম, স্থানিক বিন্দুতে পরিণত করেছে। পরবর্তীতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, যত রাষ্ট্রক্ষমতার দিকে এগিয়েছে, ততো তাদের সঙ্গে জাতিগত অস্মিতাকে অবলম্বন করে রাজনৈতিক শক্তি বৃদ্ধিতে উৎসাহী, শিবসেনার মতো আঞ্চলিক শক্তি যুক্ত হয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেসের মতো কখনো ভাষাভিত্তিক অস্মিতাকে এগিয়ে দেওয়ার জন্যে, স্বয়ং তাদের সর্বোচ্চ নেত্রী অবলম্বন করেছেন ভাষা বৈরিতা (২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের পর বারাকপুর লোকসভা কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন মন্তব্য স্মরণীয়)। আবার কখনো বা তাঁদের বন্ধু হিসেবে, কার্যত শিবসেনার স্যাঙাততুল্য ‘বাংলা পক্ষ’, আরএসএস-বিজেপি’র উর্দু বিরোধিতার মতোই বাংলার বুকে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার লক্ষ্যে ছড়িয়েছে হিন্দি বিদ্বেষ।

কেবলমাত্র মুসলমানরাই যে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির আক্রমণের লক্ষ্যস্থল, তা কিন্তু নয়। যে কোনো বহুত্ববাদী চেতনায় বিশ্বাসী মানুষই তাদের আক্রমণস্থল।খ্রিস্টান সম্প্রদায় সম্পর্কে ছয়ের দশকেই আরএস এস’র মূল্যায়ন ছিলঃ খ্রিস্টানরা হিন্দি বা সংস্কৃতের মতো ভারতীয় ভাষা ব্যবহার করে না।তারা ইংরেজি ব্যবহার করে। তবে এই খ্রিস্টান বিদ্বেষের জায়গাটাকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি ’৪৭ সালে স্বাধীনতার পর থেকে অনেক বেশি প্রকট করেছে। ব্রিটিশ আমলে আরএসএস যেহেতু ইংরেজদের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে, সেই সময়ে তারা খ্রিস্টান বিরোধিতার থেকে মুসলমান বিরোধিতার প্রশ্নেই অনেক বেশি জঙ্গি ছিল।পরবর্তীতে অবশ্য মুসলমান আর খ্রিস্টানদের অভিন্ন অবস্থানে রেখেই তারা বিদ্বেষ ছড়িয়েছে।জৈন এবং বৌদ্ধদের সম্পর্কেও একইভাবে আরএসএস বিদ্বেষ ছড়িয়েছে। জৈন বা বৌদ্ধরা অর্থনৈতিকভাবে বা দর্শন চিন্তায় কোনো প্রভাব রাখতে পারেনি - এটাই হলো আরএসএস’র মূল্যায়ন (অর্গানাইজার, ১০\০৬\১৯৬৩)।

বহুত্ববাদী ভারতকে ধ্বংস করতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের অন্যতম বৌদ্ধিক অস্ত্র হলো এই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন। বস্তুত, দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে ধ্বংস করবার ক্ষেত্রেও এই আইন এবং আইনজনিত পটভূমিকে ব্যবহার করবার ষড়যন্ত্রে সঙ্ঘ-বিজেপি লিপ্ত।দলীয় রাজনীতির প্রেক্ষিতের পরোয়া না করে, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক মানুষ, বিশেষ করে যুব সমাজ, এই আইনের বিরুদ্ধে এভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে, বিগত লোকসভা ভোটে স্বপ্নাতীত সাফল্য পাওয়ার পর, সেটা কল্পনাতেও আনতে পারেনি আরএসএস-বিজেপি। তাই এনআরসি বিরোধী শাহিনবাগ সহ যাবতীয় আন্দোলনকে ভেস্তে দিতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে সবরকমভাবে ব্যবহার করতে কসুর করেনি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শিবির। সেই উদ্দেশেই তারা রাষ্ট্রীয় মদতে সংগঠিত করেছে দিল্লি গণহত্যা। বীভৎস অত্যাচার চালিয়েছে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। করোনাজনিত পরিস্থিতিকে এখন, যখন নয়া স্বাভাবিক বলে প্রশাসন ঢাক ঢোল পেটাতে শুরু করেছে, তখন যাতে নতুন করে আর কোনোভাবে এনআরসি, এনপিআর বিরোধী আন্দোলন, প্রতিবাদ, প্রতিরোধ দানা বাঁধতে না পারে, সেই তাগিদ থেকেই আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে সীতারাম ইয়েচুরিদের। সীতারামদের ঘিরে রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র প্রকাশ্যে আসাতে বেজায় মুখ পুড়েছে দিল্লি পুলিশের। তাই উমর খালিদকেও এইভাবে ইউএপিএ আইনে অভিযুক্ত করে, তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবে ভয় দেখিয়ে নওজোয়ানকে স্তব্ধ করতে হিটলার পারেনি। ইন্দিরা গান্ধী পারেনি। নরেন্দ্র মোদী তো কোন্‌ ছাড়।