৫৮ বর্ষ ৬ষ্ঠ সংখ্যা / ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২০ / ১ আশ্বিন ১৪২৭
দিকু ও হড়
পল্লব সেনগুপ্ত
শিরোনামের সাঁওতালি শব্দ দুটির অর্থ যাঁরা জানেন, তাঁরা অবশ্যই এই লেখার উপজীব্য বিষয় কী হতে চলেছে, তার একটা আন্দাজ পেয়ে গেছেন। যাঁরা মানে দুটো জানেন না এখনও, তাঁদের অবগতির জন্য বলিঃ শব্দ দুটির বাংলা ভাষায় ব্যঞ্জনা হলো (যথাক্রমে) ‘ওরা’ আর ‘আমরা’। সাদাসাপটা করে বোঝাতে গেলে - ‘বহিরাগত’ এবং ‘ভূমিপুত্র/কন্যা’।
এবারে কিছু কিঞ্চিৎ বলি কেন এই লেখার অবতারণা। আসলে ‘দিকু’ শব্দটাই মুখে না বললেও ‘ওরা’ কিংবা ‘বহিরাগত’ যারা, তাদের বিরুদ্ধে হঠাৎই দেশে-বিদেশে বেশ রাগঝাল দেখানো হচ্ছে এবং সেই দেখানোওলাদের মধ্যে শ্রীল শ্রীযুক্ত ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে বলিউডের ট্র্যাম্প, ভ্যাম্পরাও আছেন। কুল্লে এক উপাচার্যও এই বিতর্কে বিজড়িত হয়ে অশান্তির জয়কেতন ওড়াচ্ছেন। তো, সাম্প্রতিককালে এহেন বিশ্বময় ‘কোভিড-১৯’ তুল্য ‘দিকু বনাম হড়-দের দ্বন্দ্বের বীজাণু তথা ভাইরাসরা যে’ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে দেখছি, তাতে এ নিয়ে কিছু তো বলা-টলা দরকার বলেই মনে হচ্ছে!
মহামান্য ট্রাম্পের বচন দিয়েই শুরু করি। মার্কিন দেশের আগামী নির্বাচনে তাঁর ফের প্রেসিডেন্ট হবার সম্ভাবনা যত কমছে, হু হু করে ততই তাঁর আ-কথা, কু-কথা বলা বাড়ছে এবং রাগ চড়ছে; তাঁর মতে যাঁরা ওদেশে ‘দিকু’ তাঁদের বিরুদ্ধে। তাঁর মতে, যাঁরা কয়েক শতাব্দী আগে আফ্রিকা থেকে ইয়োরোপীয় দাস ব্যবসায়ীদের হাতে ধরা পড়ে সেদেশে আসতে বাধ্য হয়েছিলেন, তাঁদের এই এতবছর পরের বংশধররাও ‘দিকু’! যে হারে মার্কিনি পুলিশ - অবশ্যই চিফ-প্রভুর নির্দেশে কালোরঙা, তামারঙা নাগরিকদের ওপর দমন-পীড়ন, খুন-খারাপি চালাচ্ছে - তাতে তাঁদের বৃহত্তম অংশ আর তাঁকে ভোট দেবে না! ভারতে এসে মোদীবাবুর ‘পেন্নাম টেরাম্প কত্তা’ যতই শুনে পরিতৃপ্তি পান - তাতেও ওদেশের ভারতীয়-বংশজ নাগরিকদের অংশের ভোটও তাঁর বিরুদ্ধে সিকস্তি-পয়োস্তি হয়ে যাচ্ছে যে, সেটা শ্রীমতী কমলা হ্যারিসের (যাঁর মায়ের বাপের বাড়ি তামিলনাড়ুতে) বিরুদ্ধে তাঁর বিষ-গর্জনেই মালুম হচ্ছে! শ্রীমতী কমলার অপরাধ তিনি ডেমোক্রাটদলের পক্ষে ভাইস-প্রেসিডেন্টের পদে নির্বাচনে লড়ছেন! তার জন্যই মোদী অনুগত কিছু সংখ্যক ভারতীয়-বংশজ মার্কিন নাগরিক ছাড়া, সমস্ত সমীক্ষাই বলছে তাঁদের বৃহত্তম অংশই সমর্থন করছেন বিডেন-কমলা জুটিকেই প্রেসিডেন্ট-ভাইসপ্রেসিডেন্ট পদের জন্য। অতএব ভারতীয় বংশজরাও ‘দিকু’ - তা তাঁরা আইনসম্মতভাবে আমেরিকান হওয়া সত্ত্বেও।
ট্রাম্প অবশ্য রবীন্দ্রনাথের ‘শেষের কবিতা’-র সেই বিশেষ লাইনটার মূর্ত প্রতীকঃ ‘‘শুনিবে না মূঢ়তার সেনা।’’ কিন্তু আফ্রো-মার্কিন, ইন্দো-মার্কিন নাগরিকদের ‘দিকু’ বানাতে গিয়ে ট্রাম্পবাবু তো বিসমিল্লায় গলদ ঘটিয়ে ফেলেছেন! পূর্বপুরুষরা ভারত তথা এশিয়ার অন্যান্য দেশ কিংবা আফ্রিকার অধিবাসী ছিলেন বলে ওঁরা যদি ‘দিকু’ হন, তাহলে ট্রাম্পের মতো ইয়োরোপের মানুষের উত্তরপুরুষ যাঁরা, তাঁরাই বা কম ‘দিকু’ কিসে? সেই বিচারে তো আমেরিকার আদি জাতিগোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ যাঁরা, তাঁরা ছাড়া আর ‘‘হড়’’ কারা!?! রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তত্ত্বে বলে, নাগরিকত্ব দু’ভাবে হয়, স্বতঃস্ফূর্ত গতিতেঃ ‘জাস সলি’ (ভূমিজাত) এবং ‘জাস শ্যাঙ্গুইনিস’ (বংশজাত রক্তধারার কারণে)। ট্রাম্পের মতো ইয়োরোপীয় সূত্রজাতরাও যেমন ওদেশের নাগরিক, ঠিক তেমনই নাগরিক আফ্রিকি ও এশীয় সূত্রজাতরাও।
।। দুই ।।
এদেশেও এনআরসি ইত্যাদি নিয়ে যে প্রবল হেউৎ তোলা হচ্ছে এবং তার সূত্রে বহু মানুষকে ‘ভারতীয় নয়’ বলে ছাপ্পা লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে নামের পাশে, তারও অন্তরীক্ষে (না, না প্রকাশ্যেই)! সরি!!) রাজনীতির স্বার্থ আছে, সন্দেহ নেই, কিন্তু সেইসঙ্গে ‘‘দিকু-হড়’’ অঙ্ক যে নেই, এমনটাও নয়। আসামের বঙ্গভাষী বিতাড়ন প্রয়াস তার জ্বলন্ত নিদর্শন। সুশান্ত রাজপুতের বেদনাদায়ক মৃত্যুকে উপলক্ষ করে মহারাষ্ট্র বনাম বিহার যে বিতণ্ডা শুরু করা হয়েছিল, পুলিশ বনাম পুলিশ ঝগড়া বাঁধিয়ে, তারও অন্তরীক্ষে পুরানো ‘‘মারাঠা আমজি’’ মানসিকতাই সক্রিয়। মহারাষ্ট্র থেকে হিন্দিভাষী উত্তর ভারতীয় হটিয়ে দেবার সেই আন্দোলনের ‘জড়্’ এখনও থেকে গেছে। সুশান্তের মৃত্যু তা সলতে উস্কে দিয়েছে ফের। আসলে সংবিধানে যা-ই নির্দেশ থাকুক না কেন, সেটাকে মান্য করার দায় কারোরই বোধ হয় নেই - গণতন্ত্রের চারটি স্তম্ভ বলে যেগুলি কথিত - সরকার, আইনসভা, ন্যায়ালয় এবং গণমাধ্যম - তাদের কারোর মধ্যেই তো সে ব্যাপারে নিষ্ঠা নেই। ‘সব নাগরিকেরই সমান অধিকার’ এই সাংবিধানিক নির্দেশকে কাঁচকলা দেখানোর জন্য নাগরিকত্বকেই মুছে দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষকে ‘‘দিকু’’ বানানোর কুৎসিত ষড়যন্ত্রকে গণতন্ত্রের ওই চারটি স্তম্ভকেই শামিল করেছে একটি রাজনৈতিক দল - যারা সারাদেশে এক ভাষা চালানোরও কুটিল ষড়যন্ত্রে দীর্ঘদিন সক্রিয়। ইদানীং নতুন শিক্ষানীতি নামে একটি ভুলভুলাইয়ার চক্করে সেটাকে আরও জোরদার করেছে।
এই প্রবণতা সর্বত্রই প্রায়। বিপন্ন শরণার্থীদের আশ্রয় দেবার বদলে ইয়োরোপের বিভিন্ন দেশে যেভাবে তাদেরকে বিতাড়ন করা হচ্ছে - তার পিছনে অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে নিঃসন্দেহে। কিন্তু ‘আমরা-ওরা’ ব্যাপারটাও যে যথেষ্ট পরিমাণেই আছে, সেটাও অনস্বীকার্য।
অর্থনৈতিক স্বার্থ অবশ্য বর্তমানের দেশশাসক যারা, সেই বিজেপি কয়েকজন পেটোয়া ধনকুবেরের চরণে ঢেলে দিয়েছে। কিন্তু তারা যে এই রাজ্যে রাজ্যে দ্বন্দ্ব, ভাষা ও ধর্মগত বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে দমন ও বঞ্চনার মাধ্যমে বিভেদের বিষবীজ বপণ করছে, সেটাই ‘‘ওরা এখানে দিকু’’ এই মানসিকতার মহীরূহের গোড়াপত্তন করছে।
।। তিন ।।
নিজের পাড়া কিংবা বংশ অথবা গোষ্ঠী ইত্যাদি নিয়ে এক ধরনের হাস্যকর শভিনিজম (ওরফে উচ্চম্মন্য উন্নাসিকতা) বহুজনেরই থাকে। ‘আমরা অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ’ এই মনোভাবটা খুবই ব্যাপক। শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের সেই নতুনদা নামক কার্টুন চরিত্রটির কথা মনে পড়ছে? নিজের ‘‘দর্জিপাড়ার ছেলে’’ হওয়ার অহংকারের সাহায্যে সে তার উদ্ঘাটিত ভিতুপনাকে যে ভাবে ঢাকতে চেষ্টা করেছিল - সেটা নিশ্চয়ই আপনাদের ভোলার কথা নয়! অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করার জন্যও অন্যকে এমন অহেতুকভাবেই হেয় করা হয়। এই মানসিকতাও ‘দিকু-হড়’ প্রবণতার অন্তরালে থাকে। আর সেটা থেকেই ‘আমরা’-দের, মধ্যে ‘ওরা’-দের খাটো করে দেখানোরও একটা মূর্খতা থাকে।
এমনই একটি আপত্তিকর ঘটনা ক’দিন আগে ঘটে যেতে দেখা গেল এই মহানগরীরই একটি বাংলা সংবাদ চ্যানেলে। সেখানে প্রতিদিনের মতোই কয়েকজনকে সংগ্রহ করে নিয়মিত অভব্য কলহের সান্ধ্য আসর বসানো হয়েছিল (বোধহয় ব্যাপারটার ‘টিআরপি’ খুব বেশি, কারণ সর্বত্রই সব নিউজ চ্যানেলই এটা করে)। তো, নতুন শিক্ষানীতি নিয়ে উতোরচাপান চলতে চলতে হঠাৎই বিজেপি’র এক প্রতিনিধি (যিনি হিন্দিভাষী) বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে মিথ্যা এবং কুৎসিত কিছু কথা বলে বসলেন! এই ‘বৎসরূপটি’ (মানেটা অভিধান খুলে দেখে নেবেন ভাই) জানেনই না বাংলা ভাষার ঐতিহ্য এবং সমৃদ্ধির বিশ্বজোড়া অবস্থানের কথা। জানার কথাও নয়, তাহলে আর বিজেপি’র গোশালায় ঢুকবেন কেন! বেদনার কথা, সঞ্চালিকা এবং অন্যান্য বক্তারাও কোনো প্রতিবাদ করলেন না - যদিও তাঁরা সবাই ছিলেন বঙ্গভাষী। নিজেদেরকেই যদি ‘দিকু’ বানিয়ে রাখা হয় এভাবে, তাহলে আর প্রতিকার কী হবে?
এক উপাচার্যের কথা লেখার শুরুতে বলেছিলাম, তাঁর কথা দিয়েই শেষও করি। বিশ্বভারতীর সাম্প্রতিক গুন্ডামি এবং পালটা গুন্ডামির সূত্রে কেউ তাঁকে ‘বহিরাগত’ (দিকু) বলেছিল। জবাবে তিনিও বলেছেন, ‘‘তাহলে রবিঠাকুরও সেখানে বহিরাগত’’!... হায়রে! যেখানের আদর্শ ছিল ‘যত্র বিশ্বভবতি এক নীড়ম্’’ - সেখানেও এই মূঢ় ‘‘হড়-দিকু’’ বিতণ্ডা? কী বলব বলুন তো!