৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯
দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে প্রতিদিনই নিজের রেকর্ড ভাঙছে তৃণমূল
সিপিআই(এম)-র ডাকে ১৬ আগস্ট পশ্চিম মেদিনীপুরে জেলাশাসক দপ্তর অভিযান।
রয়েছেন মহম্মদ সেলিম, সুশান্ত ঘোষ সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ তৃণমূলের মহাসচিব, সরকারে মুখ্যমন্ত্রীর পর দ্বিতীয় স্থানাধিকারী এবং দলের শৃঙ্খলারক্ষা কমিটির চেয়ারম্যান পার্থ চ্যাটার্জির হাজতবাসের প্রায় মাসখানেক পর অবশেষে গ্রেপ্তার হয়েছেন দলের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহভাজন বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডল ওরফে কেষ্ট। গোরুপাচার কাণ্ডে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছে শাসকদল তৃণমূলের প্রকৃত চেহারা। একইসঙ্গে এটাও আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, এই জমানায় এমন ক্ষেত্র নেই যে, দুর্নীতি যেখানে স্পর্শ করেনি। দলের ওপরতলা থেকে নিচতলা - নবান্ন থেকে পঞ্চায়েত-পৌরসভা-সমবায় - সর্বত্র শাসকদল তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রী-মেম্বার-মাতব্বরদের মদতে চলছে অবাধ দুর্নীতি, তোলাবাজি, সরকারি তহবিল তছরুপ সহ নানা অবৈধ কারবার। এসবের মধ্য দিয়ে কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলছে এবং তার নানা ভাগ সুনির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের মাধ্যমে পৌঁছে যাচ্ছে শাসকদলের বিভিন্ন স্তরের নেতা-মন্ত্রী সহ তৃণমূলের সর্বস্তরে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি নিয়ে সিবিআই-ইডি যে তদন্ত চালাচ্ছে, তাতে স্পষ্ট হয়েছে যে, দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি যেমন তৃণমূল দলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জড়িয়ে গেছে, তেমনি এই দুর্নীতি ছুঁয়ে আছে দল ও সরকারের একেবারে শীর্ষস্তরে। সারদা কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পরই তা টের পাওয়া যাচ্ছিল। আজ তা দিনের আলোর মতোই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
তৃণমূল দল সরকারে থাকার সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটি কোটি টাকার দুর্নীতিকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা দিয়েছে। গোটা প্রশাসন ও পুলিশকে ব্যবহার করে রাজ্যজুড়ে অবাধ দুর্নীতি- অপশাসন জারি রেখেছে। কাজেই এই সমস্ত দুর্নীতির যারা মূল পান্ডা, অপারেটর তারা নির্বিবাদে সরকারের রক্ষাকবচকে কাজে লাগিয়ে বুক ফুলিয়ে দিনের পর দিন এই সমস্ত দুর্নীতি-কুকীর্তি চালিয়ে গেছে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্যনীয় বিষয় যে, স্বয়ং দলনেত্রী ও মুখ্যমন্ত্রীর বরাভয় দুর্নীতির মাতব্বরদের সাহস জুগিয়েছে।
তাই তৃণমূলের বীরভূম জেলার মহাপ্রতাপশালী সভাপতি অনুব্রত মণ্ডল, মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহের ‘কেষ্ট’ অবলীলায় পরপর সিবিআই’র জেরা এড়িয়ে যেতে সাহস পেয়েছেন। এর আগে ন’বার সিবিআই’র জেরা এড়ানোর পর শেষ পর্যন্ত ১১ আগস্ট তাকে গ্রেপ্তার করেছে সিবিআই। কখনো ‘অসুস্থতার’ অজুহাতে আবার কখনো ‘দলের কাজে’, ‘ভোটের কাজে’ ব্যস্ত বলে অনুব্রত জেরা এড়িয়ে গেছেন।
দেখা গেছে সিবিআই’র ডাক এলেই তিনি সরকারি ব্যবস্থাপনায় এসএসকেএম হাসপাতালের মহার্ঘ কেবিনে ভরতি হয়ে গেছেন। শেষবেলায়ও সিবিআই’র মুখোমুখি যাতে না হতে হয় তারজন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়েছেন বীরভূমের বাহুবলী নেতা অনুব্রত। এসএসকেএম-এ ভরতি হতে না পেরে বীরভূমে নিজের সাম্রাজ্যে এসে নিজের প্রভাব খাটিয়ে সরকারি চিকিৎসকদের বাড়িতে তলব করে সাদা কাগজে ‘বেড রেস্ট’ লিখিয়ে নেওয়া, চেন্নাইয়ে চিকিৎসার জন্য যাওয়ার পরিকল্পনাসহ অনেক নাটকের অবতারণা করে গেছেন। সবকিছুর পিছনে উদ্দেশ্য ছিল সিবিআই’র মুখোমুখি না হওয়া। হয়ত তিনি বুঝেই গেছিলেন সিবিআই’র জেরার মুখে পড়লে তার গ্রেপ্তারি অবধারিত। তাই শেষ পর্যন্ত প্রবল দাপুটে নেতা বোলপুর ছাড়ার গোপন পরিকল্পনাও করেছিলেন। সাতসকালে কেন্দ্রীয় বাহিনী তার বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলার পর দোতলার ঘরে ছিটকানি দিয়ে লুকিয়ে থাকারও চেষ্টা করেছিলেন। সব চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। যে নেতা একদা প্রকাশ্যে প্রবল হুমকির সুরে বিরোধীদের নিঃশেষ করতে চেয়েছেন, পুলিশকে বোমা ছোঁড়ার ডাক দিয়েছেন, জেলার প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাদের পার্টি অফিসে তলব করে কাজের নিদান দিয়েছেন, সেই দাপুটে নেতা বাড়িতে সংক্ষিপ্ত জেরায় অশ্রুসিক্ত হয়ে ‘আমায় অ্যারেস্ট করবেন না’ বলে অনুনয় বিনয় করেছেন।
গোরু পাচার কাণ্ডে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগের তথ্য মিলেছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর সিবিআই জানিয়েছে, অনুব্রত মণ্ডল নিজেই পড়শি দেশ বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যায় গোরু পাচারে যুক্ত ছিলেন। ইলামবাজারে পশুহাট থেকে গোরু নিয়ে পাচারকারীরা যাতে নির্বিঘ্নে কোনো বাধা ছাড়াই আন্তর্জাতিক সীমান্তে পৌঁছাতে পারে তার তদারকি করতেন অনুব্রত নিজে। এই পাচার কাণ্ডে বিপুল পরিমাণ টাকার লেনদেন হয়েছে।
গোরুপাচার কাণ্ডে অনুব্রতকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার নাম জড়িয়েছে কয়লা পাচারের সাথেও। এর আগে অনুব্রত’র দেহরক্ষী সায়গল হোসেনকে গ্রেপ্তার করে সিবিআই। তাকে জেরা করে গোরুপাচার সহ অন্যান্য অবৈধ কারবারের হদিশ পায় সিবিআই। এমনকী সায়গলের অসংখ্য বাড়িসহ বিশাল সম্পত্তির হদিশ মেলে। তাকে জেরার মধ্য দিয়েই অনুব্রত’র গ্রেপ্তারের পথও খুলে যায়। জানা গেছে, গোরু পাচারের মূল পান্ডা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ এনামূল হক ওরফে বিশুর সঙ্গে অনুব্রত’র নিবিড় যোগাযোগ ছিল। অসংখ্য ভুয়ো সিমের মাধ্যমেই এই এনামুলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন অনুব্রত। এক্ষেত্রে শিখণ্ডী হিসেবে ব্যবহার করা হতো তারই দেহরক্ষী সায়গল হোসেনকে।
লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, মুখ্যমন্ত্রীর স্নেহধন্য ‘কেষ্ট’ কেবল গোরু পাচারের সঙ্গেই লিপ্ত ছিলেন না, কয়লা পাচারেও তার নাম জড়িয়েছে। এনামূল হক থেকে ধৃত বাঁকুড়ার আইসি অজয় মিশ্র এবং কয়লা কাণ্ডে অভিযুক্ত ফেরার অভিষেক ব্যানার্জি ঘনিষ্ঠ তৃণমূল নেতা বিনয় মিশ্রের ভাই বিকাশ মিশ্রকে জেরা করে কয়লা পাচার কাণ্ডে অনুব্রতর জড়িত থাকার একাধিক নথি মিলেছে। এনামূল হকের বাড়ি, অফিসে তল্লাশি ও লাগাতার জেরা থেকেও বিস্তর তথ্য সামনে এসেছে। সিবিআই’র হাতে এনামুলের একটা ডায়েরি এসেছে। যা আগেই আদালতে পেশ করেছিল সিবিআই। সেই ডায়েরিতে একাধিক পুলিশ কর্তা, আমলা, বিএসএফ’র আধিকারিকদের পাশাপাশি শাসকদলের একাধিক শীর্ষ নেতার নাম রয়েছে। সেখানেই রয়েছে অনুব্রত মণ্ডলের নাম। অভিযোগ, গোটা পাচার কাণ্ডে নিরুপদ্রবে রুট করে দেওয়ার জন্য মাত্র তিন বছরে কোটি কোটি টাকা নিয়েছেন অনুব্রত মণ্ডল।
গোরু পাচার চক্রে তদন্তে নেমে সিবিআই ইতিমধ্যে বীরভূম সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় ৬০টির মতো জমি, বাড়ি সম্পত্তির হদিশ পেয়েছে। তার সব ক’টিই অনুব্রত ও তার মেয়ের নামে। এছাড়াও একাধিক রাইস মিল, ক্রাশার, বালি খাদনে বিনিয়োগ, একাধিক ডাম্পারও রয়েছে অনুব্রত মণ্ডলের নামে বেনামে। যে অনুব্রত এক সময় বাবার মণিহারি দোকানে বসতেন, তারপর বাজারে মাছ বিক্রি করেছেন, সেখান থেকে আজ কোটি কোটি টাকার মালিক।
শুধু অনুব্রত মণ্ডল নয়, তার দেহরক্ষী সায়গল হোসেনের বিপুল সম্পত্তির হদিশ জানান দিচ্ছে, কী বিশাল দুর্নীতির কারবার চালিয়েছে অনুব্রত’র বাহিনী।
গোরু, কয়লা, বালি পাচারের পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা দপ্তরের দুর্নীতিতেও অনুব্রত মণ্ডলের যোগসূত্র মিলেছে। এই দুর্নীতিতে অনুব্রত’র অন্যতম সাগরেদ হিসেবে মলয় পিটের নাম উঠে এসেছে। তার নামে রয়েছে অসংখ্য চ্যারিটেবল ট্রাস্ট। এই এজেন্সিগুলির নাম দিয়ে অনুব্রত’র অনুগ্রহে ১৪০টির মতো বৃত্তিমূলক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার পায় মলয় পিটের সংস্থা। এরমধ্যে ৪৮টি বিদ্যালয় রয়েছে বীরভূম জেলায়। এরমধ্য দিয়ে বিপুল অর্থের নয়ছয় হয়েছে। তাঁর একাংশ গেছে ‘প্রভাবশালী’দের পকেটে।
অনুব্রত-র গ্রেপ্তারের পর আরও চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে এসেছে। টেট পাশ না করেই অনুব্রত কন্যা সুকন্যা ২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষকের চাকরি পেয়ে যান। একইভাবে চাকরি মিলেছে অনুব্রত-র পরিবারের আরও পাঁচজনের। এই সূত্রে আরও যে চমকপ্রদ ঘটনা সামনে এসেছে তাহলো, অনুব্রত কন্যা সুকন্যা কোনোদিন স্কুলে যেতেন না। তার বাড়িতে হাজিরা খাতা পৌঁছে যেত। তিনি হাজিরা খাতায় সই করে দিতেন। দলীয় প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে এভাবেই সমস্ত নীতি-নিয়মকে তোয়াক্কা না করে একের পর এক অন্যায় করে গেছে তৃণমূলের নেতা-মন্ত্রীরা।
সর্বশেষ ঘটনায় জানা গেছে, গোরু পাচার কাণ্ডে ধৃত অনুব্রত মণ্ডল, তাঁর মেয়ে ও চারজন ঘনিষ্ঠের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৬ কোটি ৯৭ লক্ষ টাকা রয়েছে। ফিক্সড ডিপোজিটে। ইতিমধ্যে ওই অ্যাকাউন্টগুলি ফ্রিজ করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সিবিআই।
এহেন দলীয় নেতা, স্নেহের কেষ্টকে সাহস জোগাতে অভয়বাণী শুনিয়েছেন স্বয়ং দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী। তিনি সম্প্রতি বেহালার এক প্রকাশ্য সভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, ‘আমি মনে করি কেষ্টরা ভয় পাবে না। একটা কেষ্টকে ধরলে লক্ষ কেষ্ট রাস্তায় নামবে।’ তবে সিবিআই তল্লাশি নিয়ে আশঙ্কার সুরও শোনা গেছে। তিনি এমনও বলেছেন, ‘কাল যদি আমার বাড়িতে সিবিআই যায়, আপনারা কী করবেন? রাস্তায় নামবেন তো?’
তবে এদিনের সভায় ববি, অরূপ, মালা, শুভাশিস, অভিষেকের নাম উচ্চারণ করে গলা চড়ালেও নেত্রীর মুখে শোনা যায়নি বর্তমানে নিয়োগ দুর্নীতিতে হাজতে থাকা পার্থ চ্যাটার্জির নাম।
পার্থ চ্যাটার্র্জি ঘনিষ্ঠ বান্ধবী অর্পিতার হরিদেবপুর ও বেলঘরিয়ার ফ্ল্যাট থেকে নগদ উদ্ধার হয়েছে ৪৯ কোটি ৮০ লক্ষ টাকা, সেইসঙ্গে বিপুল সোনার অলঙ্কার, হদিশ মিলেছে অসংখ্য বাড়ি, জমিজমার।
অনুব্রতকে জেরার প্রাথমিক পর্বেই ৬০টির মতো বাড়ি জমি ইত্যাদির সম্পত্তির পাশাপাশি ব্যাঙ্কে ফিক্সড ডিপোজিট হিসেবে ১৭ কোটি টাকার সন্ধান মিলেছে। গোরু, জমি, কয়লাসহ নানা দুর্নীতিচক্রের সূত্রে সহজেই অনুমান করা যায় যে আরও বিপুল পরিমাণ অর্থ ও বেআইনি সম্পত্তির হদিশ মিলবে। দুর্নীতি কেলেঙ্কারিতে প্রতিদিনই নিজের রেকর্ড ভেঙে চলেছে তৃণমূল।
দলের সর্বস্তরে পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির হদিশ মেলার পর তৃণমূল সরকারের নেতা-মন্ত্রীদের সাংবাদিক সম্মেলন করে তাদের বিশাল সম্পত্তির বৈধতা প্রমাণে সচেষ্ট হতে দেখা গেছে। সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী প্রতিবারের মতো দিল্লি গিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তিনবার গোপন বৈঠক করে ‘সেটিং’ করে এসেছেন বলে সর্বত্র আলোচিত হচ্ছে। কিন্তু ইতিমধ্যে আরও ১৯ জন নেতা-মন্ত্রীর অবৈধ সম্পত্তি ইডি-র নজরে এসেছে। তাছাড়া কয়লা পাচারের বিপুল অঙ্কের টাকা দলের শীর্ষ নেতার স্ত্রীর বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা পড়ারও অভিযোগ উঠেছে। এসবের জেরে তৃণমূল দলের ঠগ বাছতে গা উজাড় হওয়া দশার পরিণাম কী দাঁড়ায় সেটাই দেখার।