E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯

কমরেড রূপচাঁদ পালের জীবনাবসান


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ হুগলী জেলার প্রবীণ সিপিআই (এম) নেতা ও প্রাক্তন সাংসদ কমরেড রূপচাঁদ পালের জীবনাবসান হয়েছে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। অবশেষে মঙ্গলবার ১৬ আগস্ট বেলা ১১টা ৩৫ মিনিটে প্রয়াত হন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। তাঁর মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাজ্য বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম, সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা, সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য সূর্য মিশ্র প্রমুখ।

শ্রীরামপুর জেলা পার্টি অফিসে কমরেড রূপচাঁদ পালকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে উপস্থিত ছিলেন মহম্মদ সেলিম। তিনি শোক জানিয়ে বলেন, উনি পার্টির নেতার পাশাপাশি শ্রমিক, কৃষক, মেহনতী মানুষেরও নেতা ছিলেন। ওনার ভাষণ সংসদে একটা ইতিহাস। সংসদে ওঁর বক্তব্য যা সংরক্ষিত আছে, তা এখনকার সাংসদদের কাছে শেখার বিষয়। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি ছিলেন একজন ভালো শিক্ষক। সমাজের পাঠদানের সাথে সাথে শিক্ষার জগতে বহু ছাত্রছাত্রীদের সমাজের উপযুক্ত মানুষ তৈরি করেছেন।

কমরেড রূপচাঁদ পাল ১৯৫৮ সালে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। পরবর্তীতে তিনি সিপিআই(এম)-এ যোগ দেন। তিনি ১৯৭১ সালে সিপিআই(এম) হুগলী জেলা কমিটি ও ১৯৮৮ সালে পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হন। ১৯৮০ সালে হুগলী লোকসভা কেন্দ্র থেকে প্রথমবার সাংসদ নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী হত্যার সহানুভূতির প্রভাবে কমরেড পাল জিততে পারেননি। তারপর ১৯৮৯ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্র থেকে আবার বিজয়ী হন এবং ২০০৯ সাল পর্যন্ত একটানা সাংসদ ছিলেন। সংসদীয় রাজনীতিতে তিনি ছিলেন উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘদিন লোকসভায় পার্টির মুখ্য সচেতকের দায়িত্বে ছিলেন। পাবলিক আন্ডারটেকিং কমিটি, ফিনান্স এবং বিভিন্ন স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য ছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে তাঁর ক্ষুরধার এবং যুক্তিশীল বক্তব্য লোকসভায় সমাদৃত হয়েছিল। সংসদীয় দলের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করেন। বহু উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

কমরেড রূপচাঁদ পালের উদ্যোগেই হুগলী শিশু বিজ্ঞান কেন্দ্র, হুগলী পিআরসি গড়ে উঠেছিল। তিনি ছিলেন এক নির্ভীক নেতা, উন্নত রুচিবোধ সম্পন্ন, তাঁর মধুর ব্যবহারে সকলের কাছ থেকে তিনি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অর্জন করেছিলেন। সংসদের বাইরেও সুবক্তা হিসাবে জনপ্রিয় ছিলেন। গণশক্তি, পিপলস ডেমোক্রেসি সহ বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে তিনি নানান বিষয়ে লেখালেখি করতেন। পার্টির শিক্ষক হিসাবে সুনামের অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন হুগলী জেলার যুব ফেডারেশনের প্রথম যুগ্ম-আহ্বায়ক, এরপর জেলা সভাপতি। পরবর্তীতে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। ত্রিবেণী টিস্যু, রেয়ন মিল সহ জেলার বেশ কিছু বড় শিল্পে শ্রমিক সংগঠনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

কমরেড রূপচাঁদ পাল হুগলীর বড়াল গলি এলাকার বাসিন্দা ছিলেন। ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে পরিচিতি ছিল তাঁর। তিনি হুগলীর গভর্মেন্ট ব্রাঞ্চ স্কুল থেকে উত্তীর্ণ হয়ে হুগলী মহসিন কলেজে ইংরেজিতে অনার্সে ভর্তি হন। তৎকালীন বামপন্থী ছাত্র সংগঠন বিপিএসএফ’র সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে ইংরেজি সাহিত্যে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন। ১৯৫৮ সাল থেকে মগরার বাগাটি শ্রীগোপাল ব্যানার্জি কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। বামপন্থী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য কলেজের গভর্নিং বডি তাঁকে ছাঁটাই করার উদ্যোগ নিলে তিনি কলেজ ছেড়ে নৈহাটি ঋষি বঙ্কিম কলেজে অধ্যাপনায় যুক্ত হন। তিনি ২০২১ সালে ‘হুগলি জেলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের ইতিবৃত্ত’ নামে পুস্তক রচনা করেন।

হুগলী জেলার গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী মানুষ, কৃষক, খেতমজুরদের সংগঠিত করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। সুদীর্ঘকাল তিনি ছিলেন হুগলী জেলা কৃষক কাউন্সিলের সদস্য। জেলায় খেতমজুর সংগঠন পৃথকভাবে গড়ে উঠলে তিনি খেতমজুর সংগঠনে নেতৃত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। হুগলী জেলার বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চল এলাকা বিশেষত ধনিয়াখালি, পাণ্ডুয়া, বলাগড়, পোলবা, দাদপুর, মগরা থানা এলাকায় কৃষক সংগঠন ও আন্দোলনে তিনি ছিলেন এক পরিচিত মুখ। হুগলী জেলায় সাক্ষরতা ও জনস্বাস্থ্য আন্দোলন এবং পিআরসি'র সাথেও সবসময় যুক্ত থেকেছেন।

কলকাতা থেকে কমরেড রূপচাঁদ পালের মরদেহ শ্রীরামপুর জেলা পার্টি অফিসে নিয়ে আসা হয়। সেখানে মরদেহে লাল পতাকা আচ্ছাদিত করে শ্রদ্ধা জানান মহন্মদ সেলিম, জেলা সম্পাদক দেবব্রত ঘোষ, মনোদীপ ঘোষ, আব্দুল হাই, শ্রুতিনাথ প্রহরাজ প্রমুখ। মরদেহে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, মিতালি কুমার, শান্তশ্রী চ্যাটার্জি, আশুতোষ মুখার্জি, দুলাল ভৌমিক, দেবু চ্যাটার্জি, মোজ্জামেল হোসেন সহ জেলা সম্পাদকমন্ডলী পার্টি ও বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতা, কর্মীরা। শ্রদ্ধা জানান সিপিআই নেতা তিমির ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা সুনীল সাহা, আরএসপি নেতা মৃন্ময় সেনগুপ্ত, অধ্যাপক অনীত কুমার চক্রবর্তী। শ্রদ্ধা জানানো হয় প্রয়াত নেতার পরিবারের পক্ষ থেকেও।

শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের পর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন দেবব্রত ঘোষ। এরপর শোক মিছিল করে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় শ্রীরামপুর শ্রমিক-কৃষক ভবনে। সেখানে শ্রদ্ধার্ঘ অর্পণের পর হুগলীতে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, স্টুডেন্টস হেলথ হোম, বালির মোড়ে বিজয় মোদক ভবন, পিআরসি ভবন হয়ে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে।

রাতে কমরেড রূপচাঁদ পালের মরদেহ কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। মরনোত্তর দেহ ও চক্ষুদান করেছেন তিনি। বুধবার এনআরএস হাসপাতালে সেই কাজ সম্পন্ন হয়। তিনি অকৃতদার ছিলেন।