৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯
ইতিহাসের বিকৃতি, বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস
পলাশ দাশ
১৫ আগস্ট জাতীয় পতাকা উঠল, লাল কেল্লায় ভাষণ হলো, দেশি কামানের তোপ দেগে কুচকাওয়াজ হলো, যেমনটা প্রতিবার হয়। এবার দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচারে মানুষ শুনলেন, ‘‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’’। দেশের অধিকাংশ মানুষই এর অর্থ বুঝলেন না। স্বাধীনতার ৭৫তম বার্ষিকী উদ্যাপন বললে সাধারণের বোধগম্য হয়, কিন্তু এমন সাদামাটা কথার যুগ চলে গেছে। দেশ ‘নিউ ইন্ডিয়া’-র পথে চলেছে তাই প্যাকেজিং, ব্র্যান্ডিং, মার্কেটিং, ক্যাচ লাইন দিতে হবে যাতে মানুষের সম্ভ্রম, সমীহ আদায় করা যায়। প্রচারের তীব্রতা, ব্যাপকতা ও বিশালত্বের সামনে আমজনতা দিশাহারা হবে, সত্য-মিথ্যা বিচারের যুক্তি হারিয়ে ফেলবে। তেজ, বিক্রম, আস্ফালন, বীরত্ব প্রদর্শিত হবে এমনভাবে যে, এক শক্তিমানের প্রতি ভয়মিশ্রিত ভক্তিবোধ জাগাতে তা সক্ষম হয়। অনেক মানুষ প্রধানমন্ত্রীর কথায় বিশ্বাস করেছিলেন, আজও অনেকে করেন দ্বিধা, সংশয় নিয়ে। আবার বহু মানুষ, শ্রমিক-কৃষক-বেকারের দল আজ আর ওনার অমৃতবাণীকে বিশ্বাস করেন না। তাই প্রায় ভগবানের উচ্চতার, প্রবল পরাক্রমশালীর স্বনির্মিত ইমেজ চুরমার হতেও দেখা যায় ধীর, স্থির, অবিচল, ঐতিহাসিক কৃষক সংগ্রামের কাছে। ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব প্রদানের চেষ্টার বিরুদ্ধেও ভয় উপেক্ষা করে বাঁধ ভাঙা প্রতিবাদে শামিল হন নানা ধর্ম, ভাষা, জাতি উপজাতির অসংখ্য মানুষ।
বিজেপি বা নরেন্দ্র মোদি কেউ আকাশ থেকে পড়েননি। এঁদের ইতিহাসটা গর্বের নয়, ক্লেদাক্ত। বিজেপি, পার্টি হিসেবে অন্য সবার থেকে আলাদা, কারণ তারা পরিচালিত হয় আরএসএস-র দ্বারা। আরএসএস একটি চরম হিন্দুত্ববাদী সংগঠন। হিন্দু ধর্মের কোনো উন্নতি, সংস্কার করা এদের লক্ষ্য নয়। এরা ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করে। অন্য ধর্মের প্রতি ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়াতে সাম্প্রদায়িকতা এদের অস্ত্র, এই অস্ত্রের ব্যবহার এরা পরাধীন ভারত থেকেই করে আসছে। হিন্দুমহাসভা, আরএসএস, মুসলিম লিগ সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আশ্রয় নিয়েছে রাজনৈতিক ক্ষমতা ও লক্ষ্য পূরণের জন্য। এরা ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নিয়ে ব্রিটিশকে সহায়তা করেছে।
হাস্যকর লাগলেও মোদি সরকার গান্ধীজি, বল্লভভাই প্যাটেল, সুভাষ চন্দ্র বসু, ভগৎ সিং-দের সঙ্গে নিজেদের ঘনিষ্ঠতা দেখাতে চাইছে। গান্ধীজির ছবি, চরকা-চশমা ব্যবহার করছে দেশে ও বিদেশে নিজেদের ভাবমূর্তি নির্মাণ করতে। বিজেপি-আরএসএস’র একটা বড়ো সমস্যা হলো স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ না নেওয়ায় তাদের কোনো স্বাধীনতা সংগ্রামী নেই। তাই বিজেপি-আরএসএস’র হাতে আজ সরকার এলেও তারা জাতীয় সংগ্রামের গরিমার ভাগীদার হতে পারছে না। তাই এই হীন কৌশল। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সুউচ্চ মূর্তি, সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্মদিবসকে পরাক্রম দিবস হিসেবে ঘোষণা, ইন্ডিয়া গেটে সুভাষ বসুর অতিকায় মূর্তি স্থাপনের পরিকল্পনার ঘোষণা ও হলোগ্রাম প্রকাশের পেছনে আছে সেই এক উদ্দেশ্য। এরা সভা সমিতিতে বাবা সাহেব আম্বেদকরের ছবি ব্যবহার করছে, মালা দিচ্ছে। এদের এই হাস্যকর, বিচিত্র প্রচেষ্টায় আমাদের জাতীয় নেতা ও বিশিষ্ট মনীষীদের ভাবমূর্তি, মর্যাদা বিনষ্ট হচ্ছে ও অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে। দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার অতীত ইতিহাস মুছে ফেলে নিজেদের একটা পরিচ্ছন্ন, দেশপ্রেমিক ইমেজ নির্মাণের নির্লজ্জ ফ্যাসিস্ত চেষ্টা চলছে।
স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতায় গান্ধীজি, সুভাষ বসু, আম্বেদকরদের সঙ্গে এক পঙক্তিতে স্থান হয়েছে বীর সাভারকরের, উল্লেখ হয়েছে শ্যামাপ্রসাদের নাম। সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদের নেতৃত্বে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, ব্রিটিশের সঙ্গে সহযোগিতার পথে গিয়েছিল যাতে ব্রিটিশ চলে গেলে ক্ষমতা হিন্দুত্ববাদীদের হাতে দিয়ে যায় এবং তারা যাতে হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে পারে। ওদের লক্ষ্য পূরণ সেদিন সম্ভব হয়নি। স্বাধীন দেশ গ্রহণ করেছে গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো, বহুত্ববাদের পথ। আইনের চোখে ধর্ম, ভাষা, জাতি, লিঙ্গ নির্বিশেষে সব মানুষ এদেশে সমান। সংবিধানে জোর দেওয়া হয়েছে ন্যায় বিচার, সমতার ওপর। ভারতীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য হলো তার বৈচিত্র্যঃ নানা ভাষা, নানা মত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ নিহিত আছে তার বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের ওপর। এটাকেই ভাঙতে সচেষ্ট থেকেছে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস, মুসলিম লিগ। এরাই হিন্দু জাতীয়তাবাদ, মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা।
তাই সুভাষ চন্দ্র বসুর এই শক্তিগুলি সম্পর্কে ধারণা কী ছিল বিজেপি-আরএসএস ঘুণাক্ষরে তা সামনে আনে না। সুভাষ বসু হিন্দু-মুসলমান-শিখ-জৈন-বৌদ্ধ সকল ভারতীয়কে সম চোখে দেখতেন; কোনো বৈষম্য বা ধর্মীয় বিভাজন, সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিতেন না। ফরওয়ার্ড ব্লকের সাপ্তাহিক মুখপত্রে ৮ মে, ১৯৪০ সালে সম্পাদকীয়তে সুভাষ চন্দ্র বসু লেখেনঃ
‘‘এককালে সাম্প্রয়ায়িক দলগুলির সদস্য হয়েও কংগ্রেসের সদস্য হওয়া যেত, কিন্তু এখন পরিস্থিতি বদলেছে, এরা আরও সাম্প্রদায়িক হয়েছে, তাই কংগ্রেসের সংবিধানে নতুন ধারা যুক্ত করা হয়েছে এবং এখন হিন্দু মহাসভা বা মুসলিম লিগের মতো কোনো সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্য কংগ্রেসের নির্বাচিত কোনো কমিটিতে থাকতে পারবে না।’’
আরএসএস-বিজেপি সরকার হওয়ার পরে সাভারকরের নামে পোর্ট ব্লেয়ার বিমান বন্দরের নামকরণ হয়, বাজপেয়ীর আমলে পার্লামেন্ট ভবনে তাঁর ছবি টাঙিয়ে দেওয়া হয়। সাভারকর প্রথম জীবনে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যুক্ত ছিলেন। কারাদণ্ড হয় তাঁর এবং আন্দামান সেলুলার জেলে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয়। মাত্র ৬ মাসের মধ্যেই তিনি ক্ষমা চেয়ে মুক্তির আবেদন করেন, তখন ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা জেনে গেছেন দেশবাসী। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকবেন না, এই শর্তে মুচলেকা দিয়ে জেল থেকে ছাড়া পেয়েছিলেন সাভারকর। ১৯১১ সালে এক ক্ষমাপত্রে তিনি লেখেন, ‘‘অনুতপ্ত পুত্র পিতৃ-মাতৃ সদৃশ সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথা ফিরতে পারে।” ১৯৩৩-এর ১৪ নভেম্বর এক আবেদনপত্রে তিনি লেখেন, “ভারতের প্রতিরক্ষা ও ইংল্যান্ডের বিজয়ের জন্য আমরা সেনাবাহিনীতে স্বেচ্ছাসৈনিক হিসেবে নিজেদের উৎসর্গ করব। অতএব আমাদের মুক্তি দিন...।” অর্থাৎ নিজের মুক্তির জন্য বিপ্লবীসত্তা সম্পূর্ণ বিসর্জন দিয়েছিলেন। ১৯২৩ সালে তিনি জেলে বসে একটি বই লেখেনঃ ‘হিন্দুত্বঃ হিন্দু কে?’। হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ঘৃণা, বিদ্বেষের এই বই আর তার লেখক যেমন হিন্দুত্ববাদী শক্তির পরমপ্রিয় হয়ে উঠল, তেমনই ব্রিটিশরা পেল তার ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতি প্রয়োগে বিশ্বস্ত অনুচর। ছাড়া পাওয়ার পর ১৯৩৯ সালে সাভারকর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে নিঃশর্ত সহযোগিতার আশ্বাস দেন। ৭ অক্টোবর ১৯৩৯ সালে রাষ্ট্রসচিব লর্ড জেটল্যান্ডকে একটি রিপোর্ট পাঠান ভাইসরয় লিনলিথগোর কাছে। তাতে বলা হয়, সাভারকর ব্রিটিশ সরকারের বন্ধুর মতো। সাভারকর ভারতের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনকে নির্বোধ ও মূর্খের প্রচেষ্টা মাত্র বলে উল্লেখ করেন।
চল্লিশের দশকের গোড়ায় স্বাধীনতা সংগ্রামের উত্তাল দিনগুলিতে নেতাজি আজাদ হিন্দ বাহিনী গড়ে তোলেন। সুভাষ চন্দ্র বসু ও তাঁর আজাদ হিন্দ ফৌজের সশস্ত্র লড়াইকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছিল আরএসএস, হিন্দু মহাসভা। নেতাজি যখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আজাদ হিন্দ ফৌজ গড়ছেন, তখন হিন্দু মহাসভা, আরএসএস সাভারকরের নেতৃত্বে ব্রিটিশদের পক্ষে হিন্দু জনগণের মধ্যে প্রচার করে, ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য। রিক্রুটমেন্ট ক্যাম্প সংগঠিত করে ব্রিটিশ বাহিনীতে ‘হিন্দু’-দের নিয়োগ করতে থাকেন। লক্ষাধিক ‘স্বয়ংসেবক’ রিক্রুট হয়। সাভারকরের এই অতিসক্রিয় ভূমিকা আজাদ হিন্দ বাহিনীকে রাজনৈতিক ও সামরিকভাবে পরাজিত করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করে। ব্রিটিশ বাহিনীতে হিন্দুদের রিক্রুট করার উদ্যোগের পেছনে সাভারকরের আরেকটি গূঢ় উদ্দেশ্য ছিল; তা হলো, হিন্দুরা সামরিক শিক্ষায় শিক্ষিত হলে তা পরবর্তীকালে একটি জঙ্গি হিন্দুরাষ্ট্র গঠনে সাহায্য করবে। বস্তুত সাভারকরের স্লোগানই ছিলঃ “সমগ্র সামরিক বাহিনীর হিন্দুকরণ ও হিন্দুদের সামরিকীকরণ”।
স্বাধীন ভারতের জাতীয় পতাকাকে সাভারকর মান্যতা দেননি। ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধীকে খুন করে নাথুরাম গডসে। গডসের সঙ্গে আরএসএস এবং সাভারকর দুয়েরই যোগ ছিল। সাভারকর গান্ধী হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ছিলেন, ২ বছর জেলেও ছিলেন। মোট ৮ জন জেলে ছিলেন তাঁরা। কয়েকজনের ফাঁসি হয়, আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে তিনি মুক্ত হন। গান্ধীর হত্যার পরে আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করে স্বাধীন ভারতের সরকার। এই সাভারকর আরএসএস না করলেও জেল থেকে মুক্ত হওয়ার পর আরএসএস তার সভার পর সভায় জমায়েত করে, তাঁকে সংবর্ধনা দেয়। আজ সেই বিশ্বাসঘাতককে বসানো হলো গান্ধীজি, সুভাষ বসু, আম্বেদকরের সঙ্গে একাসনে।
আরেকটি এমন চরিত্র হলো শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। তিনি হিন্দু মহাসভার নেতা ছিলেন। গান্ধীজির নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর তিনি মহাসভা ছাড়লেও হিন্দুত্ববাদী পথ যে ছাড়েননি তা বোঝা যায়, যখন তিনি আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ জনসঙ্ঘের সভাপতি হয়ে যান। এই জনসঙ্ঘই পরে রূপান্তরিত হয়ে বিজেপি’র জন্ম হয়। হিন্দুত্বের ব্লু আইড বয়, তাই প্রধানমন্ত্রী তাঁকেও বিশেষ মর্যাদা দিয়ে দিলেন। শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য থাকাকালীন একবার ছাত্রদের নিয়ে তৈরি ইউনিভার্সিটি ট্রেনিং কর্পসের কুচকাওয়াজের সময় ছাত্রদের ব্রিটিশ পতাকাকে স্যালুট করতে নির্দেশ দেন। ছাত্ররা প্রতিবাদ করে, ধর্মঘট করে। দুজন ছাত্রকে শ্যামাপ্রসাদ বহিষ্কার করেন।
সুভাষচন্দ্র বসু শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ববাদী কাজকর্ম একেবারেই পছন্দ করেননি। তাঁর অভিযোগ ছিল, ভারতের স্বাধীনতার থেকে কংগ্রেসের পরাজয়ে বেশি আগ্রহী ছিল হিন্দু মহাসভা। ১৯৪০ সালের মার্চ মাসে দলের মুখপত্রের সম্পাদকীয়তে তিনি লিখেছিলেন, হিন্দু মহাসভা ভারতীয় দলগুলির পরিবর্তে কলকাতা পুর নির্বাচনে ব্রিটিশদের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়েছিল। তিনি আরও লেখেন, “...কয়েক জন হিন্দু মহাসভা নেতার নিযুক্ত কৌশলগুলি... আমাদের বেদনা ও শোকের কারণ সৃষ্টি করেছে। হিন্দু মহাসভা কোনো স্বচ্ছ লড়াই লড়েনি... (তাদের) প্রার্থীদের মধ্যে এমন লোকেরাও অন্তর্ভুক্ত ছিল যারা কংগ্রেস পুরসমিতি ভেঙে দেওয়ার জন্য তাদের সর্বস্তরের চেষ্টা করেছিল এবং সেই লক্ষ্যে ব্রিটিশ এবং মনোনীত কাউন্সিলর গোষ্ঠীর সহযোগিতায় কর্পোরেশনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজনকে পুনরায় নির্বাচিত করা হয়েছে এবং তারা ভবিষ্যতে কীভাবে আচরণ করবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।’’ ১৯৪০ সালের ১২ মে তিনি লেখেন, ‘‘সন্ন্যাসী সন্ন্যাসিনীদের ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠিয়েছে। ত্রিশূল আর গেরুয়া বসন দেখলেই হিন্দু মাত্র শির নত করে। ধর্মের সুযোগ নিয়ে ধর্মকে কলুষিত করে হিন্দু মহাসভা রাজনীতির ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে। হিন্দু মাত্রেই এর নিন্দা করা কর্তব্য। এই বিশ্বাসঘাতকদের আপনার রাষ্ট্রীয় জীবন থেকে সরিয়ে দিন। এদের কথা শুনবেন না।’’
১৯৩৯ সালে শ্যামাপ্রসাদ হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। কার্যকরী সভাপতি হন। এমনটা জানা যায়, কলকাতায় হিন্দু মহাসভার সাম্প্রদায়িক প্রচারসভাকে একাধিকবার বিক্ষোভ দেখিয়ে বন্ধ করে দিয়েছিল ফরওয়ার্ড ব্লকের যুব বাহিনী। শ্যামাপ্রসাদ তাঁর ডায়েরিতে লিখেছেন, “সুভাষ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন এবং হুঁশিয়ার দিয়ে বলেন যে ‘হিন্দু মহাসভা’ রাজনীতি করতে এলে প্রয়োজনে বলপ্রয়োগ করে তিনি তা আটকাবেন”। শ্যামাপ্রসাদ শেষে নিজে নামলে, একটি সভায় ইট ছুড়ে শ্যামাপ্রসাদের কপাল ফাটিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ফরওয়ার্ড ব্লকের ছেলেদের বিরুদ্ধে। নানা পার্টিতে ক্ষমতার লিপ্সায় তিনি যোগ দিয়েছিলেন। এমনকী মুসলিম লিগের সঙ্গে সরকারে মন্ত্রীও থেকেছেন।
১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় শ্যামাপ্রসাদ ভারতীয়দের কাছে আবেদন করেছিলেন নিজেদের প্রদেশের রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ব্রিটিশদের বিশ্বাস করতে। এই আন্দোলনের বিরোধিতা করে তিনি ইংরেজ সরকারকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘‘বাংলাতে শাসনকার্য এমনভাবে চালানো উচিত যাতে এই আন্দোলন বাংলায় শিকড় গাড়তে না পারে। আমরা, বিশেষত দায়িত্বশীল মন্ত্রীরা যাতে বলতে পারি, কংগ্রেস যে স্বাধীনতার আন্দোলন করছেঃ তা ইতিপূর্বেই জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে এসে গেছে।’’ অর্থাৎ ভারত নাকি স্বাধীন হয়ে গেছে, ইনি পাগল না ইংরেজের দালাল! সুভাষ চন্দ্র বসু কঠোর ভাষায় এদের বিশ্বাসঘাতক বলেছেন, আর আজ প্রধানমন্ত্রী সেই সুভাষ বসুর পাশে তাঁরই চিহ্ণিত বিশ্বাসঘাতকদের মহান দেশপ্রেমিক নেতা বানিয়ে দিচ্ছেন।
নেহরু খারাপ কিন্তু বল্লভভাই প্যাটেল ভালো। আসলে কার কী অবস্থান তা সর্দার প্যাটেলের দুটি ঐতিহাসিক চিঠির অংশ পড়লেই বোঝা যাবে। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদকে ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাই সর্দার প্যাটেল লিখছেন, ‘‘আরএসএস এবং হিন্দু মহাসভার বিষয়ে বলা যায়, গান্ধীজির হত্যা সংক্রান্ত মামলাটি বিচারাধীন আছে, তাই আমি তাঁর হত্যাকাণ্ডে এই দুটি সংগঠনের যুক্ত থাকার ব্যাপারে কিছু বলতে চাই না। কিন্তু আমাদের রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, এই দুটি সংগঠনের, বিশেষত প্রথমটির কার্যকলাপের ফলে এমন একটা পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যার দরুন এই ভয়ঙ্কর ট্রাজেডি ঘটা সম্ভবপর হয়েছিল।’’
দ্বিতীয় চিঠিতে ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আরএসএস প্রধান গোলওয়ালকরকে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল লেখেন, ‘‘হিন্দুদের সংগঠিত করা ও তাদের সাহায্য করা এক জিনিস, তাদের দুঃখ-দুর্দশার বদলা হিসেবে অসহায় পুরুষ নারী ও শিশুদের বেছে নেওয়া সম্পূর্ণ অন্য জিনিস।.... তাছাড়াও তাদের এই কংগ্রেস বিরোধিতা তাও আবার এত বিদ্বেষপূর্ণ যেখানে ব্যক্তিত্ব, বিচার, শালীনতা বা শিষ্টতার কোনো বালাই নেই, তা মানুষকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। তাদের সমস্ত বক্তৃতাই সাম্প্রদায়িকতার বিষে ভরা। হিন্দুদের উদ্দীপ্ত করা এবং নিজেদের নিরাপত্তার জন্য তাদের সংগঠিত করার জন্য বিষ ছড়ানোর কোনো প্রয়োজন ছিল না। এই বিষেরই চূড়ান্ত ফল হিসেবে গান্ধীজির অমূল্য জীবন হারাতে হয়েছে দেশকে। আরএসএস’র জন্য সরকারের বা মানুষের আর এতোটুকু সহানুভূতি ও অবশিষ্ট নেই।’’
হিন্দুত্ববাদী শক্তি হিন্দু ভারত গড়তে চায়, তালিবান শাসিত আফগানিস্তানের মতো। ‘হিন্দুত্ব’ কার্যত একটি রাজনৈতিক প্রকল্প, যার শুরু হিন্দু মহাসভার নেতা সাভারকরের হাত ধরে। তাঁর স্বপ্ন ছিল এক ‘অখণ্ড ভারতের’, যেখানে থাকবে ‘এক ভগবান, এক রাষ্ট্র, এক লক্ষ্য, এক জাত, এক জীবন, এক ভাষা।’ এদেশে শুধু তাদের অধিকার যাদের জন্মভূমি ও পুণ্যভূমি এই দেশ, বাকিরা বিধর্মী, বিদেশি। দেশ চলবে মনুস্মৃতি অনুযায়ী। তাই হিন্দুত্ববাদীরা ভারতের সংবিধানের বিরোধিতা করেছে, বিধর্মীদের পতাকা, বিধর্মীদের সংবিধান বলেছে। মনুস্মৃতি অনুযায়ী, জাতিভেদ প্রথা থাকবে, অস্পৃশ্যতাকে মান্যতা দিতে হবে, নারী ও শূদ্রের কোনো অধিকার থাকবে না। এদের কাজ হবে উচ্চবর্ণের সেবা করা। নারী শৈশবে, যৌবনে অথবা বার্ধক্যে থাকবে পুরুষের অধীন। স্বাধীন ভারত মনুস্মৃতির নির্দেশ না মেনে ন্যায়-সমতা, সমান অধিকারের পথ নেয় এবং আধুনিক ভারতের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আম্বেদকরের এক্ষেত্রে ছিল উল্লেখযোগ্য ভূমিকা। প্রতি পদে তাঁকে তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে।
আরএসএস’র 'হিন্দুত্ব' বলতে যে আসলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক জীবনে উচ্চবর্ণের পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা বোঝায় তা সংবিধান প্রণেতারা বুঝেছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে আম্বেদকর ছিলেন আপসহীন। গান্ধী ও নেহরু উভয়েই এই বর্ণভিত্তিক পুরুষ-নিয়ন্ত্রিত অনগ্রসর অখণ্ড ভারতের পরিবর্তে বহুত্ববাদী, বৈচিত্র্যময় ভারতে সমতা, ন্যায়ের পক্ষে ছিলেন, সবার সমান অধিকারের পক্ষে ছিলেন। সেদিন সাভারকররা হেরেছিলেন, জিতেছিল ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, আধুনিক ভারতের আদর্শ। রবীন্দ্রনাথ থেকে সুভাষ চন্দ্র বসু, গান্ধী-নেহরু, আম্বেদকরদের ভারতকে আজ বদলে দেওয়া হচ্ছে। আর তাই সাভারকর, শ্যামাপ্রসাদকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে তাঁদের বিকৃত আদর্শকে ভারতীয় সমাজে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করার হীন চক্রান্ত চলছে। সেই গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই আরএসএস’র সংগঠক প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসকে বদলিয়ে বেইমানদের আদর্শ বানানোর নিকৃষ্ট কাজটি ৭৫ তম স্বাধীনতা দিবসের মঞ্চ থেকে করলেন। ভারতবাসী হিসেবে এর প্রতিবাদে মুখর না হলে বহু ত্যাগ, কষ্ট, শহিদের মৃত্যুবরণের গৌরবোজ্জ্বল স্বাধীনতা সংগ্রামের, স্বাধীন দেশ গড়ে তোলার ইতিহাসের কাছে অপরাধী হব সবাই। তাই আর দেরি নয়, আসুন ঐক্যবদ্ধ হই, ভারতকে রক্ষার সংগ্রামে নিজেদের যুক্ত করি।