৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯
প্রসঙ্গঃ ভারত ছাড়ো আন্দোলন
সুপ্রতীপ রায়
এবছর ভারতের স্বাধীনতার ৭৫। আমাদের দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৯৪২-র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন নিয়ে চর্চা, গবেষণার অন্ত নেই। ১৯৪২ সালের ২৬ এপ্রিল গান্ধীজি ‘হরিজন’ পত্রিকায় প্রথম ‘ভারত ছাড়ো’ সম্পর্কিত পরিকল্পনা জানান। তিনি এই মর্মে ব্রিটিশ সরকারকে অনুরোধ করেন - তাঁরা যেন ভারত থেকে চলে যান।
১৯৪২ সালের ১৪ জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির ওয়ার্ধা বৈঠকে ‘ভারত ছাড়ো’ নীতি অনুমোদিত হয়। কংগ্রেস পরিষ্কার জানিয়ে দেয় যে, ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের প্রস্তাব গ্রহণ না করলে ১৯২০ সালের থেকেও বড়ো ধরনের অহিংস আন্দোলন হবে। ৯ আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির বোম্বাই অধিবেশনে ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।
আগস্ট প্রস্তাব পাশ হওয়ার পর গান্ধীজি ঘোষণা করেছিলেন, “এই মুহূর্তে ভারতের প্রত্যেক নরনারী নিজেকে স্বাধীন মনে করেন এবং সেই মতো আচরণ করবেন। ...পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই আমি সন্তুষ্ট হব না। লক্ষ্য অর্জন, নয় মৃত্যূ। আমরা ভারত স্বাধীন করব নতুবা মৃত্যু বরণ করব।’’ ১৯৪২ সালের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। জনতার রোষে ব্যাপক সরকারি সম্পত্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। কেন্দ্রীয় আইন সভায় দেওয়া তথ্য অনুসারে ১৯৪২-র ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি ক্ষতির পরিমাণ এইরূপ [১] - পুলিশ থানা (ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত) - ১৯২, অন্যান্য সরকারি গৃহ - ৪৯৪, রেল স্টেশন - ৩১৮, রেলপথের ক্ষতি - ১০২, পোস্ট ও টেলিগ্রাফ অফিস - ৩০৯, কেবল বিনষ্ট - ১১,২৮৫।
আন্দোলন দমনে সরকারি দমননীতিও নামিয়ে আনা হয়েছিল। ১৯৪২-র শেষ পর্যন্ত সময়ে গ্রেপ্তার, মৃত ও হতাহতের সরকারি তথ্য এইরূপ [২] - গ্রেপ্তার-৬০,২২৯, ভারত নিরাপত্তা আইনে ধৃত ব্যক্তির সংখ্যা - ১৮,০০০, পুলিশ ও মিলিটারি দ্বারা নিহত ব্যক্তির সংখ্যা - ৯৪০, পুলিশ, মিলিটারির গুলিতে আহতের সংখ্যা - ১,৬৩০।
মহাত্মা গান্ধী, জওহরলাল, আজাদ প্রমুখ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব আন্দোলন শুরুর আগেই গ্রেপ্তার হলেন। কিন্তু নেতৃত্বহীন অবস্থায় যে গণ-আন্দোলন পরিচালিত হতে লাগল তা এক কথায় গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলনের প্রথম পর্বে ব্রিটিশের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। মৌলানা আজাদের ভাষায়, ‘It created an electric atmosphere in the country. Please did not pause to consider what were its Implications’. [৩]
একথা উল্লেখ্য, ‘ভারত ছাড়ো’ প্রস্তাবে কংগ্রেস নেতারা একমত ছিলেন না। রাজা গোপালাচারি গান্ধীজির মত সমর্থন করেননি। নেহরু প্রথম দিকে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রতি মানসিক সমর্থন জ্ঞাপন করেন নি। তিনি মনে করতেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধজনিত পরিস্থিতিতে মিত্রশক্তিবর্গের বিরোধিতা করলে ফ্যাসিবাদী শক্তিকেই উৎসাহিত করা হবে। যদিও তিনি শেষ পর্যন্ত গান্ধীজিকেই সমর্থন করেছিলেন। [৪] আজাদের অভিমত ছিল - জটিল যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ব্রিটিশের কাছে ভারতীয় সাম্রাজ্য রক্ষার বিষয়টি অগ্রাধিকার। সেই কারণেই কোনো গণ আন্দোলন শুরু হলে ব্রিটিশ সরকার তা বরদাস্ত করবে না। [৫]
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সম্পর্কে কংগ্রেস নেতৃত্বের মধ্যেই ভিন্ন মত ছিল। উইকেনডেনের গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায় - কিরণশঙ্কর রায়, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখের মতো বঙ্গীয় প্রাদেশিক কমিটির নেতৃত্ব নীতিগতভাবে এই আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন। [৬]
গান্ধীজি ছিলেন অহিংসার পূজারি। তিনি আন্দোলনের মধ্যে হিংসাকে পছন্দ করতেন না। কিন্তু ১৯৪২- এর আন্দোলন কী পুরোপুরি অহিংস ছিল? কখনই না। মেদিনীপুরের দিকে তাকালেই বোঝা যায় আন্দোলন সম্পূর্ণ অহিংস ছিল না।
“...মেদিনীপুরের ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রস্তুতি পর্যায় (৯ আগস্ট ১৯৪২ - ২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৪২) ছিল মিটিং, মিছিল, বিক্ষোভ, গণসংগঠন এবং গণচেতনার প্রসার। এই পর্যায় সম্পূর্ণ অহিংস পন্থায়। পরবর্তী সংঘর্ষ পর্যায়ে (২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ - নভেম্বর, ১৯৪২) ঐতিহাসিক থানা অভিযান, দখল এবং অন্যান্য সরকারি অফিসের ব্যাপক ধ্বংসসাধন। উক্ত ঘটনাবলি ছিল হিংসাত্মক। পুলিশের ৩৩টি বন্দুক ছাড়ান, সরকারি কর্মচারী-পুলিশ এবং খাসমহল অফিসার ও অন্যান্যদের গ্রেপ্তার এবং আটক ছাড়াও মোট ১৩২টি সরকারি অফিস আক্রমণ-ধ্বংসসাধন করা হয়েছিল। অন্যদিকে সাম্রাজ্যবাদী শাসক পরিস্থিতির মোকাবিলায় সশস্ত্রভাবে প্রস্তুত। তথাপি ২৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৪২ খেজুরি থানা এবং খাসমহল অফিস দখল বিনা রক্তপাতে। পরদিন ২৯ সেপ্টেম্বর পটাশপুর ও সূতাহাটা থানাও বিনারক্তপাতে দখল করেছিল জনগণ। কিন্তু ওইদিন তমলুক থানা, মহিষাদল থানা এবং ভগবানপুর থানা অভিযানে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মাতঙ্গিনী হাজরা সহ ৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক। এছাড়া ৩০ সেপ্টেম্বর নন্দীগ্রাম থানা অভিযানে শহিদ হন ৫ জন। সেই সময় এবং পরবর্তী পর্যায়ে পোস্ট অফিস, ইউনিয়ন বোর্ড এবং রেজেস্ট্রি অফিস প্রভৃতির ধ্বংস সাধন বিনা রক্তপাতে। পরিসংখ্যান নিম্নবর্নিত - পোস্ট অফিস ধ্বংস সাধন - ৩৮, ইউনিয়ন বোর্ড - ২১, পঞ্চায়েতি ইউনিয়ন - ২১, সাব রেজিস্ট্রি অফিস - ৭, ঋণ সালিশি বোর্ড - ১৩, ডাক বাংলো - ১৭, আবগারি দোকান - ১৪, সরকারি বন্দুক ছাড়ান - ৩৩, ব্রিজ ধ্বংস - ৩৮, সাব ওভারসিয়ার অফিস - ২, টোল অফিস - ২, থানা আক্রমণ - ৭...”। [৭]
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে মোট চারটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়েছিল-খেজুরি থানা জাতীয় সরকার, পটাশপুর থানা জাতীয় সরকার, মহাভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকার, কাঁথি মহকুমা স্বরাজ পঞ্চায়েত। তমলুক মহকুমার ‘গরমদল’এর সহিংস ভূমিকা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ‘বিদ্যুৎ বাহিনী’ এবং ‘ভগিনী সেনা’র মধ্যে বিশ্বাসভাজন, সাহসী অংশকে নিয়ে গঠিত হয়েছিল ‘গরমদল’। [৮]
আন্দোলন চলাকালীন ব্রিটিশের অত্যাচার বাড়ছিল। যেমন ১৯৪৩ সালের ৯ জানুয়ারি মহিষাদল থানায় চণ্ডীপুর, মাশুরিয়া, ডিহি মাশুরিয়া - এই গ্রামগুলিতে ব্রিটিশ পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনী মহিলাদের গণধর্ষণ করে। ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ছিল - ৪৬৮। পুলিশের এই অমানবিকতা রুখতে এবং ব্রিটিশের চর হিসাবে যারা কাজ করত তাদের সাজা দিতে গঠিত হয়েছিল ‘গরমদল’। জাতীয় সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ দেশদ্রোহীদের সম্বন্ধে তথ্য সংগ্রহ করে মৃত্যুদণ্ড, গ্রেপ্তার, অর্থদণ্ড দিত। থানা অনুযায়ী প্রাণদণ্ডের সংখ্যা এরূপ - মহিষাদল - ২৩, সুতাহাটা - ১২, নন্দীগ্রাম - ৩, তমলুক থানা - ২। [৯] মেদিনীপুরের বিশিষ্ট গান্ধীবাদী নেতা কুমারচন্দ্র জানা তাম্রলিপ্ত জাতীয় সরকারের হিংসাত্মক কাজের তীব্র বিরোধী ছিলেন।
বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করলে দেখা যায় অসহযোগ বা আইন অমান্য আন্দোলনের থেকে এর পদ্ধতি ছিল আলাদা। আবার গান্ধী শেষ পর্যন্ত কোনো কার্যসূচি স্থির করেননি। উইকেনডেনের রিপোর্ট থেকে জানা যায়, বল্লভভাই প্যাটেল নাশকতামূলক কার্যকলাপ বিষয়ে একটি কর্মসূচি গুজরাট প্রদেশ কমিটির হাতে দিয়েছিলেন। অর্থাৎ ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অহিংসা ও হিংসার সহাবস্থান ও সংঘাত ছিল।
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন সফল হয়নি। ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে জাতীয় কংগ্রেস নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাব ছিল। আন্দোলনের আহ্বান দিয়ে জাতীয় সরকার গঠনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। গান্ধী আন্দোলনের সূচনা করলেও আন্দোলন পরিচালনার কোনো কাঠামো তিনি গঠন করেননি। গান্ধীজির আশা ছিল - বড়োলাট হয়তো তাঁকে আলোচনার সুযোগ দেবেন, তাঁর আশা পূরণ হয়নি। ১৯৪৪ সালে সরকার নির্বাচন ঘোষণার জন্য তৎপর হয়ে পড়ে। অনেক কংগ্রেস নেতা আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এটাও উল্লেখ্য - ‘আগস্ট প্রস্তাব’ গ্রহণ করার সময় সারা ভারত কংগ্রেস কমিটির সভায় গান্ধীজি যে বক্তব্য রেখেছিলেন, সেখানে ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন কার্যকর করার জন্য তিনি সুনির্দিষ্ট কার্যসূচি ঘোষণা করেননি। অত্যাচার চালিয়ে আন্দোলন দমনে ব্রিটিশের খুব বেশি দিন সময় লাগেনি।
কিন্তু ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন নিয়ে তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান সম্পর্কে কুৎসা, মিথ্যাচার, বিকৃত তথ্য পরিবেশন আজও বিদ্যমান। কমিউনিস্ট পার্টি যুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করার নীতি গ্রহণ করেছিল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি কখনই ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশের সহযোগী ছিল না। ভারতবর্ষের কমিউনিস্টরা অন্ধভাবে যুদ্ধ প্রয়াসে সাহায্য করেনি ও ব্রিটিশ সরকার কমিউনিস্টদের আন্তরিকতায় সন্দিহান ছিল। [১০]
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে ১৯৪২ সালের ২৩ জুলাই নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। এটা নিয়েও কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে কুৎসা করা হয়। ১ আগস্ট সমাবেশ করে কলকাতার টাউন হলে। এই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রাহুল সাংকৃত্যায়ন। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা থাকার কারণে কাকাবাবু, সোমনাথ লাহিড়ী, আব্দুল হালিম প্রমুখ নেতৃত্ব অনুপস্থিত ছিলেন। [১১] কমিউনিস্ট পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহৃত হলেও অনেকে গ্রেপ্তার ছিলেন। ব্রিটিশ কখনই কমিউনিস্টদের প্রতি সদয় ছিল না।
“এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বোম্বাইয়ে সিপিআই-র এই কংগ্রেস যখন অনুষ্ঠিত হয় তখনও কয়েকশত সদস্য ও সমর্থক (যার মধ্যে প্রাক্তন বিপ্লবীরাও ছিলেন) ব্রিটিশ কারাগারে বন্দি ছিলেন। সিপিআই-র হিসাব অনুসারে ১৯৪২’র ৯ আগস্ট মোট ৪১৩ জন কমিউনিস্ট কারারুদ্ধ ছিলেন, যার মধ্যে মুক্তিপ্রাপ্তর সংখ্যা খুব বেশি নয়। তাছাড়া ওই সময় থেকে পার্টি কংগ্রেসের সময়কাল পর্যন্ত ৭ মাসে বিভিন্ন অভিযোগে আরও ৩০০ জন কমিউনিস্টকে ব্রিটিশ সরকার কারারুদ্ধ করে। যদিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী যে বিপুল সংখ্যক স্বাধীনতা সংগ্রামী কারারুদ্ধ হয়েছিলেন সে তুলনায় এই সংখ্যা খুবই নগণ্য, তথাপি সরকারের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহায়তাকারী ভূমিকা থাকা সত্ত্বেও ব্রিটিশ সরকার যে আনুমানিক ৫ শতাধিক কমিউনিস্টকে আটক করে রেখেছিল তার তাৎপর্য নেহাত কম নয়। ১৬০ জনের মধ্যে ১০৫ জন ছিলেন যাবজ্জীবন দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার অভিযানের দুই নায়ক গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং। এছাড়া বাংলার জেলে আটক প্রভাত চক্রবর্তী, নলিনী দাস, আনন্দ গুপ্ত প্রমুখ কমিউনিস্ট বন্দিরা ছিলেন প্রায় মৃত্যুশয্যায়। এছাড়া মালবারের অন্যতম কমিউনিস্ট নেতা কেপিআর গোপালন, মুলা পোকান, ভগৎ সিং-এর সহকর্মী গয়াপ্রসাদ এবং কাপুর, বাবা গুরমুখ সিং ও কানপুরের শ্রমিক নেতা চাচা জান মহম্মদ প্রমুখের নাম ছিল উল্লেখযোগ্য বন্দিদের তালিকায়। এঁদের মুক্তির জন্য সিপিআই-র কংগ্রেস থেকে বাবা সোহন সিং ভাখনাকে সভাপতি এবং পার্বতী কুমারমঙ্গলমকে সম্পাদক করে একটি ‘Prisoner’s Aid committee’ গঠন করা হয়েছিল।” [১২]
কমিউনিস্ট পার্টি বৈধ ঘোষিত হওয়ার দু’মাসের মাথায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় বর্ধিত প্লেনাম অনুষ্ঠিত হয়। তখনও অনেক কমিউনিস্ট নেতা কারারুদ্ধ ছিলেন। ১ আগস্ট টাউন হলের সভার মঞ্চের পিছনে লাল পতাকার সঙ্গে তেরঙ্গা পতাকা বা প্লেনাম থেকে কংগ্রেসের বন্দি নেতাদের মুক্তির দাবি তোলা থেকে প্রমাণিত হয় কমিউনিস্টরা ভারতের স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন।
১৯৪২ সালের ৯ আগস্ট কংগ্রেস নেতৃত্বের গ্রেপ্তার হওয়ার অব্যবহিত পরেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে কংগ্রেস নেতাদের গ্রেপ্তারের প্রতিবাদ করে বিবৃতি প্রচার করে। বিবৃতিতে ব্রিটিশ দমননীতির তীব্র সমালোচনা করা হয়। একই দিনে পার্টি সদস্য ও কর্মীদের উদ্দেশ্যে কমিউনিস্ট পার্টির পলিট ব্যুরোর পক্ষ থেকে প্রকাশিত ‘পার্টি চিঠি’তে কংগ্রেস নেতৃত্ব ও আন্দোলনকে হেয় করা হয় এরূপ কোনো বক্তব্য ছিল না।
সিপিআই-র ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত ‘পিপলস ওয়ার’ পত্রিকায় ১৬ আগস্ট সংখ্যাতে সাম্রাজ্যবাদী দমন নীতির তীব্র নিন্দা করা হয়েছিল। ব্রিটিশ সবসময় কমিউনিস্ট পার্টিকে সন্দেহের চোখে দেখতো। ১৯৪২ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ভারত সচিব এমেরির কাছে জরুরি গোপন তারবার্তা বড়োলাট লিননিথগো পাঠিয়েছিলেন, সেখানে বলা হয়েছিল, কার্যত কমিউনিস্টরা কংগ্রেসেরই পক্ষে। ৫ সেপ্টেম্বর ভারত সচিবকে পাঠানো আর একটি গোপন তারবার্তায় ভারত সরকার বলেছিল - সিপিআই মূলত ব্রিটিশ-বিরোধী বিপ্লবীদের দ্বারাই গঠিত।
সিপিআই আগস্ট আন্দোলনের সময় ব্রিটিশ সরকারের দমননীতিকে তীব্র আক্রমণ করেছিল। আগস্ট আন্দোলনের শুরুতেই সিপিআই-র কেন্দ্রীয় কমিটির মুখপত্র ‘পিপলস ওয়ার’-এর সম্পাদকীয় তার প্রমাণ। [১৩] সম্পাদকীয়তে লেখা হয়েছিল -
“...সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্রী যে পাশবিক দমন ব্যবস্থাকে বিদ্যুৎ গতিতে দেশের মধ্যে বিচরণ করিতে দিতেছে, তাহাই দেশে আগুন জ্বালাইয়াছে। জনগণের সঞ্চিত ক্রোধ ও অসন্তোষকে সংগঠনহীন ও স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের পক্ষে ঠেলিয়া দেওয়ার চেষ্টাই উহারা করিয়াছে। তাহার পর সে বিক্ষোভকে উহারা লাঠি, বুলেট ও কাঁদুনি গ্যাস দিয়া ঠেকাইতেছে।
...তাহারা জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠা করিতে দেয় নাই। এখন তাহারা আমাদের একমাত্র সংগঠিত শক্তি কংগ্রেসকে চূর্ণ করিতে চাহিতেছে। কারণ একমাত্র কংগ্রেসই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া উহাদের অনিচ্ছুক হস্ত হইতে জাতীয় সরকার ছিনাইয়া আনিতে পারে’’। [১৪]
‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন, ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস সম্পর্কে আরও চর্চা হওয়া প্রয়োজন। কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ও কুৎসাকে খণ্ডন করে প্রকৃত তথ্যগুলি জনগণের সামনে আরও বেশি পরিমাণে আসবে।
তথ্যসূত্রঃ
১। বি. বি. মিশ্র - Indian Political Parties; (পৃঃ ৪৩৭-৪৪২)।
২। ওই।
৩। ১৯৪২র ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলন ও মূল্যায়নের হেরফের - শুচিব্রত সেন; (পৃঃ ৮) [ভারত ছাড়ো আন্দোলন ফিরে দেখা - পঃ বঃ ইতিহাস সংসদ]।
৪। বাংলার গণ আন্দোলনের ছয় দশক (সম্পাদনা - কমল চৌধুরী; পৃঃ ৫৯)।
৫। India wins Freedom - মৌলানা আবুল কালাম আজাদ (দিল্লি সংস্করণ; পৃঃ-৭২)।
৬। ৪২’এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন কংগ্রেস নেতৃত্বের দায়িত্ব ও কৃতিত্ব - রাজর্ষি মহাপাত্র; পৃঃ ৪০২ (ইতিহাস অনুসন্ধান-৯)।
৭। মেদিনীপুরের ৪২’র গণ আন্দোলনঃ অহিংস এবং সহিংস ধারার সহাবস্থান ও সংঘাত - হরিপদ মাইতি; পৃঃ-৮৩৩ (ইতিহাস অনুসন্ধান-১৫)।
৮। ওই; পৃঃ-৮৩৫।
৯। ওই; পৃঃ ৮৩৮।
১০। The Transfer of Power, দ্বিতীয় খণ্ড; পৃঃ ৪৩৯-৪৪১।
১১। বাংলায় বামেরা রাজপথে ও রাজ্যপাটে (১৯২০-২০১১); অঞ্জন বসু; পৃঃ ৮৭।
১২। ভারত ছাড়ো আন্দোলন, ফ্যাসিস্ট - বিরোধী জনযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা (১৯৪২-৪৫) সুস্নাত দাস; পৃঃ ৮৭-৮৮ [ভারত ছাড়ো আন্দোলন ফিরে দেখা, পশ্চিমবঙ্গ ইতিহাস সংসদ]।
১৩। উত্তাল চল্লিশঃ অসমাপ্ত বিপ্লব - অমলেন্দু সেনগুপ্ত; পৃঃ-৯।
১৪। People’s War - 16.08.1942