৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯
উত্তর দিনাজপুরের তেভাগা
মানবেশ চৌধুরী
প্রত্যেক জেলারই গর্ব করার মতো কিছু না কিছু ইতিহাস আছে। কিন্তু আমাদের বৃহত্তর দিনাজপুরের আছে কিছু বেশি। এবং তা বিদ্রোহ ও সংগ্রামের ইতিহাস।
দ্বিতীয় বিগ্রহপাল ১০৭২ সালে মারা গেলে দ্বিতীয় মহিপাল রাজা হন। তিনি অত্যাচারী শাসক ছিলেন। কৈবর্ত সামন্তদের বিদ্রোহে তিনি নিহত হন। দিব্বোক নামে একজন কৈবর্ত সামন্তকে রাজা করা হয়। বিদ্রোহীরা যে স্থানে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেন, জয়ের স্মারক হিসাবে তার পাশের দিবর দিঘিতে ৩৪ ফুট উঁচু ও ১০ ফুট বেড়ের একটি প্রস্তর স্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। যা এখনও বিদ্যমান। এটি তখনকার দিনাজপুরের পত্নীতলা থানায়। দিব্বোকের বাড়ি ছিল ধামইর (বদলগাছি) থানায়। এখন এই থানাগুলো নওগাঁ জেলায়। পাল রাজত্ব অনেক দিনের জন্য উধাও হয়ে যায়। এই লড়াইটা বাংলায় গণতন্ত্রের জন্য একটি সফল সংগ্রাম। বিষয়টি খুবই গুরুত্বপুর্ণ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ওয়ারেন হেস্টিংসকে তিন লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে খাজনা আদায়ের জন্য রংপুরের ও দিনাজপুরের ইজারাদারের পদ লাভ করে দেবী সিংহ। তিনি জমিদার সহ সমস্ত মানুষের ওপর বিরাট আক্রমণ নামিয়ে নিয়ে এলে, লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হন। বাংলায় ১১৭৬’এর ভয়াবহ মন্বন্তর, ইংরেজির ১৭৫৯-৬০। সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ হয়। কিন্তু দিনাজপুর - রংপুরের মতো নয়। সারা বাংলায় ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি মানুষ মারা যান। তার বিরুদ্ধে রতিরাম দাস লেখেন “জাগ গান”। জাগ মানে জাগরণ নয়। এটা কামদেবের গান। কামোদ্দীপকের গ্রামীণ উৎসবের জন্য রচিত ও গীত হতো। কিন্তু এক্ষেত্রে রতিরাম দাস এই গান লেখেন, জাগরণের পক্ষে। দেবী সিংহকে বলতো নরপিশাচ। তার বিরুদ্ধে, তথা অত্যাচার ও দুর্ভিক্ষের বিরুদ্ধে জমিদার সহ গণমানুষের বিরোধিতা ও বিরাট লড়াই দিনাজপুর ও রংপুরে গড়ে ওঠে। ব্রিটিশ সরকার অত্যাচার-আক্রমণ ও খুনের মাধ্যমে আন্দোলন শেষ করে দেয়। তবুও ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত ৪০ বছর ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ বহমান ছিল।
১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ। ঢাকার বিদ্রোহীরা দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে, একটা ভাগ দিনাজপুরের ঠাকুরগাঁ এলাকার জনমানুষের সাহায্য নিয়ে কিষানগঞ্জ প্রবেশ করেন। কোম্পানির সৈন্যদের সঙ্গে অনেক লুকোচুরি হয়। তাঁরা ভুটানে গিয়ে সাহায্য পান রাজার কাছ থেকে। তারপর আবার দিনাজপুরের উদয়পুর, মদনমাল, জগদ্দল, কাশিমপুর, নেকমর্দন, রানি শংকাইল ইত্যাদি জায়গার জনমানুষের সাহায্য নিয়ে সহানুভূতি পেয়ে কিষানগঞ্জ হয়ে অযোধ্যার পথে অগ্রসর হন। এভাবে দিনাজপুর সিপাহি বিদ্রোহে একটা ভূমিকা পালন করে। এখানকার জমিদার সহ জনমানুষ বিদ্রোহীদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন।
মূলত দিনাজপুর শহরের কাশীশ্বর চক্রবর্তীর নেতৃত্বে গঙ্গারামপুর থানার বেলবাড়ি (এখন ৩ নং বেলবাড়ি-২) ও শুকদেবপুর হয়ে কুশমণ্ডির দুর্গাপুর পর্যন্ত সাঁওতালদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাঁদের ওপর যে অত্যাচার হতো, জমিদার ও ইউনিয়ন বোর্ডের চৌকিদারি ট্যাক্সের যে জুলুম হতো - তার বিরুদ্ধে বিরাট লড়াই হয়েছিল। সাঁওতালরা কোচ, বল্লম, টাঙ্গি, তির-ধনুক ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী অস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ে নামেন। ১৯৩২ সালে এই লড়াই তীব্র হয়ে ওঠে। ২৭শে জুন লড়াকুদের গ্রেপ্তার করতে এলে বহু সংখ্যক সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষ পুলিশকে ঘেরাও করে রাখে। সেদিন পুলিশ কোনোমতে রক্ষা পায়। কিন্তু ১ জুলাই আবার ওই দুষ্কাণ্ড অন্য এক গ্রামে করতে এলে তীর দিয়ে তিন জন পুলিশকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেন লড়াকুরা। পুলিশের সঙ্গে এই দু’দিনের সংঘর্ষ ঘটে আকচা গ্রামে।
১৯৩৩ সালে হিলি মেইল লুট করা হয়। করেন বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীরা। এই মামলাকে ‘হিলি ষড়যন্ত্র মামলা’ বলা হয়। ১ জন ১৫ বছরের কিশোর (কালী সরকার), ১৭-২০ বছর বয়সের মধ্যে বেশিরভাগ কিশোর-যুবক, ১ জন ২৮ বছরের, আরেকজন ২৯ বছর বয়েসের - মোট ১৩ জন ছিলেন অপারেশনে অংশগ্রহণকারী। এই বিষয়টা উল্লেখের কারণ, তরুণ বয়েসি ছাড়া ঝুঁকি পূর্ণ কাজ করা মুশকিল, তা বোঝাতে।
এঁদের মধ্যে কয়েক জন ও অন্যান্য মামলায় কারাবন্দি বীর বিপ্লবী-সন্ত্রাসবাদীরা কারামুক্ত হবার পর দিনাজপুর নিমতলার একটি ঘরে আলোচনায় বসতে থাকেন। অতঃপর কী করা যায়, এ বিষয় নিয়ে উথালপাথাল চিন্তা করার পর তাঁরা কলকাতায় মুজফ্ফর আহ্মদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তিনি প্রথমে বঙ্কিম মুখার্জিকে পাঠান। তিনি এসে কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রস্তুতি কমিটি গড়ে দেন। বিভূতি গুহ হন সম্পাদক। তার কিছুদিন পরে বিভূতি গুহকে প্রাদেশিক দপ্তরে নিয়ে গেলে সুশীল সেন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। এসব ১৯৩৮ সালেই নিষ্পন্ন হয়। ১৯৩৮’র শেষের দিকে, মতান্তরে ১৯৩৯ সালের প্রথমে জেলা কৃষক সমিতি গঠিত হয় প্রথম সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পরবর্তীকালের এমএলএ রূপনারায়ণ রায়ের নিজ গ্রাম লালপুর ডাঙ্গায়। এসেছিলেন মুজফ্ফর আহ্মদ, বঙ্কিম মুখার্জি প্রমুখ।
(দুই)
দিনাজপুর জেলার ভূ-সীমানার অনেক রূপান্তর হয়েছে। আগে ছিল বিশাল জেলা। দেশভাগের পরে তার থেকে দক্ষিণে কেটে গেল ধামইরহাট, পত্নীতলা, সাফাহার - রাজশাহী জেলায়। আবার ওই তিনটি থানার সঙ্গে, অবিভক্ত মালদহ জেলার যে কয়টি থানাকে নিয়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জ থানা গঠিত হয়েছিল, সেই জেলা থেকে পোরশা থানা এসে যুক্ত হয়ে এবং আরও কয়েকটি থানা নিয়ে হয়েছে নওগাঁ জেলা।
দিনাজপুরের উত্তরের থানাগুলি, যা দেশভাগের পর পাকিস্তানে পড়েছিল, তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল আগের জলপাইগুড়ির তেঁতুলিয়া,পঞ্চগড়, বোদা ও দেবীগঞ্জ। বাংলাদেশ হবার অনেক পরে, সেই দিনাজপুর জেলাকে যখন তিন ভাগ করা হলো, তখন ঠাকুরগাঁ সাব ডিভিশনের আটওয়ারি থানাকে নিয়ে এসে ওই চারটি থানার সঙ্গে যুক্ত করে করা হলো পঞ্চগড় জেলা। দিনাজপুর সদর, পার্বতীপুর, বিরামপুর, বীরগঞ্জ, বিরল, বোচাগঞ্জ, চিরিরবন্দর, ফুলবাড়ি, ঘোড়াঘাট, হাকিমপুর, কাহারোল, খানসামা, নবাবগঞ্জ নিয়ে এখনকার দিনাজপুর জেলা। আর বালিয়াডাঙ্গি, হরিপুর, পীরগঞ্জ, রানিশংকইল ও ঠাকুরগাঁ সদর নিয়ে হয়েছে ঠাকুরগাঁ জেলা।
তা হ’লে দেখা যাচ্ছে একদা বিরাট দিনাজপুর জেলাটা কেমন তছনছ হয়ে গিয়েছে!
দেশভাগের সময়, পাকিস্তানে যাবার পরে হিলির যে অংশটুকু এদিকে থাকল - সেই হিলি, বালুরঘাট, কুমারগঞ্জ, তপন, গঙ্গারামপুর, বংশীহারী, কুশমণ্ডি, ইটাহার, কালিয়াগঞ্জ, হেমতাবাদ ও রায়গঞ্জ থানা নিয়ে তৈরি হলো যে জেলা, তার নাম হলো - পশ্চিম দিনাজপুর। ১৯৫৬ সালে তার সঙ্গে যুক্ত হলো কিষানগঞ্জের ইসলামপুর মহকুমার বর্তমান থানাগুলো। নাম ওই একই থাকল। আবার ১৯৯২ সালের ১লা এপ্রিল থেকে আমরা দুই জেলায় - উত্তর দিনাজপুর আর দক্ষিণ দিনাজপুর নামাঙ্কিত হয়ে বিভক্ত হয়েছি। এদিকে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় বংশীহারী থানা কেটে কয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত ও ইটাহার থানার কয়টি গ্রাম পঞ্চায়েত কেটে নিয়ে এসে তৈরি হলো নতুন হরিরামপুর থানা। আবার হরিরামপুর থানার কয়েকটি গ্রাম পঞ্চায়েত কেটে নিয়ে ছয়ঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত তৈরি করে ইটাহারের সঙ্গে যুক্ত করা হলো।
(তিন)
কৃষকদের ওপর যুগে যুগে হয়েছে অত্যাচার। তবে তার রকমফের হয়েছে। যেমন মোগল যুগে ছিল গ্রাম ভিত্তিক এক একটি সমাজ। শাসক জমির মালিক ছিল না। তারা খাজনা আদায় করতো মণ্ডলদের দ্বারা। ঔরঙজেবের শাসন পতনের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি-যুগের প্রথম দিকেও জমির মালিক কৃষকরা ছিল। কিন্তু জমির খাজনার হার বিপুল ভাবে বাড়িয়ে দিয়ে, তা ইজারাদারদের দ্বারা ভীষণ অত্যাচারের মাধ্যমে আদায় করা হতো। দেবী সিংহের নির্মমতার কাহিনি আমরা আলোচনা করেছি। দুর্ভিক্ষে মানুষ মারা গিয়েছে গ্রামকে গ্রাম, কিন্তু কোম্পানির ইজারাদারের লোক এসে জীবিত মানুষের কাছ থেকে খাজনা আদায় করেছে। কত মানুষ গ্রাম ছাড়া হয়ে পালিয়ে গিয়ে সাময়িকভাবে বেঁচে, আবার না খেতে পেয়ে মারা গিয়েছে।
কিন্তু তবুও কোম্পানি খুশি নয়। আরও খাজনা চাই, আরও। তাই ১৭৯৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত-এর আইন করে সব জমি কোম্পানি নিয়ে নিল। আর কিছু পুরাতন আর বেশিরভাগ নতুন জমিদারকে ঠিকা দিয়ে ঠিক করে দিল, তাদের এতো পরিমাণ খাজনা দিতে হবে। এরকম ব্যবস্থায়, চাষিরা অবাক হয়ে গেল, যখন জানলো এ জমি তার নয়। জমিদারের খাজনা আদায়কারীকে প্রতিরোধ করলো কোথাও কোথাও। হাজার হাজার মামলা রুজু করলো আদালতে। কিন্তু কে শোনে কার কথা!
চাষিদের একেবারে বঞ্চিত করেও খাজনা মনোমতো আদায় হচ্ছে না। তখন ১৮৫৯ নতুন আইন করে চাষিদের কিছু কিছু অধিকার দিলো ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু তা নাম কে ওয়াস্তে।
(চার)
এই অংশের মধ্যে সব থেকে অরক্ষিত ও অবহেলিত প্রজা ছিলেন আধিয়ার বা বর্গাদাররা। গ্রামীণ জনসংখ্যার ৪১ শতাংশ তাঁরা। জমিদার, জোতদার, মধ্যস্বত্বভোগী রায়তদের সঙ্গে মৌখিক লিজে চুক্তিবদ্ধ এক শ্রেণির কৃষক। তাঁদের যখন তখন উচ্ছেদ করা যেত। তার বিরুদ্ধে আইনের কোনো রক্ষাকবচ ছিল না। জমিদার-জোতদার ও নানা নামের মধ্যস্বত্বভোগীরা ফসল তুলতে বাধ্য করতো নিজেদের খইলানে। তাঁদের কাছ থেকে অর্ধেকের বেশি ফসল আদায় করতো। আরও ছিল কত ধরনের আদায়! জমিদারবাবুর নজরানা, বিভিন্ন উৎসবের পার্বণী, খইলান চাঁচার খরচ, পাহাড়াদারি ও মহলদারির খরচের ভাগ ইত্যাদি হরেকরকম নজরানা আর আদায় দিতে দিতে নিঃশেষিত হয়ে যেতেন তাঁরা। তার সঙ্গে ছিল বড়ো অঙ্কের সুদ-যুক্ত দাদনের কারবার।
সরলপ্রাণ প্রখ্যাত কৃষক নেতা বাচ্চা মুন্সি আলাপচারিতায় তখনকার একটা গান শুনিয়েছিলেন এই লেখককে -
“পারুই আর না বহিম আধি হাল
সারা বছর মাইয়া ছাওয়া
সুদ্দায় আবাদ করি
আর সুদায় খাটে মরি
ঢাকি কুলা ধরে আসি বাড়ি
ইলা খালি অধিকা জঞ্জাল।
পারুই আর না বহিম আধি হাল।”
তখনকার জলপাইগুড়ি, দেশভাগ-পরবর্তী এখনকার বাংলাদেশের পঞ্চগড় জেলার বোদা থানা এলাকার আঞ্চলিক উপভাষায় গাওয়া এই গান।
‘পারুই’ মানে জোতদারকে বলা হচ্ছে - আর আধি হাল বইব না। সারাবছর ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে আবাদ করি আর শুধু খেটে মরি। শেষে ধান নয়, শূন্য ঢাকি (ডালি) - কুলা নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। (কারণ, বিভিন্ন দফায় সব ধানই তো দিয়ে আসতে হয়!) আধিয়ারি শুধু মাত্র অতিরিক্ত জঞ্জাল বিশেষ।
তেভাগা বর্গাদারের হকের লড়াই। কেন? বাচ্চা মুন্সি সরল অর্থনৈতিক পরিভাষায় লেখককে নিজের মতো করে বুঝিয়েছিলেন - আধির ক্ষেত্রে জোতের মালিকের শুধু একটা উপাদান, জমি। আর চাষের সরঞ্জাম ও শ্রম - এই দু’টি আধিয়ারের পরিবারের লোকদের। তাই এক উপাদানের মালিক, জোতের মালিক পাবে এক ভাগ। আর দুই উপাদানের মালিক, আধিয়ার পাবে দুই ভাগ।
সিদ্ধান্ত হলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, মন্বন্তর, মজুত উদ্ধার ও মহামারী প্রতিরোধে কমিউনিস্ট পার্টি ও কৃষক সভাকে বিরাট ভূমিকা পালন করতে হয়েছিল। অর্থনৈতিক দুরবস্থা অসহনীয় হয়ে গেলে এবং সাম্যব্রতীদের অনুকূলে রাজনৈতিক অবস্থার ইতিবাচক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা তেভাগা আন্দোলনের ডাক দিল। স্লোগান বেঁধে দেওয়া হলো - নিজ খইলানে ধান তোলো, দু'ভাগ নয় - তে'ভাগ চাই, কর্জা ধানে সুদ নাই। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ - দূর হটো। সাংগঠনিক স্লোগান ঠিক হলো - প্রতি বাড়ি থেকে এক মানুষ, এক টাকা, এক লাঠি দিতে হবে। কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য সম্পাদক ভবানী সেন রংপুরে এসে তিনটি জেলার কমিউনিস্ট ও কৃষক নেতাদের সঙ্গে সভা করে গেলেন। অন্যত্র অন্যান্য নেতারা এভাবে মিটিং করলেন।
শুরু হয়ে গেল, মহান তেভাগার ঐতিহাসিক সংগ্রাম। সে ইতিহাস বিস্তারিত অন্যত্র বলা হয়েছে।
(পাঁচ)
দেশভাগ-পূর্ব বিশাল দিনাজপুর, তার আটোয়ারি, বালিয়াডাঙ্গি, ঠাকুরগাঁ, পীরগঞ্জ, বোচাগঞ্জ, কালিয়াগঞ্জ, ইটাহার, কুশমণ্ডি এবং চিরিরবন্দর, পতিরাম ও সর্বোপরি খাঁপুর (দু’টিই বালুরঘাট থানা)’তে তেভাগা লড়াই সংগঠিত হয়েছিল।
ও বাংলায় যে থানাগুলোতে লড়াই হয়েছে, সেগুলো এখনকার উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থেকে চোপড়া পর্যন্ত বিস্তৃত বর্ডার সন্নিহিত এলাকায়। যেমন বোচাগঞ্জের পাশে কালিয়াগঞ্জ ও হেমতাবাদ থানা, বালিয়াডাঙ্গি ও ঠাকুরগাঁয়ের পাশে ইসলামপুর থানা, আটোয়ারির পাশে চোপড়া থানা। লেখক ওই থানাগুলি (ওপারে বলে উপজেলা)’র তেভাগার রণক্ষেত্রসমূহ চাক্ষুষ দেখার সুবাদে, ওপার থেকে এপারের গ্রামগুলো দেখেছে। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার কুমারগঞ্জের পাশে। বালুরঘাটের পতিরাম ও খাঁপুরের লড়াইয়ের ক্ষেত্রের ওপারে দিনাজপুর জেলার ফুলবাড়ি থানা। সেখানেও অনেকবার যাবার সুযোগ হয়েছে!
বসন্তলাল চ্যাটার্জি।
এপারের ইটাহার, কুশমণ্ডি ও কালিয়াগঞ্জে তেভাগা লড়াইগুলো হয়েছিল বসন্তলাল চ্যাটার্জির পরিচালনায়, যাঁর বাড়ি ইটাহারের মারনাই। ইটাহারের লড়াইয়ের এলাকা পতিরাজ, দুর্লভপুর, দুর্গাপুর ও জয়হাট গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়; কুশমণ্ডির লড়াইয়ের ক্ষেত্র দেউল ও বেরল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়; কালিয়াগঞ্জ থানার লড়াইয়ের এলাকা ভাণ্ডার, মোস্তাফানগর ও বোচাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়।
ইটাহার ভিত্তিক পতিরাজের ও কুশমণ্ডির লড়াইয়ের ইতিহাস কিছুটা জানা হয়েছে আগেই। লেখকের ‘তেভাগার পথ ধরে’ বইতে তার উল্লেখ আছে।
কালো সরকার (মা), বৈশালী সরকার (কন্যা) ও তেভাগা সরকার।
(ছয়)
১৯৯৭ সালে তেভাগার সুবর্ণজয়ন্তী বর্ষে যখন নানারকম কাজে কর্মে ব্যস্ত, তখন কুশমণ্ডির কমরেডরা তেভাগা সরকার নামে একজনের সন্ধান দেন।
কুশমণ্ডি থানার বেরল গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার কচরা গ্রামের ভেরেলি পাড়ায় তেভাগা সরকারের বাড়ি।
ওই বাড়িতে পৌঁছানোর কিছুক্ষণ পরে তিনি ও তাঁর মা কালো সরকার এলেন। কালো সরকারের পরনে বুকনি।
তেভাগার বাবার নাম জয়া সরকার। ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে কি মার্চ মাসের প্রথমে, তেভাগা লড়াইয়ের যে সমস্ত সেনানী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে ছিলেন (দিনাজপুর জেল), তিনি ছিলেন তঁদের অন্যতম। লেখক ও তার সাথিরা ওঁর বাড়িতে যাবার অনেক দিন আগেই তিনি মারা গিয়েছেন।
মা কালো সরকারকে জিজ্ঞেস করা হলো - ছেলের নাম তেভাগা রাখলেন কেন?
মা উত্তর দিলেন - যখন পুলাটুলা ভাঙে তখন এ পেটে। মানে যখন খইলান ভাঙা শুরু হয়, তখন তেভাগা মায়ের পেটে। তারপর এর জন্ম হলো। কিন্তু জোতদার ও পুলিশের মিলিত আক্রমণও নেমে এসেছে। তেভাগা মাস দু’য়েকের হয়ে উঠেছে সে সময়।
মা কালো সরকার বলছেন - মানুষলা, কমরেডলা তখন এদিক ওদিক বেড়ায়। হামরা ইটাহারের সান্ধিয়ার মধ্যে জঙ্গলের মধ্যে কাটাই। তখন মানুষলা কহিল্ল - এর নামটো কী রাখা যায়! সবাই কহিল্লে তেভাগা রাখা যাউক। তখন থাকি তেভাগা নামটো সৃষ্টি থাকিল্ল।
অর্থাৎ ইটাহার তখন লড়াকুদের আত্মগোপন করে থাকবারও ঘাঁটি।
যাই হোক, আবার চলুন ভেরেলি পাড়ায়। ওই গ্রামেই বাড়ি এতদএলাকার অন্যতম নেতা হরি মোহন সরকার ও খোকারাম সরকারের। তেভাগার বাড়ি থেকে বেরিয়ে ওঁদের সঙ্গে দেখা করা হলো। বসন্তলাল চ্যাটার্জি যে আসল নেতা, তা তাঁদের সঙ্গে আলাপচারিতায় আরও স্পষ্ট হলো। খোকারাম সরকারের কথায় - অঁহে সমিতির গুরু। শিক্ষা-সাধন দেওয়ানিয়া, এখানে তোলপাড় করিত - সমিতির কাজ কর। এখানেই থাকিত। ওর নিন ঘিন নাই। কত কষ্ট সহ্য করিহা!
হরিমোহন সরকার।
হরিমোহন সরকারের ভাষায় - অঁহে কিরষক সমিতির মুখপাত্র। তাঁর মুখে ‘মুখপাত্র’ কথাটা শুনে একটু অবাক লাগলো। কারণ, লড়াইয়ের মধ্যবর্তিতায় তাঁরা এ ধরনের শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। খাঁপুরেও শহিদ কমরেড যশোদারানি সরকারের বড়ো পুত্র দেবেন্দ্র নাথ সরকার একজনের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ও তো ‘পঞ্চমবাহিনীর লোক’।
কুশমণ্ডির কমরেডরা ১৯৪৪ সালে দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার রাজ্য সপ্তম সম্মেলনে হাঁটা মিছিলে অংশ নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসলামপুর মহকুমার থানাগুলো তখনও জেলায় যুক্ত হয় নি। বলা বাহুল্য, তাই তাদের বাদ দিয়ে তৎকালীন পশ্চিম দিনাজপুর থেকে ৮০ জন লড়াকু ওই মিছিলে ছিলেন।
এই গ্রাম থেকে ফুলবাড়ির দূরত্ব কমপক্ষে ৮০ কিলোমিটার।
এতো কথা বলা হলো, বসন্তলাল চ্যাটার্জির সংগ্রামী জীবনের কিছুটা পরিচয় দেবার জন্য। আর ইটাহার ও কুশমণ্ডি যে একাকার হয়ে, তেভাগার প্রস্তুতি পর্ব থেকে লড়াইয়ের পর্ব পর্যন্ত ও তারপরেও অনেক দিন, যেন আদতে একটা থানারই অংশ হয়ে গিয়েছিল, সেটা জানানোর জন্য।
ওই সব গ্রামে জঙ্গি কৃষক সমিতি গড়ে উঠেছিল গত শতাব্দীর চারের দশকের প্রারম্ভ থেকেই। বসন্তলাল চ্যাটার্জির অনুরোধে পতিরাম-খাঁপুর এলাকা থেকে পায়ে হাঁটা মিছিল রওয়ানা দিয়ে পথিমধ্যে কুশমণ্ডি, কালিয়াগঞ্জের সঙ্গীদের নিয়ে ১৯৪২-এর ৯ই আগস্ট রায়গঞ্জের পাশে সুদর্শন নগরে এসে উপস্থিত হয় সন্ধ্যাবেলায়। পরদিন বিকালে স্নেহলতা ইনস্টিটিউশনের সামনের মাঠে অনুষ্ঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টির জনসভা। এখানে বলার, দিনাজপুর শহরের উত্তরে তখন পতিরাম ভিত্তিক পার্টির একমাত্র লোকাল কমিটি। সেই লোকাল কমিটির দ্বারা এই সমস্ত এলাকার কাজকর্ম পরিচালিত হতো। ইটাহারের কণ্ঠমণি বর্মণি নামে এক নেত্রী সেই লোকাল কমিটির মেম্বার ছিলেন। তিনি একদিন মিটিংয়ে প্রশ্ন তোলেন - গোরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি - এসব থেকে যে সামান্য আয় হয়, তার মালিকানা কেন বাড়ির বৌয়ের হবে না! রায়, বলা বাহুল্য তাঁর পক্ষেই যায়।
(সাত)
শুধু আত্মগোপন করার ঘাঁটি কী হতে পারে ইটাহার! যেখানে বসন্তলাল চ্যাটার্জি আছেন! একটু আগেই বলা হয়েছে, ইটাহারের কোন কোন এলাকায় তেভাগা লড়াই সংঘটিত হয়েছিল। সেসব মূলত রাজবংশী ও আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম।
এসব বিষয়ে বিস্তারিত না জানাতে পারাটা লেখকের কাছে অন্যায় বিশেষ। বিশেষকরে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সে ১৯৮৪ থেকে ১৯৯২ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ইটাহারের দায়িত্ব পালন করেছে। এই ত্রুটির কথা সে অকপটে স্বীকার করছে।
অন্তত তেভাগার সুবর্ণ জয়ন্তীবর্ষের আগে এসব জায়গায় তার যাওয়া উচিত ছিল।
এই নিবন্ধ লেখার আগে তাই ইটাহারেরর প্রাক্তন বিধায়ক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য নেতা, বামফ্রন্ট সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী, সাথি শ্রীকুমার মুখার্জির শরণ নিয়ে যা জানা গেল, তাই লেখা হয়েছে। তাঁর কাছে অনেক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে লেখক।
শুধু কুশমণ্ডির কমরেডদের নয়, স্বয়ং বসন্তলাল চ্যাটার্জিকেও আত্মগোপন করে থাকতে হতো। এবং সেটাই স্বাভাবিক।
সান্ধিয়ার পাশে নুড়িরহাট। গ্রাম পঞ্চায়েত ওই পতিরাজ। সেখানে মুকুল সরকারদের বাড়িতে এক সময় এভাবে আছেন, একদিন খবর পাওয়া গেল, তাঁকে গ্রেপ্তার করতে পুলিশবাহিনী আসছে।
সঙ্গে সঙ্গে কমরেডরা বুদ্ধি করে ফেললেন। আদিবাসী কমরেডরা তাঁকে একটা বাঁশের সঙ্গে পাটি (খেজুর পাতা চিড়ে তৈরি করা এক ধরনের মাদুর)’তে আপাদমস্তক ঢেকে বেঁধে ধ্বনি দিতে দিতে নিয়ে গেলেন শ্মশানের দিকে। এই চালাকি পুলিশ ধরে, তার সাধ্য কী!
অন্য একদিনও ওইগ্রামেই পুলিশ আসছে খবর হলো। তখন ওই পাড়ায় চলছে হরি সংকীর্তনের আসর। সেখানে মাথায় পাগড়ি বেঁধে ভক্ত সেজে বসে যেন কত নিমগ্ন হয়ে সংকীর্তন শুনছেন বসন্তলাল চ্যাটার্জি! কিন্তু সেদিন পুলিশের সঙ্গে তাদের সোর্স বিমল আচার্যও এসেছে। সে বিপ্লবীদের ব্যাপারে সন্ধান দেবার জন্য প্রতি খবর পিছু সে সময়ের এক টাকা করে পেতো। বুঝবেন, তখন এক টাকার মূল্য কিন্তু কম নয়! তার সঙ্গে নিজে জোতদার হবার কারণে, কৃষক সমিতির ওপরও তার ছিল প্রবল শ্রেণি ঘৃণা। সে কীর্তনের আসরে বসন্তবাবুকে চিহ্নিত করে ধরিয়ে দিল। তাঁকে ধরে খুব নৃশংসভাবে, একটা ঘোড়ার পেছনে বেঁধে ছেঁচড়াতে ছেঁচড়াতে থানায় নিয়ে গেল পুলিশ বাহিনী।
এই সব এলাকার অন্যতম নেতা ছিলেন পাশের দুর্লভপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের নন্দনগ্রামের চাপাতু দেবশর্মা। তিনি পতিরাজ, দুর্লভপুর, দু্র্গাপুর ও সুরুন গ্রাম পঞ্চায়েতের যেখানে যেখানে লড়াই হয়েছিল, সে সবের সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
দুর্গাপুরের জঙ্গি কর্মী ছিলেন বুধরাই সরেন, চিয়ার উদ্দিন শেখ। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হতেন চাপাতু দেবশর্মা। তাঁদের নেতৃত্বে দুর্গাপুরের জমিদারের সুরুন গ্রাম পঞ্চায়েতের অবৈধ জমি উদ্ধার করে বিলিবণ্টন করে দেওয়া হয়। এখনও প্রাপকদের দখলে আছে সে জমি। যুক্তফ্রন্ট ও বামফ্রন্ট সরকার এলে এ জমি খণ্ডগুলির পাট্টা সহ নানারকম সুরক্ষা দেওয়া হয়।
ওদিকে দক্ষিণে জয়হাট গ্রাম পঞ্চায়েতের নেতা ছিলেন কানু মার্ডি। তাঁর বাড়ি ছিল দিঘিশাল। ওই গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রায় সব গ্রাম সাঁওতাল অধ্যুষিত। সহজ সরল জেদি সাহসী মানুষ। আগেই বলা হয়েছে, শিরশি গ্রাম পঞ্চায়েতের যে গ্রামগুলো নিয়ে ছয়ঘরা গ্রাম পঞ্চায়েত তৈরি হয়, তাও সাঁওতাল অধ্যুষিত। পাশাপাশি। এই সব এলাকায়, বিশেষ করে জয়হাট গ্রাম পঞ্চায়েতের এলাকাগুলিতে বড়ো বড়ো লড়াই গড়ে উঠেছিল এবং দীর্ঘদিন তার পরম্পরা বজায় ছিল।
লড়াইয়ের এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে কানু মার্ডির একটা চোখে পুলিশের গুলির স্প্লিন্টার ঢুকে গিয়ে চোখটি নষ্ট হয়ে যায়। শ্রীকুমারবাবু কলকাতায় নিয়ে গিয়ে তাঁর চিকিৎসা করান। কিন্তু তা আর উদ্ধার হয় না। আরেকটা চোখও ধীরে ধীরে খারাপ হয়ে যায়।
এখানে বলার, খাঁপুরের হত্যাকাণ্ড (২০শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭)-এর পরে ইটাহারের উল্লিখিত এলাকায় তেভাগা ও সংশ্লিষ্ট লড়াই শুরু হয় এবং কয়েক বছর ধরে তা চলতে থাকে। এ ক্ষেত্রেও ইটাহারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আমাদের লক্ষ্য করতে হবে।
(আট)
কালিয়াগঞ্জের বরুণা গ্রাম পঞ্চায়েতের মঙ্গলদহ গ্রামের মুলিয়া দেশি, দক্ষিণ গোবিন্দপুর গ্রামের ভজু টুডু, মোস্তাফানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের ভেউর গ্রামের বুড়িয়া দেব শর্মা ও শিবপুর গ্রামের মদন দেব দেব বর্মন - এঁরা ছিলেন সাহসী ত্যাগী সংগ্রামী গ্রামীণ নেতা। এই এলাকাগুলোতে নেতৃত্ব দিতে আসতেন দিনাজপুর থেকে জনার্দন ভট্টাচার্য। অকৃতদার এই মানুষটি দেশভাগের পরে স্থায়ীভাবে প্রথমে রাধিকাপুর ও পরে জীবনের বেশিরভাগ সময় অনন্তপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের মুদাফত গ্রামের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হয়ে জীবন সায়াহ্ন পর্যন্ত কাটিয়ে যান।
আগেই বলা হয়েছে, কালিয়াগঞ্জের রণক্ষেত্রগুলিরও নিয়মিত পরিচর্যা করতেন বসন্তলাল চ্যাটার্জি।
কালিয়াগঞ্জের ভাণ্ডার গ্রাম পঞ্চায়েতের বাঘন গ্রামের সতীশ চৌধুরী, বোচাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের তরঙ্গেপুরের সতীশ ঘোষ, মোস্তাফানগর গ্রাম পঞ্চায়েতের নীলকণ্ঠ রায় - এরা ছিল বড়ো বড়ো জোতদার। এদের জমিতে তেভাগা করা হয়েছিল। নীলকণ্ঠের খইলান বা ধানের পুজ ভাঙার সময় জোতদার পক্ষ গুলি করে। লড়াকু জনা দশেক আদিবাসী কমরেড আহত হন। এই পঞ্চায়েতগুলি প্রায় পাশাপাশি অবস্থিত বলা যায়।
পাঠক সমীপে স্বীকারোক্তি করছে লেখক, কালিয়াগঞ্জের তেভাগা লড়াইয়ের কথা আজ যেটুকু তুলে ধরা হলো, তা অতি অল্প। এটা লেখকের সীমাবদ্ধতা। আগামীদিনে আরও বিস্তারিতভাবে এই সমস্ত অঞ্চলের তেভাগার লড়াইয়ের ইতিবৃত্ত তুলে ধরার বাসনা রইলো। ১৯৫৮ সালে খাদ্য আন্দোলনের প্রথম শহিদ বাতাসন কৈপুকুর গ্রামের রাঁধুনি হেমব্রম বা কানু ঘোষের নেতৃত্বে কালিয়াগঞ্জ স্টেশনের চাল ভরতি মালগাড়ির বগি ভেঙে চাল উদ্ধার করে বণ্টন করার কাহিনি এইসব অঞ্চলে বিখ্যাত হয়ে আছে।
তথ্য সহায়তাঃ
১। অসমাপ্ত বিপ্লব অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা - নরহরি কবিরা
২। দিনাজপুর (১৭৫৭-১৯৪৪) - ইন্দ্রজিৎ চক্রবর্তী, শুভাশীষ গুপ্ত
৩। তেভাগার পথ ধরে - মানবেশ চৌধুরী