৬০ বর্ষ ২ সংখ্যা / ১৯ আগস্ট, ২০২২ / ২ ভাদ্র, ১৪২৯
ভারতীয় গণনাট্য সংঘ, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ষোড়শ সম্মেলনের প্রাক্কালে
সংস্কৃতি আন্দোলন গণআন্দোলনের পরিপূরক - একি কথার কথা?
হিরণ্ময় ঘোষাল
প্রায় আট দশক পেরিয়ে এক যুগসন্ধিক্ষণে ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘ, পশ্চিমবঙ্গ। কলকাতার মোহিত মৈত্র মঞ্চে আগামী ১ থেকে ৩ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হতে চলেছে সংগঠনের রাজ্য ষোড়শ সম্মেলন। ২০২২ সালের প্রেক্ষাপটে আসন্ন রাজ্য সম্মেলনের মুখে দাঁড়িয়ে এই সময়ের সংকট, তার দাবি এবং চাহিদার প্রসঙ্গকে খতিয়ে দেখা জরুরি। গণনাট্য আন্দোলন এবং সংগঠন গড়ে ওঠার কালের সঙ্গে চলতি সময়ের অনেকগুলি সাধারণ মিল যেমন পাওয়া যাচ্ছে, তেমনই চোখে পড়ছে অমিলেরও নানাদিক। ইতিহাসের নিয়ম মেনেই সংকটের বিশ্বজোড়া ছবির অনেকটাই আমাদের চেনা আবার অনেকটাই অচেনা। তখনও একটা দশক-পুরনো মন্দার গ্রাসে হাঁসফাঁস করছিল বিশ্ব ব্যবস্থার সিংহভাগ, আর সেই মন্দার জেরে ঘনীভূত অর্থনৈতিক সংকটকে অন্যতম হাতিয়ার করেই জন্ম হয়েছিল ফ্যাসিবাদের। তখন আমাদের দেশে তৈরি হয়েছিল দুর্ভিক্ষ, নেমে এসেছিল দাঙ্গার ভয়ঙ্কর আবহ। এই পর্বে ২০০৮ সাল থেকে পৃথিবী জুড়েই চলছে অর্থনৈতিক মন্দাজনিত সংকট। সংকটের কারণগুলি থেকে নজর ঘোরাতে আজও একই ছকে তৈরি হয়েছে জাতি ধর্ম বর্ণের ভিন্নতার ভিত্তিতে নানাভাবে মানুষকে বিভাজিত করার প্রকরণ। কিন্তু সেই সময় ভারতবর্ষ ছিল ব্রিটিশের উপনিবেশ। বিদেশি শাসক তখন ভারতবর্ষকে শাসন করেছে, শোষণ করেছে। আর এখন আমাদের দেশে জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার নানারকম প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে তার কথা রাখেনি। শুধু তাই নয়, এখন গণতন্ত্রের আবরণটুকুর রাখা আছে, আড়ালে তারা মানুষকে চূড়ান্ত রকমভাবে শোষণ করা এবং কর্পোরেট পুঁজিকে আরো ফুলিয়ে তোলার ক্ষেত্রে যা যা করণীয় সেগুলো করছে।
কিন্তু এই সরকার কোনও বিদেশি প্রভু নয়, দেশের একটি রাজনৈতিক দল যার পেছনে আরএসএস রয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদের জনসমর্থনও রয়েছে। আজকের আন্দোলন অনেক কঠিন। সেদিন স্বাধীনতা আন্দোলনের আবেগ ছিল মানুষের মনে। সমস্ত ক্ষেত্রেই ব্রিটিশ-বিরুদ্ধতার প্রশ্নে তাদের কার্যত কোনো ভেদাভেদ ছিল না। তাদের মধ্যে মতের বিরোধ ছিল, নানা রকম ধারণা নিয়ে মানুষ চলতো বটে, কিন্তু একটি প্রশ্নে তাদের সাধারণ ঐক্য ছিল সেটা হচ্ছে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতার আবেগ সকলকে একটা মঞ্চে জড়ো করতে পেরেছিল। এমনকী সক্রিয়ভাবে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও প্রায় সবাই এর সমর্থক ছিলেন। আজকের দিনে কিন্তু পরিস্থিতিটা অনেকটাই ভিন্ন।
এখন মানুষ নানা পরস্পরবিরোধী মতের রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় রয়েছে। খেটে খাওয়া মানুষ শ্রেণিগতভাবে ঐক্যের উপলব্ধিতে পৌঁছাতে না পেরে ভুল বুঝে, কখনো সামান্য কিছু পাওয়ার আশায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলে শামিল হয়ে যাচ্ছে।
সেদিনের মিডিয়ার ভূমিকার সঙ্গে আজকের মিডিয়ার গুণগত তফাত ঘটে গেছে। যুগান্তর আনন্দবাজার ইত্যাদি সেই সময়কার যে সমস্ত সংবাদপত্র সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থরক্ষায় গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে। আজকের দিনে যখন ক্রমশ ক্রমশ ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে গিয়ে বিজেপি-আরএসএস সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মুঠোর মধ্যে রাখতে চাইছে, তেমনই সিংহভাগ মিডিয়া তার পরিপূরক ভূমিকা পালন করছে। করপোরেট পুঁজি তাদের মালিকানা নিয়ে নিয়েছে। পুঁজি পরিচালিত এই মিডিয়া তাই এখন আর মানুষের পক্ষে কথা বলে না, মানুষের আন্দোলনকে আড়াল করে। মানুষের আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি করতে চায়, মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করতে চায়। মানুষের দুর্দশাকেই ‘বিকাশ’ ‘উন্নয়ন’ বলে হাজির করতে চায়। কারণ আন্দোলন থেকে মানুষকে যতটা সম্ভব দূরে সরিয়ে রেখে মুনাফাই তার একমাত্র লক্ষ্য। তাই লুটেরা পুঁজিবাদ উৎপাদন বৃদ্ধি মানুষের চাহিদার দিকে লক্ষ্য রেখে নয়, কেবলমাত্র পুজির জোগান বাড়াতে। তাই আজ আক্রান্ত চিন্তার জগত। তাই আন্দোলন থেকে, রাজনীতি থেকে সংস্কৃতি থেকে মানুষকে দূরে সরাতে নানা বিষয়ের মধ্যে মশগুল করে রাখার জন্য শুধুমাত্র বিনোদন সর্বস্ব বিভিন্ন কর্মসূচি, অনুষ্ঠান ইত্যাদির মধ্যে মাতিয়ে রাখার চেষ্টা। নানাভাবে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া, বিপথগামী করে দেওয়া সহ বিরাজনীতিকরণের লক্ষ্যে প্রতি মুহূর্তে সক্রিয় উদ্যোগে চালিয়ে যাচ্ছে মিডিয়া। তাই আন্দোলনের খবর বেশিরভাগ পৌঁছায় না মানুষের কাছে। আবার যে খবর পৌঁছায় তা কখনও মিথ্যা বা অর্ধসত্য, কখনও বিকৃত বা লঘুকৃত! তাঁরা জানতেও পারেন না বিকল্প ভাবনার কথা।
১৯৪৩ সালে গণনাট্য আন্দোলনের শুরুর সময় তাদের গান নাটকে তারা নতুন আঙ্গিক নিয়ে এসেছিল মানুষের কথা বলতে। এককথায়, ‘পিপলস্ থিয়েটার স্টারস্ দ্য পিপল’ মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে কথা বলা, মানুষের পক্ষে দাঁড়িয়ে আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গে থাকা এটাই সময়ের প্রয়োজনে সে সময় গড়ে ওঠা সংস্কৃতির খতিয়ান। স্বাধীনতা আন্দোলনের পাশাপাশি বাংলায় মুক্তির গানের যে পরম্পরা তারই উত্তরণ ঘটেছিল গণনাট্যের গানে নাটকে এক নতুন মাত্রায়। তাই নাটকের ভাষা, গানের ভাষায় বিপ্লব ঘটেছিল, প্লাবন আসে সৃষ্টির ঢেউয়ে। অজস্র মানুষ অজস্র গীতিকার-সুরকার, (তখন এত গীতিকার সুরকার আলাদা ছিল না সংগীত নির্মাতা বলা যায়) গোটা বাংলায় একটা আলোড়ন সৃষ্টি করে ফেলেছিলেন।
আজকের দিনে লড়াই আন্দোলনও রয়েছে, গণনাট্যও রয়েছে কিন্তু পরিস্থিতির প্রতিকূলতা যেখানে এসে দাঁড়িয়েছে, সেখানে গণনাট্যের গান নাটক নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানো কঠিনতর হয়েছে। তাই আজ মানুষের কাছে আমাদের কথাকে পৌঁছে দিতে খুঁজতে হচ্ছে নতুন পরিসর। আমাদের সম্মেলনের আলোচনায় উঠে আসবে সেই পরিসর খোঁজার দিশা। সেই পরিসরের মধ্যে অতি অবশ্যই সোশ্যাল মিডিয়া, যা মুহূর্তের মধ্যে বক্তব্যকে দুনিয়াজুড়ে ছড়িয়ে দিতে পারে, তাকে আরও পরিণত এবং ইতিবাচকভাবে ব্যবহারের প্রশ্ন আসবে। গণনাট্য ইতিমধ্যেই সে কাজ শুরু করেছে অতিমারীর পরিস্থিতিতে। অনলাইনে গান, আলোচনা সভা, শর্ট ফিল্ম, ডকু ফিল্ম তৈরি করার মধ্যদিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছানোর সমস্ত রাস্তাকে খুলে দিতে চেয়েছে। এটা ঠিক, এ ব্যাপারে আমাদের সীমাবদ্ধতা আছে, অভিজ্ঞতার অভাব আছে, তবে দ্রুত এই মাধ্যমকে আরও বেশি বেশি করে সাফল্যের সাথে ব্যবহার করার পথ অনুসন্ধান করে আমাদের সেই কাজে অবিলম্বে হাত দিতে হবে। তার মানে এটা নয় যে সামাজিক মাধ্যমের যত ক্ষমতাই থাকুক না কেন, আমাদের শিল্প সম্ভার নিয়ে মানুষের সঙ্গে সরাসরি সংযোগকে বাদ দিয়ে আমরা চলতে পারব। দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে ব্যবহার করতে হবে।
গণনাট্য সংঘের গান নাটক মানে একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের গান বা নাটক - সেভাবেই মানুষের কাছে তা পরিচিত হয়েছে। এটা ঠিক জন্মলগ্ন থেকে কখনো তার উদ্দেশ্যকে গোপন করেনি গণনাট্য সংঘ। সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদ, সামন্তবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং সারা পৃথিবীর মানুষের মুক্তি সংগ্রামের পাশে গণনাট্য সংঘ তার নাটক গান চেতনা নিয়ে থাকবে - এই ঘোষণা আমরা জন্মলগ্ন থেকেই করেছি।
কিন্তু গণনাট্য সংঘের কাজটা শুধু যদি এটাই হয় যে তারা শুধু রাজনৈতিক কিছু কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে তাহলে সেটা হবে আর একটা ভুল। তার কারণ হচ্ছে যে, গণআন্দোলনের ময়দানে সরাসরি উপস্থিত থাকে সমগ্র জনসংখ্যার একটা ক্ষুদ্র অংশ। তার বাইরে প্রচুর মানুষ থাকেন যাঁরা আমাদের পক্ষেই থাকুন আর বিপক্ষেই থাকুন, তাদের সঙ্গে কখনোই আমাদের উভমুখী সংযোগ গড়ে উঠছে না। সেই কারণে গণআন্দোলনের পাশে গণনাট্য আন্দোলনের ভূমিকা বহাল রেখেও আমাদের কাজের পরিধিকে আরও অনেক বাড়িয়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে সরাসরি আন্দোলনের ময়দানের বাইরে যারা আছেন তাদের কাছে আমরা পৌঁছাতে পারি। তার কারণ শিল্প সৃষ্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের মনে স্বপ্ন জাগানো। আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত মানুষকে উদ্দীপ্ত করাটা যেমন আমাদের কাজ, তেমনি যারা ময়দানে নেই তাদের সামনে এই সমাজের কুৎসিত বীভৎসতা তুলে ধরা দরকার। মুক্তির আলো দেখানোর কাজটা যদি আমরা আমাদের নাটক গানে না করতে পারি তাহলে আমাদের কাজের অধিকাংশটাই অধরা থাকবে। কারণ মানুষকে নিশ্চিত ভোরের স্বপ্ন দেখানোই আমাদের কাজ।
এখন মানুষের কাজ এবং বিশ্রামের সময়টুকু বাদ দিলে বাকি সময়টুকু আক্রান্ত। অফিসে গিয়েই হোক বা ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’ হোক, মানুষকে ৮ ঘণ্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। মে দিবসের আন্দোলন আবার নতুন করে শুরু করতে হবে কিনা সেটা ভাবার সময় এসেছে। যে অবসরটাকে ওরা গিলে খেতে চাইছে চিন্তায় বশংবদ করার জন্য সেই অবসরের সময়ে তার ভাবনার জগতে আমরা অনুপস্থিত। বলা যেতে পারে বিভিন্ন মাধ্যমে পারিবারিক ও কূটকচালি নির্ভর অনুষ্ঠান থেকেই মানুষ তার বিনোদন খুঁজে নেওয়ার চেষ্টা করছে। শক্তিশালী মিডিয়ার করায়ত্তে থাকা ওই জায়গায় পৌঁছানোটা খুব কঠিন। কিন্তু না পৌঁছে আমাদের কোনো উপায় নেই। এই জায়গাটায় আমাদের যেতে হবে সাংস্কৃতিক অভিযানের মধ্যদিয়ে। গণ-আন্দোলনের শক্তি এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের শক্তি উভয়ে একত্রে যদি কাজটা না করতে পারে তাহলে শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পক্ষে এ কাজ করা সম্ভব না।
যে সমস্ত মানুষ শ্রেণিগতভাবে আমার পক্ষে অথচ ভুল বুঝে বা অন্য কোনো কারণে আমার সঙ্গে নেই তাদের মন জয় করাটা অন্যতম কাজ। শুধুমাত্র আন্দোলনের কথা পৌঁছে দেওয়া নয়, ভ্রান্ত অবৈজ্ঞানিক ধারণা, কুসংস্কার, সাম্প্রদায়িক ভেদ ভাবনা এগুলো দূর করতে তাদের কাছে যদি পৌঁছাতে না পারি তাহলে আমাদের পক্ষে নিয়ে আসার কাজটা দুরূহ হয়ে যাবে।
তাই আজকে সংস্কৃতি আন্দোলন গণ আন্দোলন এবং শ্রেণি আন্দোলনের পরিপূরক - এটা কথার কথা হয়ে থাকলে হবে না, তাকে বাস্তবায়িত করতে হবে যাতে গণআন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলন পাশাপাশি চলতে পারে সমান শক্তি নিয়ে। আন্দোলনের অভিমুখ যেহেতু নিম্ন কোটির দিকে, তাই পরস্পরের সহায়তায় আমাদের তাদের কাছে পৌঁছে যাওয়া এবং শ্রেণিগতভাবে তাদের জয় করে নিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। এই কাজটা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যেমন হবে তেমনি তাদের মনের বিকাশ ঘটানোর জন্য আমাদের উপাদান জুগিয়ে যেতে হবে।
আজকে যে সরকার দেশে রাজত্ব করছে তারা তাদের অ্যাজেন্ডা অনুযায়ী ভারতের সংবিধান মানে না। ভারতের ইতিহাস বহুত্ববাদের ইতিহাস। বহু জাতি, বহু বর্ণ, বহু ভাষার মিলনের মধ্যেই ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে খুজে পাওয়া যায়। ভারতীয় সংবিধানেও তো তারই স্পষ্ট প্রতিফলন। সহনশীলতা ভারতীয় সমাজের ঐতিহ্য। সে সবকিছুকে সহ্য করতে পারে ধারণ করতে পারে। আর যা ধারণ করতে পারে সেটাই তো ধর্ম। এটাই ভারতের ধর্ম। এই জায়গাটাকে এরা আঘাত করতে চাইছে। ধর্ম দাঙ্গা বাঁধায় না, দাঙ্গা বাঁধায় শ্রেণিস্বার্থের রাজনীতি। সাম্প্রদায়িকতার মধ্য দিয়ে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা হয়। মানুষ অজ্ঞানতাবশত এর মাঝে পড়ে বিভাজিত হয়ে যায়, সমর্থক হয়ে পড়ে। হিন্দু রাষ্ট্রের নাম করে এরা দেশটাকে ব্রাহ্মণ্যবাদের বর্ণ হিন্দু ভাবনার কাঠামোর ভিত্তিতে পিছিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সমন্বয়ী ভারতের ধারণাটিকে ধ্বংস করতে চাইছে। শুধু হিন্দুরাই এখানে থাকবে মুসলিম সহ খ্রিস্টান ও বাকিরা দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে থাকবে এটা করার চেষ্টা হচ্ছে। আমাদের লড়াই এর বিরুদ্ধেও, কারণ লড়াইটা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের।
এই দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা এবং পুঁজিকে কেন্দ্রীভূত করা হচ্ছে সরকারের এই দুই অ্যাজেন্ডা। তাই সরকার কর্পোরেটদের চালাচ্ছে, না কর্পোরেটরা সরকারকে চালাচ্ছে - সেই প্রশ্নটাকে সামনে আনতে হবে। একটু ভাবলেই বোঝা যায়, সরকার কর্পোরেটের মুনাফা ছাড়া কিছু ভাবছে না, আর কর্পোরেট সরকারে কে আসবে থাকবে সেটা নির্ধারণের ভূমিকা পালন করছে। কর্পোরেট তাদের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক দলকে পরিচালিত করে। কিন্তু বামপন্থীদের পরিচালিত করতে পারে না। কমিউনিস্টরা - যারা মানুষের প্রকৃত মুক্তি চায় তাদের এরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলেই আজ তাদের বিরুদ্ধেই সমস্ত আক্রমণ কেন্দ্রীভূত। স্বাভাবিকভাবেই সেই আক্রমণের শিকার গণনাট্য সংঘও হয়ে পড়ে।
বিগত ২০১৭ সালের সম্মেলনে আমরা ‘আরও নতুন বন্ধু হোক’ এই আহ্বানকে সামনে রেখেছিলাম। কিন্তু সে কাজে আমরা খুব একটা সফল হয়েছি তা নয়। এক্ষেত্রে আমাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। যদিও আমরা জানি এমন অনেক শিল্পী বা নাট্যদল রয়েছে যারা গণনাট্য সংঘের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্পর্কের ভিত্তিতে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেন, বিভিন্ন কর্মসূচিতে তারা সাড়া দেন। গণনাট্য সংঘের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ আরো দৃঢ় ও নিবিড় করতে ভাবনাচিন্তা শুরু হয়েছে। আমাদের ঘোষণাপত্রে কিছু পরিবর্তনের প্রস্তাব এসেছে, যা নিয়ে সম্মেলনে আলোচনা হবে। গণনাট্য সংঘের যারা সদস্য, যারা সংগঠনের নিয়ম-কানুন মেনে চলতে দায়বদ্ধ তারা ছাড়াও মতাদর্শের ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রশ্নে বিরোধিতা নেই - এমন যারা আশেপাশে আছেন তাদের এক ধরনের সদস্যপদ দেওয়ার প্রস্তাব রাখা হচ্ছে। সম্মেলন থেকে সিদ্ধান্ত হয়ে গেলে (তারা যেমন কাজ করছেন করুন) কিন্তু তাদের জন্য দরজাটা খোলা রাখা যাবে।
পরিশেষে বলতে চাই, এত কিছু প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও আমরা হতাশ নই, উদ্বিগ্ন। যে আক্রমণ নেমে এসেছে, বস্তুজগতের এবং সমাজ বিজ্ঞানের নিয়ম মেনেই তার পালটা প্রতিক্রিয়া হবেই। তাই যাদের মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছিল তারা কিন্তু এখন মুখ খুলছেন। প্রতিবাদ যত তীব্র হচ্ছে অত্যাচার তীব্রতর হচ্ছে, তবু আন্দোলন ঢেউ উঠছে। আমরা জানি শেষ লড়াইয়ে মানুষ জয়যুক্ত হবেন। পুঁজিবাদের ধ্বংসের কারণ তার গর্ভেই নিহিত রয়েছে। গণআন্দোলন এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে তীব্র করে এই অনিবার্য পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করতে হবে। গণনাট্য সংঘ এ কাজে তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যথাসাধ্য হাতিয়ার নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে।