E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭

পুলিশি বর্বরতা‌য় মৃত্যু যুবকর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার

প্রতিবাদ বিক্ষোভে উত্তাল রাজ্য


এসএফআই-ডিওয়াইএফআই রাজ্য দপ্তরের সামনে শহিদ কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃতদেহ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ পুলি‍‌শের লাঠির আঘাতে ডিওয়াইএফআই কর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর ঘটনায় রাজ্যজু‍ড়েই প্রতিবাদের ঝড় উঠেছে। স্বৈরাচারী তৃণমূল সরকারের পুলিশের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে উত্তরবঙ্গ থেকে দক্ষিণবঙ্গ - সর্বত্র ধিক্কার মিছিল, প্রতিবাদ সভা, পথ অবরোধ, থানা ঘেরাও ইত্যাদির মধ্য দিয়ে প্রতিবা‍‌দে সোচ্চার হয়েছেন মানুষ। ছাত্র-যুবদের পাশাপাশি এ‍‌ই প্রতিবাদে শামিল হয়েছে মহিলা, শ্রমিক, কর্মচারীসহ সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ।

রাজ্যের বাম ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেছেন, রাজ্যজুড়ে উত্তাল গণআন্দোলনের পথেই কমরেড মইদুলের হত্যার বদলা নেবেন ছাত্র-যুবরা। ১০টি বাম ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ১৬ ফেব্রু‌য়ারি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সস্তার হাততালি কুড়োতে ঘোষণা করেছেন, সরকার নাকি মইদুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াবে। আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, পুলিশ মইদুলকে ঠান্ডা মাথায় লাঠি দিয়ে পিটিয়ে খুন করেছে। পুরোটাই হয়েছে পুলিশ মন্ত্রীর নির্দেশে। সরকারি ক্ষতিপূরণ শোকগ্রস্ত পরিবারটির প্রাপ্য। তাই মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছের উপর নির্ভরশীল নয়, সরকারকে মইদুলের পরিবারের পাশে দাঁড়াতেই হবে।

ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সায়নদীপ মিত্র বলেছেন, যে চাকরির দাবিতে মইদুল আন্দোলনে নেমে মিছিলে হেঁটেছিলেন, আগামীতে বাম এবং ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলির জোট সরকার ক্ষ‌মতায় এলে মইদুলের সেই স্বপ্ন পূরণ করা হবে। ছাত্র-যুব নেতৃবৃন্দ দোষী পুলিশ অফিসারদের শাস্তির দাবিও সোচ্চারে তুলে ধরেছেন।

১১ ফেব্রুয়ারি এসএফআই-ডিওয়াইএফআই সহ রাজ্যের দশটি ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে সকলের জন্য শিক্ষা, সব বেকারের চাকরির দাবিতে নবান্ন অভিযানে অংশ নিতে আরও অনেকের সঙ্গে এসেছিলেন বাঁকুড়ার কোতুলপুরের গরিব যুবক মইদুল ইসলাম মিদ্যা। সেদিন এস এন ব্যানার্জি রোড চারপাশ থেকে অবরুদ্ধ করে জালিয়ানওয়ালাবাগের ধাঁচে মমতা ব্যানার্জি সরকারের পুলিশ বর্বর আক্রমণ নামিয়ে এনেছিল আন্দোলনকারীদের উপর। নির্বিচারে লাঠি, টিয়ার গ্যাস, জলকামান ইত্যাদির মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার জঘন্যতম নিদর্শন তৈরি করেছিল পুলিশ প্রশাসন। পুলিশের হিংস্র আক্রমণে মারাত্মক জখম হয়ে বেশ কিছুক্ষণ রাস্তায় পড়েছিলেন মইদুল। তাঁর মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল করুণ আর্তনাদ - ‘আমি আর বাঁচবুনি’। মারাত্মক জখম হওয়া সত্ত্বেও সেদিন পুলিশ ন্যূনতম মানবিকতার দায়ে তাঁর প্রাথমিক চিকিৎসার উদ্যোগটুকু নেয়নি। শেষ পর্যন্ত ছাত্র-যুবদের তৎপরতায় তাঁকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হয় ইরান সোসাইটিতে ডাক্তার ফুয়াদ হালিমের চেম্বারে। সেখানে চিকিৎসার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে ক্যামাক স্ট্রিটে একটি নার্সিংহোমে ভরতি করা হয়। ১৫ ফেব্রু‌য়ারি সেখানেই মৃত্যু হয় কোতুলপুরের গোপীনাথপুর পঞ্চায়ে‌তের চোরকলা গ্রামের বাসিন্দা যুব আন্দোলনের কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার।

পুলিশের নির্মম লাঠির আঘাতে যুব আন্দোলনের কর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর ঘটনায় তীব্র প্রতিবাদ-ধিক্কার জানিয়েছেন বাম ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ। ১৫ ফেব্রুয়ারি দীনেশ মজুমদার ভবনের সামনে যুবকর্মীর মরদেহে মালা দিয়ে বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেছেন, যুবকর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যাকে সরকার খুন করেছে। এই খুনি সরকারের আর একদিনও ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই।

সিপিআই (এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, শিক্ষা ও কাজের দাবি নিয়ে নবান্নে যেতে চাওয়ায় যেভাবে পুলিশ তাঁকে পিটিয়ে হত্যা করেছে, তা কলঙ্কজনক ঘটনা। এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই চলবে। আদালতে লড়াই হবে, ময়দানেও লড়াই হবে।

প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী বলেছেন, বর্বর আক্রমণ করা হয়েছিল ছাত্র-যুবদের উপর। এই মৃত্যুর জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর পুলিশ প্রশাসনই দায়ী।

বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নান বলেছেন, গণআন্দোলন দমন করতে গিয়ে স্বৈরাচারী সরকার যা করেছে তাকে ধিক্কার জানানোর ভাষা নেই।

বিধানসভায় বামপরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী এটাকে খুন বলে অভিহিত করে বলেছেন, নবান্নের সাহস হলো না ছাত্র-যুবদের কথা শোনার। তাঁদের ওপর বেধড়ক আক্রমণ করা হলো। একজন টগবগে যুবককে লাশ বানিয়ে দিল, আর কত লাশ চাই সরকারের? ক্ষমতা দেখাতে খুন করেছে সরকার।

ডিওয়াইএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভয় মুখার্জি বলেছেন, চাকরি চাইতে গিয়ে পুলিশের হাতে খুন হতে হলো, পশ্চিমবাংলায় এমন ঘটনা নজিরবিহীন।

যুব কর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছেন সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সভানেত্রী অঞ্জু কর এবং সম্পাদিকা কনীনিকা ঘোষ। তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, এটা একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা। তাঁরা দোষী পুলিশদের শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।

১৬ ফেব্রুয়ারি কোতুলপুরের চোরকলা গ্রামে কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন গোটা গ্রামের মানুষ। উপস্থিত ছিলেন ছাত্র-যুব আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। শেষকৃত্যে উপস্থিত হাজারো মানুষ শোক জানানোর পাশাপাশি তৃণমূল সরকারের পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ-ধিক্কার প্রতিধ্বনিত করেছেন। পুলিশের নির্যাতনে যুব আন্দোলনের কর্মী কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর প্রতিবাদে রাজ্যজুড়েই প্রতিবাদ-বিক্ষোভ সংগঠিত হয়েছে। ১৭ ফেব্রুয়ারি যুব কর্মীর মৃত্যুর প্রকৃত তদন্ত, দোষীদের শাস্তির দাবি জানিয়ে রাজ্যজুড়ে থানা ঘেরাও করে প্রতিবাদ ধ্বনিত করেন তাঁরা। এ‍ই কর্মসূচির মাধ্যমে তাঁরা ঘোষণা করেছেন দোষীদের শাস্তির ব্যবস্থা না হলে আন্দোলন আরও তীব্র হবে। তাঁরা জানিয়ে দিয়েছেন পুলিশ দিয়ে বামপন্থী আন্দোলন রোখা যাবে না।

এদিনের কর্মসূচিতে পুলিশ নানাভাবে বাধা তৈরি করে। কোথাও ব্যারিকেড দিয়ে থানা ঘেরাও, কোথাও যুব কর্মীদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে লিপ্ত হয় পুলিশ। কোথাও আবার অশালীন মন্তব্য করে আন্দোলনকারী ছাত্র-যুবদের প্ররোচনা দিতে থাকে। সব কিছুকে উপেক্ষা করেই এ‍ই অত্যাচারী শাসক ও তাদের ঘাতক লেঠেল বাহিনীর দিকে ঘৃণা ছুঁড়ে দেয় ছাত্র-যুবরা।

এদিন কলকাতায় ১৫টির বে‍‌শি থানা সহ রাজ্যের বিভিন্ন জেলার ২৫০টি থানার সামনে বিক্ষোভ সংগঠিত করেন ছাত্র-যুবরা। বিভিন্ন জায়গায় পুলিশ স্মারকলিপি নিতেও আপত্তি জানায়। এছাড়া বিক্ষোভ সভা-‍‌মিছিল রোখার চেষ্টা করে। কিন্তু সব কিছুকে প্রতিহত করেই রাজ্যজুড়ে ছাত্র-যুবদের প্রতিবাদ সোচ্চারে ধ্বনিত হয়েছে।

এদিকে যুবকর্মী মইদুল ইসলাম মিদ্যার মৃত্যুর তদন্তের জন্য রাজ্য সরকার ‘সিট’ গঠন করলেও তদন্তের মুখ ঘোরাতে চাইছে পুলিশ। এই লক্ষ্য নিয়ে ডাঃ ফুয়াদ হালিমকে ডেকে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে গোয়েন্দারা। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশেই তদন্তের গতি অন্যদিকে ঘোরাতে মৃত্যুর মূল কারণের ওপর জোর না‍‌ দিয়ে অন্যান্য বিষয় সামনে নিয়ে আসছে। নবান্নের নির্দেশেই পরিকল্পিতভাবে মামলা সাজাতে ১১ ফেব্রুয়ারি ঘটনাস্থল সংলগ্ন দোকানদারদের নিউ মার্কেট থানায় নিয়ে গিয়ে মিথ্যা বয়ান মুখস্ত করা‍‌নো চলছে। আবার পুলিশি দমনপীড়ন, চক্রান্তও চলছে সমানতালে। প্রিয় সহযাত্রী মিদ্যার মরদেহে শ্রদ্ধা জানাতে আসা বাঙ্গুরের বাসিন্দা যুবকর্মী দীপঙ্কর সেনগুপ্তকে গ্রেপ্তার করে অমানুষিক অত্যাচার চালিয়েছে পুলিশ। পুলি‍‌শের এই নৃশংসতা স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের বিচারপতি সঙ্গীতা চ্যাটার্জি। এছাড়াও প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার যুবকর্মী হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভ প্রদর্শনের জন্য এসএফআই রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য, সংগঠনের কলকাতা জেলা কমিটির সম্পাদক সমন্বয় রাহা, সভাপতি অর্জুন রায়, ডিওয়াইএফআই’র কলকাতা জেলা সভাপতি কলতান দাশগুপ্ত সহ প্রায় ২৫০ ছাত্র-যুব’র বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করেছে। মমতা ব্যানার্জির পুলিশ এসব করে প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দিতে চাইলেও রাজ্যজুড়েই ছাত্র-যুবদের প্রতিবাদী আন্দোলন ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে।