৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭
‘প্রতিবাদ চাই’-এর কসম খেয়ে শপথ নিচ্ছি সহযোদ্ধা মইদুলের শহিদি মৃত্যুর জবাব আমরা দেবোই
সমন্বয় রাহা
কমরেড মইদুল ইসলাম মিদ্যা লাল সেলাম...
‘‘আমার আব্বাকে যারা মেরেছে আমি প্রতিবাদ চাই’’ - কান্না ভেজা চোখে বছর এগারোর এক শিশুর আবেদন। পশ্চিমবাংলার এক স্বপ্নভঙ্গ হওয়া বেকারের মেয়ের আবেদন তার আব্বার শাহাদাতের পর। মইদুল ইসলাম মিদ্যা। ডাকনাম ফরিদ। বাঁকুড়া জেলার কোতুলপুর গ্রামের গ্র্যাজুয়েট মইদুল বামপন্থী যুব সংগঠন ডিওয়াইএফআই-র সক্রিয় কর্মী। ডিইআইইডি (DEIEd) পাশ করা বছর বত্রিশের মইদুল বুঝতে পেরেছিলেন এ রাজ্যে বেকার যুবদের চাকরির স্বপ্ন মমতা ব্যানার্জি গত ১০ বছরে পিষে মেরে দিয়েছেন। বছরের পর বছর এসএসসি, টেট বন্ধ। সরকারি দপ্তরে কয়েক লক্ষ শূন্যপদ। যেটুকু নিয়োগ হচ্ছে তাতেও সীমাহীন দুর্নীতি। তাই ধার করে টোটো কিনে টোটো চালিয়েই দু’বেলা ভাতের জোগাড় করতেন মইদুল। আর প্রতিদিনের জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় শানিত করতেন নিজের চেতনাকে।
মইদুল বামপন্থী রাজনীতি করতেন। নিজেকে বিক্রি করে শাসক দলের ভৈরব বাহিনীর সদস্য হননি। কিংবা এই অস্থির সময়ে দলবদল করে নিজে ভালো থাকার চেষ্টা করেন নি। কারণ মইদুল জানতেন এই লড়াইটা দলবদলের নয়, দিনবদলের। সেই লড়াইয়ের একনিষ্ঠ সৈনিক হয়েই তিনি শহিদের মৃত্যু বরণ করলেন গত ১১ ফেব্রুয়ারি।
এ রাজ্যের সব বেকার যুবর কাজের দাবি নিয়ে, শিক্ষাকে ধর্ম বা বাজারের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করার দাবি নিয়ে ১১ ফেব্রুয়ারির নবান্ন অভিযানে শামিল হয়েছিলেন মইদুলের মতো হাজার হাজার তরুণ তরুণী। পুলিশের নৃশংস লাঠিচার্জের পর কলকাতার রাজপথে ‘‘আমি আর বাঁচবোনি’’ বলে লুটিয়ে পড়েন মইদুল। আসলে ওই তিনটি শব্দ শুধু মইদুলের মরণ যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ ছিলনা, এ ছিল রাজ্যের সমগ্র ছাত্র-যুব সমাজের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আর্তনাদ! ১১ ফেব্রুয়ারি ১০টি বাম ছাত্র-যুব সংগঠনের ডাকে নবান্ন অভিযানের স্লোগান ছিল খুব স্পষ্ট - ‘‘শিক্ষা দাও, কাজ দাও, লাল ফেরাও, হাল ফেরাও"।
গোটা বাংলার ছাত্র-যুবরা নিজেদের হকের কথা বলতে মিছিল করছিল। সে মিছিলে না ছিল কোনো অস্ত্রের আস্ফালন, না ছিল পুলিশদের প্রতি কোনো প্ররোচনা। গণতান্ত্রিক মিছিলে বিনা প্ররোচনায় পুলিশ জলকামান, টিয়ার শেল প্রয়োগ করেই থেমে থাকেনি-যথেচ্ছভাবে লাঠিচার্জ করে ছাত্র ছাত্রী, যুবক-যুবতী নির্বিশেষে। মাথা ফেটে রাস্তায় যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকা ছাত্রী,যুবতীরাও রক্ষা পায়নি পুলিশের বিকৃত বীরত্বের হাত থেকে। গণতন্ত্রকে এভাবে প্রকাশ্যে হত্যা করে, প্রশ্ন তোলার অধিকার হরণ করে পরাধীন ভারতের ব্রিটিশ পুলিশের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে মমতা ব্যানার্জির পুলিশ।
কোন্ সময়ে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র তার লেঠেল বাহিনীকে এগিয়ে দিচ্ছে ছাত্র-যুবর বিরূদ্ধে? যখন দেশের বেকারত্ব গত ৪৫ বছরে সর্বোচ্চ। যখন জিডিপি দ্রুতহারে নিম্নগামী। যখন কেন্দ্রের সরকার বিভিন্ন সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বিক্রি করে দিচ্ছে, দেশের জল-জমিন-জঙ্গল বিক্রি করে দেওয়ার ছক কষছে,দেশের খেত-ধানের গোলা কর্পোরেটদের কাছে বিক্রি করে দেওয়ার জন্য কৃষিবিরোধী বিল আনা হয়েছে। যখন শ্রমিকের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে দাসে পরিণত করার জন্য নয়া শ্রমকোড চালু করা হচ্ছে।
তবে দেশের আমজনতা নীরবে শাসকের এই আক্রমণ বরদাস্ত করতে রাজি নয়।গত নভেম্বর মাস থেকে দিল্লির সিঙ্ঘু, টিকরি বর্ডারে এ দেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক বসে আছে দিল্লির প্রবল শীত,বৃষ্টিকে উপেক্ষা করে। কৃষকদের প্রতিরোধকে চূর্ণ করার জন্য রাষ্ট্র যখন তার সমস্ত মেশিনারি নিয়ে আক্রমণ করেছিল তখন এ দেশের কৃষকরা একবারের জন্যও রাস্তা ছেড়ে যাননি। যখন মুজফফরনগরে কৃষক মহিলাদের উপর গাড়ির চাকা তুলে দিল রাষ্ট্র,তারপরও তাঁরা লড়াই ছেড়ে যাননি। এক ইঞ্চিও পেছপা হননি।ঠিক যেন পিট সিগারের সেই কালজয়ী গান ‘‘We shall not be moved’’-এর বাস্তবায়ন।
আমাদের রাজ্যেও একই অবস্থা। গত এক দশকে এ রাজ্যে কোনো শিল্পায়ন হয়নি। কোনো নতুন কারখানা, কোনো নতুন আই টি অফিস তৈরি হয়নি।বদলে বেড়েছে বেকারত্ব, বেড়েছে স্কুল কলেজে পড়ার খরচ, কমেছে স্কুল কলেজে সিট। এখন স্কলারশিপ কমছে। বদলে বাড়ছে সেল্ফ ফাইনান্সিং কোর্স। এসময় আবার কেন্দ্রীয় সরকার কোনো আলাপ আলোচনা ছাড়াই নয়া শিক্ষানীতি (NEP2020) নিয়ে এল। যার প্রতি পাতায় কীভাবে শিক্ষাকে আরও কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া যায় তা রয়েছে। এই শিক্ষানীতি আসলে মনুবাদী ধ্যানধারণারই ফসল। এই শিক্ষানীতির ফলেই আরও বেড়ে উঠবে আরএসএস পরিচালিত স্কুল। অর্থাৎ এই শিক্ষা নীতি আসলে ক্লাসরুমে বেঞ্চকে ধর্মের নামে ভাগাভাগি করার ব্লু প্রিন্ট। এই সময় তাই আমাদের লড়াই কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারের কর্পোরেটমুখী, জনস্বার্থবিরোধী নীতির বিরুদ্ধে। নীতিগত প্রশ্নে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কার্যত কেন্দ্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করছে। তাই বর্তমান রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে আমাদের আপসহীন সংগ্রাম চলছে।
১১ ফেব্রুয়ারি নবান্ন অভিযান আসলে এই অপদার্থ তৃণমূল সরকারকে লাল কার্ড দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সংগঠিত হয়েছিল। আমরা সরকারকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে গিয়েছিলাম যে, সরকার তার যাবতীয় দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ। তাই এই দলের আর সরকার চালানোর অধিকার নেই। এই সময় দাঁড়িয়ে আমরা তাই সরাসরি রাস্তায় নেমে লড়াইয়ের কথা বলছি। অর্থাৎ এই ফ্যাসিস্ত মনোভাবাপন্ন সরকার সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে আইনসভায় যে অন্যায়কে আইন সিদ্ধ করবে তাকে রাস্তার লড়াইয়ে ব্যর্থ করে দেওয়া। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ প্রতিরোধে শামিল হওয়ার এই আহ্বান আমরা জানিয়েছি মরিয়া হয়ে, কেননা সরকার সাধারণ ছাত্র-যুবর চাহিদার প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন। ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতার রাজপথে ছাত্র যুবরা কোনো প্রতীকী অবস্থান বা আন্দোলন করতে চায়নি।বরং সরাসরি এই সরকারের অন্যায় কার্যকলাপের বিরূদ্ধে,সরকারের ফ্যাসিস্তসুলভ পদক্ষেপের বিরূদ্ধে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে লড়াই করতে চেয়েছিল। সেদিন রাজ্যের সব জেলা থেকে হাজার হাজার ছাত্র-যুব এসেছিল সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা জানাতে, নবান্নের নির্লজ্জ শাসককে ধিক্কার জানাতে, তাদের দশ বছরের অপকর্মের জবাব চাইতে। কিন্তু পুলিশ প্রশাসন এই গণঅসন্তোষকে নির্মমভাবে দমন করার আগাম পরিকল্পনা করেছিল। তাই এস এন ব্যানার্জি রোডের পার্শ্ববর্তী সবকটি গলিতে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। কার্যত এই রাস্তাকে জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো অবরুদ্ধ করে বিক্ষোভকারী ছাত্র-যুবর ওপর নৃশংসভাবে হামলা করে উর্দীধারী গুন্ডার দল। আহত, রক্তাক্ত আমাদের অসংখ্য কমরেড। আর সকলকে কাঁদিয়ে চিরবিদায় নিল মইদুল। ভারতের ছাত্র ফেডারেশন এবং ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশনের রাজ্য নেতৃত্ব ঘোষণা করেছেন যে, মইদুলের মেয়েদের পড়াশোনার দায়িত্ব আমরা গ্রহণ করছি। বামপন্থী সংগঠনগুলি অর্থ সংগ্রহের ডাক দিয়েছে। আমরা দুদিন অর্থাৎ ১৭ ও ১৮ ই সেপ্টেম্বর থানা ঘেরাও ও রেল অবরোধ করেছি রাজ্যজুড়ে তরুণ প্রজন্মের ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে এই দুই কর্মসূচিতে। আমরা স্পষ্টতই সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই যে, লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে আমরা কখনোই পিছিয়ে আসব না, শহিদের রক্তে রাঙা পথ বেয়ে আমাদের মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হবে। ২০১১-র পর থেকে এ রাজ্যে আমাদের শহিদের সংখ্যা ২৫০শেরও অধিক। এই জঙ্গলরাজের মধ্যে দাঁড়িয়ে, দেশে সাম্প্রদায়িক শাসকদলের চোখে চোখ রেখে এবং সুবিধাবাদী বিভিন্ন দলের বিরূদ্ধে আমরা বামপন্থীরা যে দিনবদলের লড়াই লড়ছি তাতে আমাদের পতাকার লাল তারাটা আবারও একজন শহিদের রক্তে আরও গাঢ় হলো। মইদুল আমাদের গুরুদায়িত্ব দিয়ে গেছে। ওর একরত্তি মেয়ের সেই কান্নাভেজা চোখে বলা ‘‘প্রতিবাদ চাই’’-এর কসম খেয়ে আমরাও শপথ করছি শহিদের মৃত্যুর বদলা আমরা নেবোই।