E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭

চরম অমানবিক আচরণ অনশনরত মাদ্রাসা শিক্ষকদের উপর

পিয়াল রায়


মাদ্রাসা শিক্ষকদের অবস্থানে বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম।

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, ১০,০০০ অ-অনুমোদিত মাদ্রাসার তিনি অনুমোদন দেবেন। মমতার মুখ্যমন্ত্রিত্বের ১০ বছর অতিক্রান্ত। রাজ্য বিধানসভার ভোট আসন্ন। মমতারই ১০ বছরের শাসনকালে তাঁর ঘোষণা ১০,০০০ মাদ্রাসার মধ্যে মাত্র ২৩৫টি মাদ্রাসা সরকারি অনুমোদন পেয়েছে। বাকি যেসব অ-অনুমোদিত মাদ্রাসা রয়েছে, সেইসব মাদ্রাসাগুলির ছাত্র-ছাত্রীরা গত প্রায় ১০ বছর ধরে মিড-ডে-মিল থেকে বঞ্চিত।

মমতা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর, বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ছাত্র-ছাত্রীদের যে পোশাক দেওয়া হতো সরকারি টাকায়, সেই প্রকল্পটিকে নানা ঢাকঢোল পিটিয়ে নিজের নামে চালাতে শুরু করেন। অথচ এই অ-অনুমোদিত মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা কিন্তু গত ১০ বছরে মমতার অসত্য সংখ্যালঘু উন্নয়ন সম্পর্কিত নীতির জন্য সরকারি কোষাগারের টাকায় একটিও পোশাক, বইপত্র কিছুই পায়নি।

এইসব অ-অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকারা রাজ্য সরকার কর্তৃক প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও মাদ্রাসাগুলি সরকারি অনুমোদন না পাওয়ার দরুন আজ পর্যন্ত বেতন, মহার্ঘ ভাতা, চিকিৎসাভাতা ইত্যাদি সহ কোনো ধরনের সরকারি আর্থিক সুযোগ-সুবিধা পান না। এইসব আন এইডেড মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকার পক্ষ থেকে তাঁদের বেতন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা এবং ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাপ্য অধিকার নিয়ে একাধিকবার রাজ্য সরকারের কাছে বিনীত আবেদন করা হয়েছে। রাজ্য সরকার কোনরকম আবেদনে আজ পর্যন্ত কর্ণপাত করেনি।

এইসব অ-অনুমোদিত মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা গত ১০ বছর ধরে একাধিকবার আন্দোলন করেছেন তাঁদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে। ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য অধিকারের দাবিতে। সেই সব আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিসূচক নানা শব্দ রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চারণ করা হলেও, বলাবাহুল্য, একটি প্রতিশ্রুতিও গত ১০ বছরে রাজ্য সরকার রাখেনি।

এইরকম এক পরিস্থিতিতে কোভিড ১৯ জনিত লকডাউনের কারণে গোটা দেশে যে ভয়াবহ আর্থ-সামাজিক সঙ্কট, সেই সঙ্কটের জেরে অ-অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের জীবন একেবারে প্রান্তসীমায় এসে দাঁড়িয়েছে। ভয়াবহ দারিদ্র্যের সঙ্গে সংগ্রাম করেও তাঁরা কিন্তু সেই মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষাদান থেকে নিজেদেরকে দূরে সরিয়ে নেননি। ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য যতটুকু সুযোগ সুবিধা দিতে পারা যায়, কার্যত মানুষের কাছে ভিক্ষা করে সেই ধরনের সুযোগ সুবিধাগুলি দেওয়ার তাঁরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

এইরকম অবস্থাতেও তাঁরা রাজ্য সরকারের কাছে মাদ্রাসাগুলির সরকারি অনুমোদনের জন্য বারবার আবেদন করে ব্যর্থ হওয়ার পর, অবশেষে আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত নেন। অনশনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর সল্টলেকে বিকাশ ভবনের সামনে সেই অবস্থান অনশন করবার জন্য তাঁরা রাজ্য প্রশাসনের কাছে অনুমতি প্রার্থনা করেন। রাজ্য সরকার তথা খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে সংখ্যালঘু উন্নয়ন সংক্রান্ত দপ্তরের পূর্ণমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও এইসব অ-অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলির শতশত শিক্ষক-শিক্ষিকা, তাঁদের অনশন মঞ্চের উপরে একটি অস্থায়ী আবরণ তৈরি করবার জন্য স্থানীয় ডেকরেটরদের কাছ থেকে ত্রিপল ইত্যাদি ভাড়া করতে চাইলেও, তাঁদের শুনতে হয় যে, রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের পক্ষ থেকে স্পষ্ট নির্দেশ আছে, অ-অনুমোদিত মাদ্রাসা শিক্ষকদের অনশন মঞ্চে কোনরকম, কিছু ভাড়া যদি স্থানীয় ডেকরেটররা দেন, তাহলে তাঁদের ভবিষ্যতে ব্যবসা করতে দেওয়া হবে না।

এই শীতের রাতে, শতশত শিক্ষক-শিক্ষিকা কার্যত খোলা আকাশের নিচেই সল্টলেকের বিকাশ ভবনের সামনে এই অবস্থানে বসেছেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে একজন মহিলা হওয়া সত্ত্বেও অ-অনুমোদিত মাদ্রাসার অনশনরত শিক্ষিকাদের জন্য স্থানীয় কোনো বাথরুম পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেওয়া হচ্ছে না সরকারের নির্দেশে এবং শাসকদলের নির্দেশে। কোনরকম আলোর ব্যবস্থাও তাঁদের করতে দেওয়া হচ্ছে না। বিদ্যুৎ ভবন থেকে ঢিলছোঁড়া দূরত্বে এইসব অসহায় গরিব ঘরের হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে অ-অনুমোদিত মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষিকারা কার্যত কোনরকম বৈদ্যুতিক সংযোগ ছাড়াই এই একুশ শতকে সারারাত ধরে অবস্থান অনশন চালাচ্ছেন। সেই অনশনে কেউ অসুস্থ হলে তাঁদের সরকারি হাসপাতালে পর্যন্ত ভরতি নেওয়া হচ্ছে না সরাসরি রাজ্য সরকারের নির্দেশে। স্থানীয় চিকিৎসকেরাও যদি সেই অনশনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তাহলেও তাঁদের উপরে নানাধরনের রাজরোষ নেমে আসছে।

এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও রাজ্য সরকার এবং শাসকদলের সমস্ত হুমকি উপেক্ষা করে অ-অনুমোদিত মাদ্রাসাগুলির শিক্ষক-শিক্ষিকারা দিনের পর দিন অবস্থান অনশন চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব এই অনুষ্ঠান মঞ্চে উপস্থিত হয়ে অনশনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করেছেন এবং তাঁদের অনশন মঞ্চে ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা না দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারের যে নোংরা ষড়যন্ত্র, তাকে ধিক্কার জানিয়েছেন।

সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরোর সদস্য মহম্মদ সেলিম এই অনশন মঞ্চে গিয়ে অনশনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে তাঁদের দাবি দাওয়ার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। সংখ্যালঘু উন্নয়নের নাম করে কি ধরনের ভাঁওতা দিয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কার্যত হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি বিজেপি-কে শক্তিশালী করছেন, সে বিষয়ে সেলিম ওই অনুষ্ঠান মঞ্চ থেকে নিজের বক্তৃতায় এবং পরে সংবাদমাধ্যমের কাছে বিস্তারিত বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, রাজ্য সরকার তাদের কার্যকারিতার যে রেকর্ড কার্ড বের করছে, সেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নিজের সংখ্যালঘু উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও, সংখ্যালঘু উন্নয়নজনিত যে উন্নতির ঢালাও প্রচার তিনি করে থাকেন সে সম্পর্কে একটিও তথ্য নেই। প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু সমাজ সম্পর্কে, সংখ্যালঘু সমাজের ছেলেমেয়েদের শিক্ষা, আর্থিক বনিয়াদ, সামাজিক বৈশিষ্ট্য, কর্মসংস্থান ঘিরে রাজ্যের শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেস এবং তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মানসিকতা যে কোন্ স্তরের এ থেকেই তা পরিষ্কার বোঝা যায় বলে তিনি ওই অনশন মঞ্চে বলেন।

গণ আন্দোলনের নেতা সুজন চক্রবর্তী রাজ্যের বিরোধী দলনেতা আব্দুল মান্নান সহ রাজ্যের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেতৃত্ব ওই অনশন মঞ্চে গিয়ে অনশনরত শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দাবি-দাওয়ার প্রতি তাঁদের আন্তরিক সমর্থন, সহমর্মিতা জ্ঞাপন করেন। রাজ্যের বামপন্থী ছাত্র আন্দোলন, যুব আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা এই অনশনরত ছাত্র-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি তাঁদের অনশনের প্রথম দিন থেকে যতখানি সম্ভব সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন।