৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭
কেন্দ্রীয় সরকারের দমননীতিকে অগ্রাহ্য করেই শক্তিশালী হচ্ছে কৃষক আন্দোলন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দিল্লিতে আড়াই মাসেরও বেশি সময় ধরে চলা কৃষক আন্দোলনকে দমন করতে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে রেল রোকো কর্মসূচি সংগঠিত হলো। ১৮ ফেব্রুয়ারি সংযুক্ত কিষান মোর্চা এবং সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমন্বয় কমিটির ডাকে এই কর্মসূচি পশ্চিমবঙ্গ জুড়েও পালিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এই কর্মসূচিতে ছাত্র, যুব, মহিলা, শ্রমিক সংগঠনের কর্মীরাও অংশ নেন।
কেন্দ্রের কৃষিআইন বাতিলের দাবিতে গড়ে ওঠা কৃষক আন্দোলন সমর্থনকারীদের ওপর প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে উদ্যত হয়েছে মোদী- অমিত শাহ’র পুলিশ। কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে ট্যুইটারে লেখার জন্য বেঙ্গালুরুর কলেজ ছাত্রী, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মী ২১ বছরের দিশা রবিকে ১৪ ফেব্রুয়ারি গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এছাড়া কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করে ট্যুইটারে লেখার জন্য মুম্বাইয়ের আইনজীবী নিকিতা জ্যাকব ও পুনের ইঞ্জিনিয়ার শান্তনুর বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সুইডেনের পরিবেশবিদ গ্রেটা থুনবার্গ যে টুইট করেছিলেন, দিশা ‘টুলকিট’ ব্যবহার করে তা ছড়িয়েছেন - এই অভিযোগেই তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ‘টুলকিট’ শব্দটি এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তাতে মনে হবে যেন এটি কোনো নিষিদ্ধ প্রযুক্তি। আসলে এটি ব্যবহার করা হয় তথ্যভাণ্ডার তৈরির জন্য। আসলে দিশা গ্রেটা থুনবার্গের পুরনো তথ্য সম্পাদনা করে নতুন তথ্য যুক্ত করে গুগল ডকুমেন্টে একটি ট্যুইট করেছিলেন। এজন্য দিশার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা, বিভাজন সৃষ্টির মতো মারাত্মক অভিযোগ আনা হয়।
সুইডেনের পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গের ‘ফ্রাইডে ফর ফিউচার’ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত দিশা। জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে নজর টানাই এই সংগঠনের কাজ। ২১ বছরের কলেজ ছাত্রী দিশা রবিকে গ্রেপ্তার করার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো বলেছে, দিশা রবিকে গ্রেপ্তার জঘন্যতম ঘটনা। কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে ‘টুলকিট’ ফরওয়ার্ড করার আজগুবি অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতা ও অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের মামলা করা হয়েছে। এর তীব্রতম নিন্দা হওয়া উচিত। দিশা রবির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করে তাঁকে মুক্তি দিতে হবে।
সংযুক্ত কৃষক মোর্চা বলেছে, চলমান কৃষক আন্দোলনকে দুর্বল করার জন্য পুলিশকে নির্লজ্জভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তারই অঙ্গ দিশা রবিকে গ্রেপ্তার। ভারতের তরুণ পরিবেশবিদরা বোঝেন অলাভজনক কৃষি এমন কৃষি পদ্ধতির দিকে ঠেলে দেয় যা পরিবেশের পক্ষে অনুকূল নয়। কৃষকের সমস্যা তাঁরা উপলব্ধি করেন। সেই কারণেই তাঁরা কৃষক আন্দোলনকে সমর্থন করছেন। সোস্যাল মিডিয়াতেও দিশা রবির মুক্তির জোরালো দাবি উঠেছে।
এদিকে ২৬ জানুয়ারি সাধারণতন্ত্র দিবসে লালকেল্লায় অনাকাক্ষিত হাঙ্গামার ঘটনার উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় তদন্ত দাবি করেছে প্রতিবাদী কৃষক সংগঠনগুলি। আন্দোলনরত কৃষকদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা এবং পুলিশি হয়রানিরও তীব্র নিন্দা করেছেন তারা।
আন্দোলনের প্রতি সমর্থন বাড়ছে
তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সমর্থন বাড়ছে প্রতিদিন। দেশের বিভিন্নপ্রান্তে কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে হাজার হাজার মানুষের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থানে কিষান মহাপঞ্চায়েতে বিপুল জনসমাগম ঘটছে। সংযুক্ত কিষান মোর্চার তরফে ১২ ফেব্রুয়ারি এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আন্দোলনস্থলে এপর্যন্ত ২২৮ জন প্রতিবাদী কৃষকের মৃত্যু হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের শহিদ তাঁরা। এই শহিদদের পরিবারে সহায়তা দেবার কোনো পরিকল্পনা নেই বলে সংসদ অধিবেশনে কবুল করেছে কেন্দ্র। সরকারের এই মনোভাবও লজ্জাজনক। অথচ কৃষকদের এই জীবনহানির জন্য একমাত্র দায়ী মোদী সরকার। ন্যায্য দাবি পূরণের জন্য আর কতো কৃষকের জীবনদান দেখতে চায় সরকার? সরকারের এই অনুভূতিহীন আচরণকে তীব্র ধিক্কার জানাচ্ছে কিষান মোর্চা।
সংযুক্ত কিষান মোর্চার বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কৃষক আন্দোলন প্রতিদিন জোরালো হতে থাকায় স্পষ্টতই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। এজন্য তারা নানা কায়দায় নাগরিকদের এবং গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ করতে চাইছে। কৃষক আন্দোলনের কণ্ঠস্বর তুলে ধরায় সংশ্লিষ্ট সংবাদমাধ্যমগুলির ওপর ধারাবাহিক আক্রমণ চলছে। ‘নিউজক্লিক’-এর দপ্তরে ইডি-র হানাদারি আসলে সংবাদমাধ্যমের শ্বাসরোধের চেষ্টার সর্বশেষ নির্দশন।
কিষান মোর্চার বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, এমন একটি প্রগতিশীল, ন্যায়সঙ্গত ও সমতামূলক সমাজ গঠনের লক্ষ্যে সংযুক্ত কিষান মোর্চা এগিয়ে যেতে চায়, যেখানে কৃষকের অধিকারকেও পুরোপুরি মর্যাদা দেওয়া হবে।
লড়াই চালিয়ে নিতে প্রস্তুতি
দিল্লি সীমান্তের কৃষক আন্দোলন ৮০ দিন অতিক্রম করলেও অন্নদাতাদের দাবি মানতে চাইছে না কেন্দ্রের সরকার। সরকারের উদ্ধত এবং একগুঁয়ে মনোভাব যত বাড়ছে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে এককাট্টা হচ্ছেন কৃষকরা। পাঞ্জাবের কৃষক সংগঠনগুলি স্থির করেছে, দিল্লি সীমান্তে নির্দিষ্ট সংখ্যক আন্দোলনকারীকে রেখে বাকিদের গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হবে। তাঁরা গ্রামেই আন্দোলন গড়ে তুলবেন। গ্রামভিত্তিক কতজন দিল্লি সীমান্তে আসবেন, তাও ঠিক করা হচ্ছে। দাবি আদায়ের লড়াই আরও দীর্ঘস্থায়ী হবে ধরে নিয়েই সিঙ্ঘু সহ সবক’টি প্রতিবাদস্থলে ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। সংযুক্ত কিষান মোর্চার নেতারা ইতিমধ্যেই ঘোষণা করে দিয়েছেন, কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিল এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি)-র আইনি স্বীকৃতির দাবি না মেটা পর্যন্ত লড়াই চলবে।
কৃষক নেতৃবৃন্দ সিঙ্ঘুর আন্দোলনস্থলের প্রস্তুতি সম্পর্কে জানিয়েছেন, বোঝাই যাচ্ছে আরও লড়াই চলবে। তাই এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং অন্যান্য পরিকাঠামো আরও জোরদার করার প্রস্তুতি চলছে। কৃষকনেতা দীপ খাত্রি জানিয়েছেন, প্রতিদিন এখানে অসংখ্য চেনা-অচেনা মানুষের যাতায়াত চলছে। তাই প্রতিবাদস্থলের সুরক্ষা বাড়াতে এবং সম্ভাব্য দুষ্কৃতীদের উপর নজর রাখতে আন্দোলনের মূল মঞ্চ এবং আশেপাশে ডিজিটাল ভিডিয়ো রেকর্ডার সহ কমপক্ষে ১০০টি সিসি টিভি বসানো হচ্ছে। চারদিকে নজর রাখতে, যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে এবং রাতপাহারায় আরও অন্তত ৬০০ স্বেচ্ছাসেবক নামানো হচ্ছে। তাঁদের গায়ে থাকবে সবুজ জ্যাকেট, পকেটে থাকবে পরিচিতিপত্র।
কৃষক নেতাদের বক্তৃতা এবং নানান সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান যাতে সকলেই ভালোভাবে দেখতে-শুনতে পান, তারজন্য ৭০০-৮০০ মিটার দূরত্বে বিরাট এলসিডি স্ক্রিন বসানো হবে। জরুরি পরিস্থিতির কথা ভেবে অ্যাম্বুলেন্সসহ অন্যান্য ব্যবস্থাও জোরদার করা হচ্ছে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে দিতে প্রায়শই ইন্টারনেট পরিষেবায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে মোদী সরকার। ওদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলায় ইন্টারনেট সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ওয়াইফাইয়ের আলাদা অপটিক্যাল ফাইবার লাইন ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। এছাড়া আগামী গ্রীষ্মে দাবদাহের কথা ভেবে ইলেকট্রিক ফ্যানের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
আন্দোলনকারীদের স্পষ্ট কথা, সরকার দাবি না মানলে মাসের পর মাস বসে থাকব এখানে। আমরা লঙ্গর (যৌথ রান্নাঘর) সংস্কৃতির লোক। তাই খাবার নিয়ে আমাদের কোনো অসুবিধা নেই। কৃষকের দাবি মানতেই হবে সরকারকে।
শহিদ স্মরণে মশাল মিছিল
২০১৯-এ পুলওয়ামায় বিস্ফোরণে নিহত জওয়ান এবং চলমান কৃষক আন্দোলনে শহিদ কৃষকদের একই সঙ্গে স্মরণ করলেন কৃষকরা। ১৪ ফেব্রুয়ারি দেশের নানা প্রান্তে সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ‘শহিদ স্মরণ’ কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সন্ধ্যায় মোমবাতি ও মশাল নিয়ে মিছিল হয়েছে। রাজধানীর সীমান্তে সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুর, শাহজাহানপুরে কৃষক জমায়েত থেকে মিছিল বেড় হয়। মশাল ও মোমবাতি হাতে এদিন হাজার হাজার কৃষক আওয়াজ তোলেন, ‘অমর শহিদ অমর রহে’, মোর্চার নেতৃবৃন্দ এইসব মিছিলে অংশ নেন। সিঙ্ঘুতে বলবীর সিং রাজেওয়াল, জগদীপ সিং দালেওয়াল এবং গাজিপুরে অন্যান্যদের সঙ্গে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সভানেত্রী মরিয়ম ধাওয়ালে, কে পুণ্যবতী সহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। এদিন পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থানের গ্রামে গ্রামে মশাল মিছিল সংগঠিত হয়েছে।
এদিন কৃষক নেতৃবৃন্দ বলেছেন, বিজেপি-আরএসএস’র ছদ্ম জাতীয়তাবাদের বদলে এদেশের কৃষকরা দেশের সর্বভৌমত্ব, ঐক্য, সম্মান রক্ষায় প্রকৃত দায়বদ্ধ। কৃষকরা জাগছেন। ক্রমশ বেশি বেশি সংখ্যায় কৃষক আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। বিজেপি’র দিন ফুরিয়ে আসছে, কৃষকরা রাজ্য, ধর্ম, জাতপাতের বাধা ভেঙে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। সরকারের বিভাজনের কৌশলকে পরাস্ত করেই মহাপঞ্চায়েত হচ্ছে। গ্রামীণ ভারত ও কৃষিই এখন মূল আলোচ্য।