৫৮ বর্ষ ২৭ সংখ্যা / ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ / ৬ ফাল্গুন, ১৪২৭
আজকের পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে একুশের চেতনা
গৌতম রায়
পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে সংগ্রামকে সামনে রেখে মহান একুশের চেতনা আজ মানুষের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্নে, অতীতের ধারাবাহিকতাকে বজায় রেখে এক নতুন সংগ্রামের দিকচিহ্ন হিসেবে আমাদের সামনে উঠে আসছে। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের মানুষ মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার প্রশ্নে যে ঐতিহাসিক লড়াই করেছিলেন, তার মূল নির্যাসটুকু, পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার আসন্ন নির্বাচনে সংগ্রামের এই সন্ধিক্ষণে এসে, কেবল এই রাজ্যের প্রেক্ষিতেই নয়, গোটা ভারতের আর্থ- সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে একটা বড়ো ধরনের বিপদের হাত থেকে বাঁচাবার প্রশ্নে অত্যন্ত বেশিরকমের প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে গত শতাব্দীর ’৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি লড়াই, যা ভাষা দিবস হিসেবে ইতিহাসের পাতায় স্বীকৃত এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে একটা আন্তর্জাতিক মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত, সেই লড়াইটি ভূগোলের সীমানাকে অতিক্রম করে আজ ভারতের বুকে সংখ্যাগুরু আধিপত্যবাদের যে ভয়াবহ বিপদ ক্রমশ তীব্র হয়ে উঠছে, তার প্রেক্ষিতে গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াইকে একটা সঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থাপিত করবার প্রশ্নে মহান একুশের চেতনা একটা নতুন তাৎপর্য নিয়ে আমাদের সামনে উঠে এসেছে।
সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ গত প্রায় এক দশক ধরে ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে ক্রমশ একটা সমস্যা দীর্ণ পথে এগিয়ে নিয়ে চলছিল। সাধারণ মানুষের রুটি রুজির লড়াই, ভাতের লড়াই, জমির লড়াই, আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই, নারী-পুরুষের বৈষম্য দূর করবার লড়াই, সংখ্যালঘুর অধিকারের লড়াই, আদিবাসী, দলিত মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে, জঙ্গলমহলের মানুষদের অরণ্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম - এই সমস্ত মৌলিক বিষয়গুলিকে রাজনীতির মূল লক্ষ্য থেকে বিভ্রান্ত করে, ধর্মান্ধতা, সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুর সাম্প্রদায়িকতা মৌলবাদকে রাজনীতির এক এবং একমাত্র লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরার জন্য ভারতে, সংখ্যাগুরু মৌলবাদী শক্তি দীর্ঘদিন ধরে আদাজল খেয়ে নেমেছে। ক্রমশ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তির সেই প্রবণতা এখন সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের ভয়াবহ এক পঙ্কিল আবর্তের মধ্যে আমাদের এনে ফেলেছে। ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতার প্রতিভূ হিসেবে আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি যেভাবে ভারতের ঐক্য-সংহতি, সামাজিক পরিবেশ ইত্যাদিকে বিপন্ন করে তুলছে তা, শুধুমাত্র ভারত নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশকেই একটা ভয়াবহ বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এভাবে চক্রান্তের ভিতর দিয়ে রাজনীতিকেই নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় ক্রমশ তীব্র করে তোলা হচ্ছে।প্রধান্য পাচ্ছে অরাজনীতি।
অপরপক্ষে এই ধর্মান্ধতার বিস্তার ঘটিয়ে, সাম্প্রদায়িকতাকে মানুষের জীবনের একটি অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হিসেবে তুলে ধরে অর্থনীতির প্রশ্নে মানুষের যে দাবিদাওয়া, কর্মসংস্থানের প্রশ্নে মানুষের যে ন্যায্য অধিকার - সেই সমস্ত কিছুকেই একদম ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মানুষকে মাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে ধর্মান্ধতার মাতলামিতে। ভারতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের অবশ্যম্ভাবী ফলশ্রুতি হিসেবে বাংলাদেশে বাড়ছে সেদেশের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবিরের নানা ধরনের কর্মতৎপরতা। একই অবস্থা পাকিস্তানেরও।
এইরকম একটা আত্মহননের সময়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদেরকে মহান একুশের চেতনার যে মূল নির্যাস, মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা, তার সাথে সাথে সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা, ধর্মান্ধতার বিরোধিতা, সাম্প্রদায়িকতার বিরোধিতা, মৌলবাদের বিরোধিতা - এই প্রশ্নগুলিকে একত্রিত করতে হবে। গণআন্দোলনের লড়াইয়ের ময়দানে সার্বিকভাবে মেলে ধরতে হবে। এইসব রাজনীতিকে অরাজনীতি করবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত বন্য শ্বাপদেরা কোনদিন, কোনো অবস্থাতেই ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকে সামনে রেখে নানা ধরনের কলাকৌশলকে মেলতে না পারে, তা দেখা দরকার। এই অবস্থার ভেতর দিয়ে আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠনের সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদকে ভারতের বুকে কায়েম করার লক্ষ্যে আত্মনিবেদিত প্রচেষ্টাকে বানচাল করাই এখন আমাদের কাছে অনেক বড়ো রাজনেতিক চ্যালেঞ্জ।
মহান একুশের আন্দোলনের গভীরে ছিল মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার সাথে সাথেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই, মৌলবাদের বিরুদ্ধে লড়াই এবং ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ। আজ ভারতে, সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, তাদের নখদন্ত বিস্তার করছে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদের প্রতিষ্ঠা লাভ করবার জন্য। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে এই কাজে তারা ব্যবহার করতে উন্মুখ। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, ‘বহিরাগত’ তত্ত্বকে এমনভাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, যা সার্বিকভাবে মহান একুশের চিন্তা-চেতনার সম্পূর্ণ বিরোধী।
বাহান্ন’র ভাষা আন্দোলন, মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ প্রতিষ্ঠায় কিন্তু একটিবারের জন্যেও অপরের মাতৃভাষা সম্পর্কে কোনো বিদ্বেষের মানসিকতার জন্ম দেয়নি। আমার মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ প্রতিষ্ঠার জন্য, আমি অপরের মাতৃভাষাকে ছোটো করে দেখব, খাটো করে দেখব, তাকে অবদমিত করে রাখব, এই মানসিকতার বিরুদ্ধে লড়াই-ই হচ্ছে মহান একুশের চেতনার গভীরের, অন্তঃস্হলের বাণী।
পশ্চিমবঙ্গে গত লোকসভা নির্বাচনে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি আঠারোটি আসন পাবার পর থেকেই এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ধর্মান্ধ সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবিরের রাজনৈতিক মোকাবিলা না করে, সেই প্রবণতাকে তাঁর নিজের প্রতিযোগিতামূলক সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে যুক্ত করেছেন ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতভিত্তিক বিভাজনের ভয়ঙ্কর এক প্রবণতাকে। পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে বাতাবরণ দীর্ঘদিন ধরে প্রবহমান ছিল তাকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দশ বছরের শাসনকালে যেভাবে কৌশলে ভেঙেছেন, তেমনিই, ভাষাভিত্তিক সম্প্রীতির শক্ত বনিয়াদকেও আজকে তিনি নিজের হাতে ভেঙে তছনছ করে একুশের চেতনাকে পশ্চিমবঙ্গের প্রেক্ষিতে একেবারে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছেন।
ভারতের বিহার, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান ইত্যাদি হিন্দি বলয়ের রাজ্যগুলিতে জাতপাতভিত্তিক যে বিভাজন দীর্ঘদিন ধরে রয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে কিন্তু তেমন পরিবেশ কখনো ছিল না। সাম্প্রতিক অতীতে পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের শাসকদল এবং স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর ব্যক্তিগত উদ্যোগে যেভাবে জাতপাতভিত্তিক বিভাজনকে উস্কানি দেওয়া হয়েছে, তা কেবলমাত্র পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে প্রভাবিত করবে তা নয়, পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে, ভাষার নামে বিভক্ত করার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই প্রবণতা, ভারতের ভৌগোলিক সীমাকে অতিক্রম করে গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ এবং সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদকে উস্কানি দেবে।
পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে কোনো রাজনৈতিক দলের কোনো ব্যক্তি এসে রাজনীতি করতে পারবেন না, এমন প্রবণতা কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনকালের আগে, পশ্চিমবঙ্গে ’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর থেকে কোনদিন হয়নি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু বিজেপি’র ভিন্ রাজ্য থেকে নেতৃত্বের এই রাজ্যে আসার রাজনৈতিক বিরোধিতার পরিবর্তে, সেই সমস্ত নেতৃবৃন্দকে ভাষাভিত্তিক কারণে বিরোধিতার প্রশ্ন তুলেছেন। সেভাবেই মমতা ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের অবতারণা করেছেন।
এটিই আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবিরকে, ধর্মের নামে, জাতপাতের নামে, ভাষার নামে মানুষকে বিভক্ত করতে শুরু করেছে। এটিই সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদীদের নিজেদের ফায়দা লোটার কাজে অনেকখানি সাহায্য করছে। সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে দিচ্ছে রুটি-রুজির প্রশ্ন। সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে দিচ্ছে রান্নার গ্যাসের অস্বাভাবিক দরবৃদ্ধির প্রশ্ন। সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে দিচ্ছে পেট্রোল-ডিজেলের ধারাবাহিক দাম বৃদ্ধির প্রশ্ন। ভুলিয়ে দিচ্ছে কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে নানা ধরনের অর্থনৈতিক সঙ্কট, স্বাস্থ্যজনিত সঙ্কট, বিশেষ করে, কোভিড ১৯-এর সময়কালের আর্থ-সামাজিক সঙ্কট, তীব্র বেকারি, ছাঁটাইয়ের কথা।
সাধারণ মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্নগুলিকে আড়াল করার লক্ষ্যেই, ধর্মান্ধ হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির আরএসএস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি, আর তাদের সঙ্গীসাথীরা যেভাবে ধর্মীয় মেরুকরণের পথে হাঁটছে, ঠিক সেইভাবেই ধর্মীয় মেরুকরণকে সামাজিক মেরুকরণের একটা জায়গা তৈরি করে দিতে, ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, জাতপাতের বিদ্বেষ আর ‘বহিরাগত’ তত্ত্বের ভেতর দিয়ে রাজ্যের শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনী সংগ্রামের আগে এই রাজ্যের মানুষকে রুটি রুজির লড়াই থেকে অন্য দিকে ঘুরিয়ে দেবার লক্ষ্যেই এই ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা, বহিরাগত তত্ত্ব, জাতপাতভিত্তিক বিদ্বেষ - এই ধরনের বিভাজনমূলক নানা প্রবণতার অবতারণা ঘটিয়েছে। এভাবেই তারা একুশের চেতনার যে প্রধান লক্ষ্য, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, যা আজ গোটা বিশ্বের আর্থ-সামাজিক রাজনীতির প্রেক্ষিতে নতুন করে একটি লড়াইয়ের পর্যায়ক্রম তৈরি করেছে নয়া-উদারঅর্থনীতির বিরুদ্ধতার ভেতর দিয়ে। সাম্রাজ্যবাদের সেই নতুন পোশাক, আস্তিনের ভেতরে নখদন্ত লুকিয়ে রাখার বিরুদ্ধতার প্রশ্নে মহান একুশের চেতনাকে পরিচালিত করবার যে রাজনৈতিক প্রবণতা সুস্থ স্বাভাবিক রাজনীতিকদের ভেতরে থাকা উচিত, তাকে ঘুরিয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে, তাকে বিভ্রান্ত করার লক্ষ্যে, বিজেপি একদিকে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থ রক্ষার তাগিদকে পরিচালিত করছে, ঠিক সেইভাবেই বিজেপি’র শত্রু, প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে নিজেদের দেখিয়ে গোপন বন্ধুর পরিচয় প্রকৃতভাবে উপস্থাপিত করতে শুরু করেছে তৃণমূল কংগ্রেস।
বিজেপি তাদের ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতিকে নির্বাচনী সংগ্রামে ভয়ঙ্করভাবে প্রয়োগ করার লক্ষ্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আরএসএস’র প্রথম সারির নেতাদের পশ্চিমবঙ্গে বেশ কিছুদিন ধরেই কার্যত নিত্যযাত্রীতে পরিণত করেছে। এইসব আরএসএস’র ব্যক্তিত্বরা বিজেপি’র ছত্রছায়াকে ব্যবহার করে গত দশ বছরের শাসনকালে পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে যে সাম্প্রদায়িকতার চাষ, মৌলবাদের চাষ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছিলেন, সেই জমিতে এখন ফসল ফলাতে সবরকমভাবে আত্মশক্তি নিয়োগ করেছে। তাদের বিরুদ্ধে যদি লড়াই করতে হয়, তাহলে সেই লড়াইটা করতে হবে রাজনৈতিক লড়াই। যেমন লড়াইটা বামপন্থীরা করছেন। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এইসব ভিন্ রাজ্য থেকে আসা বিজেপি তথা আরএসএস’র প্রথম সারির নেতৃত্বের বিরুদ্ধে একটিবারের জন্যও কোনো রাজনৈতিক লড়াই করছেন না। মমতার কথাবার্তায় এমন কোনো ইঙ্গিত আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি যে, আরএসএস নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তিনি সার্বিকভাবে কোনো লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত।
আরএসএস’র এই সমস্ত নেতা, যাঁরা এখন তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র হয়ে পশ্চিমবঙ্গে আসছেন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে বহিরাগত তত্ত্বকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন। মমতার এই প্রবণতা থেকে খুব ভালভাবেই বুঝতে পারা যায় যে, জাতি এবং ভাষাভিত্তিক বিরুদ্ধতার নাম করে মমতা ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক শক্তিকে, তাদের ধর্মীয় মেরুকরণের যে তত্ত্ব, তাকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে আরও অনেক জোড়ালো অস্ত্র তুলে দিচ্ছেন।
এভাবেই কিন্তু মহান একুশে ফেব্রুয়ারির যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রশ্নের লড়াই, মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রশ্নে আত্মনিবেদন, সর্বোপরি ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রতিষ্ঠা করে প্রত্যেকটা ভাষাভিত্তিক মানুষকে, তার নিজস্ব অধিকার প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় সংকল্প করার চেষ্টা তাকে ভেস্তে দেওয়ার উদ্দেশে একটা বিকৃত দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, বাঙালি ও অবাঙালি, হিন্দিভাষীদের প্রতি বিদ্বেষ, হিন্দিভাষীদের প্রতি সামন্ততান্ত্রিক আচরণ - এই সমস্ত কিছুর ভেতর দিয়ে মহান একুশের চেতনাকে পদদলিত করা হচ্ছে। এভাবেই হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি-কে সবরকমভাবে সুবিধা করে দিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এখন দৃঢ় সংকল্প করে নিয়েছেন।
গত লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলের পর থেকেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজে প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে ভাষাবিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। জাতিবিদ্বেষ ছড়িয়েছেন। ভোটের রাজনীতির জয়-পরাজয়ের হতাশাকে ঘিরে যে ভাষা বিদ্বেষের কার্যত খেউড় প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেছেন, তাকে নিছক তৃণমূল নেত্রীর রাজনৈতিক হতাশা বলে যদি আমরা দেখি, তাহলে, তার সঠিক রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হয় না। মমতার ওভাবে সেদিন প্রকাশ্য রাজপথে দাঁড়িয়ে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতা ছড়ানোর মূল কারণ ছিল, আরএসএস-বিজেপি’র ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার দেয়ালকে আরও শক্ত করা। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই তিনি পশ্চিমবঙ্গে বাঙালি-অবাঙালি বিভাজনকে তীব্র করে তুলতে চেয়েছিলেন।
সেই রাজনৈতিক কুচক্রী মানসিকতার আরও স্পষ্ট প্রমাণ তিনি পরবর্তীকালে রেখেছেন তার বিভাজন তত্ত্বের ভেতর দিয়ে। এভাবেই একুশের চেতনা থেকে যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতার প্রেরণা কেবলমাত্র বাংলাদেশের মানুষ নয় গোটা বিশ্বের গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ পেয়ে থাকেন, তাকে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির স্বার্থে ভারত এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা, তাদের শাসকের দোর্দণ্ড মানসিকতার দ্বারা পদদলিত করেছেন।
মহান একুশে ফেব্রুয়ারি যে মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইকে আন্তর্জাতিকস্তরে একটি স্বীকৃতি এনে দিয়েছে তা কিন্তু অপরের মাতৃভাষার প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর মানসিকতা থেকে উদ্ভূত কোনো চেতনা নয়। ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, কিন্তু মাতৃভাষার পক্ষে কথা বলতে গিয়ে এখানকার শাসকেরা যে ধরনের মানসিকতা প্রকাশ্যে দেখিয়ে ফেলছেন তা স্বাভাবিকভাবেই অপরের মাতৃভাষার প্রতি বিদ্বেষ। আর সেই অপরের মাতৃভাষার প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই নিজের মাতৃভাষার প্রতি অনুরাগ দেখানো যায় না। বিদ্বেষের গহীনে কিন্তু থেকেই যায় হিংসা। আরও বড়ো, আরও বেশি বিদ্বেষের মানসিকতা। বিজেপি-কে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে না পেরে, প্রকাশ্যে হিন্দিভাষী মানুষদের অপমান করে, তাদের মাতৃভাষাকে অপমান করে। ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে আরও উস্কে দেবার লক্ষ্যেই এখানে ভাষাভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতার এহেন নগ্ন বহিঃপ্রকাশের ঘটনা ঘটছে।
এই মানসিকতা সার্বিকভাবে মহান একুশের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানসিকতা, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী মানসিকতা, মৌলবাদবিরোধী মানসিকতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার পক্ষে একটি উদার মানবিক আবেদন প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের সম্পূর্ণ বিরোধী।